শুক্রবার, ৯ এপ্রিল, ২০১০

একবিংশ ২৫ বছর পূর্তি সংখ্যা




একবিংশ
২৫
পঁচিশবছরপূর্তি সংখ্যা
ফেব্রুয়ারি- ২০১০

সম্পাদক
খোন্দকার আশরাফ হোসেন

সহকারী সম্পাদক
কামরুল হাসান

সম্পাদকীয় যোগাযোগ
ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

ফোন : ০১৭১১-০১৯২৪৮
ই-মেইল : ashrafengdu@yahoo.com

প্রচ্ছদ : শুভ সালাতিন
মুদ্রক : মমিন আর্ট প্রেস, ৯ নীলক্ষেত, বাবুপুরা, ঢাকা-১২০৫

একশত টাকা



সম্পাদকীয়

একবিংশ তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছে। আজ থেকে সিকি শতাব্দী আগে সে ঘোষণা করেছিল নতুন-শতাব্দী আবাহনের মন্ত্র, বলেছিল, একুশশতকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেবে কবিতার পাঠকদের, বিনম্র পুরোহিতের মতো শতাব্দীপূরণের মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানের পাশে দাঁড়াবে, দেখবে নতুন কবিতার জন্মের মুহূর্তকে ধাত্রীমাতার মমতায়। পাঠক সাক্ষী, একবিংশ তা করেছে; একবিংশ ধূলিঝড়ে উটপাখির অন্ধতা মেনে নেয়নি, পিছিয়ে আসেনি তার লক্ষ্য ও কক্ষপথ থেকে। যাঁরা ছিটকে পড়েছেন, দায়ভার তাঁদের। একবিংশ পূর্ণতার অভিসারী ছিল, পূর্ণতা সে পায়নি, কেননা পূর্ণতা তো সর্বাংশে পাবার বস্তু নয়, শুধু আরাধনার জিনিস, শুধু চোখের সামনে জাগিয়ে রাখার ধ্রুবতারা। একবিংশ এখন যা-খুশি করতে পারে, নিতে পারে ছুটি, বরণ করতে পারে স্বেচ্ছামৃত্যু ভীষ্মের মতো, পাল্টে নিতে পারে নিজের অবয়ব, ছোটাতে পারে অশ্ব ভিন্ন-কোনো দিগন্তের দিকে।
পঁচিশবছরপূর্তির এই সংখ্যার সম্পাদকীয় লিখতে গিয়ে আবেগাক্রান্ত হচ্ছি। একবিংশ বেড়ে উঠেছে আমারই সাথে-- আমি ওকে গড়েছি, না ও আমাকে গড়েছে, সে বিচার করাও সহজ নয়। আমার আত্মা থেকে জাত এই আত্মজকে বেড়ে উঠতে দেখে আনন্দিত হয়েছি; সে এখন গাইতে চায় গান--

“বামন পিতাকে যথা ব্যঙ্গ করে বেড়ে উঠে দীর্ঘাঙ্গ তনয়
তেমনি উঠেছি বেড়ে, হে বৃক্ষেরা, হে আমার জনক সময়,
এখন আকাশ শুধু বুকে ধরি, এখন দিগন্তরেখা মাইল-পাথর।”

প্রবন্ধ : কবি ও পাঠকের যৌথশিল্প : মাসুদুজ্জামান

মাসুদুজ্জামান

কবি ও পাঠকের যৌথশিল্প

আমরা যারা কবিতা ভালোবাসি, শব্দটি মাথায় এলেই সমস্ত ইন্দ্রিয় তীক্ষ্ম হয়ে ওঠে; স্নায়ুসংবেদে মনে হয় প্রবেশ করছি অন্য কোনো লোকে, লোকান্তরে। কবিতা পড়তেও জাগে সুখদ অনুভূতি। কিন্তু কখন কবিতা পড়তে হবে? জোৎস্নাপ্লাবিত মধ্যরাতে? নাকি গনগনে কোনো দুপুরে? নদীর ধারে বসে, নাকি বন্ধুর একচিলতে নাগরিক আবাসনে দু’জনে গড়াগড়ি খেয়ে? যেখানেই হোক, যখনই হোক, কবিতা যারা ভালোবাসেন, কবিতা তাদের গ্রাস করে, বিমুগ্ধ আচ্ছন্নতায় তারা কবিতা পড়ে অকারণ পুলকে কাটিয়ে দিতে পারেন অনেক অনিঃশেষ মুহূর্ত।

খোন্দকার আশরাফ হোসেন : ইঙ্গ-মার্কিন কবিতায় আধুনিকবাদ


ইঙ্গ-মার্কিন কবিতায় আধুনিকবাদ
প্রেক্ষাপট

ইংরেজি কবিতায় আধুনিকবাদের আর¤ভ বিশশতকের শুরুতে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমসময়ে, যখন এজরা পাউন্ডের নেতৃত্বে ইমেজিস্ট আন্দোলনের সূচনা হয়। ঊনিশশতকের প্রথমার্দ্ধে রোমান্টিক কবিতার প্রধান পুরুষরা কাব্যসিদ্ধির যে-জায়গায় পৌঁছেছিলেন, মধ্য ও শেষ ভাগের ভিক্টোরীয় কবিগণ সেই চূড়া স্পর্শ করতে পারেননি। শেষোক্তরা কবিতায় মূলত রোমান্টিকতার অনুধ্যানই করেছেন, কিন্তু সে-রোমান্টিকতা শেলি-কীটসের প্রাণবন্ত ঐকান্তিকতা থেকে ছিল বঞ্চিত। আলফ্রেড লর্ড টেনিসন (Alfred Lord Tennyson), ম্যাথ্যু আর্নল্ড (Matthew Arnold) কবিতায় চিত্তাকর্ষক অনেক উপাদান যোগ করেন : আর্নল্ডের ক্ষেত্রে দার্শনিক বিষাদ কবিতার দেহে যুক্ত করেছিল ভিক্টোরীয় সমাজের অনপনেয় হতাশা ও অনির্দেশ্যতাকে।

কবিতা : জফির সেতু

দুধগাছ


দুধগাছ আমার মা;

না হলে বাবা কি করে আমাদের
এই বনের ভেতর পেলে-পুষে মানুষ করলেন

নাঙ্গা সময়ের নিচে শিশুদের ভাতের যোগাড় ছিল না;

জন্মেছি রোগা-পটকা আমরা ন’ভাই-বোন

মা ছিল হাড়-জিরজিরে কিন্তু বুকভরা দুধ
আমরা ন’ভাই-বোন স্তন চুষে স্তন খেয়ে;

দুধের ফেনায় পুড়ে পুড়ে মা আমার ধনুক আর

শস্যের দেবী হয়ে গমক্ষেতে সূর্যালোক হয়ে জ্বলে
ফলবতী মাটিতে বিষন্ন লাল ফুল হয়ে ঝরে;

মা আমার চিরহরিৎ, বাবা বিষগাছ--বড্ড হারামি!

মোস্তাক আহমাদ দীন

মোস্তাক আহমাদ দীন

যুবক

গাছে হাত রেখেছে আবার। তার চুল
উড়ছে, যেমন বাঘিনীকেশর, যেন
মন-উড়ানিয়া স্থির ও ধ্যানী ভাবের বিপরীতে
ফুঁসছে যুবক।
তবু জেনো, সর্প বলা যাবে না তাহাকে।
যে-রূপে সময় দোষী, এ যে তার অন্য এক রূপ
সজারুর কাঁটা নিয়ে খাড়া

বরং এ-কথা বলা যায়,
সমতাপে-পোড়া এক কঠিন শরীর
যার মনে মরু উজানের
খরতর বালি উড়ে যায়

ফারহান ইশরাক

ফারহান ইশরাক

লবণ ও ললিপপ


সল্ট ইজ কামিং ফ্রম দ্য ব্লু সী-- প্রসেসিং প্রায় শেষ

হুঁশিয়ার ভাতমাছি পান্তার প্লেট ছেড়ে এক্ষুণি

পালাও বলছি!


ইকবাল আজিজ

ইকবাল আজিজ


মৃত্যুঞ্জয় মানুষের কথা


যার মৃত্যু নেই শুধু জন্ম আছে, দূর গ্রহ-নক্ষত্রের দিকে ধাবমান;

যার মৃত্যু নেই, শুধু পুনর্জন্ম আর রূপান্তর--

শিশিরের জলে ভেজা ফসলের মাঠে আকাশের শূন্যঘর জন্মজন্মান্তর;

নদী বহমান পদ্মা ও মেঘনা, যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র, তিতাস ও কর্ণফুলি--

সীমান্তের সব বাঁধ ভেঙে যাবে, জল জানি বহমান ভাটিয়ালি গান।

সৌম্য সরকার

সৌম্য সরকার


অনেক দেখিয়াছি


অনেক দেখেছি আমি-- বলতেই একটি তৃতীয় শক্তি এসে জেঁকে বসে

আমারে জিগাইল-- কী; কী দেখেছেন ভাই? হেক্টর বা মেঘনাদের পরাজয়?

নাকি একলব্যের কাটা বৃদ্ধাঙ্গুলি? অথবা ডাইডোর শোক! ‘ইকারুসের আকাশ’!

আমাকে অস্বীকার করতেই হলো: না রে ভাই, ওসব তো হোমারেরা দেখেছেন--

তবে তবে! ‘বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগৎ’?

কামরুল ইসলাম

কামরুল ইসলাম


আমাদের কিছু ঘাস ছিল


আমাদের উঠোনের কোণে কিছু ঘাস ছিল

আমাদের নিঃশ্বাসে ছিল নির্ভার নদীর কলতান;

ঘরে ঘরে ঘোড়াদের কাল শেষে ফিরে আসে আস্তাবল

তাদের স্মরণে আসে অন্ধকার-- স্মৃতির ঘাসে নূপুর বাজে শোন:

আমাদের কিছু ঘাস ছিল-- ঘোড়ারা ঘাস খেত

ঘোড়ারা ঘাসহীন দলে দলে

ঘাসের পরানে বাজে শূন্যতা

ও ঘাস, ও শূন্যতা, তোমরা আমাদের উঠোনে আজো

বিবিধ তৈজস--

জহির হাসান

জহির হাসান


মরিয়ম বিষয়ে পদাবলী


বাজারের ব্যাগ কোথা গেল, বৃষ্টি হচ্ছে, বাইরে যাবো,

মরিয়ম কই, তজবিদানার মত বৃষ্টি ঝরে, মনে, যথাতথা,

উনুনে বসানো ঠান্ডা বেগুন তরকারী, বেড়ালে কি মুখ দিয়েছিল ওতে?

আমি নাহি গো কোথাও প্রতিসরণের মধ্য দিয়ে পৌঁছে যাবো

বাউলা চুলা তেমাথার গাছের নিকটে, দেখি তাকে কিছু বলা সাজে কি না,

যদি চলে যাইতাম তাহার চিরহেফাজতে, তার ছায়াটি হইতাম মন চায়!


পানডুবি সাথে ছানাপোনা দেখিছি বর্ষায়, তার কাছে যাবো, যদি ভাসতাম,

যদি অনায়াসে একবেলা সঙ্গী হই সরপুটির মতন খোকার, হাতে রৌপ্যবালা, বড় হাউসের,

আজ আমার কী হলো কত হাউ হাউ বোতল মাতাল সমীরণ কোন দেশে ছুটে যাচ্ছে,

মেঘের কিনারে ঠাঁই পাওয়া রোহিনী তারার মতো কেউ পাহারাদার ডাকিছে

লিচ্ছবি বংশের মেয়ে, হূণ আক্রমণ থেকে বেঁচে গিয়ে

পালিয়েছে স্বাতী বিশাখার আশেপাশে,

এতসব প্রশ্নকর্তা কোথায় থাকেন?

হাওয়া সরে যায় লেবুবনের নিকট দিয়ে পুকুরপাড়ের তুলা গাছের ওপর দিয়ে

দ্বৈত সত্তা উড়ে যায় বুদ্ধি ও বিবেকসহ ছন্নছাড়া

আর অন্ধকার বৃদ্ধ দিন বৃষ্টি পড়ে গুপ্ত যুগ থেকে অনিবার্য রয়নার বনে,

মরি, হায়, বাজারের ব্যাগ কই থুইলা!


আম্মার চৌকির নিচে মশার কয়েল জ্বলে কেন, তেলচিটে বালিশ বিছানা মাতা-মাথা শুয়ে আছে,

আঙুল ফাড়ায় নুনপানি ঢালো, বলি, যেন আজ দূর্বার উপর

মরে পড়ে আছে বিষহারা ঢোঁড়াসাপ, বলি আম্মা, পান, সুপারি, মিঠাই

আর কিছু, ইনি স্বামীহারা, ইনি যজ্ঞির ডুমুর খাওয়ায়ে দুপুরের চাল বাঁচায়েছে,

সেই প্রহসন করে নাই পুরোপুরি দিশাহারা, আজ তবে বাহিরে আহারে নিমন্ত্রণ,

পরমায়ু বাড়ে ছাগলের দুধ খেলে কী কী রোগে সেরে যায়, কেন জানিনি জড়ায়ে জিওলগাছে ওঠে আলকুশি লতা প্রেরণা বাৎসল্যে বিড়াল যেভাবে নিজ বিষ্ঠা ঢেকে তাড়হুড়া চলে যায়,

যেতে হবে,

বাজার বহিয়া যায়, দেরি হয়ে যায়, ঠেকে গেছি, বখে গেছি,

আজ টাকা নাই কাল টাকা হবে অর্থের হায় রে স্থির অর্থ নাই ক্যানে,

কে মুছায়ে দেবে বাছুরের মুখে দুধফেনা লেগে আছে,

মরিয়ম, ঘুম থেকে ওঠো, বাজারের ব্যাগ আনি দাও!


#

মানকচু ছেঁড়া কলাপাতা, শরীফের ছাতা, কিবা কাজে লাগে, এই ঘোরলাগা গৃহবন্দী ধন্দলাগা

কিছুকাল এই বাদলায় না গো তোতলায় মোর জিহ্বা,

কোন উছিলায় কমে যাচ্ছে উবে যাচ্ছে কাকে বলি নিজ উতলা ভাবনা,

সংশয় সান্ত্বনা জ্বরো রোগী দেখে জানালার থেকে দূরে আমের আঁটির গায়ে মৃদু গন্ধবহ আঁশ,

নরম হলুদ

কৃষকের হস্তচ্যুত শস্য পণ্য নামে বাজারে ও হাটে ভয় দেখায় কঠিন দোকানে দোকানে প্রাণ

শুকায় শুটকির মতো, নাই খানাপিনা, ঠেলিয়া দিয়াছো নানা রং

দজ্জাল, আকাল, মনের ভেতরে তবু কত ঘুড়ি ইন্তেকাল ক’রে বেঁচে আছি,

দূর থেকে খেলা দেখো আজ যার যার তার তার সেই সে টানাপোড়েন

অম্বর কহিছে, হায়, তোমাকে আসতে হবেই

জামরুল গাছের তলায় পোতা আছে অগাধ এলেম,

মরিয়ম, তুমি কোথা, চলে গেছো রাত্রির কবলে,

ওঠো ন’লে প্যাঁচ বেঁধে চুকা হইয়া যাবে মোগো লেনদেন,

বাজার তোমারে ডাকে, নমাজ তোমাকে ডাকে, বাজারের ব্যাগ রাখিছি কোথায়?


গোয়ালের পিছে বিদেহী বনবিড়াল আছে খোয়াড়ে কাঁপছে মুরগির মন গরম শরীর

চোখ লাল, ওগো আমি তোমাদের নিকৃষ্ট মনিব, ওগো আজ আতরের শিশি থেকে

কেরোসিনের গন্ধ আসে, অবলা নির্বোধ আকৃতির প্রশ্ন আসে মনে,

যেন কূটবাক্য প্রসব করিব আজ এইক্ষণে জেদী লিঙ্গ পুঁজিপিতা আপনি থামেন,

দারিদ্ররেখার নিচে ঘুমায়ে পড়েছি ঠুনকো সম্বলহীনা ব্রাত্যজন,

যদি ভাবো মাকড়শা জালে শিশির কণার মতো ঝুলে আছি,

কেউ খাবে কেউ খাবে না তা হবে তো না,

পাবনার পাগল মিলন বলে, ডাল নয়, এইডা তো ঘাটের পানি,

পাগলা গারদে যাবো, বেঁচে যাবো, উৎকণ্ঠায় পাগল দেখাবো পাছা

ফটোতোলাদের দিকে, নিরক্ষর হবো এ-জীবনে একদিন জানি সানকিতে ফ্যান নাকি পানি

নাকি কুড়া বুঝিব না কেন আজ মনোসন্ধ্যা, কেন মন দরুদ শরীফ পড়ে

মরিয়ম, জানি না বুঝি না আমি কোন্ বাজারে যাবো?


সবাই নমাজে গেছে আমার কি হবে, ঝরে নষ্ট ছবেদার ফল,

অন্তরে যে আশা করে বাসা,

অন্তরে তা নেচে-কুঁদে ধসে পড়ে,

জীবন চরমে ওঠে ফলে কতবার গেছি হরিতকি বনে

তবু পাই নাই সেই অগাধ প্রশান্তি, ছায়াতলে কান পেতে শুনি, গাছ মোরে বলে,

‘নিরাশ্রয় রতা, কোনোভাবে প্রাপ্য তোমার এ ডাল তোমাকে দেবো না।’

রাগে ক্ষোভে কান ধ’রে বলি,

এর বীজ পোড়াও ক’তেছি, পরে

কঠিন বঙ্কিম বিষবৃক্ষ হবে, তার ফল

ভুলে অকারণে হিলে ফেলবানে,

ফলে শুয়ে থাকি যেইরূপ চরম ঘাপান খেয়ে পালোয়ান

শুয়ে থাকে গাবতলে, কি কবো হয়নি তাতে নিবিড় বিশ্রাম,

মনে হয় পড়ে থাকি সেই রূপ থেমে পড়া বিকশিত লেনদেন,

মোরব্বার কোনো চাঙ যেন,

ওশে ভেজাপেঁচা তেতুঁলের ডালে বসে দেখে এই সব,

এবার মন চায় বিষুবরেখাটা ধরে চলে যাবো মধ্যাহ্ন সকালে

দিশেহারা বাঁকা পথে জাহাজে টাহাজে করে গাভীন গরু চরা মাঠে,

জ্ঞান ফেরে যেই মনে আসে,

মরিয়ম, বাজারের ব্যাগ কনে গেল হায়!

আবদুর রাজ্জাক

আবদুর রাজ্জাক


রিংটোন


এই যে এখানে থমকে দাঁড়িয়ে আছে নদীময় বাঁক,

তার নামের নদী, বরফগলা সন্ধ্যার আলো

নৈরাশ্যের নিঝুম বিকেল, শীতের পিছনে আসা

বসন্ত সখি, আর সুগন্ধ দ্বীপের থেকে আসা

নীল কালো হাওয়া,

তুমি যদি আসো সুগন্ধ দ্বীপের দিকেই এসো,

হাওয়াবদলের নামে তোমার সাথে

দেখা হতেও তো পারে?


স্বপ্ন আছে বলেই মাটি ও মানুষ তা বিশ্বাসে আছে,

শীতমুদ্রার মৌনস্রোত আছে নদীময় গানের অন্তরে।

মানুষের সকল আকাক্সআ ছিন্ন করেই হেঁটে যায়

নদীময় বাঁক, রেখে যায় স্রোতচিহ্নের গভীর রেখা,

বেহালা বাদকের সুর প্রস্রবণের ডাক


নদী যে দিকেই যায় সে দিকেই বাঁক নেয় জল,বাঁক

নেয় ঘাসময় চোখ, আঁকাবাঁকা ঠোঁট, নারীর চোখের

মতো অজস্র বৃষ্টির ঢেউ, মোবাইল ফোনের

ছন্দগাঁথারিংটোন যত

নদী বলতেÑ থমকে থাকা নদীরই নানা প্রশ্নকথা,

ক্রমশ উজাড় করা জলকণাপাঠ


তার নামটা যে ভুলেই গেছি


বৈশাখের তীব্র দিবসে আমার রাধা

আমাকে ছেড়ে বনবাসে যায়,

তার মেঘ, ভাগে ভাগে ভাগ করে আমার

আঙুলের ডগা,

কোন্ পিপাসা নিয়ে সে, ঝড়ের বেগে ফিরে

এসে কড়া নাড়ে বারবার

যেন এক সৃষ্টিছাড়া চপলবালিকা দাহ করে তার

স্বচ্ছ প্রেম, আর আমার অঙ্গনে রেখে যায়

ঘরগেরস্থালির একমুঠো অমা,

অধীর আত্মা থেকে ধার করা ছায়া


সে আসে ভিন্ন মেঘে, গন্ধবিভাবে, ঝড়ো হাওয়ার

ক্রমাগত উচ্ছাসে, ধুলোর পুলক সন্ধানে,

প্রার্থনা করি বোশেখ আসার আগেই যেন ফিরে যায়

সে, যেন তার আনন্দ হরষে আসার দীর্ঘশ্বাস

আমাকে বিব্রত না করে


তার খরা জীবনে আমিই প্রথম এক রূপালি ইলিশÑ

চকচকে রোদ, পিপাসা সিঞ্চনের তীব্র হাওয়া,

শতাব্দী কাল ধরে দাঁড়িয়ে দেখা মেঘচারী নদ


অপেক্ষার শেষ সীমান্তে এসে দেখা আসন্ন বৈশাখ

রনক মুহম্মদ রফিক

রনক মুহম্মদ রফিক


মেঘবরিষণ ঢালে স্নিগ্ধ অধ্যাপিকার শাড়ি


আমার তাবৎ প্রেম ভেসে যাচ্ছে মেঘবতী জলে; মহাকাশে অভিশাপ তিলশর্তে খুলে পড়ে পাখিদের ডানা।

তুমিরূপ মহামায়া করতোয়া নদী বুকে মেঘ ভেসে ভেসে; ঘ্রাণ ঢেলে দেয় স্নিগ্ধ অধ্যাপিকার শাড়ি ...

শাড়িটায় মহাকাশ,Ñ

নীলাকাশে যতেœ মোড়া সলমা জরিতে দীপ্ত মাধুরী বুনন

হাতঘড়ি মৈথুনে যান অধ্যাপিকা; দেখেন চুম্বক চোখে সহোদর তিন কাঁটা

গোলক কাচের ঘরে বাস করে শূন্য বিন্দুতে ... কাজে কর্মে স্বাতন্ত্রে উজ্জ্বল:

জঙ্গী কাচের মেঘ, সারাক্ষণ বৃষ্টিপাত মাথার ওপর

শূন্যে ভেসে যান প্রিয় অধ্যাপিকা ...

তাঁকে যত ভালবাসি, ছুঁতে গিয়ে স্পর্শ-রোদে পুড়ি

প্রাণপঙ্কে হানা দেয় দ্বিধালগ্ন এসে। তিনিও বাড়িয়ে দেন হাত

প্রোটন ঘূর্ণনে তার আরো এক সঙ্গী আছে প্রহরী চেতনে! ধ্র“ব ভার্নিয়ারে তিনি দূরে

অবস্থিত ... হঠাৎ শিরায় রক্ত, স্পর্শে কেঁপে ওঠে, স্পর্শমোহে টের পাই ফণিমনসার কাঁটা

বিস্ফারিত তীর, উঁকি মারে চুম্বনের ডালিম কর্নারে! রঙ ও রঙ্গে সর্বকাল মহৎ সজারু যেন

ফিরে পেল গৃহ ব্যালিন ...

ডালিম ফাটে না তবে রসদানা ফাটে : ছিনতাই হলে ভ্রƒণ মাতৃত্বেই বাড়ে : এই যে আমি তপ্তক্ষত

রেণুÑ বিচ্ছেদ বিন্দুভেদী ব্যাস ভিন্ন ব্যাসার্ধকে গিলেÑ একাই এঁকেছি আমি রমণ জ্যামিতি!

