শুক্রবার, ৯ এপ্রিল, ২০১০

পুনর্পাঠ : আহমদ মিনহাজ : তোমার সৃষ্টির পথ

সীমাবদ্ধ যে আকাশ
জঠরের জ্বালা চিরন্তন
চিরক্লেদাক্ত এই জীবন
যুগ নিষাদের কপিশ নয়ন হানবে সেখানে দৃষ্টিবাণ।
--(আহসান হাবীব)


বাঙলা সাহিত্যে দুঃসময়-- কথাটি আমরা বলি প্রায়ই। বলার পিছনে সঙ্গত কারণ আছে নিশ্চয়; যুক্তিও বোধ হয় কম নেই। আমাদের যে পারিপার্শ্ব তাতে অহরহ রদবদল ঘটে। যেমন পরিবর্তনের ভিতর দিয়ে আমরা বেড়ে ওঠি তা সাহিত্যকেও প্রভাবিত করে। প্রভাবটা বহুমুখী। অর্থনীতি অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে আমাদের ঠেলে দেয়, রাজনীতি তৈরী করে বৈষম্য-সংঘাত আর ধর্ম রূপ নেয় হানাহানির মরাণাস্ত্রে। সুরুচি ও বিশ্বাস এভাবেই উবে যায়। আমাদের জীবনের অন্তরালে হতাশা ও মনোযাতনা প্রবল হয়ে পড়ে। সাহিত্য এ আক্রমণ থেকে রেহাই পায় না যেহেতু জীবন নিয়েই তার কারবার। সময়ের ঘাটে ঘাটে জীবনের রঙ বদলায়। সাহিত্যেও ঘটে পালাবদল। প্রায় শেষ বয়সে পৌঁছে বঙ্কিম খেদোক্তি করে বলেছিলেন, এই জীবন লইয়া কি করিব। কি করবেন ভেবে পাননি বঙ্কিম; ভাবাটা দুরূহ হয়ে উঠেছিল তাঁর পক্ষে। সেই উনিশ শতকে বিশ্বব্যাপী অখণ্ড একটি যোগাযোগ রক্ষার কোনো পথ ছিল না। এই বিচিত্র বিশ্বকে তার অজস্র বৈচিত্র ও বিলোড়নে বড় করে দেখবার কথা কল্পনাও করা যেত না। তারপরও সংযোগ গড়ে উঠেছিল; যাকে বলা যায় হৃদয়ের সংযোগ। পরাধীন ভারতবর্ষের ততোধিক পরাধীন বঙ্কিম আর ইউরোপের জন কীটস সমান শূন্যতা অনুভব করেছেন। জীবন নিয়ে কী করা যায়, তার ভাবার্থটা ঠিক কোন খানে তা স্বল্পায়ু কীটসকেও ভাবিয়েছিল। ঊনবিংশ শতকের প্রথম দুটো দশককে পেরেছিলেন ছুঁতে, কিন্তু প্রাজ্ঞ কণ্ঠে বলে গেছেন, Of the wide world I stand alone and think/till love and fame to nothingness do sink1 স্নেহ-মমতা কিংবা ভালবাসার মধ্যেও জীবনের শিকড় খুঁজে না পাওয়ার বেদনা আজকের নয়; চিরন্তন। আমরা চাই কিংবা না চাই সময়ের স্রোতে ভেসে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। যুগে যুগে আমরা এভাবেই যাই। যাওয়াটা অবধারিত জেনেই যাই। যে-শেকস্পীয়ারে চিরকালের মানুষ অবিষ্কার করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, সেই শেকসপীয়ারের অমর চরিত্র ফলষ্টাফ বলেছিল, “মানুষের চিন্তা তো জীবনের দাস আর জীবন হচ্ছে কালের নির্বোধ ক্রীতদাস।” এ-কারণেই হয়তো হিন্দুধর্মে কালীর আবিভাব। কালী অনন্ত, সীমাহীন সময়-কালের প্রতীক; ধারক। শক্তিময় শক্তিদাত্রী আবার শক্তি সংহিতাকারিণী। কালকে নিজের মধ্যে ধারণ করেও তিনি অমেয়। তাঁর মধ্যে যুগান্তের প্রবাহটা সঞ্চিত হয়ে আছে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের চমৎকার একটি গল্প ‘সর্পিল’, যেখানে কালী-পূজারী শংকর বলে, ‘তোমরা বেটিকে কালী বলেই জানো আমরা বলি শক্তি। যার প্রলংকরী শক্তির সংযমে সৃষ্টির স্থিতি। এক স্তনে বিষ সঞ্চিত রেখে অন্য স্তনের অমৃতে যে জগৎকে পালন করেছে।”২ শংকরের প্রগাঢ ভক্তির ধারে কাটা পড়েছিল বিদেশফেরত অনন্তের সংস্কারমুক্ত মন। শতবছরের পুরনো একটি জীর্ণ প্রাসাদের খাঁচায়, আধুনিকতার বিসর্পিল মোহ হতে মুক্ত কিন্তু স্থবিরতার মধ্যে মুখ-গোঁজা শংকরের উদ্ভট খেয়ালের মাশুল গুণতে হয়েছিল অনন্তকে। সে নিজেকে বাঁচাতে পারেনি যেমন পারেনি বাঁচাতে শংকরের স্ত্রী তার নিকটজন কেতকীকে। অনন্ত কেন পারলো না তার পিছনে একটির পর একটি কারণ দাঁড় করানো যায়। বলা যায় সে পারেনি যেহেতু কুসংস্কারের প্রতীক একটি সাপকে সে মেরেছিল, কিন্তু সমস্ত স্থবিরতাকে প্যাঁচিয়ে আছে যে তাকে আঘাত হানতে পারেনি; তার নাগরিক মানসিকতায় আধুনিকতা ছিল, যুক্তির দৃঢ়তা ছিল না। তবে যাই বলা হোক্ না কেন, সব ছাপিয়ে উঠে এই সত্য যে শাশ্বত এক কালপ্রবাহে ভেসে যাওয়াটা অনিবার্য। ‘বাইবেল’-এ জীবন-পানির কথা বলা হয়েছে। অবিনশ্বর লোকে উত্তীর্ণ হওয়ার পর তার সন্ধান মেলে। তাই আহবান “যাহার পিপাসা পাইয়াছে সে আসুক এবং যে পানি খাইতে চায়, সে বিনামূল্যে জীবন পানি খাইয়া যাক”।৩ কিন্তু সে পানি পান করার জন্যে যোগ্য হয়ে ওঠা চাই। নিজের কর্মফলের মধ্য দিয়েই মানুষ তার যোগ্যতাকে প্রমাণ করতে পারে। কেননা “চোখ দেহের প্রদীপ। সেইজন্য তোমার চোখ যদি ভাল হয়, তবে তোমার সমস্ত দেহই আলোতে পূর্ণ হইবে। তোমার মধ্যে যে আলো আছে তাহা যদি আসলে অন্ধকারই হয়, তবে সেই অন্ধকার কি ভীষণ”। অথচ সীমিত সময়ে মানুষ নিজেকে পূর্ণ করে তুলতে না তুলতে মৃত্যুর শিকার হয়। পৃথিবীর সময়টা দ্রুত ফুরিয়ে যায়, আর যার বলেই তার বাঁকে বাঁকে চাওয়া না চাওয়া পাওয়া না পাওয়ার বেদনা জমে থাকে, জন্ম দেয় রিক্ততার, প্রচণ্ড হয়ে পড়ে শূন্যতার প্রতি আকর্ষণ। যদিও এই রিক্ততা কিংবা শূন্যতাকে একটি প্রযৌক্তিক মূল্যবোধের ফসল বলা যায়। সাহিত্য যদি সে মূল্যবোধের খপ্পরে পড়ে, তাকে একা আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে বুলেট ঠোকাটা অনায়। এই জটিল মানববিশ্বের অগুণতি মন এবং মনস্তত্ত্বের নীরব দর্শকমাত্র সে। আমরা যা ভাবি যা কল্পনা করি আমাদের মস্তিষ্কে অনুভবের যে বিচিত্র পাখাটি ঘোরে তাই সাহিত্যকে জীবন্ত করে তোলে। সুতরাং তার ব্যর্থতা, সফলতার দায়ভার আমাদের একার। আমাদের চিন্তার উপলব্ধির প্রসারণ কিংবা সীমাবদ্ধতার উপর সে নির্ভর করে। মনের শরীরে সাহিত্যের ধারণাটা পাই আর অক্ষরের গাঁথুনিতে পাই তার পরিচয়। এ অর্থে সাহিত্যের সাথে স্থাপত্যের সম্বন্ধ বড় নিবিড়। স্থাপত্যের মতো সাহিত্যও অসংখ্য বাক্য-হরফ শব্দের সম্মিলনে এক জমাটবদ্ধ শিল্প, উপকরণের বিশুদ্ধতা রক্ষা তাতে অপরিহার্য। একটি মনোরম গৃহ-নির্মাণে বিবিধ উপকরণের প্রয়োজন পড়ে। যদি তার কোনো একটিতে ভেজাল থাকে তবে তার ভিত্তি হয় দুর্বল। অপেক্ষায় থাকে, কখন পড়বে ধসে। সাহিত্যে সে ভেজাল বা ফাঁকির খেলা যদি চলে তার পরিণাম আত্মঘাতী হতে বাধ্য। আমাদের বাঙলা সাহিত্য সেই ভেজালের বিষ এড়াতে পারেনি পুরোপুরি। এড়াতে দেয় না রাষ্ট্র কাঠামোয় আমাদের হতদরিদ্র অবস্থান। ভুলে গেলে চলবে না উত্তরাধিকার সূত্রে উদ্ভুত অদ্ভুত একটি আর্থ-রাজনৈতিক পরিকাঠামো আমরা লাভ করেছি। নৈতিক মূল্যবোধ, সুদৃঢ় জাতীয় চেতনার উৎকর্ষ ঘটানোর সামর্থ্য এর অতি-অল্প। যার ফলে পরাধীনতার লেবাস ছেড়ে পুনরায় অধীনতার শিকল পরতে আমরা বাধ্য হই। সাহিত্যে মাটি ও জীবনবিমুখী প্রবণতার অন্যতম কারণই হচ্ছে এই পরাধীন প্রথা-আচার ও সংস্কারে আটকে পড়া। তবে একদিনে পড়ে উঠেনি এটা। ভৌগোলিক আবহের ভূমিকা এতে আছে বৈকি। আর সাহিত্যের সাথে ভূগোলের সম্পৃক্ততা কিভাবে অস্বীকার করি? ডানিয়েল ডিফোর বিখাত উপন্যাস রবিনসন ক্রুসো’র কথা আমরা সবাই জানি, এ-ও জানি সে সমুদ্রে একাই পাড়ি দিয়েছিল, নির্জন-জনমানবহীন একটি দ্বীপকে নিজের মতো করে গড়ে নিয়েছিল কিংবা আরও স্পষ্ট করে বলা যায় একটি উপনিবেশের পত্তনও সে করেছিল। স্বদেশ কিংবা পরিবার কেউই তাকে আটকে রাখতে পারেনি। কেননা তখন তার শরীরে রোমঞ্চের নেশা, চোখে ঝুঁকিপূর্ণ কিন্তু সোনালি দিনের স্বপ্ন। স্বদেশে আর্থিক একটা ভিত্তি, একটা নিশ্চিত জীবন তখনো উমুক্তই ছিল তার জন্য। যেহেতু চতুর্দশ থেকে ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যে ইংল্যান্ডে বুর্জোয়া একটি কাঠামোর যেটুকু অবশিষ্ট ছিল তা ভেঙে পড়তেই পুঁজিতে টান পড়বে এ বিবেচনা ডিফোর ছিল। তাই সামন্ততন্ত্রের প্রায় শেষ পরিচ্ছেদ উল্টে-পাল্টে, তার পতন ও বণিক-ধনতন্ত্রের আসন্ন উত্থানকে মেনে নিয়ে ডিফো তাঁর রবিনসনকে সমুদ্রে ভাসান। ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত হল্যান্ড ও ফ্রান্স সে স্থান দখলে নিতে শুরু করে। ডিফো সে সময়কার মানুষ হিসাবে রবিনসনকে উপস্থান করেছেন। ১৬৫১ খ্রী থেকে সমুদ্রের সাথে রবিনসনের মরণপণ বোঝাপড়ার শুরু। ডিফো দূরদর্শী ছিলেন। ইংল্যান্ড ভূমিনির্ভর সামন্ততন্ত্র একটু একটু করে খসে পড়ছে, প্রস্তুতি নিচ্ছে দূরাগত শিল্প-বিপ্লবের, যে বিপ্লবের প্রয়োজনেই আসলে ইংরেজরা বেরিয়ে পড়েছিল এতদিন। রবিনসনে তার সূচনা: সে পথ দেখিয়ে গেছে যার উপর দিয়ে এসেছে পুুঁজিবাদর বিজয় আর সুনিশ্চিত হয়েছে বুর্জোয়া শক্তি ও সাম্রাজ্যবাদের উত্থান। তারা অর্থাৎ “বুর্জোয়া শ্রেণী যে উৎপাদন-শক্তির সৃষ্টি করেছে তা’ অতীতে সকল যুগের সমষ্টিগত উৎপাদন-শক্তির চেয়েও বিশাল ও অতিকায়। প্রাকৃতিক শক্তিকে মানুষের কর্তৃত্বাধীন করা, যন্ত্রের ব্যবহার, শিল্প ও কৃষিতে রসায়নের প্রয়োগ, বাষ্পশক্তির সাহায্যে জলযাত্রা, রেলপথ, ইলেকট্রিক টেলিগ্রাফ, চাষাবাদের জন্য গোটা মহাদেশকে সাফ করে ফেলা, জলযাত্রার জন্য নদীর খাত কাটা, ভেলকিবাজির মতো যেন মাটি ফুঁড়ে জনসমষ্টির আবির্ভাব।”৪ এই জনসমষ্টি পুঁজিবাদের উৎস। শাসন ও শোষণ, ব্যবহার ও বিনিময়ের বিকল্প পুঁজিবাদে নেই। অবাধ ব্যক্তি-মালিকানা, মধ্যবিত্ত মুৎসুদ্দিও এলিট পুঁজিপতি শ্রেণীর বিকাশ সেখানে অবধারিত। যা সম্মিলিত শক্তি সঞ্চয় করে, শোষণের অস্ত্র প্রয়োগ করে গরিষ্ঠ লোকসাধারণের উপর। মার্কস-এঙ্গেলস যাদের বলছেন সর্বহারা। পুঁজিবাদ বিশ্বের ভূগোলকে নিজের মতো গড়ে নেয়ার সাথে সাথে তার সাহিত্য ও সৃজনীতে সেই ভৌগোলিক পরিবেশের ছাপ পড়েছে। তবে পূর্ণাঙ্গ পুঁজিবাদী চরিত্রের সমাজে যে নোংরামি আমরা দেখি তা’ চিন্তার স্বাধিকারকে শেষ পর্যন্ত দমিয়ে রাখতে পারে না। তার সাহিত্য এর প্রতিফলন আছে। পুঁজিবাদী সমাজের খবরদারী লেখকদের বিব্রত করলেও, মুক্ত হাওয়ায় তাঁরা নিশ্বাস নিতে না পারলেও এ-থেকে মুক্তি খোঁজার বিরাম ঘটে না। লেখকরা পুজিবাদী মানসকাঠামোয় স্থির থাকলেও গঠনমূলক একটি পথ নিজের ভেতরে তৈরি করে নেন। আমাদের আধা--সামন্ততান্ত্রিক একং আধা-পুঁজিবাদী কাঠামোয়ও এর প্রমাণ মাঝে মধ্যে পাওয়া যায়। তবে নিজেদের সুরক্ষা দিতে পারিনি আমরা। রবিনসনের মতো আমাদেরকেও লড়তে হয়েছে। বেনিয়া স্পেনিশ ওলন্দাজ ফরাসী পর্তুগীজ ইংরেজ এমনকি উপমহাদেশীয় পাকিস্তানীদের সাথেও। ঐসব বেনিয়া পশ্চিমাদের ন্যায় সমুদ্র পাড়ি দেয়া, ব্যবসা বাণিজ্যর নামে সম্পদ লুণ্ঠন ধর্মপ্রচারের সুযোগে উপনিবেশ ফাঁদার উপায় বা শক্তি আমাদের ছিল না। নদীবহুল সমতলভূমির মানুষ আমরা, ক্ষুদ্র একটি অংশ জুড়ে সমুদ্রের উন্মত্ত দাপাদাপি সহ্য করে আসছি। নদী পর নদী ডিঙ্গিয়ে সমুদ্রে পড়ার শক্তি হয়নি সবসময়। সমতল ও পাহাড়পরিবেষ্টিত যে ভূমি আমাদের আছে তার বৃহৎ অংশই সমুদ্রের সাথে সংযোগহীন। একটি মজবুত অর্থনৈতিক বা সামরিক ভিত্তি তাই আমাদের ছিল না বললেই চলে। আমাদের নদী-জঙ্গল ঘেরা দুর্ভেদ্য প্রাচীর তাই টিকতে পারেনি বারুদ কম্পাস আর বিশাল নৌ--বহরের কাছে। পাঠানরা মিশে গিয়েছিল, মুঘলরা পারেনি, ইংরেজরা ক্ষেত্রবিশেষ ব্যতীত মেশার প্রয়োজন ভাবেনি। তারা যা চাপিয়ে দিয়েছে তাই আমরা নিতে বাধ্য হয়েছি; মাথা নুইয়েছি তাদের পায়ে। নোয়ানোটা প্রয়োজনীয় ছিল বলেই হয়তো! তবে প্রয়োজনের চেয়েও প্রধান হয়ে উঠেছিল আত্মশক্তির দৈন্য। সাহিত্য ভুগছে দীর্গনি ধরে। তার প্রসারণ বা বিপ্লবী পরিবর্ধনের চিত্রও স্পষ্ট হয়নি আজও। অবশ্য ঠিক বিপ্লব জন্ম দেয়া অথবা তাকে পত্র-পুষ্পে পল্লবিত করা সাহিত্যের কাজ নয়। একটি জাতি স্বয়ং আর্থসামাজিক পরিবেশ থেকে বিপ্লবের পটভূমি গড়ে নেয়। বিপ্লবের প্রেক্ষিত গঠেনে সাহিত্যের ভূমিকা তাই অপাতভাবে হলেও গৌণ। তবে বিপ্লবের সম্ভাবনা থাক বা না থাক পরিবর্তনের জেয়ার থাকা উচিত সবসময়-- অন্তত সাহিত্যে। এর ফলে তার ধারণ ও প্রসারণ ক্ষমতার পরিচয় মেলে। অগণিত নদীর জল সমুদ্র একাই বহন করে; তার বহন ক্ষমতা অসীম। সাহিত্যকে সেই ক্ষমতা অর্জন করতে হয়। এর জন্য ভিতরে ভিতরে বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়া থাকা চাই। ফরাসী-জার্মান ও রুশ সাহিত্য দীর্ঘদিন আমাদের মাতিয়ে রেখেছিল। তাদের মাহাত্ম্য আজও আমাদের আকর্ষণ করে। এখন ল্যাটিন আমেরিকা ও আফ্রিকার সাহিত্যের দিকে আমরা তাকিয়ে আছি। নতুন কাজ হচ্ছে, তৈরী হচ্ছে শিল্পর সংজ্ঞা। এসবের কোনোটাই আকস্মিক নয়। সুদীর্ঘ দিনের প্রস্তুতি চলছে, যা ভূমিকা রাখছে সাহিত্যের পশ্চাদভূমি নির্মাণে। স্পার্টাকাসের নেতৃত্বে সংগঠিত দাস-বিদ্রোহ রোমক সাম্রাজ্যের ভিতরে নাড়িয়ে দিয়েছিল একসময়। কিন্তু পারেনি দাস-মালিকদের প্রভুর আসন থেকে টেনে নামাতে। দাসরা শোষণ ও অত্যাচারের অবসান চেয়েছিল কিন্তু গোটা ব্যবস্থা পরিবর্তনের কথা ভাবেনি, ভাবার মতো সময় বা রাজনৈতিক পদ্ধতি সজ্ঞা প্রজ্ঞা তাদের ছিলনা। তাই বিপ্লবের সম্ভাবনা থাকার পরও তা বিদ্রোহের উপর উঠতে পারেনি। রোমের দাসরা যা পারেনি তাকেই অনেকটা সম্ভব করে তুলেছিল ফরাসিরা। কারণটা পিছনের ইতিহাসে নিহিত। ভলতেয়ার তাঁর নিজ জীবদ্দশায় বিপ্লব দেখে যেতে পারেননি কিন্তু বলে গেছেন, “দেখছি সবকিছু বিপ্লবের বীজ ঝড়িয়ে দিচ্ছে, বিপ্লব একদিন আসবেই আসবে কিন্তু তা দেখার আনন্দ থেকে আমি থাকবো বঞ্চিত। যে কোন ব্যাপারেই ফরাসীরা কিছুটা বিলম্ব করে থাকে কিন্তু শেষে হলেও তারা আসেই”৫ একটা সরল সত্য ভলতেয়ার পেয়েছিলেন ইংল্যান্ডে। দেখেছিলেন বণিক-জাতি ইংরেজ অতি দ্রুত বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞান, সম্পদ পুঁজি পকেটে পুরতে ব্যস্ত। অর্থ ও মূলধন বাজারের সম্প্রসারণের ফলে খসে পড়ছে পুরনো মূলোবোধ, সামজিক প্রতিবেশে ধর্মের স্থান সীমিত হয়ে আসছে। পাশাপাশি বিজ্ঞাননির্ভর চিন্তা-ভাবনার ঘটছে প্রসার। ফ্রান্সের কৃষিনির্ভর যাজকতন্ত্রশাসিত ক্যাথিড্রাল উড়িয়ে দেয়ার সাহস তাঁর সেখানেই সঞ্চিত হয়েছিল। ‘কাঁদিদ’-এ সেই সাহস স্ফুলিঙ্গের মতো ঠিকরে পড়েছে। পেরেক ঠুকেছে শোষণ ও অধিভৌতিক সংস্কারের কফিনে। বিপ্লবের তাত্ত্বিক অনুপ্রেরণায় এর অবদান যথেষ্ট। যেরকম রুশোর ‘সামাজিক চুক্তি’ পরিণত হয়েছিল বিপ্লবের হাতিয়ারে। কেবল শোষণের অবসান কাম্য ছিল না উপরন্তু নিম্ন পেশাজীবী বিশেষত মধ্যবিত্ত শ্রেণী তাদের জায়গা চেয়েছিল। যদিও বিপ্লবের বিশৃংখলার মধ্য থেকে নেপোলিয়ান উঠে এসেছিলেন, পরবর্তীতে পুনরায় কায়েম করেছিলেন রাজতন্ত্র; তবুও বিপ্লবের নয়-দশ বৎসরব্যাপী প্রভাব একবারে দুর্বল ছিল না। রোবসপীয়র, দাঁতো, লাফইয়েৎ, মিরাবো এঁরা কেউ-ই টিকে থাকতে পারেননি বটে, কিন্তু বিজ্ঞাননিষ্ঠ চিন্তু-ভাবনা, শিক্ষার