: এই যে অধ্যাপিকা, (?) তোমার ত্রিভুজ কানন বায়োটেক বিক্রিয়া বোঝে না

: এই যে স্নিগ্ধশাড়ি, (?) বরিষণ ঢেলে দিলে প্রেমিকের যে কোন ফাল্গুনে

তার গড়া বনানীতে করাতের ছিন্নশব্দে, Ñ প্রেমিক মিস্তিরি বাবু ওমেগা পাখির ডাক

করাতেই কাটে ...

অধ্যাপিকা রেগে গেলে অথৈ বর্ষা নামে তালদিঘি পাড়ে! শাড়িতে শাড়ির মর্মে সুতো মুখে

ঝগড়া করে পিয়াসী চাতক! চাতক চায় না কোন অন্ন পানি, অন্য রাঙা জল; Ñ

পিপাসিত ডানা ঠোঁট কালিক বিরহী ...

মেঘ আছে দূত নেই, অধ্যাপিকা শাড়ি তলে রূপরেখা বুনে যায় বর্ষা মঙ্গল।

পাহাড়ের চূড়া ধরে যখন হাসেন অধ্যাপিকা, আমি অন্ধ চাই নিতে শাড়িমেঘ বরষা

সুষমা : হিমালয় থেকে আসা গতরের ঘ্রাণ ...

মহাকাশে উড়ে উড়ে সকালিক মেঘমালা অধ্যাপিকা জড়িয়ে নিলে গায়,

মেঘবুকে আমি হই ক্ষুধাতুর প্রণয়ী পাইলট ...

..........


আমার অধ্যাপিকা থাকে দূর শহর পাড়ায়

স্বপ্নচোখে দেখি তার শাড়ি ওড়ে সুতোর আড়ায়

বারান্দায় দোল খায়, কোনো সুতো শোভাশূন্য নয়

সলমা জরির কাজ পাড়চিহ্নে তারকাখচিত মনে হয় ...

আমার অধ্যাপিকা শাড়িরূপ মেঘবক্ষেÑ একটুকরা আলোকিত চাঁদ

ভ্রƒবিলাসী চোখ আর নয়ন পটলচেরা, সুহাসিনী ফাঁদ

সে ফাঁদেই নিবেদিত সৌন্দর্যকে অধ্যয়ন করি

যে রূপের পাঠ্যসূচি ভুবনের বিদ্যালয়ে পড়ি

সুবোধ ছাত্র আমি

আমাদের শ্রেণিকক্ষ নেই

পঠনপাঠন সব

একাগ্র চিত্তে থাকে, থাকে অন্তরেই ...

তাবৎ বর্ষণগীত, শাড়ির সুষমা আমি প্রতিদিনই পড়ি

হয়তো ঘুমের ঘোরে, শাড়ি বক্ষ তুলি দিয়ে ভরি

আমার অধ্যাপিকা হেঁটে গেলে বর্ষণের রাত

ভর করে শাড়িশুদ্ধ, সীমাহীন ছন্দ বারিপাত

কী রঙে সাজাতে পারি, শুধু ঐ রঙধনু জানে

যখন বাসন্তী-ধারাÑ তাকে আর শাড়ি ধরে টানে

আমি তার দেহ, রং, শাড়ি, সুতো মুখস্তের মত

একা মগ্ন পড়ি বসে; যেন ঋষি ধ্যানে অবিরত

তার জোড়া পামসু-খানা যদি তোলে শব্দ অলঙ্কার

বর্ষামাস শেষ হয়, খুলে যায় বসন্তের দ্বার

প্রতিপাদ্য অধ্যাপিকাÑ আমি তাকি সুরে, তিনি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে

সকল রাগের স্বরে মিলে মিশে একাকার, গায়কী ভঙ্গিতে

কে তার মুগ্ধ শ্রোতা, শুধু জানি বুকের কৈলাসে

আসে আর ফিরে যায়, জানাজানি হয় না তো উতল উচ্ছাসে


যখন তুমি প্রথম দৃষ্টি হানো

অবলোকন ছিল প্রথম থেকে

আমার ছিল এক পক্ষ টান

হৃদয় ছিল অন্য দিকে বেঁকে


প্রথম দেখা প্রথম শাড়ির ঘ্রাণে

চোখ ফিরিয়ে খেয়েছিলাম খাবি

মাছের মত ভয় ছিল খুব প্রাণে

তাই তুলিনি জড়িয়ে পড়ার দাবি


এখন আমি মড়া নদীর ঘাট

ভাঙা ডিঙি এপার ওপার করি

বুকের ভেতর সমস্ত তল্লাটে

বালিয়াড়ি, যায় না বাওয়া তরী ...


এষণাপক্ষ


চাইলেই পারো Ñনদী : আমি দেশ প্রজন্মে গৃহমুখি,

খনন করতে পারো নীলসীমা বঙ্গোপসাগরÑ

তুমিই যেখানে একা আঙুলে কাটতে পারো জলের উল্লাস

চাতক সখ্য ঋণ পরিশোধ করে ...


চাইলেই পারো প্রেম : তাবৎ মেঘের তুলো, আর্দ্র সামিয়ানা

মাথার ওপরে পারি গুটাতে বর্ষণ,

সকল বৃষ্টিপাত : বর্ষার আশ্রয় অন্য রাজ্যপাটে

প্রশ্নই ওঠে না ...


চাইলেই পারো মন : তারাপুঞ্জ পাটসারে

গুটিয়ে প্রভাত আগে, গুণে গুণে গেঁথে দেব

অলকা তিলকা ক’রে ব্যক্তিগত মনোহারি টিপ...

চাইলেই পারো গৃহস্থালি : চালচুলো হেসে উঠবে

আমাদের রান্নাঘরে ...

সূর্যোদয়ের আগে ফোঁটা-চোঁয়া জল ছেড়ে

অনার্য শাড়িখানি বায়ুমন্ত্রে উড়বে বারান্দায়,

প্রতিবেশি টিটকারি, লাজ পদাবলিÑ ছড়িয়ে গড়িয়ে তবে;

জানাজানি হয়ে যাবে কলঙ্ক বাজারে ...


চাইলেই পারো শস্যকণা : নিষ্পাপ এক ঝাঁক পায়ের আঙুল

পোতনে-উঠোন ধারে

ঘুরপাক কাবে ক্ষুদ্র, আলতা সঙ্গীতে

মুঠো মুঠো মাটি চুষে দাঁতহীন জিহ্বা আড়ালেÑ


চাইলেই পারো প্রার্থনা :

হাদিসের কালো স্বর ব্যঞ্জনধ্বনি, তসবি পাহারা আর

তোমাকে রাখবে ঘিরে বোরকাহীন তনু

উদার প্রকাশ্য ধ্যানে, অধরা আলোক এষণায় Ñ

সুদূরের মাদুরীয় ওম, প্রার্থিত সুরের প্রথমা

ছুটে আসে এই বোধিদ্রুমে; প্রেমিক উন্মত্ত ক’রে যাবে

রাবেয়া বসরীর অনুরাগে ...


বিহঙ্গ বৃক্ষকীট : পতঙ্গ পাখিরা

দেখবে সুবর্ণ বীথি, জন্তু মনিব যত, যত হিংস্র হাতি

গাছেরা সরিয়ে নিয়ে ছায়াÑ ঢালবে আলেয়া ঝর্না সুখ

দূরে শুধু আমি দেখবো : মেঝেয় গড়িয়ে আর্দ্র আলেয়া ঝলকানি ।

সরোয়ার সবুজ

সরোয়ার সবুজ


আমিও পাথর হবো আমিও শ্রাবণ


আমিও পাথর হবো, আমিও শ্রাবণ। জ্বলে জ্বলে খাক হবো, জমে জমে হিম

শ্রাবণের বারিধারা অজস্র অলীক। স্বপ্নের বৃত্তভেদীÑ নৃত্যময়ী গান

রমনার বটমূলে, স্মৃতির চূড়ায়Ñ অপরাজেয়্


যেদিন প্রথম ভোরে ডেকেছিল দূত: হিমাদ্রি আঁধারে, সেদিনও স্বচ্ছ ছিল

এমনই শালীন। বৃন্দাবনে রাধা ছিল Ñ কৃষ্ণ মথুরায়

শ্যামার অত্যঞ্চল সঘন বয়ানÑ মহিমার চঞ্চুভেদী তড়িৎ কম্পনে ...


হিমাদ্রি, হায়, হিমাদ্রি! তন্দ্রা অতল, বৃক্ষের বাকল আচ্ছাদিত

কৃষ্ণ গহ্বর। আভার আবীরে লিপ্ত দশমী বিকাল

শান্তনু সেদিনও আকুল, থই থই বুকÑ শিলাখণ্ডে পৃষ্ঠলেহিÑ

সলিল সঙ্গমে। গোড়ালি তবুও সজীব, শুষ্ক বশংবদ।

সুরলোক সুরাবর্তে উঠেছিল কেঁপে...


আমিও হিমাদ্রি সেদিন, অচিন আঁধারে। তাণ্ডবেÑ

হোল হোলি আচানক ভোর। সুগম বায়ুধার ধূসর মলিন,

গীর্জার ঘণ্টাধ্বনি কাঁপেনি ব্যাকুল নিভন্ত শিকার কি কঠিন সাঁতার

শত্র“র পদভারে প্রকম্পিত ভোর । রতœাগারে রতœ নেইÑ পড়ে আছে স্থবির

লুণ্ঠিত, ছিন্নভিন্ন; সৃষ্টির অপূর্ব কৌশল ...


অতঃপর বুলেটবিদ্ধ বুক-সংজ্ঞাহারা আমি। সহসাÑ

সচেতন হই শ্রবণেÑ যখন বুকের উপরে হিম শীতল লৌহদণ্ডের

স্পর্শে বলেছিলÑ‘তুম্ কোন হ্যায় ?...’

সৈয়দ তারিক

সৈয়দ তারিক


একগুচ্ছ কবিতা


পুষ্পেরা


রজনীগন্ধা উঠলেন রেগেÑ

শেফালি আমার প্রেমিকা কেন!

অপরাজিতার ভাবে মনে হয়

একা হতে চান নায়িকা যেন!


মল্লিকা, জুঁই জবা ও গোলাপ

হতে চেয়েছি তো সবার সখা,

প্রিয় মুখগুলো অভিমানে নীলÑ

ফেরে রেখে যান আমাকে একা।


সদানন্দ


তোমার চরণে আমি চপ্পল

আমার হৃদয়ে স্পন্দন তুমি,

রঙধনু-আঁকা তুমি নীলাকাশ

আমি পায়ে-হাঁটা মর্ত্যভূমি।


তুমিই পরম শুদ্ধ নিবাস

আমি জীব আমি স্পর্শযোগ্য;

তুমি, সুদূরের প্রজ্ঞানন্দ

আমি শুধু প্রেমে তোমার ভোগ্য।


কম্পন


পায়ে নূপুরের শবদ তুলে সে হেঁটে এলো

নিতম্বে গূঢ় হিল্লোল তুলে গেল সে ফিরে,

ঈশ্বর এক মহাতরঙ্গÑ

আপন রাজ্য আপনাকে দিয়ে রেখেছে ঘিরে।


কামনার ঘোরে ডুবে ভুলে যাই চেহারা তাঁর,

কামনায় নিরাকার সে জাগে,

নিষ্কামনার স্তব্ধ হ্রদে সে নীল শতদলÑ

ঢেউয়ে ঢেউয়ে তাঁর কাঁপন দেখতে দারুন লাগে।

শবরী


লুই পা যখন যোগিনীর কোলে

খুঁজে নিয়েছিল নিবিড় নিলয়

ফিরে পেয়েছিল আপন সত্তা

আপনাকে করে পূর্ণ বিলয়।


শবরী আমার লীলাবিহারিণী

আমাকে নাচিয়ে বেড়ায় ছুটে,

হাজার পাপড়ি মেলে মায়াফুল

জানি না কোথায় রয়েছে ফুটে।


ডোমনী


সরহপাদের সে কালো ডোমনী

হয়তো-বা খুব নিকটে আছে

হাত বাড়ালেই যেন যাবে ছোঁয়া

টেনে নেওয়া যাবে বুকের কাছে।


তবু চোখ মেলে দেখি না তো তাকে

মন শুধু তার বিরহে কাঁদে,

জন্মান্তরে ছিল অভিশাপÑ

এ-জীবন কাটে মায়ার ফাঁদে।


বয়স


শিউলি-শিশির-ভোরে ভাবতামÑ

কবে বড় হব বাবার মতো,

খর রৌদ্রের দুপুরে ভেবেছিÑ

স্নিগ্ধতা যদি আবার হতো!


অপরাহ্ণের ছায়া নেমে আসে

ভাবনাবিলাসে কেটেছে বেলা,

বসে আছি চুপ নম্র পাথর

আমার সকল মিটেছে খেলা।



নাচ


ধ্যানবিন্দুতে হঠাৎ যখন

নেচে উঠেছে সে দিব্য কিশোরী

তুমি কি তখন পাল্টিযে কায়া

মেতেছ লীলায়, ও সুরেশ্বরী!


নাচতে নাচতে নাচতে মেয়েটি

হঠাৎ যখন হয়ে গেল নেই

চোখ খুলে দেখি আদ্যোপান্ত

নাচিয়েছ তুমি মাস্ত্ আমাকেই।


ঈগল


নিঃসীম দূর নীলিমায়

উড্ডীন ঈগল পাখি

দুপুরের গোসল ভুলে

অপলক তাকিয়ে থাকি।


সে তাকায় আমার দিকে

আবেগে পাখনা নাড়ে,

পারি না উড়তে আমি

সে নেমে আসতে পারে।


উল্টাসাধন


যে জানে উল্টাসাধন

সে চেনে এলদোরাদো

যে ছেঁড়ে আমি-র বাঁধন

পায়ে তাঁর লুটিয়ে কাঁদো।


যে ছাড়ে মায়ার আদর

চোখে তার দিব্য আলো,

সে আলোর পুণ্য সে পায়

যে বাসে কেবল ভালো।



এবার একটু


এবার একটু নিবিড়ে যাও

এবার একটু শান্ত হয়ে বসো

এবার একটু

এবার একটু মগ্ন ভালোবাসো।


এবার একটু শূন্য হও

এবার একটু নগ্ন হয়ে নাচো,

এবার একটু

এবার একটু মৃত্যুলোকে বাঁচো।

যুবক অনার্য

যুবক অনার্য


খুব মেঘ ক’রে আসে


সলতেডাঙার ধারে মুহূর্তের অলিখিত শোক

বিবর্তিত ঘাসের নগ্ন পরতে ফড়িঙের ব্যথিত উৎসব

পাখিদের বারোয়ারি সঙ্গম পিছপা হয়ে আসে

আর অই রোদের রাখাল যে কখনো ভুলে যায় না

তার প্রিয় কোনো নাম, সেও বিষণœ যেন কবি


পথচারী জোনাকির সাথে জোছনার

অথবা নির্দলীয় নক্ষত্রের

বিধিবদ্ধ প্রেমের মধ্যে নেমে আসে

ধূর্ত ইয়াগো-সন্দেহ ওথেলো-রুমাল


তুমি চলে গ্যালে কবিতায় খুব মেঘ ক’রে আসে

তারপর দীঘির প্রথম জলের আশ্চর্য মহাপ্রয়াণ


তুমি চলে গ্যাছো, তাই ছত্রভঙ্গ বারোমাস


অসমাপ্ত অটোবায়োগ্রাফি


প্রজন্ম পেরিয়ে যাওয়া অভিধান

এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক প্রস্তুতি নিয়ে

নক্ষত্রেরও মৃত্যুু হয়


কোনো কোনো মাঝরাতে বৃষ্টি হলে

নিঃসঙ্গতার প্রতিদ্বন্দ্বী সেজে সে-ও মলাটসর্বস্ব দেয়ালের মত কাঁপে


দেখি নক্ষত্রের মতন তারো চোখে

প্রজন্ম-ডিঙানো ব্যস্ত অভিধান

মৃত্যুর জলছাপ অসমাপ্ত অটোবায়োগ্রাফি


আর্ট এক্সিবিশন


উনুনে শূন্য হাঁড়ি, রান্না হচ্ছে হাওয়া বাতাসের

যেন তৈলচিত্রের চমৎকার প্রদর্শনী


কোথায় তাহারাÑ জয়নুল, লিওনার্দো

এমন দুর্দিনে বিষাদের ঐশ্বর্য

ছলকে ওঠে পাঁজরের বাঁকা হাড়ে

দৃশ্যসংকটে তীর ধ’রে ভেসে যায়

বালিয়াড়ি ঘাস চাঁদের ফসিল


বুঝি নাÑ এখনো সন্ধ্যার সুতো ধ’রে

সকাল কেনো আসে

শাহনাজ পারভীন

শাহনাজ পারভীন


সামীপ্য

হেমন্তের ম্লান নক্ষত্রের মত শীঘ্রই ঝরে পড়বে সবাই।

কত মানুষের কত গুঞ্জন

কর্মব্যস্ততার কত আলোড়ন

সন্ধ্যার অন্ধকারের মত স্তিমিত হয়ে যাবে সব!

ওয়ার্ডসওয়ার্থ, মিল্টন,

ব্রিকলেনের মনিকা আলী, ম্যাক্রিম’রÑ‘মা’

থাকলেও কি, না থাকলেও বাÑনির্ভেজাল দিনের পৃথিবীÑ

সোনায় মোড়ানো রাত, সামারার বৈভবÑ ঝিরিঝিরি ঝরনার গান

ছলাৎ ছলাৎ তান বাজেÑ শোন, মন পাতোÑখুলে দাও কান!

তবু আকাক্সক্ষায় থাকি, আশা বাধি রোজ

শুধু জীবিত নয়, যেন জীবন্ত থাকতে পারি

তোমার সামীপ্য সুধাÑ লাভ করতে পারি আজীবন...


ইন্টেরিয়র

বিলবোর্ডের হোর্ডিংয়ের নিয়ন সাইনে কখনো যায় না দেখা

অন্তরের আলোয় ঝলমলানো সুদৃশ্য চোখ কান নাকসহ Ñ

লালিত স্বপ্নগুলো ডানামেলে পেখম তোলে ;

শৈশবের কবিতা সন্ধ্যা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান

অতীতের পদাবলি ভবিষ্যৎ-এর নৈঃশব্দ

বর্তমানের ঝঞ্ঝা রাষ্ট্রদ্রোহিতার বিক্ষোভ

সন্ত্রাস ছাড়িয়ে কাব্য ভাবনা কাব্যহিংসা আবছা হয় ;

মাথা ছেড়ে ওঠে গার্মেন্টস্ ভবনের দাউ দাউ লেলিহান আগুন।

অলিতেগলিতে অল্পবিস্তর বৃষ্টিতে হাঁটু পানি কোমরপানি।

মহানগরে বসেই স্বাদ পায় নানাবাড়িরÑদাদাবাড়ির

গাঁয়েরÑগ্রামেরÑবর্ষারÑবন্যারÑনৌকার ছলাৎ ছলাৎ শব্দের

কষ্টেরÑদুর্ভোগেরÑআনন্দেরÑঅনাদি বাংলার।

ও ভরা বর্ষার খালবিল ছইতোলা নাওয়ে বসা নাইওরির মুখ

হিজলÑতমালÑতরু গাঙচিল ভরা পুঁটি থইথই পানি পানি ভেলা ঠেলা সুখ!

মোশতাক আহমদ

মোশতাক আহমদ

ন হন্যতে


সাদা নার্সের পোশাকের ভেতরে খেলে যায়

অচিকিৎস্য ক্ষয়রোগির

অকস্মাৎ লিবিডোর চোখ


ঘন্টা-ধরা ওষুধ সুঁই ফোঁড়ানো

স্যালাইন সাকশন অক্সিজেন

ডাক্তারের গম্ভীর রাউন্ড শেষে

আরেকটি সহজ মৃত্যু


তবুও অকস্মাৎ লিবিডোর চোখ

সাদা পোশাকের রমণীর

ন হন্যতে হন্যমান শরীরে



এবার পাহাড়ে


সমুদ্র ক্লিশে মনে হয়, ব্যবহৃত ব্যবহৃত;

এ যাত্রা পাহাড়ে চলো

এই মন্ত্র বেজে উঠলো যানজটের মধ্যপ্রদেশে

বিকেল সাড়ে পাঁচটায়।


কিছু পরে খোলা হাওয়ায়

মন্ত্রের মুখোশ ফুঁড়ে বেরিয়ে এলো

দূরতমা ঝরনার গান।


সড়কদ্বীপের চকচকে ফোয়ারার উপহাস

রং করা বুটজুতো-পরা বৃক্ষের সারি

অযান্ত্রিক-প্রায় সরীসৃপ-যানজট

ঊর্ধশ্বাস-হাজিরার ক্ষমাহীন পরিসরগুলো

উপেক্ষায় ঝাপসা;


পাহাড় ডাকছে এবার।

দীর্ঘকবিতা : আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ

আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ

স্বাধীনতাবিষয়ক গুচ্ছ

স্বাধীনতা, সরলতা: ঘুড়ি

ঘুড়ি চলে গেলো সীমানার বাইরে

কুড়িয়ে পাওয়া বাতাস রঙধনুর চিহ্নে

বিকালের বিরহে- দেশ দেশান্তর।

বিবাহ বিচ্ছেদ ভাটি অঞ্চলে

কোথাও কারো মেহদি লাগে না

কালো লাল সামিয়ানা দোল খায়

যাদুঘরের জানালায়।

ছাদ অতিক্রম করে যাবে ছেলেদের দল

অতীব ভালোবাসা লালরঙ

মেয়েদের সবুজে

সীমানার বাইরেও থাকে যদি গুপ্তধন!