প্রসার, কৃষি-কাঠামোয় পরিবর্তন, পরিমাপ ও ওজনে মেট্রিক পদ্ধতি ব্যবহার ইত্যাদি কঠিন কাজগুলো ঐ সময়েই শুরু হয়েছিল। রাজতন্ত্র আবার জায়গা করে নিয়েছিল ঠিকই কিন্তু ততদিনে সামন্ততান্ত্রিক সম্পর্কের শেষ চিহ্নও প্রায় অবলুপ্তির পথে। ফরাসী বিপ্লব সৃষ্টি করেছিল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উদযোগ। পাপ পূণ্য বিশ্বাস অবিশ্বাস ক্ষুধা মৃত্যু আর অস্থিরতায় জটপাকানো সময়টাকে ধরতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়ে হয়েছে সাহিত্যকে। এ সময়টাকে সাহিত্যের নেতি-বিকার ও বিষণ্নতার কালও বলা যেতে পারে। বিপ্লবের পরে জন্মগ্রহণকারী ভিকতর হুগোয় আমরা দেখি বিক্ষোভ-বিদ্রুপ আর শ্লেষের আধিক্য; মার্কুই-দ্যা-সাদে তীব্র যথেচ্ছ নীতিবিগর্হিত যৌনাচার, বিকৃতি, মানবিক ও স্নায়বিক বৈকল্য। বিপ্লবের অভিঘাত গোটা ইউরোপে মস্ত একটা হুলুস্থুল ধাঁধিয়ে দিয়েছিল। জার্মানীতে নাস্তিক্য দর্শনের প্রসার, নীটশের জরাথ্রুষ্টীয় মতবাদ ও অতিমানবের উত্থান কামনা-- এ-সবই বিপ্লবী বিকৃতির ফসল। কিন্তু ফরাসী বিপ্লবের ফলে ফ্রান্স তথা ইউরোপে যা ঘটেছিল তা রুশ-বিপ্লবের ফলে একইভাবে রাশিয়ায় ঘটেনি। ফরাসী বিপ্লব একটি শ্রেণীনিরপেক্ষ সাংস্কৃতিক ভূমি তৈরী করতে পারেনি। রুশ বিপ্লবের সাংস্কৃতিক পটভূমি গড়ে উঠেছিল আর্থ-রাজনৈতিক ও সামাজিক মেরুকরণের প্রতিফল থেকে। পুশকিন বা গোগোল জারতান্ত্রিক শোষণের বিরুদ্ধে অতোটা তীক্ষè ছিলেন না কিন্তু মানুষের সুখ-দুঃখের চিরন্তন কিছু অনুভূতিকে তাঁরা ছুঁয়ে গিয়েছিলেন। এই সামষ্টিক প্রজাতির দর্শক তাঁদের উত্তরসূরী লেখকরা। জীবনের কোনখানে আঘাত করলে আঘাতটা বেজে উঠবে তা জানা ছিল তাঁদের। টলষ্টয় এগিয়েছেন বিরাট একটি অন্ধকার গহ্বরে চেতনার আলো ফেলতে ফেলতে। গোর্কিতে জীবন-সংগ্রামের আওয়াজ আমাদের কানে করাঘাত হানে। টুর্গেনেভ তৈরী করেন প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের ইন্দ্রজাল। কিন্তু চেখভ বলেন ক্লান্তির কথা যা
দস্তয়েভস্কি’তে সৌন্দর্য এবং বিবমিষার বিরোধ সূচিত করে। মানুষ কেন আরও ভদ্র হয়ে উঠবে না, কেন জীবনের অতিমামুলি মুখোশ খুলে হৃদয়বান হবে না-- এর জবাব না পেয়ে চেখভ বিষণ্ন ব্যথাতুর। তাঁর সম্বন্ধে গোর্কির মন্তব্য স্মর্তব্য, “অক্ষম মানুষের এই একঘেয়ে ধূসর ভেড়ার পাশ দিয়ে চলে গেলেন এক বড় মাপের মানুষ। যিনি সব জিনিসের প্রতি মনোযোগী; তিনি তাঁর এই একঘেয়ে স্বদেশবাসীর দিকে তাকালেন, তারপর বিষন্ন হাসি অথচ মৃদু গভীর ভর্ৎসনার সুরে, মুখের চেহারায় এবং বুকের ভেতরে একটা হতাশ বেদনার ভাব নিয়ে মধুর অকপট কণ্ঠে বললেন, “আপনারা বিশ্রী জীবন-যাপন করছেন মশাই!”৬
এই বিশ্রী জীবন থেকে মুক্তির বার্তা নিয়ে এসেছিল রুশ বিপ্লব। সাহিত্যে প্রসারণ ক্ষমতা ছিল তখন তুঙ্গে আর স্তেপভূমিকে ঘিরে বিস্তৃত হচ্ছিলো মহৎ রুশ লেখকদের সীমানা। রুশ সাহিত্যের মহৎদানের অধিকাংশ প্রাক-বিপ্লব মুহূর্তে রচিত। এরপর দু’দুটো বিশ্বযুদ্ধ, টানা গৃহযুদ্ধ এবং অর্থনৈতিক সংগ্রামে বিপর্যন্ত রাষ্ট্র স্বয়ং নেমেছে রক্ষণশীলতা ও আধিপত্যের অস্ত্র হাতে। নেমেছে সৃজনীর গলা কেটে দিতে। রক্ষণশীল, নিয়মতান্ত্রিক হাওয়ায় মোক্ষণ ঘটে না সাহিত্যের। রুশ সাহিত্যও এক পর্যায়ে এসে স্তিমিত হয়ে গেছে। অন্যদিকে সামরিক জান্তার লৌহনিগড় সহ্য করে লাতিন আমেরিকার সাহিত্য সিঞ্চিত করেছে প্রাণরস। অতএব বিপ্লবের চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সমকালকে চেনা, তাকে অনুভব ও অধ্যয়নের ক্ষমতা। রবিনসনের উত্তরসূরীরা তা আয়ত্তে এনেছে; ফরাসী, জার্মারী, রুশ এমনকি আমেরিকানরাও তাদের সংস্কৃতি স্বয়ংক্রিয় এক আত্মশক্তিতে পূর্ণ হয়ে উঠেছে দিন দিন। আমরা সেই শক্তিকে আত্মস্থ করে বেড়ে উঠতে পারিনি। পারিনি সে আমাদের দৌর্বল্য। দৌর্বল্য কোথায়? হৃদয়ে-মননে, আমাদের চিন্তায় ও ভাবে। পরাধীনতার শৃঙ্খল, সীমাবদ্ধতার শিকল কাটতে যেয়ে আমরা প্রতিবাদের শক্তিকে জরুরী ভেবেছি; হৃদয় ও বুদ্ধির সংযোগ, তার প্রস্তুতিকে তেমন একটা পাত্তা দেইনি। অথচ প্রতিবাদী স্বভাব আসলে প্রতিকূল প্রকৃতির দান। যে ভূ-খণ্ডে আমাদের বসবাস তা যুগে যুগে খরা-বন্যা-মহামারীর শিকারে পরিণত হয়েছে। আমরা এসবের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি এক অন্তর্গত দায়িত্বের তাগিদে। একই দায়িত্ব আমরা বোধ করেছি সামন্ত প্রভু বেনিয়া শাসক ও অত্যাচারী নৃপতিদের বিপক্ষে লড়াই দিতে যেয়ে। প্রকৃতির আকস্মিক উৎপাতের মতোই এরা সময়ে আসময়ে আমাদের বিব্রত করেছে, বিপর্যস্ত করার চাল কষেছে, চাল কষছে। ঘর পড়ো-পড়ো হলে গৃহস্থ জান বাঁচানোর তাগিদে সে ঘর পুনরায় মেরামত করে নেয়। আমাদের প্রাণ ও ধন-মান দুটোই বাঁচানোর তাড়া ছিল যার কারণে আমরা লড়ে গেছি, এখনও যাচ্ছি। তাই আমাদের রাজনীতি কিংবা অর্থনীতিকে অবলম্ব ধরে ক্ষেপে ওঠা রক্ত ঢেলে দেয়ার শৌর্য বীরত্ব আছে, মহত্ত্ব নেই। আমাদের লড়াই প্রায়শই উপর-কাঠামোর সাথে ক্রিয়াশীল থাকে; সে কামড় বসাতে পারে না মৌল কাঠামোয়। আমরা তাই অনিবার্যভাবে অবক্ষয় ও যান্ত্রিকতার কাছে অসহায় হয়ে পড়ি; হৃদয় ও কর্মের সমন্বয় সাধনে হই ব্যর্থ-- আমাদের সাহিত্যে সেই ব্যর্থতার ঝিলিক আছে যা সমগ্র বিশ্বের সঙ্গে আমাদের লেনদেনের ক্ষেত্রে অন্তরায় সৃষ্টি করেছে; তুলে দিয়েছে একের পর এক বাধার ব্যারিকেড।

দ্বিধা-দ্বন্দ্বের সূচীমুখ, প্রেক্ষিত রবীন্দ্রনাথ
বিশ্ব সৃষ্টিকর্তা একা, সৃষ্টি কাজে আমার আহ্বান
বিরাট নেপথ্যালোকে তাঁর আসনের ছায়াতলে
[রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]

চলার পথে বাধা থাকে, ব্যারিকেড থাকে-তা সরিয়ে না হয় ভেঙে এগিয়ে যায় মানুষ। আমরা যে খুব এগিয়ে যেতে পারলাম না তার প্রধান কারণ বোধ হয় এই যে, আমাদের অন্তরে এবং বাহিরে আছে ফাঁকির খেলা। পশ্চিমা অর্থাৎ পাশ্চাত্য সভ্যতার অধিবাসীদের সাথে অমাদের ভেদ-বিভেদের সীমারেখাটা এখানেই। সে সীমারেখায় আমরা নিজেদের স্বভাবজ কিছু বৈশিষ্ট্যকে প্রতিফলিত করে চলেছি। এই যেমন পশ্চিমারা কর্মপটুই শুধু নয়, তারা জ্ঞানের জন্য সুবৃহৎ একটি ভাব ও মনীষার জন্য অনায়াসে জীবনবাজি রাখতে পারে। এক কালে তাদের কর্ম কুমোরের চাকায় গড়া ছিল, আজ সে যন্ত্রের ঘাড়ে সওয়ার হয়েছে। সেই কর্মে সভ্যতার বেগ ও আবেগ দু’ই আছে। আপনাকে নানা ভাবে নানা ঢঙে নানা ভঙ্গিতে সৃজনেই তার আনন্দ। পক্ষান্তরে আমরা বাঙালিরা মূলত বাক্যপটু; গড়ানো আড্ডার আসরে রাজ-উজির মেরে লম্বা কথার দৌড়ে অন্যকে পরাস্ত করে কিংবা নিজে পরাস্ত হয়ে চিরকালের বাঙালি হয়ে পড়ি। পশ্চিমাদের সাথে আমাদের তফাৎ তাই দুস্তর। সে তফাৎ গতি এবং প্রগতির। তারা প্রগতি বলতে বোঝে বিবর্তন-পরিবর্তনের সঙ্গে নিজের চলার গতিকে খাপ খাইয়ে নেয়া, অবিরাম ঊর্ধ্বারোহন। আত্মীকরণের ক্ষমতায় তারা গরীয়ান। তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা আমাদের পক্ষে দুষ্কর। যেমন দুষ্কার তাদের মনের অতলস্পর্শী গভীরতাকে অনুৃভব করা। কোনো এক অন্ধকার কক্ষে কোনো এক গোপন কোটরে সেই মনপাখিটি লুকিয়ে আছে যুগ যুগ ধরে। তাঁকে আমরা আজও দেখিনি কেবল তাঁর ডাক শুনেছি। সেই ডাকে যুগে যুগে আমাদের যুগান্তের স্থবিরতা টুঁটে গেছে। আমরা চোখ মেলে দেখেছি সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপারে সভ্যতার কি বিরাট যজ্ঞ চলছে। গাড়ি ছুটছে, পাখা ঘুরছে, জাহাজ ছুটছে, মিল চলছে আর মানুষ সেই চলার মধ্যে নিজেকে সাঁপে দিয়ে অন্য মানুষ হয়ে উঠছে। একদিকে সে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী অন্যদিকে রাষ্ট্রিক ও সামাজিক। তাদের সেই যজ্ঞের মশাল আমরা পাইনি, দেখেছি তার লেলিহান শিখা। তার ছোঁয়াচ আমাদের গায়েও লেগেছে। তার স্পর্শে আমরা শিউরে উঠেছি। আমাদের সনাতনী বিশ্বাসের পোশাক পুড়তে বসেছিল। পোশাক না হয়ে পুড়েছে কিছুটা কিন্তু মন? না আগুনের আঁচেও সে গলেনি। কারণ তার উপর পুরু হয়ে জমেছিল সংস্কারের আবর্জনা। আমরা যার অতলে নিজেরাই হারিয়ে গিয়েছি বার বার। পশ্চিমের মনপাখিকে খোঁজা তার কাছ থেকে গোপন মন্ত্র জেনে নেয়ার তাগিদ আমাদের ছিল; সামর্থ্য ছিল না। পাশ্চাত্য বিশ্ব ও আমাদের মধ্যকার বন্ধন কেবল বাহিরের বন্ধন। অন্তরের হার্দিক আবেগ সেখানে অস্পষ্ট। পাশ্চাত্যবাসীরা যেমন আমাদের বোঝে না, বোঝার চেষ্টা নেয় না তেমনি আমরাও তাদের মন-ভাব-কর্ম ইত্যাদির সমন্বয়-ক্রিয়াটাকে ধরতে পারি না। এমনকি রবীন্দ্রনাথ যে রবীন্দ্রনাথ তিনি পর্যন্ত পশ্চিমা সভ্যতার আধুনিকত্ব ও মেকিত্বের মধ্যে একটি পরিচ্ছন্ন প্রভেদ টানতে সক্ষম হননি। তাঁর চিন্তা ভাবনায়ও আসন গেড়েছিল প্রগতি এবং প্রতিক্রিয়াশীলতার বহু পুরাতন সূক্ষ্ম দ্বন্দ্বটি। আশি বৎসরের কর্মবহুল জীবনে প্রাচ্য-প্রতীচ্যের যোগ-সম্পর্ক আবিষ্কার করতে যেয়ে রবীন্দ্রনাথ তৈরি করেছিলেন দ্বিধা-স্ববিরোধিতা-রক্ষণশীলতা ও উদারতার এক জটিল মনস্তাত্ত্বিক ভুবন। তাঁর জীবনের বিভিন্ন পর্বে বিভিন্ন অধ্যায়ে এর পরিচয় মেলে। তিরিশ বছরে পা দেয়ার প্রায় বছরখানেক পূর্বে ১৮৯০ সালে দ্বিতীয়বারের মতো ইউরোপ গিয়েছিলেন তিনি। প্রায় আড়াই মাসের বিলাত ও প্যারিস সফরে তাঁর মনে হয়েছিল, পশ্চিমা সভ্যতার মানুষগুলো বৃহৎ একটি বস্তুকাঠামো নিয়ে পড়ে আছে, তারা উপেক্ষা বরছে বস্তুর ভিতরে স্পন্দিত মনকে। প্রযুক্তির বিবিধ আড়ম্বর, আয়োজন ও তার নানামুখী ব্যবহার চিন্তিত করে তুলেছিল তাঁকে। সেই চিন্তাকে গোপন করেননি তিনি। পরিষ্কার বলেছেন, “আমি কেবল দেখলুম জাহাজ চলছে গাড়ি চলছে লোক চলছে দোকান চলছে থিয়েটার চলছে পার্লামেন্ট চলছে-- সকলই চলছে। ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ সকল বিষয়েই একটা বিপর্যয় চেষ্টা অহর্নিশি নিরতিশয় ব্যস্ত হয়ে রয়েছে; মানুষের ক্ষমতার চূড়ান্ত সীমা পাবার জন্যে সকলে মিলে অশ্রান্তভাবে ধাবিত আছে।”৭ গতির এই প্রাবল্যে পীড়া বোধ করে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর ভয় ছিল এই আগ্রাসন আগামীতে পশ্চিমা সভ্যতার জন্যে বিপদ বয়ে আনবে, সে বাড়িয়ে তুলবে মানসিক অবসাদ, হয়তো জন্ম দেবে ভয়ষ্কর শ্রেণীবেষম্য এবং উৎপাদন করবে শূন্যতা। তাঁর ভয়-শঙ্কা মিথ্যা ছিল না; বিংশ শতকের বড় অংশ জুড়েই পশ্চিমা-সভ্যতার নানা অবক্ষয়, নৈতিক চেতনার স্খলন আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় সমাজ-সভ্যতাকে এই স্খলন থেকে বাঁচানোর গরজ অনুভব করেছিলেন। ইউরোপ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকে কথার মারপ্যাঁচে ঘুরিয়ে-প্যাঁচিয়ে তিনি যা বলেছিলেন তার সারাংশ মোটামুটি এরকম--প্রাচ্যবাসী বিশেষত ভারতের বাঙলি সমাজ পাশ্চাত্যের অনুসরণ করতে যেয়ে ডুববে তথাকথিত আধুনিকতার চোরাবালিতে। তারা হারাবে পৌরুষ এবং ঘরের নারীকে খোয়াবে বাইরে অর্থাৎ মিল-কারখানা-হোটেল-রেস্তোরাঁ মায় অফিসব-আদালতে। এর ফলে প্রাচ্য পারিবারিক-অবকাঠামো, তার মায়া-মমতার নিবিড় আচ্ছাদনটুকু যাবে ভেঙে আরনারী-পুরুষের ঘরে-বাইরে সমানাধিকারের নামে শুরু হবে নৈরাজ্য। নৈরাজ্য রবীন্দ্রনাথের বরবারের অপছন্দ। তিনি চান শান্তিপূর্ণ সমাধান। পাশ্চাত্যের মনহীন যস্ত্রের পেষণ থেকে নিজে বাঁচতে এবং আর সবাইকে বাঁচাতে চেয়ে রবীন্দ্রনাথ পশ্চিমাদের সাথে বাঙালিদের তুলনা করতে গিয়ে যা বলেছিলেন তাতে সত্যকে ছাপিয়ে উঠেছিল আবেগ। নিজেদের দোষ-ক্রটি দেখার কিংবা দেখানোর প্রচেষ্টা। ইতিপূর্বে বাঙলার জনজীবনকে নিকট থেকে পর্যবেক্ষণের সুযোগ তাঁর হয়েছিল। যদিও তা ছিল নিতান্তই খণ্ডিত। তখনও জমিদারির বোঝা তাঁর ঘাড়ে চেপে বসেনি পুরোদমে। সেই খণ্ডিত অনুভবে বাঙালি জনমানসের অবক্ষয়-হতাশা-ক্ষুধা-দারিদ্র্য-অভাব-যাতনা’র অবস্থান স্বচ্ছ ছিল না। পশ্চিমাদের তুলনায় আমরা বাঙালিরা জন্তু কি না এর উপর মন্তব্য করতে যেয়ে তাই বলতে পেরেছিলেন, “আমরা মিল পড়ি, রস্কিন পড়ি’, স্পেন্সর পড়ি, কেরানিগিরি করি, খবরে কাগজে লিখি, বই ছাপাই, ওই মাটির প্রদীপ জ্বালি, ঐ মাদুরে বসি, অবস্থা সচ্ছল হলেই স্ত্রীর গয়না গড়িয়ে দিই এবং ঐ দড়িবাঁধা মোটা মশারির মধ্যে আমি আমার স্ত্রী এবং মাঝখানে একটি খোকা নিয়ে তালপাতার হাতপাখা খেয়ে রাত্রিযাপন করি ওগো তবু আমরা জন্তু নই।”৭ জন্তু আমরা নই বটে কিন্তু তা’ বলে আমরা যে মানুষ তাই বা বলি কি করে? মোটা মশারির ভিতরে আমাদের জীবন হয়তো মিল-রস্কিন পড়ে তবে দুঃখ-দৈন্য--তিক্ততাকে চাপা দিয়ে। সে পড়ায় চেষ্টা আছে প্রাণ নেই, কৃত্রিমতা আছে স্বতঃস্ফুর্ততা নেই। তারপরও রবীন্দ্রনাথের মতো একজন বড় মাপের মানুষ সেই মশারির কথা ভাবেন। কেননা--ঐ বদ্ধ মশারিঘেরা আয়তনে পাশ্চাত্য সভ্যতা হতে নির্মোহ দূরত্ব বজায় রেখে প্রাচ্য তার বিশেষত্ব নিয়ে স্থির হয়ে আছে। রবীন্দ্রনাথ তাকে ধরে রাখতে আগ্রহী যেহেতু পশ্চিমে তিনি একটি মানবিক আবেদনে ঋদ্ধ শান্ত-মধুর-গভীর হৃদয় খুঁজে পাননি; হৃদয়ের ফুল ফুটতে দেখেননি। সেখানে মানুষের চলায়-বলায় যন্ত্রের বেগ আছে; নেই দু-দণ্ড জিরিয়ে নেয়ার মনের আবেগ। তাদের ভাব-চিন্তা দক্ষতা ও কর্মে সভ্যতার উৎকর্য সাধিত হলেও সবকিছুর পেছনে যে মানুষ তার দাঁড়াবার মাটি যাচ্ছে আলগা হয়ে। তাই “যদি আমার আশঙ্কা সত্য হয়, তবে যুরোপীয় সভ্যতা হয়তোবা তলে তলে জড়ত্বের এক প্রকাণ্ড মরুভূমি সৃজন করছে।”৭ কারণ “গৃহ, যা মানুষের স্নেহ প্রেমের নিভৃত নিকেতন, কল্যাণের চির উৎসভূমি, পৃথিবীর আর সমস্তই লুপ্ত হয়ে গেলেও যেখানে একটুখানি স্থান থাকা মানুষের পক্ষে চরম আবশ্যক, স্তূপাকার বাহ্যবস্তুর দ্বারা সেইখানটা উত্তরোত্তর ভরাট করে ফেলছে; হৃদয়ের জন্মভূমি জড় আবরণে কঠিন হয়ে উঠছে।”৭ ইউরোপ তথা পশ্চিমের দেহের ক্ষতকে তার মনের ক্ষত ভেবেছিলনে রবীন্দ্রনাথ। ভেবেছিলেন তার প্রাণরস শুকিয়ে গেছে উন্মাদ-বেগের দাপটে। সে-জন্যই হয়তো বা প্রাচ্যনিসর্গে নিজেকে জোর করে স্থাপনের একটা প্রবণতা তাঁর মধ্যে দৃশ্যমান। ১৮৯০-এ ২৯ বৎসরের আবেগকে নিষিক্ত করে বলেছিলেন, “আমি প্রাচ্য, আমি আসিয়াবাসী, আমি বাংলার সন্তান, আমার কাছে য়ুরোপীয় সভ্যতা সমস্ত মিথ্যেÑ আমাকে একটি নদীতীর, একটি দিগন্তবেষ্টিত কনকসূর্যাস্তরঞ্জিত শস্যক্ষেত্র, একটুখানি বিজনতা, খ্যাতিপ্রতিপত্তিহীন প্রচণ্ডচেষ্টাবিহীন নিরীহ জীবন এবং যথার্থ নির্জনতাপ্রিয় একাগ্রগভীর ভালোবাসাপূর্ণ একটি হৃদয় দা¬ও।