ঝোপজঙ্গলে বাকাট্টা ঘুড্ডি

ছেলেধরাদেরও মন কেড়ে নেয়।

নাম জানা না জানা এই পথ পরিচিতিকরণ

আলো হয়ে জ্বলে উঠে কারাগারে

ভবিষ্যতের সাঁকো উন্মুক্ত

ঘুড়িহারাদের জন্য।


স্বাধীনতা, সরলতা: সকাল

ধরে আছো আর গান লিখে দাও

দূরে যায় খুনের চিহ্ন

শত্র“ বহনের স্মৃতি।

রাতে ছিলো জাতিভেদ ভাসমান শ্যাওলায়

গান ধরতেই কেঁদে উঠে পাখি

শিকার শেষে শহর উপকূলে

আগুনের আয়োজন - লাল তরকারি।


আহা সাধারণে অভিষিক্ত সকালবেলা

শুধু গাছ খুলে সূর্যগ্রহণের মায়া

তোমাকে যদি না-ই ডাকি

এই বেহালা বাজানোর কালে

নদীভুক্ত পাখিগুলো স্বরলিপি লেখে

ছলাকলার এই জটিল বর্তমান ভেসে যায়

সকালের বাতাসে।


স্বাধীনতা, সরলতা: যুদ্ধক্ষেত্র

ফেলে গেছো রক্তকম্বলে-

পাশে কাঁটাতারের সীমানা

তোমাকে অধিকার অথবা হরণ করি কোন সাহসে।

ভূমিদখলের অভিশাপ নিয়েছি মাথায়

আর কাছে আসে দূরে যায় শত্র“-ছাউনি।

আশেপাশে জাতিপ্রথা ক্যামোফ্লেজ রীতি

সেহেতু অতিসাবধানতা

সদা মন বাঘ বাঘদাস।

দেশ অপহরণের মন্ত্র জপি

ট্রেঞ্চের পাশে বন্ধু রাইফেল

উড়ে যায় বোমারু বিমান গুলি খাওয়া পাখি।

কখন শেষ হয় এই ধর্মযুদ্ধ

কখন সরে যায়

হামজার বুক থেকে আবু সুফিয়ানের বল্লম।

কখন ঘন্টা বাজে স্কুলে

কাঁটাতারের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন আম্মা

কবর খোঁড়া শেষ হলে

শাদা পতাকা উত্তোলন।


স্বাধীনতা, সরলতা: গাছ

আয় গাছ আয় দেখি রাস্তায় প্রতিপক্ষ পালন

ঝরে যাচ্ছে পাতা

ময়ুরের পালক কলহবাতাসে।

দূর দেশে তুমি হেসে খেলে থাকো

আর গাছ দেখে নির্বাচন করো

বাঁশখালিপথে গোত্রভিভক্তি

আত্মহনন বাঁচামরা খেলা।


দিয়েছি যে ঘুম তাতে আম পড়ে জাম পড়ে

মাটির নীচে ঘর আর বিবাহ বাসনা।

যদি দেহ বিনাশ হয় সমর হিংসায়

একটি গাছ উঠে দালানের পাশে

চির সবুজ তোমার আমন্ত্রণ আশ্রম

আর পাখি তুমি গান ধরো

প্রিয় গ্রামাঞ্চল, হেমন্ত বাতাসে।


স্বাধীনতা, সরলতা: মনপাগল

যেভাবে প্রকাশিত হতে চাই সেভাবে

হয়না, শুধু ভাষার মায়ায় আটকে থাকে মন

গরু দেখা হয় না কৃষিকাজ হয় না

ফুলে উঠা দস্যু-জগত অচেনা দুর্গে।

যদি খুলে দিই তাকে মায়ার আবেশে

তখন মরুপথে হারায় সে

যেমন পাতার বাঁশি

কবর থেকে উঠে আসা ফুলÑ পাথর প্রদেশে।

তাই গোলাপের চিহ্ন দুল মেয়েদের কানে

তেমন করে সরলতায়

এমন একটি বাতাস দুপা ছড়িয়ে আর একলা

ঘোড়া চলে যায়

মাঠ অতিক্রম করে উপত্যকা বেয়ে

ঝর্নাপথে উপকন্ঠে জনশূন্যে আড়ালে।

শোভা পাওয়া পয়সা প্রতিপক্ষে

আর মন থাকে অনায়াসে

কিরকম ব্যাকুল গোপনেÑ আকাশ আহরণে।


স্বাধীনতা, সরলতা: খুন

একটা কাক আর একটাকে কিভাবে মারে

কবর দেয় পাথরের নিচে

আর আমার ঈর্ষা কাছাকাছি আসে।

রূপ হয়ে বোন সেজে আমাকে ডাকে

দেই জ্বেলে দাবানল দাবদাহ ঘাসের মর্মরে।


ভাই হাবেল তুমি পিতৃপ্রেম চুরি করো

আর আমি দ্বিধাবিভক্ত, বঞ্চিত

যতোটুকু পারি ঘৃণা করি

আমার কোরবানি উপেক্ষিত।

যে ঋণ গ্রহণ করি ভালোবাসা প্রতিশোধেÑ তাই ভার

কাঁধের ভূভাগে পাথরের ভাণ্ড

তুমি নাও আমি নিই

বাকীটুকু প্রায়শ্চিত্ত আসমান থেকে নামে

আর লেখা থাকে ফসলের মাঠে।


স্বাধীনতা, সরলতা: ঈশ

কিসব বাতেনি জ্ঞান দয়াল

তাই ব্যবধান পরিচয়করণ

দিয়েছো জ্বেলে জগত সংসারেÑ

জাতিভেদ প্রথা

মাছে ঠোকরায় হাঙরে খায়।


যতোটুকু পারি অঙ্গীকারবদ্ধ

আর অস্বীকার করি তোমাকে

তোমার মতো সদা বিভাজনে।

যেহেতু ভালোবাসি যথা শ্বাস আর উচ্চারণে

তাই দাঁড়িয়ে রেখেছো চিকন দড়ির উপরে

নিচে দাউ দাউ আগুন

পড়ে যাবো পুড়ে যাবো

দিয়ে যাই শত পরীক্ষা।

জনযুদ্ধে জনসংঘে প্রাণ খোঁজে বান্দাগণ

সমুদ্রজঙ্গল দূরে সরে যায়

ভাগ আর বাঘ থাকে গণপৌরহিত্যে

বসবাস কেমনে করি।




স্বাধীনতা, সরলতা: সন্ন্যাসসত্য

মৃত্যু পরপারের বেদনা

সিংহাসনে যায় রাজাপ্রজা সমভাবে খায়

ঘোড়া করে আসে আর ভাষা ভরে দেয়।

আশা করে থাকি মৃত্যু হবে

তাই মনোরম বীচে আপেল গড়ানোর ভঙ্গিমা।

যে ঘর বাঁধিয়াছি তরুতলে মেহগনি বিভোরে

তাহাই সহমরণ ব্যথা

তাতে মুগ্ধ তুমি সিপাহসালার

বিনিময়ে আমাকে তরবারি দেবে না

উপহার, জানি।


স্বাধীনতা, সরলতা: নারীযাদু

বিগলিত আদিমতা তাই নতজানু সভ্যতায়

খুলে যাচ্ছো তাসের ভঙ্গিমায়

দেখা হয় আর মন কিরকম স্পর্শকাতর :

খুলে যায় এক এক করে বিবাহরাত্রি

আলট্রাসাউন্ড, পেটের পাতাল মরুঝর্না ।

ধরে আছো আঙুর ফলের মতো

মুখে দিই আর কি গন্ধবেদনা!

আমি প্রতিবন্ধী রূপঅরূপের কালে

জানি ধরা দেবে না আমাকে

হয়েছি তো ধনুকের ছিলা

টান টান করে চলে গেছি শিকার অভিমুখে

কোন শিকারি এসে আবার ব্যবহার করে

বনপর্বেÑ মাইজভাণ্ডারী।


স্বাধীনতা, সরলতা: পয়সা

পয়সা আমাকে নির্বিচার বাণিজ্য করো

তুমি কি মনোহর কুকুর আমাকে কামড় দিয়ে

সিটি কর্পোরেশনের মাঠে ফেলে দাও

সেথায় শিক্ষানিবিশি, দস্যু ঠিকাদার

আর সুলতানি দালানপর্ব।

সরলতা ভুলে যাই কাছে এসে তুলে নিই

সতত টেণ্ডারদণ্ড।


আহা বিনিময় প্রথা-

যতোটুকু নেয় সরাসরি নগ্ন করে

বাকী থাকে হাড্ডিসার কংকাল।

রপসীর বাণিজ্যে দেশে দেশে তাকাই

আর পরিশ্রম করি

আজো পাথর খুলে প্রতিশয্যা আম্রকাননে

আসো যদি এই দিকে খালি পায়ে এসো

রাবারের জুতো হারিয়েছি হতভাগ্য

রেলস্টেশনে।


স্বাধীনতা, সরলতা: অভিবাসন

ধূ ধূ দেশ বদলের দায়

কার কাছে খবর দিই

কাকে সৎমনোরূপে অভিযোগ করি।

শুধু জলপাংশু যোগাযোগ রেখা

আর হতবাক নিবন্ধকরণ

পথে পথে নিুরূপ ছদ্মবেশ

প্রজা জনসভায়

ঘটে ঋষিবেশ অপরিচিতিকরণ।

আহা বিদেশি বাতাস

আর এক ভূভাগের আকাশ

আর ভালোবাসা দূরে থাকে

পড়ে যাওয়া নৌকা সমুদ্রে

ঘুম আর ভ্রমণের কালে।


স্বাধীনতা, সরলতা: ঘর

আমিই আমার ঘর

একজনে থাকে অন্যজনে যায়

ভেতরে সদা ভাষা পরিবর্তনের ছায়া

কাছে আসে দূরসংঘ শত গ্রাম শহর পরিণাম।

ঘুরে ঘুরে আসে

ছেলেমেয়ে স্ত্রী পরিবার

আলগোছে অন্যরূপ বহুরূপ ধরে

একজন আসে অন্যজন যায়

সুরারূপে ভূগোলবিদারি আকাক্সক্ষার পা

বাহির থেকে দরোজা জানালা বন্ধÑ নিরন্তর

ঘর আমার কিভাবে হয়।


স্বাধীনতা, সরলতা: কৃষিকাজ

ছড়িয়ে পড়েছে পোকামাকড়

গণিতের ভাষায়

প্রতিহিংসা করো সরকার আমাকে।

ভর্তুকি দিয়ে ধান চাও-

মনতো আর চাও না।

মাথা থেকে পা পর্যন্ত এই ঘাম নদীসম্রুদ্র মেলে

সেখানে পুরনোকালের গতি পারাপার

আর দৌড়ে আসে মাঝি।

এই ধারণাই প্রবল

ফসল এনেছি রাক্ষসের ঘরেÑ

ওরা আগুনে ফেলে দেবে আমার সন্তান।


স্বাধীনতা, সরলতা: মনোরম বীচে

মনোরম বীচে ব’সে একটি সুমহান কাঁকড়া

আর পাশে জলপড়া-

কাপড়খোলার কাহিনী।

বাৎসায়ন আমি তোমার ছাত্র জানি

আর নিবিড় ধর্ম সর্ম্পকে ভাবি।

ভাসতে ভাসতে এই দেহ দেহের ভেতর

মাটি মাছ প্রবণতা

তাই সমুদ্রে করো নির্বাচন ধ্বনি।

বহন করেছো যে কোমল পানীয় তার ভেতরেও

পানিফল ইচ্ছাÑ

যদিও গন্ধমের স্মৃতি নাই থাকলো মনে।

যেহেতু এখানে মহিলাদের দল

জলপড়া আর কাপড়খোলার কাহিনী

মন সরোবর

প্রতি দেশে দেশে গোসলের বেশে।


স্বাধীনতা, সরলতা: ভাষাদেশ

ভাষা ব্যবহার করে তোমাকে না পাই

সরলতা বাঁচায় নিত্য ভাষাঅত্যাচার

যখন ভাষা দাও

মূক আর বধির এই গাঢ় ময়দানের দেশ।

তোমার শব্দহুলো ফুলে ফেপে

পঁচা আপেল ফল

ঝুলে আছেÑ দোকানের দড়িতে

খাওয়ার ইচ্ছা করে কোনো মৃত ঘোড়াদের।।

মোরগের পাখায় ফোটে থাকা লাল

অতিকাছে মাঝিমাল্লার সংকেতÑ

সবকিছু মনোহর আন্দোলনে

যোগাযোগ ব্যথা, দূরভিসন্ধি।

আপেল কাটার মুহূর্তেÑ হত্যাকাণ্ডের ভাষা

বন্দী থাকে দস্যুদের দলে

সবুজ দেহ আবরণে রক্তপাত।


স্বাধীনতা, সরলতা: সৃষ্টিবাজনা

অতিব্যবহার ইস্পাত আর ক্যামেরা

ভুলে যাই কাঠবিড়াল পাহাড়ের ঝর্না

সারি সারি আমগাছ

মিলন কাতরতার কালে

খুলে দিচ্ছে সীমান্ত কাঁটাতারের প্রকৌশল।

ঢল ঢল গলিপথে উপচে পড়ছে পানি

আর শিকারি আসছে উপত্যকা বেয়ে

যদি আজ প্রাণকাতরতা দিলে

প্রকাশিত হওয়ার ঝোপঝাড় দাও

হায়েনাদের পাতায়।

যেনো দেহ বদল করে এই নীল সবুজ পাজামা জামা

এই মাঠে ময়দানে থাকে

কালো চাপকল থেকে উঠে আসুক মাটি

লিখে যাওয়ার বার্তা মনোরমÑ এই রাত্রি অবসানে

জল সরোবরে ভাসে কলাগাছের পাতা

চিরদিন অপেক্ষায় থাকি।


স্বাধীনতা, সরলতা: শিশুরূপ

তরবারি দিই নাও খেলনা দিই নাও

ভুলে যাও ছলনার ভেদ-অভেদ।

দৌড়াচ্ছ আর খুলে পড়ছে জায়গাবদলের গীতলতা

আর আমি তুমি হয়ে যাই তুমি আমি হয়ে যাও

এই দেহ ব্যবধান দেহ বিচ্ছেদের ভার

আমার জন্মকালীন গান।

ঘটে দেশে দেশে খাদ্য বিতরণ

ঢেউটিন স্কুলের সমাহার

আর বাল্য বলিদান

তুমি আশা হয়ে আছো কার কাছে

স্বদেশ প্রত্যাবর্তন।


স্বাধীনতা, সরলতা: প্রতিষ্ঠান

হিংসা করো, জ্বালিয়ে দাও কাছে থাকার বীজ

যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন আজ সন্দেহ শিক্ষায়।

পরপারে যাবে

শান্তি মাঠে ময়দানে নিরাপদ আহার

আর চোখে চোখে পরিহারপ্রবণতা।

সেনাদল ডালভাত খায় কতো আয়োজনে

আর জনসাধারণে থাকো

ভেড়ার পালে লুকোনো শত্র“ ছাউনিÑ দেখাই যায়না

কামড় দেবে নিশ্চিতÑ প্রিয় ভাইবোন

পোশাক বদলের এই ইতিহাস

কবে শেষ হয়।

স্বাধীনতা, সরলতা: ভ্রাম্যমাণতায়

উঠামাত্র সৌন্দর্য ছড়িয়ে আছে

লোহাকাঠ জাতবিচার আর থাকেনা পায়ে পায়ে

চুপিসারে দল হারানোর স্মৃতিচিহ্ন মনে রাখি

দিই অধিকারচর্চা বুক ভরে

কাপালিকের ভয়ালদর্শন ভুলে যাবোÑ

এই জলসরলতায়।

নিরাকার ভালোবাসার আনন্দÑ তুমি নাইবা দিলে

ভূমিআক্রমণ কাঁটাতার ভেঙ্গে চলে যাবোÑ চোখে চোখে

যারা মমতায় সিংহ অপহরণে যায়

তারাও মিনার বানায় দলবদ্ধ শ্রমিকের দেশে।

দেশে দেশে বুঝি মাটি কাতরতা

জেগে উঠেছে যে গাছ ভোর আর বাদলে

তারাও জ্যোৎøাপ্রেমিক পাহারের নিচে।


স্বাধীনতা, সরলতা: বিচ্ছিন্নতাবাদ

আমিও বেঁচে থাকবো আমগাছতলে

অগ্ন্যুৎপাতের পর রাশি রাশি মৃতবন্ধু নিয়ে

শূন্যে তাকাবোÑ

আহা পরিত্রাণ, জলভাষা ভূমি উচ্ছেদে।

শুধু যে দোদুল্যমানতা পাতার কাঁপুনি

ঘরে ঘরে বিচ্ছিন্নতাবাদ ভ্রাতৃহিংসা অমরতা

এটুকু স্বাধীনতাবোধ না দিলেÑ মরে যাবো।

শিকারির কথা কিভাবে বলি

এই বোতলভর্তি সংবাদ কাকে দেবো

আমাকে যে মেরেই চলেছো তুমি কলহকাল।

প্রশ্ন ক’রে ক’রে তোমাকে ম্লান করি

তাই তুমি আগুনে ফেলে দিয়ে দেখো

তোমাকে চাই কি না

শত শত বাঁশঝাড় পুড়ে যায় তোমার বিষাদে।

ইশারাই যথেষ্ট নয় কাছে এসে প্রাণ দাও

আকুলতা সারাক্ষণ যেন বাঘমুক্তি, সঙ্গি।

দীর্ঘকবিতা : কামরুল হাসান

কামরুল হাসান

পর্যটকের ডায়েরী

বিদেশে গেলেই তার দুই-পা লম্বা হয়ে ওঠে

এক-একটি নক্ষত্র ঢাকে লম্ফমান পায়ের তালুতে

কামনার বড়শিতে গেঁথে নেয় মঙ্গোলীয় মাছ

জাভার সমুদ্রতীর ঢেকে রাখে হাতের ডিবায়

সুনামী জেনেও খুব নেমে পড়ে বালির সাগরে

অনন্ত সুডৌল সারি খরবাণ যৌবনের তেজ

সমস্ত তুলিয়া রাখে স্মৃতিময় চোখের ডিবায়

চঞ্চল পায়েরা ঘোরে সোমমত্ত পাড়া ও ঘোড়ায়।

দূরে যে প্রদীপ আছে ম্রিয়মান মুখ

সুদূরে বেদনাহত পথ চাওয়া সুখ

আপন বুকের পাখি ওম নিয়ে বাঁচে

বাবা তুমি নিরাপদে ফিরে এসো কাছে

তোমাকে প্রলুব্ধ করে মঙ্গোলীয় রূপ

গ্রীবা খাঁজে ঢেলে দেয়া বালির স্বরূপ

নিভে আসা জালে কত রূপালী রোহিত

প্রখর সে রৌদ্র বুঝি প্রাণঘাতী খুব।

ফিরে যে পৃথিবী দেখি একান্ত আমার

কেবল পুস্তক নয়, ছাত্র আছে হাজার হাজার

তারা তো শিক্ষা নিতে মনোযোগী খুব

সারি বেঁধে বসে থাকা নতমুখী ছাত্রীর রূপ

বলে, আমাদের চোখ চীনাদের চেয়েও আয়ত

আমাদের প্রাণে প্রাণে ভারতীয় মধুর সানাই

বাঁশি সুর সরে গেছে, বন্ধুর তবু দেখা নেই।

দেখি পৃথিবী আমার ঘরে চুপ করে বসে আছে আজ

দেখি সে রূপের ঢলে মত্ত হয় গৃহিণীর সাজ

আমার পর্বতগণ সুশ্রী খুব উপরন্তু গাছেরা সবুজ
ওরাও বিনম্র চোখে গভীর তাকায়, মধু স্বর ছুঁড়ে দেয়

বাংলার আকাশে ভাসে কি আশ্চর্য মেঘের গম্বুজ।


আমরা ভিন্ন জাতি, প্রমোদের ভিন্ন কলা জানি;

তোমাদের দুরন্ত উড়ন্ত লোভে ঘূর্ণিরত অবিরল ছবি

উপুড় রয়েছি দেখ কলসির মত্ত রূপে জলে

পান করো, সিক্ত হও, কেন ওরা ছুটে ছুটে আসে

সাদার জগৎ ছেড়ে জাভার পর্বতে আর বালির সাগরে?

সব পর্যটনপ্রিয় মানুষেরা ফিরে যায় ঘরে

সুন্দানিজ মেয়েদের রূপরঙ নিঙ্ড়ে নিঙ্ড়ে চেখে

প্রাচীন আপন ঘরে কৈবর্তের রূপালী ইলিশ চেনা খুব

তবু তারা চকচকে চোখে শুধু পাখির আগ্রহ জ্বেলে রাখে।

দেখেÑ সকল শিশুর মাঝে প্রিয়তর আপন আত্মজ

আত্মজার টান ঐ রূপশালী ধানভানা রমণীর চেয়ে

তীব্র খুব, দেখে তার নিজস্ব জগৎ হঠাৎ ঝুঁকির মুখে

পড়ে যেতে পারে, সমুদ্র উঠেছে ফুঁসে সুমাত্রার কূলে।

বিদেশে চোখের মর্ম, সুরমার কাজল গড়ায়

বিদেশে দিগন্ত হ্রদে অপরূপ ব্রিজেরা চমকায়,

অথচ আপন দেশে বিদেশের কত মূর্তি ঘোরে

এবং সকল বৃক্ষে অনবদ্য সবুজাভা দোলে

আকাশ একই নীল জলে আছে মাছের সাঁতার

বাঙালী ললনা ধরে সুমাত্রীয় বোনের বাহার।

পাহারা ডিঙিয়ে তারা চলে যায় পাহাড় চূড়ায়

স্তনবৃন্তে দীপ জ্বেলে ঊরুদের ভেলা চড়ে যায়

কেননা অর্থকড়ি কিনে আনে প্রমোদের রানী

ছড়াও রূপালি মুদ্রা রূপেরাও গড়াবে এক্ষুণি।

তক্ষুণি জেনে যাবে দেশে ও বিদেশে নেই ভেদ

জনে জনে পৃথিবীতে বৈচিত্রের অযুত সম্ভার

তাদের সামন্ত ভিন্ন কলা নেই আর্তস্বর নেই

চিৎকারে শীৎকারে তারা ভরে দেয় গোপন তল্লাট।

ওরা তো বেঁধেছে চুল সুডৌলের খোঁপা বেঁধে বেঁধে

বসাল সুদূর পথ উঁচু করে দৃশ্যমান ফ্লাইওভারে

নান্দনিক উচ্চনাসা জাকার্তার উঁচু দালানেরা

গর্বিত ঠমক হেনে দৃষ্টির মুগ্ধতা কেড়ে নেয়

দ্বীপে দ্বীপে উড়ে যায় আকাশ বাহন

দ্বীপে দ্বীপে মূর্তিমান মনুষ্যপ্রবর

জলে ঢলে কোমরের সমান প্রলয়

প্রণয়ে পীড়িত ওরা জানে প্রাণে গভীর প্রণয়।

সেখানে যন্ত্রের মত মেলে রাখে উড়ালের পথ

সেখানে পাহাড় যেন উদ্বেলিত সুউচ্চ স্তন

সেখানে মীমাংসা খুব জনে জনে পানীয়ের রঙে

তোমাকে শায়িত করে আকাশের ধ্র“বতারা ঢালে

কত যে ইঙ্গিতময় হাসি, কত ফেননিভ বিছানারা পাতা

মধুর চতুর সব ফাঁদ পাতা আছে সারিসারি

দ্রাক্ষারসের চেয়ে মধুতর মদ্যে গড়াগড়ি

তোমাকে ভেজাতে আছে দুগ্ধ সরোবর।

পর্যটনপ্রিয় দেশে দলে দলে এসেছে নাবিক

ডোডো পাখীদের মত মেয়েমানুষের মাংশ ভালবেসে

এখন শিকারী নব সুনামীয় ভীষণ তালুতে

প্রমত্ত থাবায় তুলে উগড়ে দেবে লীলাহীন খাটে।

বালির সৈকত জুড়ে পৃষ্ঠাময় নীলের স্বরূপ

অন্ধকারে কবরে ঐ যায় তারা সুন্দনিজ রূপ

সমুদ্র গর্জন আনে কঙ্গোর নিভন্ত আলোয়

যদিও সোমত্ত খুব প্রমত্তের প্রমোদ বিলোয়।

ঐ গণিকাদের রক্ষা করো প্রভূ, ওরা পরীদের বোন

জড়িয়ে মৃত্যুর বীজ ঘরে তোলে দ্রোণ

জীবন ও মৃত্যুর গলাগলি ধরে শুয়ে থাকে তারা

নম্র আর আমোদের নরোম শয্যায়

ওদের ভিন্ন ক্ষুধা, পর্যটকের চেয়েও মৌলিক

মুদ্রা কত নর্তকীর বসনের মুদ্রা খুলে দেয়

কড়ির দুরন্ত রথে নিয়ে যায় ক্ষুদ্র পরিসর

প্রেমিক জড়াবে আর ঢেলে দেবে গূঢ়তর বিষ।

দ্বীপসারি থেমে গেলে উড়ে চলা মেঘের মেয়েরা ..

বলে সে আরেক দেশে ভিন্নরূপ পায়ের সরাই

কেবল বর্ধিত হয় অন্য ঘড়া, প্রাণের ঘড়াই

বুঝি সব স্বপ্ন এক, বহুনিম্নে জাহাজের দীপ।

নিজের ভুবনে ফিরে দেখে তার সকলি অটুট

কেবল ভেঙ্গেছে সে রূপভর্তি দেহের কপাট

তার বহুগামী মন পৃথিবীর দেশে দেশে ঘোরে

বেঘোর মনের মত আশাতীত দর্পণের ছবি

জাভার পর্বত জুড়ে পুবের অজস্র মোমবাতি।

প্রজাপতি চিত্রিত বিচিত্র শত উড়ে উড়ে আসে

ঠাঁসবুননের গাঢ় সূচরীতি অনুপঙ্খ কত নকশায়

পৃথিবীর যত রঙ দ্যুতিময় রঙে মিশে গেলে

ফুটে ওঠে ছায়ারঙ আর অভিনব ছায়াপথ

সে সব পথের শেষে মোহনীয় অন্যসব পথ

উত্তপ্ত সে উরুর ভেলায় চড়ে দেখেছি পর্বত।

তারা বীক্ষণে ও বিজ্ঞাপনে তীক্ষè ইশারায়

ডাকে আর দেখায় নরোম ষ্ফীতি পদ্মভার তার

মাইল মাইল জোড়া সর্ষেক্ষেত মুঠো ছুঁয়ে থাকে

এখানেও রবিশস্যÑ বাঙলার বসন্তে যা ফোটে।

পুরাকালে আন্দামানে যেত কত পাপী ও বিপ্লবী

সন্ন্যাসী শতেক বড়বুদুরের মঠে ঘোরে সহিসের সাথে

চপলা যোনির মৌন ইশারায় ডাকা যত পাখি

প্রভাতে হাওয়ার ঢেউ প্রবাল বদ্বীপে এসে পড়ে।

তখন আকাশজুড়ে উঠেছে বিলাপ, সব পড়ে থাকে নিচে

এ্যালুমিনিয়মের ডানা নিয়ে আসে নিজ পৃথিবীতে

নম্র সহচরী শিশুদের মুখ সবচেয়ে প্রিয়তর তবু

বিদেশের ভ্রমে প’ড়ে স্বদেশ ভুলিয়া কত কাদা মাখি মুখে

ভালবাসি যত ভালবাসাবাসি পৃথিবীর দূর পথে পথে

বোনেরা সখীরা গলাগলি ধরে বসে আছে কতশত রথে

আকাশবিমানযানে উড়িয়া ছুটিয়া ট্রেন চলে অবিরাম

বুঝিবা সে সোনালী প্রদেশে দিবানিশি ঝরে ঘাম।

তাই ছুটে চলি শুধু, নতুন অভিজ্ঞা নিয়ে ভয়ে দিই পাড়ি

জানি না এমন বজ্রপাতে মাথা হবে কি চৌচির

দেশের মায়াবী মুখ জলে সেই হ্রদের ছবিটি বুকে ধ’রে

দ্বীপে দ্বীপে উড়ে যায় ডাঙ্গাপ্রেমী আকাশ বাহন।

দীর্ঘকবিতা : সৈয়দ আফসার

সৈয়দ আফসার

ভোরে রচিত কথাগুচ্ছ

বৃষ্টিরাতে স্বপ্নশ্বাসে যে কথা বলে, হাসে... ভোরে তার কথা বেশি মনে পড়ে যায়

ঘোররাতে একাই লুকাই মুখ কাঁথাবালিশের তলে কেউ যদি পোড়ায়...ওদের

বলিস, আমাকে না-জাগালে ক্ষতি নেই, শীতের দিনে শুতে যাবো না একা বিছানায়,

না-বললে কি হয়...চোখের সৌন্দর্য অলৌকিক কিছু নয়; গুটিকয় উষ্ণতা না-ছুঁলে

ক্ষতচিহ্ন গুণতে পারি, শুনতে পারি ছুটির দিনে কারও আনাগোনা; ভোরে যত দীর্ঘ

স্বপ্ন দেখি চুলে বাঁধি না তারে; শুধু দেখে নিলেই হয়, কার নিঃশ্বাসে লুকানো

সর্বশেষ বিস্ময়!

ছুঁতে যদি নাই পারো তাও ভালো, অপূর্ণ রাতে চাই না কামনা, তুমি কেঁদো না

শেষ রাতে দু’চোখের পাতা; তোমারি জন্য অনিদ্রিত চোখে বিছানায় চলে হাঁটাহাঁটি।

ব্যর্থ হলে ক্রন্দনকাকুতি করো না; তারচে ডাবু বোঝাই স্বপ্ন পুষে রাখো খালি

পকেটে ... একাকি হলে আমার দিকে ছুঁড়ে দাও পুরনো ক্ষত আর ব্যর্থ দিনলিপি; যদি

বলি সকালের রোদে কারো ভাল নাও লাগতে পারে প্রকাশপ্রীতি; জানি তোমার ভাল

লাগা আহা... রোদগাঁথা জানালার পাশে একা দাঁড়িয়ে থাকার গ্লানি, জানো তো

আমরা আদিসূত্রে পাইনি কলঘরে ঝরনার পানি ডিশএন্টিনা-ষ্টারপ্লাস মুঠোফোনে কথা

দাঁড়িয়ে থাকা...অবশিষ্ট চ্যানেল যত তাও ছুঁতে পারি; কিন্তু আমার তাকানোর

নির্ধারিত কোন গতি নেই, যখন দৃশ্য দেখার ইচ্ছে করে দুঃখসব ভুলে ঘন্টার পর

ঘন্টা দু’চোখ বন্ধ বসে থাকি, বুক থেকে চুষে নেই যত অনুপাত দেহের প্রকৃতি

তুমি যেতে পারো দূরে ঈর্ষার পাশে, অবশিষ্ট যত মিলেছে শ্বাসে; যদি চোখ থেকে নিদ্রা

খুঁটে নেয় কেউ; যদি মায়াচোখে জড়াতে চায় রাত্রিঢেউ; এই বেলা তোমার আসা-

যাওয়া অন্যপ্রকাশ দোষের কিছু নয়; চেষ্টা করে নিলে হয়, রহস্যঘেরা আমারি লালার

পাশে দাঁড়নো তবে কার ঘুমের জরা? নিদ্রায় জাগিয়েছি লুকানো চুম্বন দেয়ালে-

আয়নায় টাঙানো অন্ধ-বধিরতা। বলছি মাটি চুঁয়ে নামবে ভাবালুতা... তুমি যেতে

পারো দূরে অন্যতা, ভাবনা সম্ভাবনা; জল গুণে গুণে কান্নার রস ঢেলে দিতে পারো

কিন্তু পাশাপাশি বসে অভিশাপ দিতে পারো না

যাবার রাস্তা চিনে সে যদি ফিরে যায়; তাকে একা যেতে দেবে পথিকের চেয়ে দূরে;

তুমি থমকে দাঁড়াবে না ঘুরপথে; বাকিটা পথ পেরুলেই কাঁচা-পাকা রাস্তার পাশে

ঠোকর দিচ্ছে পাথরের রোদ ঘরে ফেরার আগে উঠানে খাড়া পা-হাঁটা পথের

গ্লানি, তারই ভেতর সকাল গড়িয়ে মধ্যদুপুর তুমি কি পিচ রাস্তা ধরে শেষ

বিকেলের দিকে হেঁটে যাবে; নাকি নিজেই নিজেকে ফিরিয়ে নেবে আলো বাতাসে

মিশে; স্বেচ্ছায় আত্মহত্যা করবো না বলে আমি পথেই রয়ে যাবো; পথের পাশেই রবো

চির নিদ্রায় শুয়ে। এরকম ধারণা তোমাকে কি কখনও তাড়ায়, বলে দাও ওহো

ভোরের হাওয়ায়...

তোর প্রস্থান ছাড়া জামার ভাঁজে লুকানো গুপ্তরতœধন তার ভেতর যাওয়া-আসা

দেহের পিপাসায় দশআঙুলে তরতাজা বৃষ্টিফুল; কাকে যে তাড়া করে ফুটিয়ে তুলছে

চাঁপা-বকুল; হাত ধরে টানাটানি কোনো এতো পাগলামি প্রতিদিন; বহুদূরে জানালা

খুলে খুলে তাকানো আর কতদিন, প্রকৃত সত্যটুকু তোর পেছনে লুকিয়েছে অলসতা

টাটকা শীতের উষ্ণতা, সে কি জানে না; ওই হালকা-পাতলা জামার নীল বোতামের

ফাঁকে আনমনে দুলছে কার কামনা

যেটুকু চেয়েছো টোলহীন গালে, না-ছুঁলে বিশ্বাস করবে না; আর বোঝানোর ভাষা

তুমিও জানো না! দুর্লভ-প্রেম। কখনো-কখনো মনে হয় টানা-টানা দিনে আমাদের

ফেলে আসা কথাগুলো হেসে-হেসে উড়িয়ে দিলে কিছুই জানলে না... দেখলে না

কার ইশারায় দেয়ালে সাজানো অকাল বরষা! বৃষ্টিজল। কথা ছিল যে যাই করি

মিলেমিশে হবে কিন্তু আজ দীর্ঘ বিরতির পর মনে হয় তোমার দু’চোখে একা

ঘুমায় পুরো সমুদ্র নিজস্ব ঠিকানা।

পরে জেনেছি সংকোচ ছিল বলে ভালই ছিলাম, রান্না ঘরের পাশে; শুধু জানি দুঃখ

কঠিন কিছু নয় অপেক্ষায় শ্বাসকষ্ট বাড়ে দীর্ঘশ্বাস ছুঁয়ে নিলে হৃদরোগ কমে; কিন্তু

তুমি কি জানো দুঃখ আমার একার হবার কথা ছিল না, গোপন হৃদপিণ্ড কি

কষ্টেই-না আছে; ইচ্ছে করলেই যে সব কিছু নিজের মতো করে ভাবি, তাও বলা

যাবে না আর দুঃখটুঃখ কম পেলে জীবনের উপলব্ধি মনে হয় জামা পরা... অন্য

কিছু বলছি না; শীত রাতে জোরাজুরি করো না কাঁথাবালিশমাথা

তুই কি জানিস্ অনতিদূরে তাকানোর শেষ ইচ্ছা স্থির করে প্রথম যেদিন তোর

সামনে দাঁড়ালাম মনে হলো এই বুঝি বেড়ে গেল চোখের জ্যোতি তোর নীরব

উপস্থিতি আঁধার কী মানে, সন্ধ্যেবেলা চোখ বুজলেই আড়াল হয়ে যায় জীবনের

একটি দিন কিন্তু মনের বয়স কখনো বাড়ে না; এ সত্যটুকু তোকে অত্যন্ত

ভালোবেসে যাবে বয়স বাড়লে; তুইও জানিস পূর্বাকাশ ঘিরে থাকা সন্ধ্যে হাওয়ার

ঘোরে আমরা যে হারিয়েছি শৈশবের কিছু কথা... কিছু উন্মাদনা; তাই বলে কি

বরফের দিনে দুর্ভোগ সামনে দাঁড়াতে পারে না

গত নয় বছরে স্বপ্ন দেখা ছাড়া কিছুই পাইনি; কোথায়ও যাওয়া হয়নি আর; তাড়া

আমার আগ্রহটা কেনো যে উড়াতে চায় ঘন কুয়াশায়; তখন কেনো জানি মনে হয়

দূরচক্রবালে তোমার মোহ, নষ্ট কীটের চেয়েও ভাল; অপেক্ষার দিনে কিছুই ঘুচল না

কেবল বেলা গড়িয়ে জীবনঘড়ি মধ্যদুপুরে ঠেকেছে; বিকেল সন্ধ্যায় হারাবে সহসাই

নিজেকে সামলাতে সামলাতে; তাই দেখে তুমি কিনা জটিল সব রোগে সুখ দাও, জানি

না কেনো? কোথায় প্রতিশোধ রেখে; তোমার বাড়ি ফেরার টানে দু-বাড়ির মাঝখানে

যত রহস্য ছিল চুপচাপ থেমে গেল আমাদের আ-ছোঁয়া স্বপ্নে মিশে

এমন কিছুই ঘটেনি ফেরার টানে, ভাবছি না-ফেরার দিকে তাকিয়ে অবাক দৃষ্টি কি

তোমার কাছে আশ্চর্য মনে হয়; এসব নিয়ে কিছুই ভাবি না, ভাবনায় মাত্রা নেই বলে

তোমার কি মনে হয়, তার কোনো মানে হয়? তুমি মাথা নাড়ালে কিছুই বললে না

কিছু কী বলার প্রয়োজন আছে জিহ্বা নাড়িয়ে; তার চেয়ে ভাল বয়াম খুলে তুমি

তেঁতুলের আচার খেতে পারো জল ঘুলিয়ে; যদি ঠোঁটের পাশে লেগে থাকে আচারের

ঝাল; তবে সবই অতিসরল পানীয় ফল

কোথায়ও যাওয়া হয় না-ফের ফিরে আসতে হয় বলে দৃষ্টি ছুঁয়ে শেষ প্রান্তে দাঁড়ায়

না-কেউ ঝড়ো হাওয়ায় যাওয়া-আসার মধ্যে কিছু জয় পরাজয় থাকে কিছু

পরাজয় জয়ের চেয়েও আনন্দ দেয়... আরো আনন্দ পাই পেছনে পড়ে থাকা

কাজের ফাঁকে। যত দায়ভার পড়ে থাকে ধুলোয় তুলে নেই নিজের কাঁধে, না-ফেরার

ভাবনা সে থেকেই জাগে; সত্যিই একদিন চলে যাব যে স্থানে যাওয়ার ইচ্ছে নেই;

গেলে আর ফিরে আসবো না; এরকম সিদ্ধান্ত নিতেও পারি না

ঘরে ফেরার পথে ছায়াপাতার উল্লাসে সেদিন বাড়ি ফিরছিলাম সন্ধ্যের

আড়ালে ধানক্ষেত বনে, কেউ দেখতে পায়নি, অনুভূতি-টনুভূতি কিছুই আটকাতে

পারেনি ঘরে ফেরার টানে; অনেক দুঃখকে দুঃখই ভাবি না, যদি কারো-কারো দুঃখ

ছোট হয়ে যায়, মার্কেস নিঃসঙ্গতার একশো বছর লিখে ফেলছেন কবে অথচ আমার

গোপন ডাইরিতে নিঃসঙ্গতার একটি মুহূর্তও লিখতে পারিনি কারণ তোমার দুঃখের

সরলতাখানি অতি আদরের না-আসা ভাদরের

সূর্য ডুবে যাওয়ার আগে খানিকটা কৌতূহল সামনে দাঁড়ালো, ভিনদেশে বন্দি জীবনের

মতো ছোটবোন দরজা বন্ধ করে রান্না ঘরে কি যেন রান্না করছে... একটু পরে

জলে-তেলে-জ্বলে উঠার শব্দ কী আবহ ছড়ালো; ভাজা মাছের ঘ্রাণ নিজেকে বলছে

জলদি খেয়ে নে দ্বিগুণ তৃপ্তি পাবে। কিন্তু সত্যি বলতে কি আমি ভাজা-পোড়া

কিছুই খেতে পারি না, লেবুরস ঘুলিয়ে ডালভাত খেলে বুকজ্বলা বাড়ে; কিন্তু লেবু-

ডাল-ভাজি এসব ছাড়া খাবারের তৃপ্তি ভাবাই যায় না।

বুঝতে পারিনি কেনো পায়ে পায়ে নুড়িপাথরগুলো ধুলোতে খেলে আবার ধূলিতে

মিলায়; মাটিতে পড়ে থাকা তোমার শেষ ইচ্ছাটি যদি আমাকে ফিরিয়ে দাও; তবে

অন্যসব রেখে স্বেচ্ছায় নির্বাসন দীর্ঘস্থায়ী বানাবো; নিকটে থাকার সিদ্ধান্ত হয়ত

আত্মঘাতী হবে বুড়ো বয়সে; নিজেকে নিজেই শুধরে নেবার পর; কিছুই মনে থাকে

না; আবার কিছু ভুল ক্লান্তিহীন সুখের চেয়েও মধুর

আত্মযন্ত্রণায় থাকা মনের রঙ কার প্রতি সদয় হলো; কার দেহে লবণাক্ততা চুষে

নিল চৈতিহাওয়ায়; অথচ শৈশব কেটেছে স্বপ্নহীন থেকে মাগুরানদীর পাড়ে দৌঁড়াদৌঁড়ি

দারাগুটি-কানামাছি খেলে; কৈশোর কুশিয়ারা থেকে সুরমার পাড় ঘেঁসে শ্রীমতি

জলের কাছে স্মৃতিরোমন্থন; কীর্তনখোলা-বুড়িগঙ্গা থেকে পদ্মা-মেঘনা-যমুনা জলে

মিশে ঢেউ তুলি ব্যথায় মিশে; বেলা চলে গেলে, ফিরে পাবো কি সেই সব দিন? তাই

বেশি চাওয়া ইচ্ছের চেয়েও লোভী মনে হয়, ভাল থাকা-টাকা; শরীর কি হৃদয়

দু’টিই পুড়ে অহেতু ভ্রান্ত লোভে বলছি তোমাকে ওহো টাইকা, ওহো শীতপ্রিয়; গাঁথছ

কি তাকে ভরা যৌবনে টেমসের হাড়ে?

শুধু তোর জন্য গোপন রেখেছি পিপাসার বেগ, না-ছোঁয়া আবেগ; জল ছুঁয়ে নামুক

ক্ষতদাগ সেদিন তোর কাছে চুম্বন চাইবে না কেউ; হাত ধরে দাঁড়াবে না আর

কেনো ভয়। কারণ তুই জল ছেড়ে ডাঙায় খুঁজবি তৃষ্ণাফল; লজ্জায় না-ফোটাই ভাল

আবেগের ক্ষরণ; শুধু মনে চেপে রাখিস ঘষা-মাজায় জ্বলে ওঠা দেহের চৌচির

কিছুটা ভাবনায়.. কোন একদিন চোখের পলকে স্বরূপে ভেসে উঠেছিল অলস-সময়

কিন্তু কি আশ্চর্য সেদিন কাউকে পোড়াতে চায়নি ভেজা... ভেজাজল-চুলের গন্ধ;

ঝরাফুলের হাসি... কিংবা ঘোরস্বপ্নদিন। হাতে গোনা সময় কথাবার্তা আমার

ভাল্লাগে না; কারো আবেগ অনুভূতি ভাল লাগেনি তাই এখনো অবিবাহিত, নিজের

দখলেও রাখিনি মন; বন্ধুÑবান্ধব নিয়ে মহানন্দে নিদ্বির্ধায় চোখে-মুখে ঘুরছে জীবন।

ছায়াদের বাড়ি আজ তোমাদের হাঁটতে দেখে সারাবেলা বরফ ধোঁয়া মোছায় ডুবে

আছি

কেউ কেউ আমাকে শত্রুও ভাবে কনটেস্ট করে, লক্ষ্য রাখে চলাফেরা গতিবিধি

পিছলা পথে কিন্তু আমার ইচ্ছাশক্তি কারো মুখোমুখি হতে দেখিনি; কারো ইচ্ছে যে

আমার কাছে ছোট্ট হয়ে আসেনি তার প্রমাণ কেবল তুমি? টুকরো টুকরো টুকরো মন;

দেহের উচাটন ব্যর্থ চেষ্টা... এত এত বৃষ্টিঝড় ভাসতে ভাসতে দুঃখগুলান তুমি বুঝে

নিতে নিতে আমি উদলামেঘের হাওয়া

তুই তো জানিস? বেঁচে থাকার লোভে কিংবা অভিমানবশে কাউকে দেইনি

শুভংকরের ফাঁকি; মন আপন ঘরে জেগে আছে, তাকে লক্ষ্য করে দু’চোখের আকুলতা

জ্বলে ওঠে ভিনদেশে; সান্ত্বনাটুকু বোধের ভেতর নিজেকে সাজাতে ভুলে গেছে মনহারা

হৃদয়; কেউ কেউ যে বলে; ‘বেঁচে থাকাটা দারুন ব্যাপার’ নীরব বেঁচে থাকা-টাকা-

কায়া আমার পাঁজরে তাকে রাখি না সুখে

তখনও পা গুণে গুণে পার হতে শিখিনি সাঁকো, নদীতীরে বসে জলের গভীরে

নিজের প্রাণদেহে দেহপ্রাণ খুঁজি পাশ-ফিরে তাকালে বহুদূরও মনে হয় কাছাকাছি;

কিছু কী বলবে? চুপিচুপি ওহো সমরূপি শুধু দূরত্ব-দাবী-দাওয়া-আর্তনাদ-বিব্রত

হাসিতে পেঁচিয়ে রাখলে; কিছুই দেখলে না কাফফারাও গাঁথলে না টলে যাওয়া

ঘুমে...এ-বেলায় গতি-বাতাসে কে যেন হেঁটে হেঁটে বলে গেল গাঁথা-পিনে-যত-কথা

দেহের ভেতর সাড়া না পেলে মন খুলে বলতে নেই স্ফুট-অস্ফুট-কথা

গ্রীন সিগন্যাল দেখে রাস্তা পারাপারে চোখ লুকোচুরি খেলে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়ালে

পাতাগাছ মাথা ছুঁয়ে হাঁটে আর ডিসিপ্লিন আমাকে বিব্রতবোধ শিখতে-শিখাতে

হাতঘড়ি দেখে, এসব ধরাবাঁধা নিয়মনীতি গৎবাঁধা রুটিন কাজ কেনো যে ভাল

লাগে না ঘুমহীন কিংবা অন্ধকার রাত ছাড়া... অন্ধকার রাতে চোখের সৌন্দর্যগুণে

গ্লানি-দেহ-চুষে ভোরে রচিত যত কথাগুচ্ছ তোমারি; কতটুকু সুখে আছো

পরিপার্শ্ব ডানাভাঙা পরি; ছুটির দিনে ফায়ারপ্লেসের কাছে বসে কী আর বলতে

পারি

দীর্ঘ কবিতা : কাজল বন্দ্যোপাধ্যায়

কাজল বন্দ্যোপাধ্যায়

স্বেদবিন্দু


১.

ক্ষুদ্রকায় লিরিক লেখায়

নেই যে কোনো ক্ষান্তি,

তবুও সে এক দুর্বলতা,

তবুও সে এক ক্লান্তি!

২.

দেখেই বুঝি

অকার্যতার সকলরকম লক্ষণ;

লেখালেখিও কতো বেশি

যাদুমন্ত্রের মতন!

৩.

দুর্বল বলেই লিখছি।

লাভ কি কিছু পাচ্ছি?

ক্ষয়ে আর ক্ষরণে

সময়-ব্যয়ের এ রণে

আমিতো আরও দুর্বলই হচ্ছি!

৪.

বাস্তব নির্বিকার নিরেট,

কবির কেন যে তবু

অধীর আবেগ?

বাস্তবের বেলা কাজ করে প্রয়োজন,

তবে কবির বেলায় কেন

এতো বেশি আবেগী নিয়ম?

৫.

আকাক্সক্ষায় ছিলাম এতোই আলোড়িত,

পথে পথে হলো শুধু ভুল যতো!

গন্তব্য অপমৃত্যু, হাত কেবলই লক্ষ্য”্যুত


৬.

তোমার অনিচ্ছায় আসা,

তাই, অকাতরে যাওয়া।

আমার কষ্টার্জিত ধন,

অন্য কারো অনায়াস অর্জন।

৭.

আমি কি তোমার প্রয়োজনের সেই পানপাত্র শুধু;

ভরে ভরে তুমি তরুণতরকে বিলাবে মধু?

৮.

বস্তু ও ভাবের নয় বুঝি খুব সহজ কিংবা নিকট বাঁধন,

অন্যথায় কী করে সম্ভব তোমার এ ঘনিষ্ঠ বসবাস,

Ñ আর এতোবেশী দূরাশ্রয়ী মন!

৯.

মানুষের নীতিবোধ নয়,

বস্তুর চলার নীতিই মূল;

বস্তু এতোই মৌলিক, প্রধান প্রয়োজন,

বাস্তবে শক্ত স্নায়ুর অধিকারী দুর্জনও

সৃষ্টি করে প্রবল আকর্ষণ!

১০.

মনোযোগ আকর্ষণে

তার পরিত্রাহী কাজ

আরো/শুধু ধিক্কারই আনে!?

১১.

অভিমান কি অযোগ্যের অনুভূতি?

যোগ্য তো পায় অম্লান, এমন কি স্ততি!

আমার অভিমানও

কি মজুরদের আন্দোলনের মতন,

তাতে বেড়েই যায় আরো নির্যাতন?

১২.

কাঁটা খুঁজে হাতড়ে ফিরি বায়ু,

উদ্বায়ুতে রক্ত ঝরায় কে?

স্নায়ু, ক্ষিপ্ত এবং অসমর্থ স্নায়ু?

১৩.