৭ হৃদয়কে নিয়ে এই আবেগে প্রাচ্য মূল্যবোধের স্পর্শ আছে। অবশ্য স্পর্শ থাকাটা দোষের না। প্রত্যাকটি জাতির নিজস্ব আঞ্চলিক স্বাত্যন্ত্র্য থাকে। যার বৈশ্বিকতার মধ্যেও নিজের শিকড় হতে প্রাণরস শোষণ করে নেয়। যদি না সে শিকড় শুকিয়ে যায় সজীবতার জল না পেয়ে। আমাদের শিকড়ে পচন ধরেছিল অনেক আগেই। সে পড়েছিল অপমৃত্যুর কবলে; তার গোড়ায় নিয়মিত জল টালা, তাকে সতেজ করার জন্য মানুষের প্রয়োজন ছিল বৈকি। একজন নয় অনেক অসংখ্যা হৃদয়বান মানুষের উপস্থিতি জরুরী হয়ে উঠেছিল। কিন্তু আবেগ দিয়ে তো আর হৃদয় সৃজন করা যায় না; বিবেচনারও দরকার পড়ে। রবীন্দ্রনাথের জীবনের প্রথম-অধ্যায়ে (১৮৬১-১৮৯০) নিজের দিকে ফিরে দাঁড়াবার দৃপ্ততা প্রবল ছিল; জাতিগত দুর্বলতা শোধনের রৈবিক দৃঢ়তা ছিল না। উনিশশতকের সমাপ্তি দশকটির সূচনা পর্যন্ত মাটি এবং মানুষের সঙ্গে তার সম্পর্ক ততটা নিবিড় ছিল না। তখন পর্যন্ত তার একচোখ ঠাকুর বাড়িতে এবং অন্য চোখটি কলকাতা ও ইউরোপের বিদ্বৎসমাজে ন্যস্ত। যার ফলে মাটি মানুষ ও প্রকৃতিসম্বন্ধীয় তাঁর চিন্তাভাবনায় রোম্যান্টিকতা ছিল; ঠিক তীব্র ছিল না রিয়ালিটির পীড়ন। রবীন্দ্রনাথ বাংলার ও প্রকৃতির মধ্যে এক আশ্চর্য বেগ, সংযম ও সংরাগের উপস্থিতি লক্ষ্য করেছিলেন। তাঁর জীবনের মীড়ে মীড়ে যা আঘাত করেছে। ‘বাইসনের’ মতো ফুঁসে ওঠা কালো মেঘ আর ঘাটে জল আনতে যাওয়া বধূ পরস্পর বিপরীত মেরুতে দাঁড়ানো সত্বেও গতি এবং নম্রতার, বিস্তৃতি এবং ব্যাপ্তিতে তারা রাবীন্দ্রিক চিন্তাভুবনে এক নিবিড় ঐক্য-সম্মিলন তথা আরঞ্জনের সূচনা করেছিল, যা তাঁর বহু কাল-উত্তীর্ণ গল্প-কবিতা প্রবন্ধে ধরা দিয়েছে। যে-কারণে বলতে পেরেছিলেন, “লোকে অনেক সময়ই আমার সম্বন্ধে সমালোচনা করে ঘরগড়া মত নিয়ে। বলে, ‘উনি তো ধনীঘরের ছেলে ইংরেজিতে যাকে বলে রুপোর চামচে মুখ নিয়ে জন্মেছেন। পল্লীগ্রামের কথা উনি কি জানেন?’ আমি বলতে পারি আমার থেকে কম জানেন তাঁরা, যাঁরা এমন কথা বলেন।”৮ কেননা, “আমার যে নিরন্তর ভালোবাসার দৃষ্টি দিয়ে আমি পল্লীগ্রামকে দেখেছি তাতেই তার হৃদয়ের দ্বার খুলে গিয়েছে। আজ বললে অহংকারের মতো শোনাবে, তবু বলব আমাদের দেশের খুব অল্পলেখকই এই রসবোধের চোখে বাংলাদেশকে দেখেছেন। আমার রচনাতে পল্লী পরিচয়ের যে অন্তরঙ্গতা আছে, কোনো বাধাবুলি দিয়ে তার সত্যতাকে উপেক্ষা করা চলবে না। সেই পল্লীর প্রতি যে একটা আনন্দময় আকর্ষণ আমার যৌবনের মুখে জাগ্রত হয়ে উঠেছিল, আজও তা যায়নি।”৮ ১৯৩৯ সালে উচ্চারিত এ উক্তি থেকে বোঝা যায় রবীন্দ্রনাথ নিজেকে একজন মরমীবাদীর পোশাকে হাজির করতে যেয়ে বাস্তবের রূঢ়তা ও তিক্ততাকে কিছুটা হলেও নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিতে দেখতে, দেখাতে চেয়েছেন। কবিতায়-গল্পে প্রকৃতির প্রতি তাঁর এক ধরনের উন্মার্গীয় তীব্রতা ছিল যা শৈল্পিক নৈপুণ্যে ভাস্বর কিন্তু জীবনের আদর্শ ও বাস্তবের মধ্যে তা অতীন্দ্রিয় রহস্য এবং ঘগন বিষাদ বা সুখাবেশের সৃষ্টি করে। এ বোধই বোধ হয় তাঁর শেষ জীবনের ক্যানভাস-তুলি-রঙ হাতে নেয়ার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। গল্প-কবিতার বাইরে যেয়ে প্রবন্ধ এবং উপন্যাসেই রবীন্দ্রনাথকে আমরা অনেক বেশি স্বচ্ছ এবং বিশ্লেষকরূপে পাই। গল্পের পাশাপাশি প্রবন্ধ উপন্যাস এবং নাটককে এনে দাঁড় করালে আমরা বিপরীতমুখী দুই রবীন্দ্রনাথকে পাই। একদিকে তিনি বাস্তবের সাথে সংশ্লিষ্ট হয়েও শেষপর্যন্ত আদর্শমুখীন, অন্যদিকে আদর্শকে ব্যক্ত করতে যেয়ে তিনি বাস্তবমুখীন। এবং এই উভয় পথের সংঘর্ষ আমারা তাঁর জীবনের প্রথম পর্বেই পাই; তবে প্রায় শেষ লগ্নে। যখন আস্তে আস্তে জমিদারির বোঝা তাঁর মাথায় চেপে বসতে যাচ্ছে এবং তিনি বেশ দীর্ঘ সময়ের জন্যে আস্তানা গাড়তে চলেছেন পুর্ববঙ্গে, পদ্মার তীরে। মাটি ও মানুষের ব্যাপক নৈক্যট্যে এ সময়ই তাঁকে আসতে হয়েছিল। পূর্বের মতো ছাড়া-ছাড়া ভাবে নয়, ব্যাপকভাবে এবং ব্যাপক সংযমে। হৃদয়ের আবেগকে সেখানে খুব বড় করে দেখার সুযোগ ছিল না। তাতে স্থান পাচ্ছিল অভাব-ক্ষুধা-যাতনা সম্পর্কে অভিযোগ অনুযোগ বেদনা সর্বোপরি বিবেচনা। তিনি দেখছিলেন জীবনের টুকরো টুকরো ঘটনা, এও দেখছিলেন কি নির্মম যাতনা বুকের খাঁচায় পুষে এরা দিন যাপন করে চলেছে। তাঁকে বিচলিত করে তুলেছিল মানুষের ভয়াবহ দারিদ্র্য। সেই দরিদ্র জনসাধারণের দায়ভার বহনের ক্ষমতা ‘ক্রিম অফ ক্যালকাটা’ এই কবির ছিল না। তবে শোষণের স্বরূপটা ক্রমে পরিষ্কার হয়ে আসছিল তাঁর কাছে; তিনি দাঁড়াতে চাচ্ছিলেন মাটির উপর। যার শুরু জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায় (১৮৯১-১৯২১)। এ পর্বে এসে এক বৃহত্তর উপলব্ধিতে আপনাকে বিন্যস্ত করার তাগিদেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর চিন্তা ও কাজের ভেতরে একটা ভারসাম্য আনতে সচেষ্ট হন। আমরা শুনি- “আমাদের ভদ্রসমাজ আরামে আছে কেননা আমাদের লোকসাধারন নিজেকে বোঝে নাই এই জন্যই জমিদার তাহাদিগকে মারিতেছে, মহাজন তাহাদিগকে ধরিতেছে, মনিব তাহাদিগকে গালি দিতেছে, পুলিশ তাহাদিগকে শুষিতেছে, গুরুঠাকুর তাহাদের মাথায় হাত বুলাইতেছে, মোক্তার তাহাদের গাঁট কাটিতেছে আর তাহারা কেবল সেই অদৃষ্টের নামে নালিশ করিতেছে যাহার নামে সময়-জারি করিবার জো নাই।”৯ বিপুল এই লোকসাধারণের মুক্তির জন্য প্রয়োজন ছিল যাবতীয় প্রথাচার, রাজশক্তি ও সাম্যাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই এবং শিক্ষা ও বৈজ্ঞানিক চেতনার বিকাশ। যা আসতে পারে একমাত্র কর্মশক্তির জোরে। কর্মশক্তি বাড়বে কিভাবে? যন্ত্রের প্রায়োগিক উপযোগিতা সৃষ্টি করা ছাড়া অন্য কোনো পথ আছে কি? রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পারছিলেন কর্ম একমাত্র কর্মই এই বিপুল জনগোষ্ঠীর চোখ খুলে দিতে পারে। সেই প্রেরণা থেকেই পুত্র রথীন্দ্রনাথকে পরে আমেরিকা পাঠিয়েছিলেন কৃষি-বিদ্যায় আধুনিক জ্ঞান লাভ করে আসার জন্য। শান্তিনিকেতনকে ক্রমসম্প্রসারিত করার পেছনেও কাজ করেছিল স্বদেশের মঙ্গল চিন্তা; যুগপৎ কর্ম ও আত্মশক্তির উদ্বোধনের তাড়না। দেখা যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথ নিজের প্রয়োজনেই পাশ্চাত্য সভ্যতার দুয়ারে হাত পাতছেন। প্রাচ্যের দেয়ার ক্ষমতা যে সীমিত হয়ে এসেছে এটা না মেনে উপায় ছিল না তাঁর। আমরা দেখি রবীন্দ্রনাথ জীবনের এই পর্বে একই সাথে আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক, বিনয়ী এবং প্রতিবাদী সর্বত রাজনীতিসচেতন হয়ে উঠছিলেন। জেগে উঠছিলেন রাজনীতির নিজস্ব বিশ্বাসের তাপে। তার চাইতেও বড় কথা মানুষ তাঁর সমস্ত মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণতি পাচ্ছিল। বিশেষ করে আর্থ-সামাজিক এবং রাষ্ট্রিক পরিবেশে বিপর্যস্ত মানুষের মনোবিকার তাঁকে আলোড়িত করেছিল। যার থেকে এ বিশ্বাসে তিনি উপনীত হয়েছিলেন যে, মানুষের কর্মের ও ভাবের নিবিড় ঐক্য-বন্ধন স্থাপিত হয়নি। আর হয়নি বলেই দেশে দেশে, জাতিতে জাতিতে শোষণের পথটা এত সরল এত উন্মুক্ত। আমাদের বাঙালি জীবনে এর আক্রমণ চরম থেকে চরমতর হয়ে পড়ছিল। একে ঠেকানোর ক্ষমতা আমরা রাখি না, যেহেতু “মনোজীবন আমাদের মধ্যে পরিণতি লাভ। করে নাই-- আগাগোড়া বাঁধিয়া যায় নাই। বেদনা ও বেদনার আভাস সে অনুভব করে, কিন্তু তাহার স্থায়িত্ব নাই। অনুভূতি হইতে কার্যসম্পাদন পর্যন্ত অবিচ্ছেদ্য যোগ ও অনিবার্য বেগ থাকে না। কাজের সহিত ভাবের, ভাবের সহিত মনের সচেতন নাড়ীজালের সজীব বন্ধন স্থাপিত হয় নাই।”