সাহসী ও স্বাভাবিক উচ্চারণেই কি

পরকীয় আবেগের দুর্বলতাকে লুকোতে চাও?

না-কি, আমার অক্ষমতার শূন্যতায়ই

তোমার কন্ঠকে নিরাপদে সুউচ্চে পাঠাও

১৪.

আমাকে কি বারবার নত

হয়েই হতে হবে মিলিত?

তোমার সবই, সকল অঙ্গই কি?

তোমার যোনীদ্বারের মতো,

যে সহজে ভেজে না,

মোচন হয় না?

১৫.

দ্বন্দ্বের যে নেই অবসান,

প্রেমেও মেলে তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।

রুদ্ধভাবের চাপে হয়ে একমুখী,

অদ্বান্দ্বিক সে হয় আরো বেশী দুঃখী।

১৬.

পৌর কর্তৃপক্ষের কাছে

আমি অন্তত কৃতজ্ঞ,

প্রিয়ার আচরণের আগুন

নেভাতে তো কলের জলে

অন্তত পাততে পারছি

এই মাথা সদাতপ্ত!

১৭.

যুঝতে যুঝতে শিথিল হলে মুঠি,

প্রাপ্তি তবু কম কি?

বোধই তোমার নিচ্ছে যখন ছুুটি!

হা: হা: ছুটি, আরামদায়ক ছুটি,

মরণশ্যামের জুটি



১৮.

আমার কবিতা

এ-কারণেও দুর্বোধ্য ঠেকবে,

যে দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি তো

আমার পরিস্থিতির নিমর্মতাকে

কল্পনা করতেও ব্যর্থ হবে।

১৯.

(ক)

বাস্তবের প্রতিফলন বলেই যেমন ধর্মকে মানি না,

আমার শত অযোগ্যতার প্রতিক্রিয়া হলেও

মানি না তেমনি তোমার অপ্রণয়কে;

হানি বরং ঘৃণা

(খ)

নেবো কি রাজ্যের তুলনায়-ঢাকা

তোমার লোভকে, অপ্রণয়ের সব ব্যাখ্যাকে?

না, আমার স্বাভাবিক কামনাকে?

২০.

খুব বেশী সুন্দরের, কুৎসিতের কীই থাকে করবার,

পেতে-পেতে আগ্রহ-অনাগ্রহ অন্তহীন,

বিপরীত দুই পথে হয় তাদের একই উপক্রম-

মরবার, মারবার।

২১.

শুধু কুরূপারই চাই মন?

সুরূপার মনোযোগ নিশ্চিত প্রান্তি;

অতএব, মনের মূল্য খুব নেই,

অতিরিক্ত তার চাই ধন।

২২.

অন্তত আবেগাধিক্যজনিত ব্যর্থতায়

তো কবি চিরকাল

দুঃখীরই পাশে রয়ে যায়


২৩.

‘ঈশ্বর’-এর ধারণায়

তো অন্তত নিস্তেজনা-প্রতিক্রিয়ার ফল হয়,

মানুষ না হোক,

তার মস্তিস্ক তো রক্ষা পায়!

২৪.

আপন দেহযন্ত্রকে বুঝেছো তো কি হয়েছে?

সেখানে কি পরিবর্তন

কিংবা উন্নতি কিছু ঘটেছে?

অক্ষম শরীরে জ্ঞানার্জন হয়তো হয়, অনেক,

তা বলে কি তার যন্ত্রণারা যায়, যন্ত্রণার উৎসরা?

২৫.

অক্ষম অন্ধকে যে তাড়াবেই, সে তো জানি।

অথচ তোমার নজর না পেলেই কেবল

হই আমি তখন অন্ধ।

তোমাকে ছাড়া আর কাকে

আমার চক্ষুষ্মানতার যুক্তি বলে মানি?

দীর্ঘ কবিতা : জওয়াহের হোসেন

জওয়াহের হোসেন

কাব্যাশ্রয়ী ও নিশাচরগণ

১.

রাত্রি হাওয়ায় যেতে-যেতে ভাল লাগে ― এ বিস্তৃত তামুক ধোঁয়ায়

কী এক ব্যবস্থাপনাপত্রে একা-একা ঘুরেছি,

অন্ধকার গলিপথ আর মর্মে জেগে থাকা

ব্যর্থ গণিত

কখনো অগ্নিস্মৃত চুম্বনে ভরে থাকে মগ্ন কুসুম, এই কি

তোমার নিভৃত মতিভ্রম ? নাকি অন্ধকারে কেউ-কেউ আমার মত

রাত্রি চেনা নগর থেকে শ্মশানে ফিরেছিল একা ― তবু জানিনি

ওই ক্ষত দাগ ছুঁয়ে আজও আমি করুণার ঝড়ে পিছুৃ নেয়া

পুরোহিত

২.

শীতের অভিসারে তুমিও চিনে রাখ রোদ

তাই প্রকাশ করতে জানো রাতপুরাণ

আমাদের চাষাবাদ সব লুট করে নিয়ে গেল প্রবাসে

তাই পরাভূত সূর্য সমুদ্র আর মেঘলোক

এমন বাসনায় ঘৃনা করেছি শুধু

শরীরে শরীরে।

৩.

তোমার স্মৃতিকে ফের করেছি সাধন ― অমৃত তৃষ্ণায়

সে সত্য এসে আমারে ভাসালো দূরে ―ঘোর মাতালের মত চিরযায়ী

আমি ওই আয়ুষ্কালে আজ রক্তাক্ত, পরাজিত মৌন

আর ওরা দ্বিধায় জড়ানো ভিন্ন-ভিন্ন তাড়নায়

অথচ আমি শুয়ে-শুয়ে দেখি নিদ্রার ভিতরে গুপ্ত গোরস্তান

চারদিকে অবশিষ্ট পোড়া-হাড় আর উষ্ণ অতল মেঘ

নির্জন মিশে আছে বিরহ-বিষাদ

এই কলিকালে কেউ না কেউ আধাশোয়া বরফের ভিতর বিস্তৃত

কেটে-কেটে কমাতে চেয়েছিলাম আয়ু ― কালো-কালো হয়ে উঠে মাটি

আমি তখনও চোখ বন্ধ করে দেখি দ্বৈততায় পৃথিবীর বয়স সত্যিই কমে যাচ্ছে।

৪.

আমার নিদ্রাপাঠ করে যাচ্ছে কুয়াশা-কুয়াশা ভোর

এই নগর যাত্রার পথে মর্মরিত পৌরাণিক দৃশ্য

ভুলে যাওয়া ইলিয়াড ও ওডিসি আরো কতোশত কাহিনীগুলো

বাতাসের সাথে দাবমান

আমার ধীরে-ধীরে অন্ধ হয়ে যাওয়ার ভেতরে ভেসে থাকে মেঘ ―

সেও বিদগ্ধ কাঁপতে-কাঁপতে চুপচাপ দীর্ঘকায়

ভেসে যাচ্ছে অতিশয় গ্রন্থপৃষ্টায়

৫.

নিন্দা মেখেছি গায়ে এ কাঙালে কি পাইবে তোমায়

যদিও চোখে এখনো উম্মাদনা

ধুকে ধুকে নির্মম বেহাগ বিভোর আমি

বুকে কেঁপে কেঁপে ওঠে মরুঝড়

জ্বলে ওঠে গান

প্রশ্ন হাঁকি খরতাপে আজ

আমি শত অপরাধী।

৬.

কোন উজানে যাবে ? বরং ঝাপ দাও―

গহীন জলের প্রপাতে উড়ে উড়ে কতোদূর আর যাবে

উষ্ণ শরীরে ধুয়ে দাও পাস্তরিত আবরণ

সন্ধায় দগ্ধ হয়ে যাওয়া অতীতের জ্বরগ্রস্তচোখ থেকে খোলে ফেলো ধূলিরাত্রি―

আনন্দের জন্য যত বিশুদ্ধ সরোবর গ্রহণ করো

পৃথিবীতে অন্ধকার বলে কিছু নেই, অক্ষয় বলে কিছু নেই।

৭.

দেহের লোমে ও রক্তে ঋণ ― বুকে জ্বলে উঠে আগুন

আর জেগে থাকা নিদ্রার ভিতরে শরীর ধরে লতিয়ে ওঠে আয়ু

আমাদের সমস্ত অনুভূতি কেমন যেন

অচেনা-অচেনা মনে হয়,

তবু তোমাদের ভেজাডানায় কান্না শুনতে পাই।

৮.

মর্মাপ্লুত, বড় অসহায় তাই উর্ধŸমূখী বিনোদিনী

তোমাকে ভেবেই এতো অবিশ্রাম হাড়ের মর্মর আসে

হায় ! অজানিত অভিন্নতা হেতু

দারুণ অবহেলায় ফুটে আছো স্মৃতিরেণুমাখা নৈঃশব্দ্য বাগানে

তবু শরীর দ্বিধা হলুদাভ

কী করে ভুলি যে কালো চিতা অন্ধকারে যেতে-যেতে একাকার

দীর্ঘ কবিতা : মুজিব ইরম

মুজিব ইরম

ঝর্নাবলী ও অন্যান্য

গাছশূন্য পাহাড়কেই মনে ধরে আজ

তার গায়ে যতো সব মেঘ আসে ভেড়াপালক রমণী হয়ে

তাদের কথায় আমি পুলকিত হই ...

তোমাকে বৃক্ষের গল্প শোনাবো বলে সেই ছিপছিপে স্রোত হতে চাই ...

চলো, ওই জলের কাছে রেখে আসি আমাদের বেদনা, যাতনা ...

Ñতুমি কি চিরটাকাল পাতাঝরা উইলো বৃক্ষ হয়ে রবে?

তুমি আছো

যেভাবে রোদেরা আছে মেঘ হয়ে নিঃসঙ্গ টিলায় ...

Ñপাহাড়যাত্রীর দল আমাকে কি সঙ্গে নেবে আজ?

আমি সেই একাকী পথের কাছে মন খুলে ঘাস হয়ে রবো ...

ভালো লাগে এই গাছ

এই ভেড়ার খামার

একটু একটু নিঃসঙ্গ চেরির ডাল

বনমোরগের ডাক

একাকী পূর্ণিমা

ফর্সা তরুণীর মতো পাহাড়িয়া রোদ ...

বলে তারাÑ নুয়ে-নামা শিলাখণ্ড হও ...

কাল যে পাথর জলে ভিজেছিলো, আজ তাকে দেখে আসি উষ্ণ হয়ে আছে

কাল যে গম্ভীর মেঘ ভিড়েছিলো ভিড়ে

আজ তাকে নিজস্ব চাঞ্চল্যে দেখে ঝরা-রোদে রাঙা হয়ে আসি

Ñও উজানিকন্যা, তোমাকে দেখার সাধ ফুটে থাকে পাহাড়চূড়ায়...

আজ এই টিলা থেকে অভিমানে নেমে-আসা

চিকন পানির মাঝে মন ঢেলে ছুটে যাবো সমুদ্র বিহারে ...

তুমি দূরে নও, কাছে আছো

পথের ধারের জলে-আঁটা পাথরের মতো নিরাপদ মনপ্রান্তে আটকে রাখি ...

তুমি ঘাসফুল Ñ শিশির ডেকেছো

Ñএতো নিলুয়া-দৃশ্য কোথায় রাখি? কোথায় বসতে দেই?

গ্রীক তরুণীর চোখে ঘুম দিতে রাত নামে পাহাড়ের গায় ...

মেয়েটির হাতে আইরিশ কফির মগ এগিয়ে দিয়ে জরিপ করি তার শীতল

চোখের রঙÑ তাকে কেনো চেনা চেনা লাগে? কেনো সে এমন করে শীতলতা

চোখ ভরে রাখে?

তুমি ডাক দিলে মধ্যরাত্রি বিছানা গুটায় ...

তুমি গান

তুমি গানের অধিক

যেরূপ ওই মাঠের পাশে শান্ত লেক

মায়া-মায়া লাগে, বন্ধু-বন্ধু লাগে

কফিল ভাই গাইছে মন

আমার নিঃসঙ্গতা কেমন করে ওঠে

Ñতোমাকে কি একবার ডাক দেবো, ঘাসফুল?

তোমার সুরে সকল কিছু রাঙা হলো আজ ...

দূর থেকে তোমাকে জাগিয়ে রাখি

আমার বেদনা যতো ধুয়েমুছে যায় ...

মধ্যরাত ভোর হলে সমস্ত উচ্ছলতা ফেরি করে রৌদ্রমগ্ন হই

Ñতুমি কেনো এতসব ভোর এনে দাও?

পর্বত আরোহী রমণীর পেটের চিকন ভাঁজ হয়ে ভোর নামে পাথুরে জলায় ...

উ™£ান্ত স্রোত নিয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছি দুপুরিয়া ছায়া দলহারা ভেড়া শাবকের মতো ...

পায়ে হাঁটা পথ পড়ে আছে মৃত ঘাস বুকে নিয়ে Ñ সেই রূপ একাকী গান

এই জলমগ্ন বক পাখিটির মতো ...

Ñ তুমি কতো দূরে থাকো ঘাসফুল?

খুঁজতে খুঁজতে একটা জীবন গেলো

ভেবেছি কোথাও আছো

ঘরে এনে বোঝা গেলোÑ নিঃসঙ্গ পাহাড়ে আজো তুমি বনে থাকো ...

যে গেছে পাহাড় কুড়াতে

যে গেছে শিশির ঝরাতে

Ñতাকে তুমি বনতিতিরের পালক দেখাবে?

তোমাকে দেখি না

জপ করি

তোমাকে বাজাই না

নিজেই আমি বাজতে বাজতে গীতের অধিক গীত হয়ে আছি ...

মৃত খামারের পাশে

এতো ঘাস

এতো প্রাণ

Ñ তোমার কেনো রে দুঃখ থাকে মনে?

পাথরের গল্প অনেক হয়েছে

তবু এই আধভেজা পাথরের গায়ে লিখে যাই তোমার বিলাপ ...

যতোদিন এই কান্না আমাকে জাগাবে

তোমার দূরের ধ্বনি ঘুম এনে দেবেÑ

ততোদিন বালির ওপর ভাঙা ডাল হয়ে রবো ...

Ñতুমি কি অবাধ্য রাত্রির গল্প শোনাবে না আজ?

তোমাকে জঙ্গল মাঝে মাথা-উঁচু শিলাখণ্ডের গর্বিত উপস্থিতি ভাবি...

Ñকী হবে আমার

পুনরায় যদি হারিয়ে ফেলি গন্তব্যের সাঁকো?

একবার ছুঁতে গিয়ে হারিয়েছি স্থিতি

Ñতুমি কি পুনর্বার অগ্নিভেজা নদী হতে বলো?

তোমার চুলের মতো ঝর্নার রোদন, রঙ তার কনিআঙুলের মতো ফর্সা ...

তার কাছে ফতুর হয়েছি ... তুমি হাসো সেই পতিত জলের মতো, যার উৎসস্থল দেখা

হয়নি এখনো ... ভেড়াশাবকের মতো মেঘগুলো আলস্য ঝাড়ছে পর্বতচূড়ায় ...

বুঝি না কিসের তুলনা দেবো Ñ ও আমার জৈন্তাপাহাড় থেকে উড়ে-আসা বক,

তুমি কি মন্ত্রগুণে বেভুল করেছো?

এই বনেলা হাওয়া সাক্ষীÑ

সমুদ্রে তোমাকে কাল ভুলিনি কখনো!

তোমাকে অনন্ত বলি

বাসনা জানাই

Ñকাজের মাঝে তোমার হাসি একবার পাঠাবে?

দরোজায় ফেরি করি মন

আজ রাত দীর্ঘতর হোক

তুমি একবার ডাক দিলে

দেখো, কতোবার আমি উচ্চারণ করি নাম ...

তোমার মনের মাঝে যতো গান থাকে, তোমার চোখের মাঝে ঢেউ

সকলি জাগিয়ে দিলেÑ রাত্রি কেনো শেষ হয়ে যায়?

এতো এতা নীল ঘাস ফুটে রয় টিলায় টিলায় ...

হু হু করা বিঁধেছিলো বুকে

তুমি কোথা থেকে ভেসে এলে

আমিও যে কেনো ঝর্নাবাসী হলাম ...

ও পাহাড়িকন্যা, মধ্যরাতে এভাবে হেসো না তো আর

আমার ক্ষতের ভার বহন করতে পারছি না।

তোমাকে জাগিয়ে রাখি

বন্ধু হতে ভয় হয়

তোমার প্রেমিক হবোÑ তুমি কি নেবে না?

ঘোড়াপালক তরুণীর হাতে ওয়াইনের বোতল তুলে দিলে তার চোখে খেলে যায়

ঘোড়াকেশরের ঢেউ, সৌজন্য বিলাপ ...

যতো হাওয়া দেখে আসি বনে

যতো বনময়ূরের নাচ

সকলি তোমার চোখে বান্ধা পড়ে থাকেÑ আমি কি আবার তবে গুহাবাসী হবো?

যদি ভুলে যাই জৈতুনের বন

যদি একবার ইশারা করো

দেখো ফের জেগে উঠি

ফের তোমাকেই দেবী করে ভাসাই সাম্পান ...

Ñতুমি কি বলবে না সেই কুহকী ইঙ্গিত?

দেখো, একটাও বাতি জ্বলেনি কোথাও

তবু ঘরময় ফুটে রয় হলদে ফুলের রঙ ...

ওই গন্ধটাকে কী বলবো

বলবো কি ব্যাখ্যাতীত

যেরূপ আদর পেয়ে বদলে যায় তোমার গাত্রবর্ণ?

তুমি একবার খুলে গেলে

ভাঁজ করে নিতে রাত্রি কেনো এতো ছোট হয়ে যায়?

তুমি কথা বলোÑ

যেন বনেলা মোরগ আলগোছে ঝাড়ে তার দুপুর-আলস্য

এসব কথারা, জানো তুমি, ভেসে আসে অলৌকিক ছায়ারথে ...

সেই যে বেনামী গাছে চড়ে জীবন রাঙিয়েছিলাম

সেই থেকে তার মাঝে জমা রাখি মন

Ñতুমি কি বলবে না সেইসব বিকেল কী রূপে হাঁস হয়ে যায়?

এইসব ঘাসের ওপর শুলে আকাশকে তোমার চোখের মতো দেখায় ...

তোমাকে বলেছি Ñ এ যাত্রা আলোর অধিক ...

যা কিছু হাঁটু ভেঙে পথে পড়েছিলো

আজ তারা তোমার স্পর্শের গুণে দেহাতীত ঢেউ ...

তোমাকে কি সেই হারিয়ে-যাওয়া আধুলির কথা এখনো বলিনি?

বলিনি কি ভেঙে-পড়া পাথরখণ্ডের নাম Ñ আমরা যেখানে একদিন

স্তব্ধ হয়েছিলাম?

Ñআলো কতোদূর, পাখি?

ছেড়ে যাচ্ছি এই পাহাড়-লাবণ্য ...

এ-যাত্রা তোমার দিকে, ও পাহাড়ি মেয়েÑ তুমি কি সেই ঝুলন্ত সেতু, যার পায়ে

উইলো বৃক্ষের ডাল কান্না হয়ে ঝরে? তুমি কি সেই সুউচ্চ পর্বত-চূড়ায় আটকে পড়া

দেউলা পাথর, যার গায়ে মেঘেরা সব রৌদ্র হয়ে নাচে?

আমি তো এসছিলাম এসব ঝর্নার নামে জপ করবো একাকীত্বের দিন ... এসব

নদীর কাছে ধুয়ে দেবো দেহের গেওইর ... তুমি এভাবে ডাক দিলে কি আর

আলো-শিকারি হবো না?

Ñআমি মনবাসী ছিলাম, তুমি কেনো আবার আমায় গৃহবাসী করো?!

একবিংশের প্রথম যুগ : রফিক উল্লাহ খান

রফিক উল্লাহ খান
একবিংশের প্রথম যুগ
শিল্পের স্রোতোধারার আদ্যন্ত অবিচ্ছিন্নতার ইতিহাস বিশ্লেষণ করে নির্দ্ধিধায় বলা যায় : শিল্পের ইতিহাস আসলে কবিতার ইতিহাসÑ তার জন্ম-নবজন্ম-পুনর্জন্মের ইতিহাস। আদিমানবের সৃজনযন্ত্রণার সঙ্গে অনাদি যুগের সৃষ্টিসম্ভাবনার যোগসূত্র কেবল কবিতাই রচনা করতে পারে। আধুনিক বাংলা কবিতার পালাবদলের বিভিন্ন পর্যায়ে সাময়িকপত্র দিগদর্শনের ভূমিকা পালন করেছে। উল্লেখ্য যে, এইসব উদ্যোগে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গোষ্ঠী অপেক্ষা ব্যক্তির অবদানই মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। গোষ্ঠী-উদ্ভূত না হলেও এইসব পত্র-পত্রিকা অনেকসময় শিল্পের আদর্শ ও রীতি-ভিত্তিক গোষ্ঠীতেও পরিণত হয়েছে। কিন্তু স্বতন্ত্র ব্যক্তিসত্তা হিসেবেই একজন কবি বা শিল্পীকে আত্মপ্রকাশ করতে হয়। সমাজায়ত বিচিত্র অনুভূতির প্রকাশ সত্ত্বেও একজন কবির ব্যক্তি-অভিজ্ঞতার শিল্পিত, ব্যক্তিত্বচিহ্নিত প্রকাশই কবিতাকে দীর্ঘজীবী করে।

খোন্দকার আশরাফ হোসেন সম্পাদিত কবিতাপত্র ‘একবিংশ’-এর ২৫ বছরের সৃষ্টিসম্ভার সামনে রেখে এ-কথাগুলোই এসে গেল অনিবার্যভাবে। বিংশ-একবিংশ শতাব্দীর সন্ধিক্ষণ থেকে দেড় দশক পেছনে থেকেও ‘একবিংশ’ নামকরণের মধ্যে যে সদম্ভ আত্মঘোষণা আছে, তা প্রতি মুহূর্তের নবজন্মের সঙ্গে আগামী শতাব্দীর অন্তরঙ্গ যোগসূত্র রচনারই কেবল ইঙ্গিত দেয় না, বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের কবিরা একবিংশ শতাব্দীর উপযোগী কাব্য-ভূমিতলও যে সৃষ্টি করে চলেছে তা-ও সুষ্পষ্ট করে তোলে। আশির দশকের মধ্য পর্যায়ে ১৯৮৫-তে নতুন প্রজন্মের পত্রিকা ‘একবিংশ’-এর আত্মপ্রকাশ ঘটে। ফেব্র“য়ারী ২০০৯ -তে প্রকাশিত হয়েছে পত্রিকাটির ২৪ তম সংখ্যা। বিগত আড়াই দশকের বাঙালি তরুণ কবিদের আবেগজীবন ও মননঋদ্ধ শিল্পচর্যার নিগূঢ় ইতিহাস এই সংখ্যাগুলো থেকে অনুধাবন করা সম্ভব। তবে এই প্রবন্ধে আমি শুধু একবিংশ-র প্রথম ১২ বছরে প্রকাশিত সংখ্যাগুলো নিয়ে সামান্য আলোচনা করব।

‘একবিংশ’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যার সম্পাদকীয়-তে এর দৃষ্টিভঙ্গি ও আদর্শের প্রতিফলন ঘটেছে। একবিংশ শতকের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে, ‘নতুন শতাব্দী, নতুন সময় এবং নতুন অভিজ্ঞতার বোধন’-কে সামনে রেখে, বাংলা কবিতার ‘প্রখর দুঃসময়’ পীড়িত সময়খণ্ডের অনুভব থেকে সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছেÑ

‘একবিংশ’ কেবল নতুন প্রজন্মের কবি-লেখকদের জন্য নির্দিষ্ট। যারা অপ্রতিষ্ঠিত, যৌবনাবেগে টলমল, প্রতিভাবান, উদার অভিনিবিষ্ট, শ্রমী এবং নির্ভয়, আমরা তাদের জন্য পাটাতন নির্মাণ করতে চাই। কবিতা, শুধু কবিতা এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ক প্রবন্ধ, কবিতালোচনা, কাব্যগ্রন্থ ও কাব্য বিষয়কগ্রন্থ সমালোচনা প্রতি সংখ্যা একবিংশ-র সূচীতে থাকবে।

এক নতুন প্রজন্ম তৈরির সদম্ভ আত্মঘোষণা যে কেবল বাগাড়ম্বর নয়, পত্রিকার প্রথম সংখ্যা থেকেই তার পরিচয় পাওয়া যায়। এ-প্রসঙ্গে প্রথম সংখ্যার সূচী বিশ্লেষণ করে দেখা যেতে পারে। এ-সংখ্যায় তিনটি প্রবন্ধ অন্তর্ভুক্ত হয়। যেমন- ১. ‘শিল্পের প্রকাশ ও তার ভাষা, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম; ২. ‘ভিন্ন শিল্পের প্রয়োগসূত্রে কবিতা’ সাজ্জাদ শরীফ; ৩. ‘দুই বিঘা জমি’ঃ ঈদিপাস গূঢ়ৈষা ও অন্যান্য অনুষঙ্গ,’ সৈয়দ তারিক। প্রবন্ধগুলোর নামকরণের মধ্যেই এর নান্দনিক অভিরুচি ও বক্তব্যের অভিনবত্বের স্বাক্ষর সুষ্পষ্ট। খোন্দকার আশরাফ হোসেন, ইকবাল আজিজ ও রেজাউদ্দিন স্টালিনের দীর্ঘ কবিতা এবং মোহাম্মদ সাদিক, তুষার দাশ, রানু ইসলাম, ফখরে আলম, শান্তনু চৌধুরী, দাউদ আল হাফিজ, মোহাম্মদ কামাল, ফরিদ কবির, বদরুল হায়দার প্রমুখের কবিতায় যে সংরক্ত জীবনাবেগ অভিব্যক্ত হয়েছে, তা নিঃসন্দেহে সমকালস্পর্শী। ‘এই প্রজন্মের চোখ’- এ শামসুর রাহমানের ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতার নির্মোহ আলোচনার মধ্যেও কবিতাবিচারের একটি নতুন অভিনিবেশ প্রযুক্ত হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, ‘একবিংশ’ পত্রিকা যাত্রালগ্নেই তার প্রতিশ্র“তি বাস্তবায়নে অনেকাংশে সমর্থ হয়েছে।

দ্বিতীয় সংখ্যা থেকেই ‘একবিংশ’ কবিতার বিচিত্র উৎসে পরিভ্রমণ করেছে। বাংলাদেশে কবিখ্যাতি ও কাব্যসমালোচনার ক্ষেত্রে একটা দৈন্য বিভাগোত্তর কাল থেকে লক্ষ করা যায়। দু-একটি ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক কাব্যচেতনাপ্রবাহকে জাতীয় চেতনাশৃঙ্খলায় বিন্যস্ত করার ক্ষেত্রে যে অধ্যয়ন, মনোনিবেশ ও সর্ববন্ধনমুক্ত জীবনাবেগের প্রয়োজন সমাজ ও রাষ্ট্রের জাতিসত্তার মৌল চেতনাবিরোধী অবস্থানের ফলে তা বার বার বাধাগ্রস্ত হয়েছে। সীমাহীন সৃজনীসম্ভাবনা নিয়ে যে-সকল কবি বিভিন্ন দশকে যাত্রা শুরু করেছেন, খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠার মোহে তাঁদের অধিকাংশকেই আত্মবিক্রয় করতে হয়েছেÑ কখনো রাষ্ট্রের কাছে, কখনো মৌলবাদের কাছে। ফলে, আমাদের কবিতাও একধরনের আবেগহীন শব্দাভ্যাসে পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্র কিংবা মৌলবাদ যাঁদের গ্রহণ করেনি, তাদের আশ্রয় জুটেছে কখনো দৈনিক পত্রিকার বিশেষসংখ্যায়, কখনো বাংলা একাডেমীর বটতলায়, কখনো মা-লক্ষ্মীর প্রসাদগুণে বিদেশী সাহায্য সংস্থার পদ্যসম্মেলনে। ‘আবেগহীন শব্দাভ্যাস’ এ-কারণে বলছি যে, বাংলা কবিতার মান এখন এমন পর্যায়ে পৌছে গেছে, যে-কোনো স্বশিক্ষিত ব্যক্তির পক্ষেও জীবনানন্দীয় শব্দবিন্যাসÑকৌশল আয়ত্ত করা সম্ভব। ‘একবিংশ’ পত্রিকা আগামী শতাব্দীর জন্য যে কাব্যভূমিতল নির্মাণ করতে চায়, তার পেছনের ইতিহাসের অনুধাবন অত্যন্ত প্রয়োজনীয় মনে করেছেন সম্পাদক। আন্তর্দেশীয় শিল্পচেতনার আন্তঃক্রিয়া আমাদের কবিতাকে যে ঋদ্ধ করতে পারে, মাইকেল মধুসূদনের কাল থেকেই তা আমাদের জানা। দ্বিতীয় সংখ্যায় কবিতা ও শিল্প বিচারের একাধিক নতুন বিভাগ পরিকল্পিত হয়েছে। ‘বিদেশ বৈভব’ অংশে লোরকা, হাইনরিশ হাইনে, গাব্রিয়ালা মিসত্রাল প্রমুখের কবিতার অনুবাদ স্থান পেয়েছে। এবং যুক্ত হয়েছে ‘অনঘ এন্টেনা’ নামে পশ্চিম বাংলার তরুণ কবিদের কবিতার বিচিত্ররূপ উপস্থাপনা। পশ্চিম বাংলার নতুন প্রজন্মের কবিতার আলোচনা, ব্যক্তিকবির গুচ্ছ উচ্চারণ এবং সা¤প্রতিক বিশ্বকবিতার অভিনিবেশী পাঠকের সংখ্যা যে পূর্বের তুলনায় বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে পত্রিকার বিশ্বজনীন অভিজ্ঞতার অঙ্গীকার তিরিশি আধুনিকতার পর অনেকান্তচারী অন্যতর সম্ভাবনার পথ খুলে দিয়েছে। সে-পথ হয়তো বা উত্তরাধুনিকতার পথ, নয়তোবা কালধর্মের প্রয়োজন-উদ্ভূত সমাজতত্ত্ব, ইতিহাস ও রাজনীতির অনুশীলনকেও ‘একবিংশ’ অনিবার্য মনে করেছে। আধুনিকতা-উত্তর ইউরোপে বিজ্ঞান ও দর্শন যেখানে এক কেন্দ্রে এসে মিলিত হয়েছেÑ ঐতিহাসিকতা ও রাজনৈতিকতা হয়ে উঠেছে সাহিত্যের স্বরূপ নিরূপনের অন্যতম মাপকাঠিÑ সেখানে আমাদের কবিতা ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রশ্নে সংগ্রাম করেছে দুই দশকেরও অধিককাল ধরে। সত্যÑ ইতিহাসের প্রশ্নে রাষ্ট্র ও জনতার প্রতিদ্বন্দ্বী অবস্থান আমাদের শিল্পচর্চার ওপরও প্রভাব বিস্তার করেছে। প্রগতি ও প্রতিক্রিয়ার দ্বৈরথ অগ্রজ কবিদের চৈতন্যের খণ্ডিত, বিকৃত যে স্বরূপ উন্মোচন করেছে, তাতে প্রথানুরাগী কবিদের বিভ্রান্ত হবারই কথা। ‘একবিংশ’ সেই বিভ্রম-আশঙ্কার গহ্বর থেকে নতুন প্রজন্মের সৃজনক্ষমতাকে মুক্তচিন্তার খোলা হাওয়ায় আত্মপ্রকাশের সুযোগ করে দিয়েছে। এভাবেই ‘একবিংশ’র কবিগোষ্ঠী সমাজসত্তা ও সময়স্বভাবের শিল্পিত প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে। ‘গোষ্ঠী’ শব্দের সঙ্গে চেতনার যৌথায়ন শিল্পবিবেচনার ক্ষেত্রে বহুলাংশে প্রাসঙ্গিক কিন্তু ‘একবিংশ’ কোনো বিশেষ কবিগোষ্ঠী সৃষ্টির পরিকল্পনা নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেনি। কবির ব্যক্তিসত্তা, ব্যক্তি-অনুভূতি, মনন ও আবেগের প্রেম ও অপ্রেমের দ্রোহ ও ঘৃণার প্রকাশপ্রক্রিয়ায় অধিকাংশ কবিই স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত, ব্যক্তিত্বচিহ্নিত। বিচিত্র তত্ত্ব, জ্ঞান ও নন্দনচিন্তার আন্তরশৃঙ্খলার অঙ্গীকার তাঁদেরকে যেমন করেছে বৈচিত্রসন্ধানী, তেমনি, ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিত্বে পরিণতি লাভের ঐকান্তিকতায় অভিনিবেশী। পত্রিকার ফেব্র“য়ারী ১৯৯০ সংখ্যাটি বিশ্লেষণ করলে এ-সত্যের পরিচয় পাওয়া যেতে পারে। এ-সংখ্যায় সংযোজিত ‘অনিরুদ্ধ আশি ঃ এক দশকের কবিতা’ শীর্ষক ক্রোড়পত্রে নবীন প্রজন্মের তেইশ জন কবির নির্বাচিত কবিতা সংকলিত হয়েছে। আমার কবিতাপাঠের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এই তেইশ জন ছাড়াও এ-সময়ে চেতনার নবত্ব এবং রূপায়ণের স্বকীয় ব্যাকরণ নিয়ে বেশ কয়েকজন কবি আবির্ভুত হয়েছেন। তেইশ জন কবি সম্পর্কে চুড়ান্ত মূল্যায়নের সময় হয়তো এখনো আসেনি, অনেকেরই স্বকণ্ঠ যে দৃঢ় ভিত্তিমূল স্পর্শ করেছে, তা নিঃসংশয়ে বলা যায়। খোন্দকার আশরাফ হোসেন, রেজাউদ্দিন স্টালিন, কাজল শাহনেওয়াজ, সাজ্জাদ শরিফ, শান্তনু চৌধুরী এবং সৈয়দ তারিকের কবিতায় জীবনানুভবের স্ব-ক্ষেত্র নির্মাণের অনুরণন সুষ্পষ্ট। ষাটের দশকের কবিদের অনেকের সমবয়সী, অথচ আশির দশকের কাব্যযাত্রায় অংশগ্রহণ আশরাফ হোসেনের ক্ষেত্রে বয়স ও চেতনার সংকটময় দ্বৈরথ সৃষ্টি করতে পারতো। কিন্তু জাতিসত্তার মৌল ভূমিতলে পা রেখে এই কবি এক নিঃশিকড়, বিশুদ্ধ, অনুর্বর সময়খণ্ডে স্বপ্ন ও প্রত্যাশার পলিস্তর জমা করেছেন কবিতাশরীরে। মিথ ও ঐতিহ্যের সংবেদনশীল অনুভাবনার সঙ্গে তিনি যোগ করেছেন অধীতি ও শিল্প অভিজ্ঞতার বিচিত্র প্রান্ত।

আশির দশকের পরও ‘একবিংশ’ নব্বই-এর দশকের অর্ধেক কাল অতিক্রম করেছে। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নতুন কবির সমান্তরালে কবিতা বিশ্লেষণের ক্ষেত্রেও নতুন নতুন মাত্রাপ্রযুক্তির সন্ধানে মনোযোগী হয়েছেন কবি-সমালোচকরা। সৃজন-মননের যৌথায়নে আধুনিকতা-উত্তর নন্দনচিন্তার যে নতুন দিগন্তরেখা দেখা দিয়েছে ‘একবিংশ’ পত্রিকার পনোরোটি সংখ্যায় তার বিচিত্ররূপ প্রকাশ আমরা লক্ষ করবো। কেবল কবিতাকে নয়, কাব্য বিশ্লেষণকেও এঁরা গূঢ়ভাষিতা, বহু অর্থব্যাপকতা ও মানসিক জ্ঞানের বিবিধ উৎসের ব্যবহারে সমৃদ্ধ করতে সচেষ্ট হয়েছেন। এবং সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভারতীয় বাংলার মনন ও সৃজনাবেগের উপস্থাপনা। বাঙালি সংস্কৃতির হাজার বছরের স্রোতোধারার খণ্ডায়ন এখন ঐতিহাসিক ও রাষ্ট্রীয় ভাবে স্বীকৃত। আর্থ-উৎপাদনকাঠামোগত ভিন্নতা সত্ত্বেও ভাষিক ও সাংস্কৃতিক ঐক্য দুই বাংলার কবিতার সহযাত্রার গতি-প্রকৃতির সংযোজন ‘একবিংশ’ পত্রিকার অন্যতর বৈশিষ্ট্য। আধুনিক বাংলা কবিতার উদ্ভব অভিন্ন ভাবকেন্দ্র থেকে সূচিত হলেও প্রায় অর্ধ-শতাব্দীর রাষ্ট্রিক ভিন্নতায় বাঙালির সৃজন-মনন এখন দুই স্বতন্ত্র ধারায় বিদ্যমান। কিন্তু আধুনিকতা-উত্তর শিল্পের বিশ্বজনীন সম্পর্কায়নের চেতনা এই রাষ্ট্রিক দূরত্বকে অবলীলায় অতিক্রম করতে সক্ষম। সম্পাদক খোন্দকার আশরাফ হোসেন পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যা থেকেই ‘অনঘ এন্টেনার’র মাধ্যমে নবপ্রজন্মের পশ্চিম বাংলার কবিতা এবং কবিতা সংক্রান্ত অনুভবগুচ্ছকে বাংলাদেশের কাব্যপ্রেমীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেন। ফলে সংস্কৃতির বিশ্বজনীন আন্তঃসম্পর্কের এই যুগে আমাদের শিল্প-অভিজ্ঞতার ক্ষেত্র সুপ্রশস্ত হওয়ার সুযোগ পায়। ‘একবিংশ’-এর দশম সংখ্যায় (সেপ্টেম্বর, ১৯৯২) কবিচৈতন্যের বিশ্বায়নের প্রচেষ্টা সুষ্পষ্ট হয়ে উঠেছে। শিল্পসমালোচক তপাধীর ভট্টাচার্যের ‘তরুণ রচনার অগ্নি’ এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয়বাহী। সামসময়িককালের দুই বাংলার কবিতার মূল্যায়ন সূত্রে ‘দেশকাল পরিধি ও প্রবহমান সাংস্কৃতিক আবহে’র পটভূমিতে কবিতার শেকড় সঞ্চালনের বহুমুখী স্বভাবধর্মকে তিনি উন্মোচন করেনÑ

সাংস্কৃতিক উপনিবেশবাদ ও এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার বিরুদ্ধে উত্তর-আধুনিক জীবনদর্শনই হতে পারে সবচেয়ে জোরালো প্রতিবাদ। এই উপলব্ধি ধীরে ধীরে শক্তি সঞ্চয় করছে বাংলাভাষা ব্যবহারকারী কবিদের মধ্যেÑ যেমন ভারতের পশ্চিমবঙ্গে, আসামে, ত্রিপুরায়, তেমনি বাংলাদেশে। যাত্রী সবাই একই তরণীর। বাংলা কবিতায় এই হলো আজকের পরিপ্রেক্ষিত। স্পষ্টতই যাতে ব্যক্তিসত্তা ও সামাজিক সংবেদনার দ্বান্দ্বিক এবং বহমান সময় ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার আবর্তন বিচিত্র প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নানাধরনের মুল্যমান তৈরী করে চলেছে।

এই সম্ভাবনাকে সামনে রেখেই পত্রিকার পঞ্চম সংখ্যায় সৈয়দ তারিক ‘শিল্পতত্ত্বের আধুনিকতার সমস্যা’ ও তার সমাধানের সূত্র নির্দেশ করেছিলেনÑ ‘প্রাক্তন শৈল্পিক সংবেদন আর নতুন শিল্পধারা সৃষ্টি করতে পারছে না। সুতরাং শিল্পের স্বার্থে নতুন সংবেদশীলতার অন্বেষণ অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। এবং নতুন সংবেদনশীলতার জন্ম দিতে পারে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি। এই দৃষ্টিভঙ্গি নিঃসন্দেহে উত্তরাধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি।’ কবিতার শরীরে আদৌ উত্তরাধুনিকতার লেবেল এঁটে দেওয়া যায় কিনা, তা বিবেচনাসাপেক্ষ। কিন্তু কবিতা মূল্যায়নের ক্ষেত্রে যে এই দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগযোগ্য, বিগত দুই যুগের শিল্প-অভিজ্ঞতা থেকে তা নিঃসংশয়ে বলা যায়। বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের কবিদের কবিদের বহুচারী মন ও মনন উত্তরাধুনিক জীবনধারণ ও শিল্পজ্ঞানকে কবিতার অবয়বে কতোটা সাফল্যের সঙ্গে রূপায়িত করতে পেরেছেন, সময় তার বিচার করবে। ‘একবিংশ’ শীমাস হীনির ইন্দ্রিয় দিয়ে যখন সিলভিয়া প্লাথের অক্লান্ত শব্দক্ষুরধ্বনি শোনে, কিংবা নাজিম হিকমত, ওক্তাবিয়ো পাস এবং এমিলি ডিকিনসনের কাব্যলোককে বাংলা কবিতার শব্দশরীরে স্থাপন করে, তখন দৃষ্টিভঙ্গির অনিবার্য পরিবর্তন-প্রক্রিয়ার মধ্যেও বিশ্বশিল্পের উত্তরাধিকার গ্রহণের প্রশ্নে পত্রিকার নিঃসংশয় মনোভাব অগোচর থাকে না।

‘একবিংশ’ পত্রিকার ১৩, ১৪ ও ১৫ সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি বৈচিত্র্যপ্রবণ ও সমৃদ্ধ। টেরি ঈগলটনের অনুদিত প্রবন্ধ ‘সাহিত্য কী?, অঞ্জন সেনের ‘কবিতার ভাষা’, আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহর ‘দরোজা খেলার স্থাপত্য’, সালাহউদ্দীন আইউবের ‘পশ্চিমের পোস্টমডার্নিজম ও পশ্চিমবঙ্গের উত্তর আধুনিকতা’ ১৩শ সংখ্যার সমৃদ্ধ মননবৃত্তের পরিচয়বাহী। ১৪তম সংখ্যায় বিন্যস্ত রচনাসমূহের মধ্যে খোন্দকার আশরাফ হোসেনের ‘কবিতায় শহর’, সফিউল আজম মঞ্জুর ‘দুই ভিন্ন শিল্পের সাধনসূত্র : স্থাপত্য ও কবিতা’, সাজিদুল হকের ‘ইউরোপীয় সাংস্কৃতিক কাঠামোয় আধুনিকতা ও আমাদের চিন্তার মেরুদণ্ডহীনতা’ মননঋদ্ধ ও চিন্তা-সৃষ্টিকারী প্রবন্ধ। খোন্দকার আশরাফ হোসেনের ‘নির্বাচিত কবিতা’ বিষয়ে গ্রন্থালোচনা বিভাগে তুষার গায়েনের পূর্ণাঙ্গ প্রবন্ধ ‘স্বদেশের মর্ম থেকে উঠে-আসা কবি’ একটি উল্লেখযোগ্য রচনা। ফকরুল আলমের ‘এডওয়ার্ড সাইদ ও উত্তর ঔপনিবেশিক কাউন্টার ডিসকোর্স’ খোন্দকার আশরাফ হোসেনের ‘রোমান্টিক কবিতার স্বরূপ’ এবং শেমাস হীনির কবিতা’, আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহর ‘চেতনার ক্ষুরধ্বনি অথবা পথে-পাওয়া আলো’ নামক প্রবন্ধসমূহ ছাড়াও কবিতার জন্য নির্ধারিত হয়েছে বিভিন্ন বর্গ। কবিতা সপ্তপর্ণার কবিরা হলেন টোকন ঠাকুর, হাফিজ রশিদ খান, আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ, খলিল মজিদ এবং মিহির মুসাকী। গুচ্ছ কবিতার কবিরা হলেন: শামসুল আরেফিন, শশী হক, তুষার গায়েন, সুহিতা সুলতানা, কামরুল হাসান, পাঁশু প্রাপণ, সৌভিক রেজা, মুজিব মেহদী, সরকার মাসুদ এবং খোন্দকার আশরাফ হোসেন। ‘সনেট-সাইকেল”- এর অনুপম ‘বর্ষালী চতুর্দশী’ রচনা করেছেন বায়তুল্লাহ কাদেরী। এছাড়াও স্মরণ পর্যায়ে রয়েছে জন কীটস, সের্গেই ইয়েসেনিন, স্টিফেন স্পেণ্ডার এবং শক্তি চট্টোপাধ্যায়। ‘কবিতাবিশ্বে’ মাহবুব মাসুম ‘স্বীকারোক্তি মূলক কবিতার সাহসী সর্বনাম’ এর পথ ধরে সিলভিয়া প্লাথের শিল্পর্ভূখণ্ডে বিচরণ করেছেন। কল্পনা ও পরিকল্পনার মৌলিকত্বের সঙ্গে শ্রম ও শৃঙ্খলার সহযোগ ছাড়া এরূপ পত্রিকা বের করা অসম্ভব।

একটি দশককে ঘিরে ‘একবিংশ’ পত্রিকায় যে-সকল লেখক আবির্ভুত হয়েছে, সৃজন- মননের যৌথ রাগে তাঁরা যে শিল্প-ভূখণ্ড রচনা করেছেন, তা যে প্রত্যাশা-জাগানিয়া, এ-সত্য নিঃসংশয়ে উচ্চারণ করা যায়। ‘একবিংশ’ দীর্ঘজীবী হোকÑ এ আমাদের আন্তরিক প্রত্যাশা। সম্পাদকের কথার প্রতিধ্বনি করে আমরাও বলতে পারিÑ ‘চলতেই হবে সামনে। যতই দুর্বহ হোক বোঝা সিসিফাসের।’

আমাদের একবিংশ : অঞ্জন সেন

অঞ্জন সেন
আমাদের একবিংশ

একবিংশ পত্রিকার সঙ্গে আমার সম্পর্ক দু’দশকেরও বেশি। একবিংশ-র আশি দশকের সংখ্যাগুলি বাংলাদেশের তরুণ কবিদের কবিতার জন্য আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ঐ সময়ই প্রকাশিত হয় ‘অনিরুদ্ধ আশি’ কবিতা সংকলন। সংকলনটির পাঠ-প্রতিক্রিয়া জানিয়ে একবিংশ সম্পাদককে চিঠি লিখি তা ‘গৃহে ফেরে ভ্রামণিক চোখ’ নামে প্রকাশিত হয় এবং বর্দ্ধিত আকারে কলকাতার ‘রক্তকরবী’ পত্রিকায় কিছুদিন পর প্রকাশিত হয়। এরপর থেকে নিয়মিত যোগাযোগ। চিন্তার সাদৃশ্য থাকায় উত্তর আধুনিকতা বিষয়ে নিবন্ধ পাঠাই, তাও প্রকাশিত হয়। পশ্চিমের পোস্টমজার্নিজম এর চিন্তায় এ উপমহাদেশ প্লাবিত হওয়ার আগেই আমরা কয়েকজন দেশীয় উৎসের চিন্তাভাবনা থেকে লেখালেখি শুরু করি। ঔপনিবেশিক ও ইউরোকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনা থেকে সরে আসার জন্য। পশ্চিমবঙ্গে প্রবল বিরোধিতা হয়, কিন্তু সমর্থনও পাই। বাংলাদেশের একবিংশ পত্রিকা আমাদের উপেক্ষা করেনি, আগ্রহের সঙ্গে নিবন্ধগুলি ছেপেছিল। এরপর ‘প্রান্ত’ ও ‘লিরিক’ পত্রিকাতে উত্তর আধুনিক কবিতা বিষয়ে প্রবন্ধ ছাপা হতে থাকে। সমর্থন পাই এ কারণে যে, ঔপনিবেশিক সাহিত্যচিন্তা থেকে মুক্তির কথা বাংলাদেশের কিছু বন্ধুও ভেবেছিলেন। ঢাকাতে যাই ১৯৯৩ মে মাসে, ‘কবিতার ভাষা বিষয়ে বাঙালির চিন্তা’ বিষয়ে বক্তব্য রাখতে, যে বক্তব্যের একটি সংক্ষিপ্ত বয়ানও একবিংশে ছাপা হয়েছিল। ইতোমধ্যে একবিংশকে নিজের পত্রিকা ভাবতে শুরু করেছি। খোন্দকার আশরাফ হোসেনের সঙ্গে নিয়মিত পত্র-বিনিময় হয়, একবার আমার কবিতাও ছাপা হয়েছিল। এর মধ্যে একবিংশ পত্রিকায় উত্তর আধুনিকতা বিষয়ে কিছু বিতর্কও প্রকাশিত হয়Ñ তাতে পশ্চিমের দৃষ্টিকোণ থেকে উত্তর আধুনিকতা বিরোধী ভাষ্য সম্পর্কে আমরা অবগত হই। অন্যদিকে চট্টগ্রামের ‘লিরিক’ পত্রিকাও এ বিষয়ে ৫টি সংখ্যা প্রকাশ করেছে। তবে কোথাও কোথাও উত্তর আধুনিকতা পশ্চিমবঙ্গের চিন্তা বা ভারতের চিন্তা বলে দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা দেখা যায়। উত্তর আধুনিকতা আসলে এ উপমহাদেশের ঔপনিবেশিকতা ও ইউরোকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনার বিরোধিতা। এ উপমহাদেশের অনেকগুলি ভাষার সাহিত্যে এ চিন্তা প্রতিফলিত।

কবি অমিয় চক্রবর্তীর জন্মশতবর্ষে ২০০১-এ একবিংশের কাছে একটি বিশেষ সংখ্যার প্রস্তাব রাখি। সে প্রস্তাব সাদরে গৃহীত হয় এবং সুন্দর একটি অমিয় চক্রবর্তী বিষয়ক ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে একবিংশ। সে সময় পশ্চিমবঙ্গে এ বিষয়ে উদ্যোগ দেখা যায়নি। আমার একটি নিবন্ধ ও কবি অমিয় চক্রবর্তীর আমাকে লেখা ২২টি চিঠি ঐ সংকলনে প্রকাশিতহয়। আমি তখন গুজরাটের সুরাটের প্রবাসী।


একবিংশ এর আগে ‘নজরুল-জীবনানন্দ সংখ্যা’ প্রকাশ করেছে; সে সংখ্যাতেও লেখার সুযোগ হয়েছিল। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ওপর একটি ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হয় যাতে লিখতেনা পারলেও সাহায্য করতে পেরেছি। এভাবে একবিংশ-র সাথে আমার যোগাযোগ ও বন্ধুত্ব দৃঢ় হয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গের লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরী ও গবেষণাকেন্দ্রে একবিংশ-কে পুরস্কৃত ও সম্মানিত করে। সে সময়ে আমি প্রবাসী। গাঙ্গেয় পত্রের ৩০ বছর উপলক্ষে কলকাতার একটি আলোচনা চক্র আয়োজিত হয় ‘শ্রীচরণেষু’ পত্রিকার উদ্যেগে ২০০৪ আগস্টে। একবিংশ সম্পাদক সে আলোচনাচক্রে মনোজ্ঞ ভাষণ রাখেন। ঐ আলোচনা চক্রে ছিলেন তপোধীর ভট্টচার্য, সুমিতা চক্রবর্তী, অমিয় দেব, মনসুর মুসা, দিলীপ কুমার বসু, দিলীপ বন্দোপাধ্যায়, বীরেন্দ্র চক্রবর্তী প্রমুখেরা। খোন্দকারের মনোজ্ঞ ভাষণটির একটি পাঠ আমার সম্পাদিত গাঙ্গেয় পত্রে, আরেকটি পাঠ একবিংশে প্রকাশিত হয়।

আমার কবিতা বিষয়ে বাংলাদেশের প্রথম নিবন্ধটিও একবিংশে প্রকাশিত হয়। এরপর ‘উত্তর আধুনিক চাতালে, বিশেষ সংখ্যা আমার আনাড়ি হাতে অঙ্কিত একটি চিত্র প্রচ্ছদে ছাপা হয়। কোনো পত্রিকার প্রচ্ছদে এটিই আমার প্রথম মুদ্রিত চিত্র। ঐ সংখ্যাতেই আমার লেখালেখি বিষয়ে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। এ জন্য আমি গর্ববোধ করি।

একবিংশ পত্রিকা বিভিন্ন সংখ্যায় বহু গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ ও কবিতা প্রকাশ করে আমাদের কৃতজ্ঞতাভাজন। উন্নত মানের প্রবন্ধ ও কবিতা ছাপিয়ে পত্রিকাটি বাংলাভাষায় বিশেষ ভূমিকা নিয়েছে। এ পত্রিকার সাথে জড়িয়ে থেকে আমিও গৌরবান্বিত। পত্রিকার সম্পাদক খোন্দকার আশরাফ হোসেনের ষাটবছর পূর্তি হল, তাঁর বিপুল সাহিত্যকর্মময় জীবন এবং সৃজনকর্মের জন্য তাঁকে অভিনন্দন জানাই।

একবিংশ : পঁচিশ বছরের দায় ও কৃতি : কামরুল ইসলাম

কামরুল ইসলাম
একবিংশ : পঁচিশ বছরের দায় ও কৃতি

লিটল ম্যগাজিনকে অনেকেই ছোট কাগজ বলে থাকেন। ‘ছোট কাগজ’ লিটল ম্যাগাজিনকে ধারণ করে কিনা জানি না, তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে লিটল ম্যাগাজিনকে ছোট কাগজ বলতে অনাগ্রহী। লিটল ম্যাগাজিন একটি বিশেষ ধাঁচের সাহিত্য পত্রিকা, যার বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্যও রয়েছে। সেসব বিষয়ে আলোচনায় না গিয়ে শুধু এটুকু বলা যায় যে, লিটল ম্যাগাজিন পরিবর্তনের, পালাবদলের,নতুনত্বের অঙ্গীকারে ঋদ্ধ। লিটল ম্যাগাজিন হিসেবে খোন্দকার আশরাফ হোসেন সম্পাদিত একবিংশ পঁচিশ বছর অতিক্রান্ত করেছে। একটি লিটল ম্যাগাজিন-এর পঁচিশ বছর পূর্তি একটি বিস্ময়কর ব্যাপারই বটে, যখন কাগজ কিংবা ছাপা-খরচের কথা আমাদের ভাবতে হয়। লিটল ম্যাগের সাথে অকাল মৃত্যুর একটি সম্পর্ক রয়েছে। আবার অনেক লিটল ম্যাগ অনেককাল টিকেও থাকে। অনেক পত্রিকাই ঢাক-ঢোল পিটিয়ে যাত্রা শুরু করে অকালেই ঝরে পড়ে। এই ঝরে পড়ার মধ্যে কোনো গ্লানি আছে বলেও আমার মনে হয় না। একটি/দুটি সংখ্যাও যদি শিল্প-সাহিত্যের কোনো এক ক্ষেত্রে একটু ঝাঁকি দিয়ে নিভে যায়, তাহলেও তার সেইটুকু প্রাপ্তিকে খাটো করে দেখার কোনো অবকাশই নেই। একথা বলাই বাহুল্য যে, সব পত্রিকাই প্রকৃত সাহিত্য পত্রিকা হয়ে ওঠে না। শিল্প-সাহিত্যের মতোই সাহিত্য পত্রিকা বা লিটল ম্যাগকে আমরা দুই ভাগে ভাগ করতে পারি। সৃষ্টিশীল সাহিত্য পত্রিকার একটি দায়বদ্ধতা থাকে। কিন্তু বাজারী সাহিত্য পত্রিকার তা থাকে না। এখানে বলে নেওয়া ভালো যে, সব সাহিত্য পত্রিকাকে লিটল ম্যাগ বলা যাবে না, সব লিটল ম্যাগকে সাহিত্য পত্রিকা বলা যাবে। লিটল ম্যাগের চরিত্র সাধারণ সাহিত্য পত্রিকার মতো নয় । এ নিয়েও রয়েছে নানা বিতর্ক। প্রতিষ্ঠান কিংবা প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার নানা কথা রয়েছে । সে-বিষয়ে না গিয়ে আজকে লিটল ম্যাগ হিসেবে একবিংশ-র দায় ও কৃতির কিছু চিত্র তুলে ধরতে চাই।

বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকা বাংলা কবিতার পালাবদলে যে ভূমিকা রেখেছিল তাকে ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখতে হবে আমাদের। বিস্ময়করভাবেই পত্রিকাটি অনেককাল টিকে ছিল এবং বাংলা কবিতার আধুনিকায়নে এর ভূমিকা ছিল অনন্য, তিরিশের প্রধান কবিরা চিহ্নিত ও বিকশিত হয়েছে এই পত্রিকার মাধ্যমে। তবে কোনো পত্রিকার টিকে থাকার ব্যাপারে পেছনের মানুষটির ভূমিকা ও যোগ্যতা বিশেষভাবে কাজ করে। শুধু কবিতা নিয়ে, আধুনিক কবিতা নিয়ে বুদ্ধদেব বসুর ভাবনা ও শ্রম, তার অভিভাবকত্ব কিংবা শিক্ষকতা আমাদের কাছে তাকে বিশেষ মর্যাদায় উন্নীত করেছে। বাংলা আধুনিক কবিতার বিকাশে ‘কবিতা’ পত্রিকাটি ছিল তার সকল স্বপ্নের উৎস। এবিষয়ে ‘সাহিত্যপত্র’ প্রবন্ধে তিনি বলেছেন : “সাহিত্যের অন্যান্য অঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন করে শুধুমাত্র কবিতার উপর এই জোর দেবার প্রয়োজন ছিলো, নয়তো সেই উঁচু জায়গাটি পাওয়া যেত না, সেখান থেকে উপেক্ষিতা কাব্যকলা লোকচক্ষের গোচর হতে পারে। ‘কবিতা’ যখন যাত্রা করেছিলো, সেই সময়কার সঙ্গে আজকের দিনের তুলনা করলে, একথা মানতেই হয় যে, কবিতা নামক একটি পদার্থের অস্তিত্বের বিষয়ে পাঠকসমাজ অনেক বেশি সচেতন হয়েছেন, সম্পাদকরাও একটু বেশি অবহিতÑ এমনকি সে এতদূর জাতে উঠেছে যে, কবিতার জন্য অর্থমুল্যও আজকের দিনে কল্পনার অতীত হয়ে নেই।” একবিংশ-র পঁচিশ বছর টিকে থাকা এবং কবিতা নিয়ে, কবিতার নতুন দিকবলয়ের অনুসন্ধানে, কবিতাকে কবিতা হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে এই পত্রিকার মাধ্যমে যে বিচিত্র সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ড সম্পাদিত হয়েছে, তার মূল্যায়ন যথাযথভাবে হওয়া উচিত।

খুব নির্মোহভাবে আমরা অনেকেই সেই ঔদার্যের জায়গাটায় পৌঁছতে পারি না বলেই হয়তো অনেককিছুর সঠিক মূল্যায়নে কার্পণ্য দেখাই। একবিংশ-র মূল্যায়নেও সেরকম বিষয় মাঝে মাঝে লক্ষ করা গেছে এবং তা কোনো শুভত্বের লক্ষণ নয়। খোন্দকার আশরাফ হোসেনকে আমার কখনো কখনো মনে হয়েছে এক নিঃসঙ্গ কর্ণধার, যিনি অনেকটা একাকীই তার ‘একবিংশ’ নামের তরণীটি বয়ে চলেছেন বিষম স্রোতধারায়। পঁচিশ বছর ধরেই চলছেন। মাঝেমাঝে ছেদ পড়লেও একেবারে থেমে যান নি। অনেকেই এসেছে এই তরণীর যাত্রী হয়ে । চলেও গেছেন। অনেক নতুন নতুন যাত্রীর কোলাহলে কখনো কখনো নতুন ও পুরনোর মিশ্রণে তার চলার গতি স্বচ্ছন্দ থেকেছে সতত। লিটল ম্যাগই মূলত সৃষ্টিশীল শিল্প-সাহিত্যের জায়গা। ১৯৮৫ সালের নভেম্বরে প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হবার পর যে আলোরেখায় তার সমূহ অবয়ব আচ্ছন্ন ছিল তাতে বুঝতে কোনো অসুবিধা হয়নি যে, এটি বাংলা কবিতার পালাবদলের অঙ্গীকার নিয়ে আবির্ভূত। আমরা আগেই বলেছি কোনো লিটল ম্যাগ কিংবা সাহিত্য পত্রিকার সৌন্দর্য-সৌকর্য কিংবা সৃষ্টিশীলতার কিংবা বেঁচে থাকার বিষয়টি অনেকখানিই নির্ভর করে সেই পত্রিকাটির পিছনের মানুষটির ওপর, যিনি সেই পত্রিকার সম্পাদক। খোন্দকার আশরাফ হোসেন ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক এবং আশির দশকের একজন উল্লেখযোগ্য কবি হিসেবে যে দায়িত্ব নিয়ে একবিংশ বের করতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেনÑ সেটি ছিল কবিতাকে প্রকৃত কবিতা করে তোলার অঙ্গীকার।

সত্তরের দশকের কবিদের কবিতা যে তরলীকৃত শব্দাচার, দ্রোহ, অকাব্যিক ন্যারেটিভ কিংবা সস্তা বাকবিন্যাসের স্রোতধারায় আচ্ছন্ন ছিল, সেটি বাংলা কবিতার জন্যে মোটেই শুভকর কোনো বিষয় ছিল না। জনপ্রিয় কবিদের একটা সময় গেছে তখন। আশির দশকে বাংলা কবিতায় একটি পরিবর্তনের হাওয়া লাগে। এসময়ে খোন্দকার আশরাফ হোসেনের উপলব্ধিতে আসে কবিতাচর্চায় শুভত্বের, সৃষ্টিশীলতার বিষয়টি। নিজে একজন সৎ কবি হিসেবে যে দায়িত্ব তিনি একবিংশ-র মাধ্যমে নিয়েছিলেন এবং আজ অবধি চালিয়ে যাচ্ছেন নিরলসভাবে কিংবা নির্ভীক ঔদার্যেÑ সে-বিষয়ে যে যা-ই ভাবুক না কেন, তার এই নিরন্তর প্রকাশনা এবং কবিতার নানা দিক নিয়ে, সাহিত্যতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা এবং বিশেষভাবে তরুণ কিংবা উদীয়মান প্রতিশ্র“তিশীল কবিদের তুলে ধরার বিষয়গুলো আলাদাভাবেই দেখতে হবে। এটি একটি দুরূহ কাজই বটে। বাংলাদেশে আর কোনো লিটল ম্যাগাজিন এরকম দায়িত্ব নিয়ে টিকে আছে কিনা আমার জানা নেই।

একবিংশ অনেক কবির জন্ম দিয়েছে। অনেক কবিই একবিংশ-র মাধ্যমে পরিচিতি পেয়েছে Ñ তাদের অনেকেই হয়তো আজ আর লিখছেন না, কিংবা দূরে সরে গেছেন, কিন্তু একবিংশ-র পালে হাওয়া লাগা থেমে যায়নি। নবীন-প্রবীণের সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ডে একবিংশ প্রতিটি প্রকাশনায় আলাদাভাবে আবির্ভূত হয়। আর এসব আলাদা কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে একবিংশ তৈরি করেছে রুচিশীল পাঠক। একবিংশ-র প্রথম সংখ্যায় সম্পাদক লিখেছিলেন, “... ভবিষ্যবাদী নামকরণের মধ্যে উপর্যুক্ত বোধটি কাজ করলেও স্বীকার করতে হবে, দৈশিক কবিতার হতাশাপূর্ণ বর্তমানই পত্রিকা প্রকাশের পেছনে মূল নিয়ামক ছিল। মনকে চোখ ঠেরে লাভ নেই; বাংলা কবিতার এখন প্রখর দুঃসময়। প্রতিভাদীপ্ত ঘোড়সওয়ারগণ বহু আগে নিস্ক্রান্ত; সুধী-জীবন-বুদ্ধের তিরিশী ত্র্যহস্পর্শ থেকে জেগে উঠলো না আর বাংলা কবিতা। কেউ কেউ বলেন, বাংলা কবিতার অনৈসর্গিক মৃত্যু ঘটেছিল কলকাতার ট্রামলাইনের উপর। অন্যরা, তুলনায় আশাবাদী, ঐ মৃত্যুর দিনক্ষণ সামনে ঠেলে কোনক্রমে পঞ্চাশ দশক পার করে দেন। সে যাই হোক, বাংলার কাব্য ক্ষেত্রটি বহুদিন প্রতিভারিক্ত আধিয়াদের দ্বারা অপকর্ষিত হচ্ছে । অন্তর্গত শ্রীহীনতাকে ঢেকে রাখছে রাজনীতির শিল্পবোধহীন চিৎকার। আমরা একটি হট্টগোলের হাটে আছি। আতœপৃষ্ঠকণ্ডূয়নের অসম্ভব যোগাভ্যাস, বামনাবতারদের কলহ, দলবাজি এবং স্বৈরাচারে অবরুদ্ধ প্রাণের স্ফুর্তি আবেগের আন্দোলন। ...একবিংশ’র প্রকাশ অপক্ষমতা ও স্বৈরাচারের শালীন জবাব; দেয়াল দ্বারা পথ বন্ধ দেখে তা ডিঙিয়ে যাবার স্পর্ধিত উল্লম্ফন বলুন আর প্রতিক্রমণ বলুন, একবিংশ’র অভীপ্সা তা-ই। একবিংশ কেবল নতুন প্রজন্মের কবি-লেখকদের জন্য নির্দিষ্ট। যারা অপ্রতিষ্ঠিত, যৌবনাবেগে টলমল, প্রতিভাবান, উদার, অভিনিবিষ্ট , শ্রমী এবং নির্ভয়, আমরা তাদের জন্য পাটাতন নির্মাণ করতে চাই...”

তরুণদের জন্য একটি মুখপত্রের অনুভব থেকে তিনি একবিংশ বের করেছিলেন এবং সুস্থধারার কবিতাচর্চার একটি পথ তৈরিতে নিজেকে অন্বিষ্ট রেখেছেন এই পত্রিকার প্রকাশনার সাথে বলতে গেলে দীর্ঘকালই। বাংলা কবিতার একটি বিশেষ সময়ের ব্যূহ থেকে বেরিয়ে আসার ক্ষেত্রে একবিংশ-র ভূমিকাকে ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখতে হবে।

একবিংশ শুধু বাংলাদেশের লেখকদের নিয়ে সন্তুষ্ট থাকেনি, ওপার বাংলার অনেক লেখকদেরও লেখা ছেপেছে। আমরা অনেকেই আগে আসাম কিংবা ত্রিপুরার বাংলা ভাষাভাষীদের লেখার সাথে পরিচিত ছিলাম না। ঐ অঞ্চলের লেখকরা এমনকি পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের কাছেও অবহেলিত, উপেক্ষিত ছিল। একবিংশই প্রথম আসাম-ত্রিপুরার কবিদের কবিতা ছাপিয়ে এবং ঐ অঞ্চলের পণ্ডিতদের তথ্যসমৃদ্ধ লেখা প্রকাশ করে তাদেরকে বৃহত্তর পরিসরে নিয়ে এসেছে। বরাক উপত্যকার বাংলা ভাষাভাষীদের সাহিত্যচর্চার বিষয়টি আমাদের নতুন ভাবনার ক্ষেত্রকে আরো বিস্তৃত করেছে বলে আমার বিশ্বাস। ঐ অঞ্চলে একদা যে ভাষা আন্দোলন হয়েছিল এবং এগারটি তাজা প্রাণ যে আত্মাহুতি দিয়েছিল, সে খবর আমারা একবিংশ-র মাধ্যমে আরো ব্যাপকভাবে জানতে পারি। আসামের কাছাড় জেলায় ১৯৬১ সালের ১৯ মে সংঘটিত ঘটনাটি তাই বাঙালির দ্বিতীয় ভাষা আন্দোলন হিসেবে ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে। একবিংশ এক্ষেত্রে যে দায়িত্বটি পালন করেছে, বাংলাদেশে প্রকাশিত আর কোনো লিটল ম্যাগাজিন সেটা করেছে বলে আমার জানা নেই। ‘বরাক উপত্যকার কবিতা: অতন্দ্র গোষ্ঠী’ নামক প্রবন্ধের গোড়াতেই তপোধীর ভট্টাচার্য বরাক উপত্যকাবাসী বাঙালির দুর্নিবার নিয়তিকে তুলে ধরেছেন, “বাঙালির উত্তাপবলয় থেকে সুদূরতম প্রান্তে বরাক উপত্যকার বঙ্গভাষীজনেরা যতটা তিনদিক ঘেরা পাহাড়ের পাহারায় বন্দী, তার চেয়ে ঢের বেশি নিমজ্জিত তারা স্বখাত সলিলে। মমতাবিহীন কালস্রোতে নির্বাসিত শ্রীভূমির কথা লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, ঐ ভূমি থেকে উৎখাত হওয়ার পরে ছিন্নমূল মানুষের স্বাভাবিক নিরাপত্তাহীনতা ও তজ্জনিত হীনমন্যতা হয়ে উঠলো বরাক উপত্যকাবাসী বাঙালির দুর্নিবার নিয়তি। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্যে এগারটি প্রাণ আহূতি দিয়েও শেষরক্ষা করতে পারলেন না। এরা আরম্ভ জানেন কিন্তু সমাপ্তিটা জানেন না। উনিশে মে তাই চৌত্রিশ বছর পরে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে অজ্ঞাতপরিচয়, আর তেতাল্লিশ বছর আগের একুশে ফেব্র“য়ারি প্রতিবেশী সমভাষীদের মধ্যে আজো জ্বলন্ত অগ্নিবলয়।” (একবিংশ, দশবছরপূর্তিসংখ্যা, নভেম্বর ১৯৯৬ )।

বাংলা সাহিত্যের রথি-মহারথিদের নিয়ে ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে একবিংশ একদিকে তাদের যেমন সম্মানিত করেছে, তেমনি তাদেরকে নতুনভাবে মূল্যায়নেরও ক্ষেত্র সৃষ্টি করেছে। তত্ত্ববিশ্বের নানা দিক ঠাঁই পেয়েছে একবিংশ-র বহুতল বুকে এবং এক্ষেত্রে এদেশের পণ্ডিতদের পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গ কিংবা আসাম-ত্রিপুরার প্রাজ্ঞজনেরাও লিখেছেন ব্যাপক পরিসরে। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, তপোধীর ভট্টাচার্য, অঞ্জন সেন, খোন্দকার আশরাফ হোসেন, আফজালুল বাসার, মঈন চৌধুরী প্রমুখের লেখার মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে তত্ত্ববিশ্বের নানা কথা। রোমান্টিক কবিতা ও রোমান্টিক আন্দোলন, উত্তর আধুনিকতা কিংবা আধুনিকবাদ নিয়ে সম্পাদক নিজে লিখেছেন বিস্তৃত তথ্যসমৃদ্ধ দীর্ঘ প্রবন্ধ। এছাড়া ইউরোপ-আমেরিকা-ল্যাটিন আমেরিকা-আফ্রিকার কবিদের কবিতার অনুবাদ ও আলোচনা পাঠককে দিয়েছে আলাদা তৃপ্তি। সব মিলিয়ে একবিংশ তার রন্ধনশালার ঔদার্যে রসনাতৃপ্তির নব নব আয়োজনে পাঠককুলকে যে পুষ্টিতে সমৃদ্ধ করেছে, সেই বিষয়টি আমাদের অনুভবের জগতে একধরনের আনন্দের সঞ্চার করে। এই আনন্দই শিল্পের নিভৃত সত্যকে জীবনের চারপাশে দাঁড়াতে সাহায্য করে। একবিংশ’র সফলতা এইখানে, এই আলোকিত অবগুন্ঠনে, এই বিভাসিত বিনম্র গুঞ্জনে।

১৯৯০ সালের ফেব্র“য়ারি মাসে প্রকাশিত একবিংশ-র ক্রোড়পত্র ধারণ করে আশির দশকের কবিদের কবিতা। ঐ ক্রোড়পত্রটি সম্পাদনা করেছিলেন সৈয়দ তারিক। ক্রোড়পত্রের শিরোনাম ছিল ‘অনিরুদ্ধ আশি: এক দশকের কবিতা’। ঐ ক্রোড়পত্রে ২৪ জন কবির প্রায় সকলেরই একাধিক কবিতা স্থান পেয়েছিল। এই কবিদের মধ্যে খোন্দকার আশরাফ হোসেন, রেজাউদ্দিন স্টালিন, মোহাম্মদ সাদিক, সরকার মাসুদ, শান্তনু চৌধুরী, মারুফ রায়হান, সুহিতা সুলতানা , মাসুদ খান সক্রিয় থাকলেও বাকিরা বেশ ম্রিয়মাণ এবং কেউ কেউ একেবারেই নিঃশব্দ। আশির দশকের কিছু সংখ্যাক কবির কবিতায় পালাবদলের ইঙ্গিত ছিল এবং পরবর্তীতে আশি ও নব্বইয়ের দশকের বেশ কিছু কবির কবিতায় জীবনানন্দ-উত্তর নতুন কবিতা চর্চার যে প্রণোদনা দেখা গেল তা আজকে নানাভাবে বিস্তৃত ও বিকশিত হয়েছে। আমরা আবারো বলতে চাই, বাংলা কবিতার পালাবদলে কিংবা সুস্থ ধারার কবিতাচর্চার ক্ষেত্রে একবিংশ’র ভূমিকাকে আলাদাভাবে ভাবার প্রয়োজন রয়েছে।

১৯৮৫ সালের নভেম্বর মাসে প্রকাশিত একবিংশ-র প্রথম সংখ্যাটি শুরু হয়েছিল সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের প্রবন্ধ দিয়ে। ঐ সংখ্যায় সাজ্জাদ শরীফ এবং সৈয়দ তারিকেরও প্রবন্ধ ছিল। খোন্দকার আশরাফ হোসেন, ইকবাল আজিজ এবং রেজাউদ্দিন স্টালিনের ছিল দীর্ঘ কবিতা। শামসুর রাহমানের ‘স্বাধীনতা তুমি’ সম্পর্কে আলোচনা করেছিলেন যথাক্রমে সৈয়দ তারিক, আহমদ মাযহার এবং আব্দুলাহ সাদী। একবিংশ-র ২৪তম সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়েছে ২০০৯-এর ফেব্র“য়ারিতে। এই সংখ্যাটি নানাদিক থেকেই গুরুত্বের দাবীদার। সম্পাদকের ভাষায় ‘একবিংশ-র বর্তমান সংখ্যাটির মূল প্রক্ষেপণ আধুনিকবাদ ও বুদ্ধদেব বসুর ওপর’। আধুনিকবাদ নিয়ে দীর্ঘ প্রবন্ধে খোন্দকার আশরাফ হোসেন স্পষ্ট করেছেন আধুনিকবাদী নানা আন্দোলন ও সেই কালখণ্ডের সামূহিক বিষয়কে। আলোচনার সাথে বেশকিছু আধুনিক ফরাসি কবির কবিতার অনুবাদ পাঠকের কাছে বাড়তি পাওনা হিসেবে মনে হয়েছে। বুদ্ধদেব বসুর জন্মশতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি হিসেবে তাঁকে নিয়ে রয়েছে ১১টি সুখপাঠ্য প্রবন্ধ। এই সংখ্যার সম্পাদকীয়-র বেশির অংশ জুড়েই রয়েছে আসামের কবি, প্রাবন্ধিক, সাহিত্যতত্ত্ববিদ তপোধীর ভট্টাচার্যকে নিয়ে আলোচনা, যাঁকে তিনি বলেছেন ‘তপস্যায় ধীর এক আচার্য’। এছাড়াও এ সংখ্যায় শূন্যের দশকের উল্লেখযোগ্য কয়েকজন কবির কবিতা মুদ্রিত হয়েছে।

অতঃপর ২৫ বছর পূর্তি সংখ্যার আয়োজন, সেই বিশাল আয়োজনে আমার এই ক্ষুদ্র লেখাটি একবিংশ-র দায় ও কৃতি নিয়ে খুব সামান্যই বলতে পেরেছে। একবিংশ-র কৃতি তার অসংখ্য সাহিত্যপ্রেমী পাঠক যারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে পত্রিকাটির পরবর্তী সংখ্যার জন্য। আমরা একবিংশ-র একশ বছর পূর্তির অপেক্ষায় থাকছি। জয়তু একবিংশ।

সাহিত্যের ছোট কাগজ একবিংশ-র ২৫ বছর পূর্তি: কালের ছাঁকনি অর্জন ও আকাঙ্ক্ষা : তুষার গায়েন

তুষার গায়েন

বহু দশকব্যাপী বাংলাদেশের সদা-অস্থির পরিবেশে প্রচলিত জনরুচির বিপরীতে দাঁড়িয়ে কোন লিটল ম্যাগাজিন/ সাহিত্য পত্রিকার ২৫ বছর আয়ুপ্রাপ্তি একটি সঞ্জীবনী ঘটনা। ‘একবিংশ’ সে ঘটনাসঞ্জাত পাত্র (পত্রিকা) — যার ভিতরে জলের ওঠানামা, ভরে উঠে সরে যাওয়া এবং আবারও প্লাবী হয়ে ওঠার আকুতিতে পূর্বাপর বন্ধু ও স্মৃতি অন্বেষণে দৃষ্টিসজল, দীর্ঘশ্বাসে ভরা।

আমি জানি, কোথাও কোনো কিছুকে ঘিরে এক বন্ধন রচিত হয়েছিল — ধুলোওড়া ফাল্গুনের বিকেলে সারি সারি বইয়ের অস্পষ্ট গুঞ্জন আর সতীর্থদের বুক-ধুকপুক করা সোনার হরিণ ধরার বৃত্তভেদী পদসঞ্চালন — গোল হয়ে বসে বহুক্ষণ আড্ডা, ধুমায়িত চা-পান-ধোঁয়া-সহযোগে, কবিতার খানাখন্দ খোঁজার পাশাপাশি এঁর-ওঁর মুণ্ডুপাত ও অদূরে প্রেসের শব্দ — লেখা দেওয়ার ডেডলাইন — তরুণতম কবি এলেন কাঁপা-কাঁপা হাতে সদ্যোজাত কবিতাটিকে প্রেসের শেষ ট্রেনে তুলে দিতে ... এইসব কিছু একবিংশ-কে ঘিরে আমার এখন মনে পড়ে। এখন এই শীতে, স্তরীভূত বরফের দেশে যেখানে বন্ধুসঙ্গ বিরল ও কবিসঙ্গ ততোধিক, ফেসবুকে অতঃপর লেপ্টে দিয়েছি নিজের মুখচ্ছবি — বহুজন অন্তর্জালে এসে ধরা দেয়, অধিকাংশ ভার্চুয়াল — স্মৃতি, শ্রুতি ও সঙ্গ-অতীত; তবু যাদের পাশাপাশি হেঁটেছি বহুদিন তাদের কেউ কেউ ভার্চুয়ালিটিকে ভেঙ্গে আসেন, দীর্ঘ বিচ্ছিন্নতার পর হঠাৎ ধরে ফেলার আনন্দ ও উত্তেজনায় বলেন: কী খবর? লেখালেখি? এমনই হ’ল অবশেষে কবি খোন্দকার আশরাফ হোসেনের সঙ্গে — বহু-গুণে-গুণান্বিত লেখক, অধ্যাপক, সমালোচক, অনুবাদক ও সর্বোপরি সম্পাদক। একবিংশ-র যতকথা তাঁকে সামনে রেখেই তো বলতে হবে, কারণ তিনিই তো সেই সফল ও ব্যর্থ পার্থ! মধ্য আশিতে দেশ থেকে সোভিয়েতে গিয়ে পড়াশুনা শেষ করেই ঐ (স্বপ্ন) দেশের ভাঙন অব্যবহিত বিস্ময় ও মর্মযাতনায় ভর করে দেশে ফিরে আসি অপ্রকাশিত কবিতার ভার লাঘব ও নতুন কবিতা সৃজনের তাগিদে। তখনো দেশের বিকল্প ধারার সাহিত্যচর্চা, লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলন ইত্যাকার বিষয়ের সঙ্গে অপরিচিত। কয়েকটি কবিতা জাতীয় দৈনিকের সাহিত্য পত্রিকায় মুদ্রিত হয়ে ঈষৎ উপশম বোধ হচ্ছে — এরই ভিতরে একদিন শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটে দেখি উজ্জ্বল ক্লীপের কামড়ে একটি পেরেকের গণ্ডদেশ থেকে এক সুদৃশ্য পত্রিকা ঝুলে আছে, প্রচ্ছদে ঘড়ির পেণ্ডুলামের মত দোলায়মান একটি হৃদয়কে নিয়ে মুখোমুখি দু’জন মানুষ দ্বৈরথে (পরে বুঝেছি দেশের সাহিত্য জগতে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ওটা এক প্রতীক) — নাম একবিংশ। চমকে যাই, নামের ভিতরে এক দূরযাত্রার আকাঙ্ক্ষা — ঋদ্ধ কলেবরে কত তরুণ কবির কবিতা, বিদেশী কবিতার অনুবাদ, সাহিত্যতত্ত্ব বিষয়ক প্রবন্ধ, সমকালীন কবিতার আলোচনা-সমালোচনা বন্দী হয়ে আছে ঝকঝকে মুদ্রণ ও বাঁধাইয়ে — নেড়ে চেড়ে দেখি আর ভাবি এইতো আমার কবিতার কাগজ! পত্রিকার সম্পাদকের নাম দেখে পাঠ-স্মৃতি থেকে উদ্ধার করি খোন্দকার আশরাফ হোসেনকে — কলেজে থাকতেই যাঁর কবিতার বই ‘তিন রমণীর ক্বাসিদা’ পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। অতঃপর তার সঙ্গে দেখা করতে যাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে, যেখানে তাঁর নিজস্ব কক্ষ ও পত্রিকার সম্পাদকীয় যোগাযোগের ঠিকানা। ‘আমাকে তো আপনি চিনবেন না’ বলে আমার নাম ঘোষণা করি এবং মূহুর্তমাত্র বিলম্ব না করে তিনি আমাকে সনাক্ত করেন এবং বলেন যে আমার কবিতা তিনি দৈনিকের সাহিত্য পাতায় পড়েছেন। আমি কিছুটা বিস্মিত হই এবং ভাবি যে, আমার সদ্য প্রকাশিত মাত্র তিনটি কবিতা কী তাহলে একটি ত্রিভুজ রচনা করেছে! যেমন বাহ্যিক দর্শনে তিনি বিশিষ্ট সাধারণ বাঙালিদের তুলনায়, দীর্ঘকায় ও দূর থেকে সনাক্তযোগ্য চুলের গড়নে — তেমনি অন্তর্গত ও কিছুটা শ্লেষী স্বভাবের এই কবি-অধ্যাপকের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা ক্রমেই বাড়তে থাকে। একে একে পরিচিত হই পত্রিকার কবি-লেখকদের সঙ্গে — খলিল মজিদ, দাউদ আল হাফিজ, রণক মুহম্মদ রফিক, আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ, কামরুল হাসান, বায়তুল্লাহ কাদেরীসহ অনেকের সঙ্গে, যাদের সাথে কেটেছে এরপর দীর্ঘকাল বন্ধুত্ব ও বিরোধিতায়, নিয়মিত দর্শন ও বহুকাল দর্শনহীনতায়। এটা ৯৩/৯৪ সালের কথা, যখন আমাদের সঙ্গে আড্ডায় আরও থাকতেন লেখক মফিজুল হক, কবি সুহিতা সুলতানা ও সমরেশ দেবনাথ।

প্রকৃতিগত কারণেই হোক অথবা জীবনের ভৌত ব্যবস্থাদি যথেষ্ট পরিমাণে নাগরিক ও সংহত না হয়ে ওঠার জন্যই হোক, বাঙালিদের ভেতর আবেগের পরিমাণ অনেক বেশি, বিশেষতঃ বাংলাদেশে, যা প্রধানতঃ গভীর ও অগভীর কাব্য রচনার মাধ্যমে চরিতার্থ হতে চায়। কবিতা রচনা করতে চাওয়ার ভেতর অগৌরবের কিছু নেই তা সে যতই সাধারণ্যে উপহাসের বিষয় হোক না কেন, কিন্তু মিডিয়া-প্রাবল্যের যুগে অনায়াস মুদ্রণের সুযোগ ও মেধাহীন অত্যুৎসাহীদের ভিড়ে এমন কবিতা পত্রিকার প্রয়োজন ছিল যা কিনা হবে কালের ছাঁকনি, যেখানে কবিতা সহজে ছাপা যায় না এবং ছাপা হওয়ার অর্থ কাব্য সম্ভাবনার এক রকম স্বীকৃতি — এমনই একটি মান একবিংশ-র অভীষ্ট ছিল এবং তা অর্জনও করেছে নিঃসন্দেহে। মধ্য আশিতে খোন্দকার আশরাফ যখন পত্রিকাটি প্রকাশ করেন তখন তিনি এমন ঘোষণাও করেছিলেন যে, একবিংশ হবে সৃজন আকাঙ্ক্ষায় ভরপুর, মেধাবী ও অপ্রতিষ্ঠিত তরুণদের আত্মপ্রকাশের পাটাতন, যেখানে মেধাহীন অথবা তথাকথিত প্রতিষ্ঠিত সূর্যের কোন স্থান নেই। হয়েও ছিল তাই, সত্তর-পরবর্তী বাংলাদেশের কবিতায় তরুণদের মধ্যে পরিবর্তনের যে আকাঙক্ষা প্রবল হয়ে উঠেছিল, তা যথেষ্ট উৎসাহ ও প্ররোচনা সংগ্রহ করে নিতে সক্ষম হয় বিশ্বব্যাপী আধুনিকতাবাদী দর্শন ও চিন্তাকাঠামো নতুন তাত্ত্বিক ও দার্শনিকদের দ্বারা ব্যাপকভাবে সমালোচিত এবং আক্রান্ত হওয়ায়। পোস্টকলোনিয়াল, পোস্টস্ট্রাকচারাল ও পোস্টমডার্ণ ডিসকোর্স তরুণদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, বিশেষতঃ এসব বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গে চর্চার ঘণত্ব ও তার প্রভাব বাংলাদেশেও বিস্তৃত হয়। খোন্দকার আশরাফ নিজে কবি, ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক ও কৃতী অনুবাদক হওয়ায় বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন আধুনিকতাবাদী কাব্য আন্দোলনের সঙ্গে পাঠককে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন ও উপহার দিয়েছেন বিদেশী কবিতার ঝকঝকে অনুবাদ; পাশাপাশি নতুন হাওয়া বদলের খবরও রেখেছেন এবং যথাসম্ভব চেষ্টা করেছেন একবিংশ-এ তা ধারণ করতে। তাঁর বিশেষ কৃতিত্ব এই যে, তিনি তত্ত্বের পাগলা ঘোড়ায় চড়ে লাগাম হারাতে রাজী হননি বরং উত্তরাধুনিকতাবাদী তত্ত্বের আড়ালে ঘাপটি মেরে থাকা বুদ্ধিবৃত্তিক মৌলবাদীদের অকুণ্ঠ সমালোচনা ও বিরোধিতা করেছেন — সেটা তাঁর প্রবন্ধে, ক্ষুরধার সম্পাদকীয়তে এবং প্রকাশ্য মঞ্চে। যদিও উত্তরাধুনিকতা নিয়ে একবিংশ-র বিশেষ সংখ্যা, যেখানে তিনি এই চিন্তা পদ্ধতিকে ফিরে দেখতে চেয়েছেন বিশ্বব্যাপী এর তাত্ত্বিক কাঠামো এবং বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে এর চর্চার পরিপ্রেক্ষিতে, সেখানে তিনি আশ্চর্যজনকভাবে বাংলাদেশের উত্তরাধুনিকতাবাদী প্রকৃত কবি ও কর্মীদের ব্যাপারে নীরব থেকেছেন; তাদের কবিতা ও কর্মের মূল্যায়ন তো দূরের কথা, নামও উচ্চারণ করেননি — যাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ একবিংশ-র নিয়মিত লেখক ও তাঁর সঙ্গী ছিল। তাঁর সাফল্য এই যে তিনি মেধাবী, সেক্যুলার ও সৃজনশীল একদল তরুণের সঙ্গ ও নিরঙ্কুশ সমর্থন পেয়েছেন যারা সৎ, নিলোর্ভ ও হঠাৎ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে অনাগ্রহী, যারা সাধ্যমত তাঁর পত্রিকায় লিখেছেন ও সেরা লেখাটিকেই দিয়েছেন একবিংশ-এ আর এই অপরাধে মিডিয়াসহ বহু সাহিত্যগোষ্ঠীর বিরাগভাজন ও ক্ষেত্রবিশেষে নিগৃহীত হয়েছেন। একবিংশ-সম্পাদকের ব্যর্থতা এইখানে যে, তিনি এই সব সপ্রতিভ ও আপোষহীন তরুণদের শক্তি ও প্রত্যাশাকে ব্যবহার করে একটি বড় সাহিত্য পরিসর নির্মাণ করতে পারেননি বা তেমন কিছু করা হয়তোবা তাঁর লক্ষ্য ছিল না। তিনি মেধা, মনন ও কর্মপ্রয়াসে যতটা প্রখর, হৃদয় ও ঔদার্যে ততটা নয়। তাঁর অন্তর্মুখিনতা, হিসেবী আবেগ ও কিছুটা শ্লেষী স্বভাবের কারণে অনেকেই তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেনি। অনেক তরুণ যারা সশ্রদ্ধ-মুগ্ধতায় তাঁর সঙ্গে সমান্তরালে পথ হাঁটার সংকল্প করে এসেছিলেন, তারা নীরবে দূরে সরে গেছেন। পত্রিকার বিন্যাসে খোন্দকার আশরাফ যতটা সুচারু, সাংগঠনিকভাবে ততটাই অনাসক্ত ও ভঙ্গুর। একবিংশ আশির দশকে প্রকাশিত হলেও নব্বই দশকেই তার মূল বিস্তার এবং এর প্রধান লেখক নব্বইয়ের কবিকূল। আশির দশকের খুব কম সংখ্যক কবিই যারা একবিংশ-এ লেখা শুরু করেছিলেন, তাদের ভেতর দু’একজন বাদে আর কেউ এ পত্রিকায় লেখা অব্যাহত রাখেননি। একবিংশ যে উজ্জ্বলতা, মেধা ও সৃষ্টিশীলতা নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিল, তাতে এটাই হয়ত স্বাভাবিক হত যদি এই পত্রিকাটিকে কেন্দ্র করে জমে উঠত তরুণদের প্রাণবন্ত আড্ডা, বছরে আয়োজন করে অন্ততঃপক্ষে দু’একটি নিয়মিত কবিতা/সাহিত্যের অনুষ্ঠান যেখানে তরুণ কবিরা তাদের কবিতা পড়বেন, কবিতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করবেন, বয়োজ্যেষ্ঠ কবিরা অংশ নেবেন তাতে অর্থাৎ কিনা গড়ে উঠবে একটা সার্বিক সেতু বন্ধন — একটা অর্গানিক সম্পর্ক — যেখানে শুধুমাত্র দু’মলাটের মধ্যে পড়ে থাকা নয় বরং উচ্চারণের গভীরতায় নতুন কবিতার মর্ম ও আবেদন পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার সুযোগ হবে যাতে বহুশ্রুত ও উচ্চারিত প্রচলিত কাব্যভাষার বিপরীতে নতুন উচ্চারণের আস্বাদ পাঠক পেতে পারেন। এইসব কিছু উজ্জীবিত ও প্রাণিত করতে পারত একবিংশকে ঘিরে আসা তরুণদের এবং যারা দূর থেকে সম্ভ্রমের দৃষ্টিতে এ পত্রিকাটিকে দেখেছেন ও ঘণিষ্ঠ হওয়ার পথ খুঁজেছেন। বিচ্ছিন্নভাবে দু’একটা অনুষ্ঠান যা কিনা একবিংশ আয়োজন করেছিল যেমন একবিংশ-র দশবছরপূর্তি অথবা সম্পাদকের পঞ্চাশতম জন্মদিন ইত্যাদি, তা যে হয়েছিল অনবদ্য ও প্রাণময় — তা কে অস্বীকার করবে? এ জাতীয় উদ্যোগের স্বল্পতা, সবাইকে উদার উষ্ণতায় কাছে টানতে না পারার ব্যর্থতা শুধু একবিংশ-র অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত, অনিয়মিত ও মন্থরই করেনি; খোন্দকার আশরাফের ব্যক্তিগত নিঃসঙ্গতাও বাড়িয়ে তুলেছে বহুগুনে। এইসব সাফল্য ও ব্যর্থতার খতিয়ান নিলে দেখা যাবে, একবিংশ-র সাফল্যের পরিমানই বেশী। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের কবিতায় বাকবদলের চিহ্ণগুলোকে ধারণ করে, দেশের প্রতিভাবান তরুণ কবিদের প্রায় অধিকাংশের কবিতা একবিংশ-র কোনো না কোনো সংখ্যা অথবা বহু সংখ্যায় মুদ্রিত করে তিনি একটি কাব্যরুচির প্রতিষ্ঠা করেছেন যা এই পত্রিকাটিকে সমকালে শ্রেষ্ঠ কবিতার কাগজ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে বলে আমার বিশ্বাস। সম্পাদক হিসেবে খোন্দকার আশরাফ কখনও কোনো তরুণ কবিকে বোঝাতে চেষ্টা করেননি যে কী ধরনের কবিতা লেখা শ্রেয় অথবা তাদের কবিতার শক্তি ও দূর্বলতা কোথায় এবং কিভাবেই বা তাকে উন্নীত করে নেওয়া যাবে — যেমনটা বুদ্ধদেব বসু, সিকান্দার আবু জাফর অথবা আহসান হাবীব করতেন বলে শুনেছি; তবুও তিনি সম্পাদক হিসাবে সমকালে কেন শ্রেষ্ঠ সে প্রশ্ন আসতেই পারে। এর উত্তর : খোন্দকারের রয়েছে বিশেষ কাব্যরুচি ও পাকা জহুরীর চোখ যিনি স্রোতের টানে ভেসে যাওয়া অনেক অবাঞ্ছিতের ভিড় থেকে সুন্দর ফুলটিকে সনাক্ত করে তুলে আনতে পারেন। কবিতা কী এবং কী নয় সেই উপলব্ধির গভীরতা এবং নিরন্তর সেই উপলব্ধিকে প্রকাশ করে যাওয়ার নিমোর্হ দৃঢ়তাই তাঁকে এবং একবিংশকে দিয়েছে এই আসন। সাম্প্রতিক কালে, বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যে বহু নান্দনিক ও মানসম্পন্ন লিটল ম্যাগাজিন বের হচ্ছে তার পিছনে একবিংশ কোন না কোনভাবে প্রেরণা হয়ে আছে।

আজ একবিংশ-র ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে আমি সম্পাদক, সতীর্থ ও পাঠকদের জানাই আমার প্রাণঢালা শুভেচ্ছা ও আন্তরিক অভিনন্দন!

টরন্টো, কানাডা
১৩ জানুয়ারী, ২০১০