১০ আমাদের চিন্তায় ও কর্মে সামঞ্জস্যের অভাব আছে। অভাবটা ব্যথিত করে ছিল রবীন্দ্রনাথকে। সেই ব্যথাকে তিনি মেলে ধরেছেন তাঁর সৃষ্টি ও কর্মে। তাঁর ব্যক্ত মতানুসারে আমরা বলতে পারি, রবীন্দ্রনাথ চান সংযোগ: দেহ ও মনে, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে, অতীত ও বর্তমানে। পাশ্চাত্যের কর্মের দিকটা আমরা নেবো তবে নগদানগদি নয় তাতে প্রাচ্যের নাড়ীর যোগটা সংযোজিত হবে অর্থাৎ “সমস্ত পৃথিবীর সঙ্গে ব্যবহার বন্ধ করিয়া, একঘরে হইয়া দুই বেলা দুই মুঠা ভাত বেশি করিয়া খাইয়া নিদ্রা দিলেই তো আমাদের চলিবে না। সমস্ত পৃথিবীর সঙ্গে দেনা পাওনা করিয়া তবে আমরা মানুষ হইতে পারিব। যে জাতি তাহা না করিবে বর্তমান কালে সে টিকিতে পারিবে না।”১১ এই বোধ রবীন্দ্রনাথের বাস্তবনিষ্ঠা ও পর্যবেক্ষণ শক্তির প্রকাশ; প্রথমপর্বের আবেগ ও প্রাচ্য-রক্ষণশীলতার বিপরীত উচ্চারণ। কিন্তু তারপরও প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের বিরোধ মেটাতে তাঁর ভূমিকা কতখানি কার্যকর হয়েছে তা বিচার সাপেক্ষ, কেননা পশ্চিমাদের সাথে তিনি যে সম্বন্ধ পাততে চেয়েছিলেন তাতে স্থুল রাজনীতির দুর্গন্ধ ছিল না, কিন্তু বৈষয়িকতার আধিপত্য হৃদয়ের যোগকে প্রষ্ফুটিত হতে দেয়নি। পশ্চিমা বিশ্বের কেজো দিকটাকে রবীন্দ্রনাথ যত বৃহৎ আকারে দেখেছিলেন তার মনস্তত্ত্বকে তত ব্যাপক করে দেখেননি। তিনি দেখেছিলেন যন্ত্রের ঘানি টানতে যেয়ে পশ্চিম স্পষ্ট দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। গড়ে উঠেছে বণিক আধিপত্য আর শ্রম-পীড়নের বাজারী অর্থনীতি। রবীন্দ্রনাথ পুঁজিবাদের স্বরূপকে চিনতে পেরেছিলেন তবে সে চেনাটা সম্পূর্ণ ছিল না। সম্পূর্ণতা এসেছিল ১৯৩০ এর রাশিয়া ভ্রমণের পর। আপাতত রবীন্দ্রনাথ দেখতে পেয়েছিলেন, “শক্তির ধারাটা এখন ক্ষত্রিয়কে ছাড়িয়া বৈশ্যের কূলে বহিতেছে। লোকসাধারণের কাঁধের উপর তাহারা চাপিয়া বসিয়াছে। মানুষকে লইয়া তাহারা আপনার ব্যবসায়ের যন্ত্র বানাইতেছে। মানুষের পেটের জ্বালাই তাহাদের কলের স্টীম উৎপন্ন করে।”৯ অথচ “পূর্বকালের ক্ষত্রিয়নায়কের সঙ্গে মানুষের যে সম্বন্ধ ছিল সেটা ছিল মানবসম্বন্ধ। দুঃখ কষ্ট অত্যাচার যতই থাক, তবু পরস্পরের হৃদয়ের আদান প্রদান ছিল। এখন বৈশ্য মহাজনদের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধ যান্ত্রিক। কর্মপ্রণালী নামক প্রকাণ্ড একটা জাঁতা মানুষের আর-সমস্তই গুঁড়া করিয়া দিয়া কেবল মজুরটুকুমাত্র বাকি রাখিবার চেষ্টা করিতেছে।”৯ অথচ তাঁর এই চিন্তাধারা মার্কসীয় তত্ত্বের সাথে মিলে গেলেও শেষপর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ আদর্শ মানবতাবাদী একজন বুর্জোয়া মাত্র। ক্ষত্রিয়ের নিপীড়ন তাঁর কাছে অনেকটা সহনীয় কারণ সেখানে হৃদয় আছে; লোকসাধারণের সাথে যোগাযোগের সরল একটি পথ আছে। কিন্তু ক্ষত্রিয় বা বৈশ্য কেউই যে লোকসাধারণের মুক্তির উপায় নয় এবং ঐ যন্ত্রকে আশ্রয় করেই পশ্চিমে ব্যাপক-জনসাধারণ শিক্ষিত ও সচেতন হয়ে উঠছে তাকে উপেক্ষা করা রবীন্দ্রনাথের পক্ষেও সম্ভব হয়নি। নিজেই বলেছেন, “য়ুরোপে শ্রমজীবীরা যেমনি বলিষ্ঠ হইয়াছে অমনি সেখানকার বণিকরা জবাবদিহির দায়ে পড়িয়াছে।”৯ বস্তুত কৌশল এবং বলপ্রয়োগ পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার নিয়ামকশক্তি। সামষ্টিক লোকসাধারণকে জিম্মি হতে হয় সীমিতসংখ্যক বিত্তবান পুঁজিপতিদের হাতে। পূর্ণাঙ্গ পুজিবাদী সমাজে তাই পরিণত হয়েছে রেওয়াজে। বুর্জোয়া চরিত্রের পালাবদল সেখানে ঘটে কিন্তু শোষণের চেহারা পাল্টায় না। সব কিছু যেন একটি বিশাল বাজার অভিমুখে ছুটে চলে সেখানে। তাই একমাত্র অর্থ এবং কর্মের শক্তিকে মুখ্য মনে হওয়া স্বাভাবিক। রবীন্দ্রনাথও একটি ক্রমঅবনতিশীল, মন ও মানবতাবিহীন রাষ্ট্রিক কিন্তু শোষক বুর্জোয়া এলিট সমাজকে পাশ্চাত্যে প্রত্যক্ষ করে শিউরে উঠেছিলেন; তাঁর শাণিত চেতনা এর মধ্যে কর্মের বিকাশ দেখেছে; হৃদয় ও মনের ঔজ্জ্বল্য দেখেনি। একটি শুভ্র আবরণ কামনা করেছিলেন তিনি; পাশ্চাত্যের গতির উন্মাদনায় সে আবরণ খুঁজে পাননি। কিন্তু আবরণ আছে, তা আবিষ্কারের পথটা প্যাঁচালো। ঐ সামষ্টিক লোকসাধারণ যাতে মুক্তি পায় অন্তত তাদের বাঁচাবার আকাক্ষা থেকে পশ্চিমা সভ্যতা পৃথক একটি পথ সৃজন করে নিয়েছে। যাঁরা এ পথের যাত্রী তাঁরা কেউই পুঁজিবাদী সমাজ-ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতে পারেননি। তাঁরা ছিটকে পড়েছেন বারবার। যেহেতু একটু আমূল বুর্জোয়া কাঠামোয় সংহত হয়েও পশ্চিমা লোকসাধারণ এবং বুদ্ধিজীবী মহলের মধ্যে একটি যোগাযোগের সেতু তাঁরাই তৈরি করেছেন। তাঁদের বুর্জোয়া পরিচয় ছাপিয়ে মানুষ পরিচয়টাই দিন দিন মুখ্য হয়ে উঠেছে। তাঁদের কর্মে কেবল কর্মের নয় হৃদয়ের শিক্ষাও ছিল। যে শিক্ষা জন্ম দিয়েছে বিপ্লব, চিরচেনা পথে এঁকে গেছে পরিবর্তনের চিহ্ন। যে পরিবর্তনের গভীরে পশ্চিমা-সভ্যতার মনপাখিটি বসে আছে। যুদ্ধ শোষণ কিংবা নির্যাতনের মাধ্যমে যারা তাকে বাঁধতে চায় তাঁদেরকে সে ধরা দেয়নি কখনো। তাকে সংগোপনে বয়ে বেড়ান প্রাগ্রসর চিন্তানায়কেরা। বাঁচিয়ে রাখেন লোকসাধারণের খাঁচায়। মনপাখি কথা বলে বলেই ধ্বংস অমানবিকতা-শোষণপীড়নের আবর্জনা থেকে মাথা তুলেছিল ইউরোপ। সময়ের অনিবার্য সংঘটনকে মেনে নিয়ে, পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের গ্রহদোষটাকে সমালোচনা করে নতুন পথের নিশানা তার চিন্তানায়কেরা বারেবারেই উড়ান। শোষণের যে স্থায়ী-অবসান রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন, যে হৃদয়ের বিকাশ ও পূর্ণতার স্বপ্ন দেখেছিলেন পশ্চিমা সভ্যতার নাগরিক-- বৈশিষ্ট্যে তা আজও আকার পায়নি। পাওয়া সম্ভবও না। কেননা পৃথিবীতে প্রত্যেকটি আদর্শই এক ধরনের ইউটোপিয়ার জন্ম দেয়; মানুষের স্বভাবজ সীমাবদ্ধতা ভেঙে অতদূর যাওয়া দুষ্কর। তাই প্লেটোর বক্তব্য অনুসারে বলা উচিত, আমাদের লক্ষ্য আদর্শকে বাস্তকে পরিণত করা নয়। ঐ বাস্তবকে আদর্শের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া। রুশ বিপ্লব এই পথ ধরে এসেছিল বলেই রাশিয়া চমৎকার একটি আদর্শ গড়ে নিতে পেরেছিল; রবীন্দ্রনাথ আশান্বিত হয়ে উঠেছিলেন তা দেখে। কিন্তু লেনিনের মৃত্যুর পর থেকে রাশিয়া পদ্ধতি পাল্টে ফেলে আদর্শকে বাস্তবে রূপ দিতে চাইল। এবং যে-যন্ত্রকে ভয়ের চোখে দেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ সেই যন্ত্রই-কি দ্বিতীয়-বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী রাশিয়াকে গ্রাস করেনি? শ্রমিক শ্রেণীর নিরঙ্কুশ একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি আদর্শ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র-সাম্য গড়ার জন্য সেভিয়েতের প্রাচীন স্থবির সমাজ ব্যবস্থার সাথে একগুঁয়ে, জেদী এবং অবাধ্য সংগ্রামে লিপ্ত হওয়ার কথা বলেছিলেন লেনিন। The dictatorship of the proletariat,” “is a stubborn struggle-bloody and bloodless, violent and peaceful, military and economic, educational and adminstrative –against the forces and traditions of the old society12 হ্যাঁ, স্টালিন সেটা করতে সক্ষম হচ্ছিলেন। কিন্তু যে পথে উন্নয়ন এসেছিল তা রাশিয়ায় অর্থৗনতিক সমৃদ্ধির নিশ্চয়তা নিয়ে এলেও সংকট কি তৈরি করেনি? করেছে বৈকি। আমলাতন্ত্রের প্রসার বেড়েছে, কৃষকরা উন্নত প্রযুক্তি পেলেও সুষম সমবায় নীতিকে নিজে অঙ্গভূত করতে পারেনি। তার চেয়েও বড় ব্যর্থতা হচ্ছে ক্রমপ্রসারমান যান্ত্রিক শ্রমিক এবং আমলা এ-দুটো স্পষ্ট শ্রেণীর বিকাশ ঘটিয়েছিল; যার অন্তর্মুখী সংঘাতের জের রাশিয়া টেনেছে এই সেদিন তক্। অর্থাৎ সংকটের, সংঘাতের অবসান কখনই এ পৃথিবী থেকে মুছে যাবে কিনা তা আজও তর্কসাপেক্ষ। এই তর্কের জোয়ারে ভাসমান বিশ্বে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন কিছু সনাতন ধ্রুব বিশ্বাস আঁকড়ে পড়ে থাকা একজন মহৎ মানুষ। তিনি কবির চোখে নিয়ে কল্পনা করতেন উচ্চ আত্মিক-আদর্শের আর বাস্তবের ক্ষত-যন্ত্রণায় বিক্ষত হয়ে খুঁজতেন নিরাময়ের ঔষধ। যা তাঁকে পরিণত করেছিল একজন সংঘাততাড়িত আত্মমগ্ন মানুষে; পাশ্চাত্যবাসীরা যে মানুষকে ভাবতো সন্ত বা ঋষি। আসলে পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের ভয়াল আগ্রাসন রবীন্দ্রনাথকে এতটাই বিপর্যন্ত করে তুলেছিল যে তিনি মানবসভ্যতার উপর বিশ্বাস হারাতে বসেছিলেন। পাশ্চাত্যের শরীর হাতড়ে একটি মনকে তিনি তাই আবিষ্কার করতে পারেননি; সে ধৈর্য্যও তাঁর ছিল না। তবে জীবনের তৃতীয়-পর্বে (১৯২১-১৯৪১) এসে ধীরে ধীরে ধীরে একটি অপেক্ষাকৃত স্থির-নিশ্চিত বিশ্বাসে তিনি এগিয়ে চলেছিলেন। স্বীকার করেছিলেন অমানবিকতার মধ্যেও পশ্চিমা সভ্যতার একটি নিজস্ব অবলম্বন আছে। এই নিজস্বতাই হয়তো তার মানবিক মূল্যবোধকে লালন করে তাকে বাড়িয়ে তুলবে। তাই দীনবন্ধু এন্ডুজের প্রসঙ্গ টেনে যা বলেছিলেন তা গোটা পশ্চিমা সভ্যতার মনস্বী মানুষ সম্বন্ধেও বোধ হয় প্রযোজ্য। বলেছিলেন, “এঁদের পরিচয় আমার জীবনে একটি শ্রেষ্ঠ সম্পদরূপে সঞ্চিত হয়ে রইলো। আমার মনে হয়েছে ইংরেজের মহত্ত্বকে এরা সকলপ্রকার নৌকাডুবি থেকে উদ্ধার করতে পারবেন। এঁদের যদি না দেখতুম এবং না জানতুম তাহলে পাশ্চাত্য জাতি সম্বন্ধে আমার নৈরাশ্য কোথাও প্রতিবাদ পেতনা।”১৩ জীবনের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এ-পর্বে এসে রবীন্দ্রনাথকে মানব সভ্যতার উপর স্থির-নির্দিষ্ট এবং সত্য বিশ্বাসে উপনীত হতে দেখে আমাদের আশা জাগে। এ বিশ্বাস অর্জনে সহায়ক হয়েছিল পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের এবং স্বদেশের খেয়ালি রাজনৈতিক আচার-আচরণের মত্ততা। এ-সবই তাঁকে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে বাধ্য করেছিল যে, আগ্রাসন ও নিপীড়ন, কৃত্রিমতা ও স্থবিরতার কোনো জাতি-অঞ্চল ভেদ নেই। সে সর্বত্র আসন গাড়তে পারে। তাই সর্বত্র একই সাথে তার শোধন-পরিশোধন কাম্য। এ বিশ্বাস তিনি অর্জন করেছিলেন বেশ কয়েকবারের জাপান সফর থেকে। ১৯৩৩ সালে বিষাদাক্রান্ত কণ্ঠে বলেছিলেন, “নতুন যুগের মানুষের সব জাগ্রত চৈতন্যকে অভ্যর্থনা করবার ইচ্ছায় একদিন পূর্ব এশিয়ায় বেরিয়ে পড়েছিলুম। দেখলুম জাপান য়ুরোপের অস্ত্র আয়ত্ত করে একদিকে নিরাপদ হয়েছে, তেমনি অন্যদিকে গভীরতর আপদের কারণ ঘটলো তার রক্তে প্রবেশ করেছে যুরোপের মারী, যাকে বলে ইম্পীরিয়ালিজম, সে নিজের চারদিকে মথিত করে তুলছে বিষ।”১৪

“এল ওরা লোহার হাতকড়ি নিয়ে
নখ যাদের তীক্ষ্ণ তোমার নেকড়ের চেয়ে, এল মানুষ ধরার দল
গর্বে যারা অন্ধ তোমার সূর্যহারা অরণ্যের চেয়ে
সভ্যতার বর্বর লোভ
নগ্ন করল আপন নির্লজ্জ অমানুষতা।
[আফ্রিকা, পত্রপুট]


সাম্রাজ্যবাদের সীমাহীন বর্বরতার বিরুদ্ধে কবির দৃপ্ত উচ্চকিত স্বর তাঁর বিশ্বাস ও মানবতাকে প্রমাণ করলেও প্রশ্ন জাগে তিনি এ থেকে মুক্তির কোনো পথ আমাদের দিয়ে যেতে পেরেছিলেন তিনি না? তাঁর সমগ্র-জীবনে যে বহুবিস্তৃত অধ্যায়সমূহ সেখানে রবীন্দ্রনাথকে, প্রতিবাদী এবং প্রতিরোধীর ভূমিকায় দেখা গেলেও ঠিক বিপ্লবী একটি লক্ষ্য আমরা পাই না। তিনি যেন দূর থেকে সব কিছুর একটা সমাধান বাতলে দিয়ে চেয়েছেন। তাঁকে আমরা মাটি ও মানুষের মধ্যে, সভ্যতা ও সমাজকাঠামোর মধ্যে স্বেচ্ছাবিহারী হিসাবে পাই না। তবে মানবিক চেতনার একটি অবিস্মরণীয় আমেজ পাই যখন তাঁর কণ্ঠে বাজে--

দুঃখ সহার তপস্যাতেই হোক বাঙালির জয়--
ভয়কে যারা মানে তারাই জাগিয়ে রাখে ভয়,
মৃত্যুকে যে এড়িয়ে চলে মৃত্যু তারেই টানে,
মৃত্যু যারা বুক পেতে লয় বাঁচতে তারাই জানে।


একই কণ্ঠ ব্যাপ্ত হয় জীবনের মেষ মুহূর্তগুলোতেও। আত্মবিশ্বাসে অনুরণন ওঠে, “আশা করবো, মহাপ্রলয়ের পরে বৈরাগ্যের মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের একটি নির্মল আত্মপ্রকাশ হয়তো আরম্ভ হবে এই পুর্বাচলের সুর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে আর একদিন অপরাজিত মানুষ নিজের জয়যাত্রার অভিযানে সকল বাধা অতিক্রম করে অগ্রসর হবে তার মহৎ মর্যাদা ফিরে পাবার পথে।”১৩। তাঁর এ আশাবাদকে স্বাগত জানিয়েও কিছুটা স্পর্ধা রেখে বলতে হয়, রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে আমরা আত্মশক্তিতে উঁচু ও ঋজু হয়ে দাঁড়াবার শিক্ষা পেলেও সময়ের ওলোট-পালোট ঘটনাপ্রবাহকে মানিয়ে নূতন পথসৃজনের দিকনির্দেশনা পাইনি। পেয়েছি স্থির, স্পষ্ট, আবরণহীন, উন্মুক্ত, সরল কিন্তু সুষম রবীন্দ্রনাথকে; পেয়েছি ভাবুক, মরমী, রহস্যময় এক রবীন্দ্রনাথকে। এই রবীন্দ্রনাথ সংঘাত চান না, দুঃখের স্থূল পীড়ন চান না, আবার অমানুষিক কর্মোদ্দীপনাও তাঁর অপছন্দ। তিনি চান অল্প ব্যথা অল্প আঘাত অল্প পীড়ন এবং এর মধ্য থেকে স্রোতস্বিনী অথচ সহনীয় আনন্দের ফল্গুধারা। রবীন্দ্রনাথ চান, স্নেহ-মায়া-মমতা-প্রেম-ভালবাসা’র একটি উদ্যান। সেখানে সমস্যা হচ্ছে, তাঁকে সমগ্র দিয়ে বুঝতে হয়। গল্প-উপন্যাস-নাটক-কবিতা-গান-প্রবন্ধ-চিত্রকলা এমনি কি ধর্ম-রাষ্ট্র ও বিজ্ঞান চিন্তায় তাঁর বহুমুখী প্রবাহ ভাব এবং কর্মের মধ্যে এমন একটি অন্তর্মুখী সংঘাত তৈরি করেছে যে সমকাল এবং আগামীকালের পক্ষেও তাঁকে নিয়ে প্রগতি ও প্রতিক্রিয়াশীলতার দ্বন্দ্ব-বিরোধ থেকে যাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। একটি জাতির মনোচেতনায় এর প্রভাব, তার ইতি-নেতির প্রশ্নটি এর সঙ্গে জড়িত। জড়িত পশ্চিমা সাহিত্যের সঙ্গে আমাদের পার্থক্য ও সমকক্ষতার প্রশ্নটিও।

সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি
১। J. Keats, ‘The Terror of Death’, The Golden Treasury, Oxford University Press P. 198. ১৯৮.
২। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘অতসীমামী ও অন্যান্য গল্প’, মানিক গ্রন্থাবলী (১) পৃ: ২৫৭। গ্রন্থালয় প্রাইভেট লিমিটেড।
৩। ২৭ শ খণ্ডে প্রকাশিত কালাম-ইউহোন্না খণ্ডের ২২ অধ্যায়ের ১৭শ আয়াত ইঞ্জিল শরীফ পৃ: ৭১৭। মথি খণ্ডের ৬’ অ্যধায়ে ২২ এবং ২৩শ আয়াত-ঐ পৃ: ১৪।
৪। মার্কস-ইঙ্গেলস, ‘কমিউনিষ্ট পার্টির ইশতেহার’ পৃ: ৩৮। প্রগতি প্রকাশন, মস্কো।
৫। উইল ডুরান্ট, দর্শনের ইতিকাহিনী, অনু: আবুল ফজল পৃ: ৩০৬। বাংলা একাডেমী ১৯৮০।
৬। ম্যাক্সিমগোর্কি, ভূমিকা, আন্তন চেখভ (গল্প ও ছোট উপন্যাস) পৃ: ১৮। রাদুগা প্রকাশন তাসখন্দ। চেখভের সৃষ্টি কর্মে আমরা একটি নরম কোমল কিন্তু বিষন্ণ-পরিহাসপ্রিয় অথচ প্রতিবেশতাড়িত মানুষের সাক্ষাৎ পাই। মানুষ যে নীরস-একঘেয়ে ক্লান্তিকর জীবনে নিজেকে ক্ষয় করে চলেছে তা দেখাতে এবং তাকে সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যেই চেখভ হাতে নেন বিদ্রুপ, পরিহাস আর কৌতুকের কঠিন চাবুক। তাই জীবনের লক্ষ্য সম্বন্ধে তাঁর স্পষ্ট উচ্চারণ কঠোর কায়িক শ্রম থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে হবেই। ওদের বোঝা হালকা করে দিতে হবে, যাতে তারা হাঁফ ফেলবার অবকাশ পায়, যাতে ওদের সমস্ত জীবনটা কেবল চুল্লীর সামনে, ধোবীখানায় কিম্বা মাঠে খাটিতে খাটতে না কেটে যায়, যাতে তারা নিজেদের আত্মার কথা, ঈশ্বরের কথা চিন্তা করারও অবকাশ পায় এবং তাদের আধ্যাত্মিক শক্তিকে বিকশিত করার সুবিধা পায়।” [দ্র: বনেদী বাড়ি(শিল্পীর গল্প) পৃ: ২৬০-ঐ] যার ফলে “মানুষ যখন অনুভব করবে তার সত্যিকার ব্রত কি, তখন তার তৃপ্তি হতে পারে একমাত্র ধর্ম বিজ্ঞান আর শিল্পে, এসব বাজে জিনিসে নয়।” [ঐ]
৭। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি, পৃ: ৩৭। বিশ্বভারতী প্রকাশনা।
দ্বিতীয়বার বিলাত-যাত্রায় রবীন্দ্রনাথ যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন এবং কিছু জিজ্ঞাসা তাঁর মনে এমন গেড়ে বসে যায় প্রভাবে প্রাচ্য পারিবারিক কাঠামো নিয়ে তিনি চিন্তান্বিত হয়ে পড়েন। পাশ্চাত্যের জন ষ্টুয়ার্ট মিলের ও অন্যান্য অনেকের চিন্তাধারার সাথে ঐক্যে আসতে পারেননি রবীন্দ্রনাথ। তাই একটু ঘুরিয়ে বলেছিলন, “যদিও বিদেশীয় সমাজ সম্বন্ধে কোনো কথা নিঃসংশয়ে বলা ধৃষ্টতা, কিন্তু বাহির হতে যতটা বোঝা যায় তাতে মনে হয় য়ুরোপে সভ্যতা যত অগ্রসর হচ্ছে স্ত্রীলোক ততই অসুখী হচ্ছে।” [দ্র:-য়ু-যা-ডা পৃ: ৪০] রবীন্দ্রনাথের কাছে নারী কেন্দ্রানুগ শক্তি। সে পরিবার কাঠামোকে ধরে রাখবে তার স্নেহ মমতা ও ভালবাসা দিয়ে। তার আধুনিকতার পরিমাপ করা হবে পরিবার ও মূল্যবোধের প্রতি তার আকর্ষণ ও দায়বদ্ধতা থেকে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ফলে পশ্চিমের সভ্যতা নারীকে কেন্দ্রানুগ না রেখে কেন্দ্রাতিগ হতে বাধ্য করছে-“তা আমার মনে হয় আমাদের সামজের যে রকম গঠন তাতে সমাজে ভালোমন্দ যাই হোক আমাদের স্ত্রী লোকেরা বেশ এক রকম সুখেই আছে।” [য়ু-যা-ডা পৃ: ৪৮]
অথচ পশ্চিমা সমাজে পরিবারে স্বাভাবিকবৃত্তি নষ্ট হয়ে পড়ায় মেয়েদের মৌচাক ভেঙ্গে যাচ্ছে। তবে এ রক্ষণশীল প্রাচ্য মনোভাবের পরও সভ্যতার গতি ও তার দাবি রবীন্দ্রনাথ এড়াতে পারেননি। তাই বিবিধ সমালোচনার পরও স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন, মেয়েদের বেরিয়ে আসার এবার সময়, কেবল মাত্র পরিবার-প্রতিপালন আমাদের একমাত্র কাজ বলে ধরে নিলে চলবে না।” [য়ুৃ-যা-ডা পৃ: ২৮১] সুতরাং “মেয়েদের অবস্থারও পরিবর্তন আবশ্যক। এখন কেবল তাদের গৃহের সামগ্রী করলে জলবে না। তাদেরও জাগ্রত হয়ে আমাদের জাগ্রত করতে হবে।”[ঐ]
৭। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি, পৃ: ২৩৯/২২২।
৮। উৎস ও ব্যাখ্যান গল্পগুচ্ছের গ্রন্থপরিচয় দ্রষ্টব্য পৃ: ১০০৮। পুস্তকমালা বাংলাবাজার, ঢাকা।
৯। লোকহিত দীপিকা সংকলন গ্রন্থ পৃ: ৮২৩, বিশ্বভারতী গ্রন্থালয় ১৩৭১।
১০। বিদ্যাসাগর ঠা:, ঐ পৃ: ৩২৪। ঐ।
১১। ভূমিলক্ষী-ঐ পৃ: ৮২৯/ঐ।
৯। লোকহিত ঐ পৃ: ৪১২/৪২১/৪২৫। ঐ।
১২। Concerning Questions of Leninism (iv) J. V. Stalin-On the opposition, P. 300, Foreign Languages Press-Peking 1975./Work of xiv Conference of R. C. P (B) (Ma) ঐ
১৩। রবীন্দ্রনাথ, সভ্যতার সংকট, পৃ: ৬৫-৬৬। প্রবন্ধ সম্ভার, ১৯৮৩।
১৪। আহমদ রফিক, আরেক কালান্তরে- পৃ: ১১৭/ বাংলা একাডেমী ১৯৭৭।
বিখ্যাত ‘আফিকা’ কবিতাটি রচনারও পূর্বে রবীন্দ্রনাথ তাঁর মানবিক বোধের স্বাক্ষর রেখেছেন ‘সংঘাত’ নামক কবিতাটিতেও। কবিতাটি তাঁর ‘নৈবেদ্য’ গ্রন্থে স্থান পেয়েছে।
শতাব্দীর সূর্য আজি রক্ত মেঘমাঝে।
--হিংসার উৎসবে আজ বাজে
অস্ত্রে অস্ত্রে মরণের উন্মাদ রাগিনী
ভয়ংকরী দয়াহীন সভ্যতা-নাগিনী,
তুলিছে কুটিল ফণা চক্ষের নিমিষে,
গুপ্ত বিষদন্ত তার ভরি তীব্র বিষে।

একথা সবাই নিশ্চয় মানবে যে রবীন্দ্রনাথকে একক একটি সমগ্রতায় ধরা সহজ নয়। তাঁর সৃষ্টিকর্ম তাঁর জীবনের মতোই বর্ণাঢ্য এবং বিচিত্র। কোনো একটি প্রেক্ষিত টেনে তাঁকে মূল্যায়ন করা কঠিন। এ কারণেই বুদ্ধদের বসু বলেছিলেন, “অথচ রবীন্দ্রনাথ ঠিক সেই জগতের লেখক, সমগ্র ভাবে না দেখলে যাঁকে চেনাই যাবে না। তিনি যে একজন মহাকবি, বিশ্বের মহত্তমদের অন্যতম এ নিয়ে বাংলাদেশে আজকের দিনে আর তর্ক নেই। কিন্তু তাঁর প্রতিভার যেটি বৈশিষ্ট্য-- যেখানে তিনি পাঠকের পক্ষে বিপত্তিস্থল এবং সমালোচকের পক্ষে হতাশাস্বরূপ সেটি এই যে তাঁর মহত্ত্ব তাঁর সমগ্রতায়।” [রবীন্দ্রনাথ-বু. ব-প্রবন্ধসম্ভার পৃ: ১২১৮] এটা একদিকে যেমন গৌরবের তেমনি তাই আমাদের বুমেরাং হয়ে আঘাত হানে। এ কারণেই তাঁর জীবন ও সৃষ্টি কর্মকে তিনটি পৃথক পর্বে বিভক্ত করে দেখানো হলেও আসলে ঐ তিনটি পর্বের সামগ্রিক দ্যোতনা মিলেই তাঁর সমগ্রতা।

(একবিংশ ১২/ডিসেম্বর ১৯৯৩ সংখ্যা থেকে পুনর্মুদ্রিত)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন