শুক্রবার, ৯ এপ্রিল, ২০১০

তরুণ রচনার অগ্নি

তপোধীর ভট্টাচার্য

তরুণ রচনার অগ্নি

বাংলা কবিতা এই মুহূর্তে সমস্ত ক্লিষ্টতা, খণ্ডতা ও অপরিচ্ছন্নতাকে পেছনে পেলে অভুতপূর্ব দিক্পরিবর্তনের সম্ভাবনায় উন্মুখ হয়ে উঠেছে। দেশকালপরিধি ও প্রবহমান সাংস্কৃতিক আবহকে পুরোপুরি নতুন ভাবে গ্রহণ করার উদ্যম দেখা যাচ্ছে তরুণতর কবিদের মধ্যে। সময়ই এখন প্রধান কুশীলব যা অনবরত কবির ব্যক্তিসত্তাকে গড়ছে, ভাঙছে, বদলে দিচ্ছে। কিন্তু এই সময়ের মূর্ত ও বিমূর্ত সারাৎসার নিয়ে নানা সংশয়, দ্বিধা। সময়লালিত সমাজ-বীক্ষণের মাত্রাবোধে তারতম্য থাকার ফলে কবির সাম্প্রতিক কাল পাঠকের সমসাময়িক হয়ে উঠছে না অনেক ক্ষেত্রেই। ফলে ঘাটতি থেকে যাচ্ছে শুধু উপলব্ধিতেই নয়, শুধু কবিতা হয়ে ওঠার মধ্যেই নয়, পাঠকের সঙ্গে কবির সহৃদয়-হৃদয়-সংবাদে অথাৎ মৌলিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে। ‘কবি শুধু লিখেই খালাস, কবিতা তাঁর কার্যকারণসূত্র-নিরপেক্ষ স্বভাবের প্রতিফলন অতএব সময়ের নিগুঢ় ছায়া কতখানি কিভাবে পড়েছে-- এই নিয়ে ভাবতে থাকুন তাত্ত্বিক অকবিরা’ : এহেন সস্তা সপ্রতিভতা এখন অচল। বরং গত ছ’সাত বছর থেকে সৃজনশীলতা ও কবিতার অন্দরমহল নিয়ে যে ধরনের সচেতন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ঘাত-প্রতিঘাত সর্বত্র দেখতে পাচ্ছি, তাতে মনে হয় অতাত্ত্বিকতার নিদালির ঘোর ধীরে কিন্তু নিশ্চিতভাবে কেটে যাচ্ছে। নতুন সৃষ্টিভাবনার যে ঢেউ পুরুলিয়ায় বা মেদিনীপুরে বিচিত্র তরঙ্গভঙ্গ নিয়ে এসেছে, তাকে আজ আর দ্বৈপায়ন মানসিকতা নিয়ে অস্বীকার করা যাচ্ছে না নদীয়ায় বা কোচবিহারে, কলিকাতায় বা গৌহাটিতে, শিলচরে বা জামশেদপুরে। ইতিবাচক না হোক, নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়েও বাংলা ভাষার কবিরা অজ নতুন সময়চেতনা ও ঐতিহ্যবোধের দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের গুরুত্বকে এমনভাবে রচনায় প্রতিফলন করছেন যা আগে দেখা যায় নি কখনো।

মাত্রাবোধের তারতম্যের যে-কথা লিখেছি শুরুতে, তারই পরিণতিতে সময় কারো কাছে স্পষ্ট, প্রত্যক্ষ ও অর্জনীয় অর্থাৎ অভিজ্ঞতা ও সচেতন পরিশীলনের মধ্য দিয়ে জীবনযাপনের অঙ্গ। কিন্তু একই কালসীমার অধিবাসী হয়েও চেতনা যাদের পাথরীভূত, তাদের কাছে সময় অস্পষ্ট, পরোক্ষ ও বিমূর্ত। ফলে জীবনের সঙ্গে ব্যক্তি-সত্তার টানাপোড়েনজনিত সমস্ত সমস্যাকে এরা শুধুই পাশ কাটিয়ে যেতে অভ্যস্ত। কবিতায় কবির যে কণ্ঠস্বর শুনি আমরা, তার সবটাই তো নিছক ব্যক্তির স্বাধীন স্বতন্ত্র উচ্চারণ নয়। কবি যদি শুধুই কথক হতেন কিংবা সাংবাদিকসুলভ বিবরণদাতা মাত্র, তাহলেও অবশ্য সময়ের প্রেক্ষিত অনুপস্থিত হত না। কিন্তু কবি ভাষ্যকার হয়েই সন্তুষ্ট থাকছেন না আর, তিনি কবিতার বহুস্তরান্বিত উচ্চারণের নাট্যক্রিয়ায় সূত্রধার হিসেবে অংশও নিচ্ছেন। তাই সময় আজকের কবিতায় আরো অনেক সূক্ষ্মা, আরো অনেক নিবিড়, আরো অনেক ব্যাপক ভূমিকা নিয়ে এসেছে। একে আর নিরবয়ব দার্শনিকতা বলে বিবেচনার বাইরে রেখে ছদ্ম-সপ্রতিভতার সুবিধাবাদী আড়ালে আত্মরক্ষা করা যাচ্ছে না। যাচ্ছে না, কারণ, জটিল সময় আজ আমাদের নিরীহ উদাসীন নিরপেক্ষ অবস্থানকে বিপন্ন করে তুলেছে। ‘কত রবি জ্বলে.রে, কেবা আঁখি মেলে রে’-এর মধ্যে নিহিত সর্বজনপরিচিত সুবিধাবাদী প্রবণতা দ্রুত পরিবর্তশীল এককেন্দ্রিক বিশ্বের সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপটে আরো ইঙ্গিতবহ, আরো প্রশ্নের তীক্ষ্মতা নিয়ে সামাজিক সংবেদনাকে জাগাতে চাইছে। সময়ের এই পটে কোন ছবি আঁকছে দীর্ণ ব্যক্তি-সত্তা, ভাষার আধারে জেগে উঠছে কোন ভ্রƒকুটিকূটিল বা প্রশ্নদীর্ণ আত্মখননের সংকেত-- এইটেই সবচেয়ে বেশি বিবেচ্য এখন। যখন দেশ জুড়ে নেমে আসছে মধ্যযুগের বিভ্রান্তি-ছড়ানো কুহেলিকার ঘেরাটোপ এবং তারই সঙ্গে গাটছড়া বেঁধে এককেন্দ্রিক বিশ্বের কর্ণধারেরা নতুন সাংস্কৃতিক উপনিবেশবাদের বেপরোয়া জাল ছড়িয়ে দিয়েছে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এবং মূল্যবোধ ঐতিহ্য মানবিকতা ইত্যাদি নিরর্থক ও বাতিল হয়ে যাচ্ছে চিত্ত-অসাড়-করে-আনা দ্রুততায়। সেই মুহূর্তে নান্দনিক ও সাংস্কৃতিক মূল্য বিচারের অভ্যাস-জর্জরিত মাপকাঠির প্রাসঙ্গিকতাও বিচার্য বিষয় হয়ে উঠছে। এই সংকটক্ষণে পূর্ববতী সমস্ত বিপন্নতাকে গৌণ বলে মনে হতে পারে। বাংলা ভাষার কবি আজ যেখানেই থাকুন-- পশ্চিমবঙ্গে কিংবা আসামে-- তাঁকে আজ, ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায়, চক্রব্যুহে সংঘর্ষলিপ্ত অভিমন্যুর ভূমিকায় নামতে হচ্ছে।
যে-ভাষাকে নিঙড়ে নিচ্ছেন কবি, সেই ভাষার যোগাযোগের মৌল লক্ষ্য অর্থাৎ পাঠক সমাজ এখন দেশ-কাল-স্থান এর অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি থেকে নির্বাসিত হচ্ছেন ক্রমশ। সার্বিক আক্রমণে ছিন্নবিচ্ছিন্ন তাঁর ঐতিহ্যের প্রোথিত শিকড়, তাঁর দিন- রজনীকে নিয়ন্ত্রণ করছে নয়া উপনিবেশবাদীদের সংস্কৃতি-বিধ্বংসী কার্যক্রম। একদিকে দেশের দেউলিয়া অর্থনীতি ও রাজনৈতিক কেন্দ্রীকরণ, অন্যদিকে ধর্মীয় পুনরুজ্জীবনবাদীদের হিংস্রা উন্মাদনা ও বিদ্বেষবুদ্ধিতে আবিল বাংলাভাষী কবিদের পরিচিত ভূগোল। বিশেষভাবে আসামের বাঙালি কবিদের কাছে সাংস্কৃতিক উপনিবেশবাদীদের আক্রমণ ও আত্মপরিচয় অর্জনের তাৎপর্য আরো অনেকান্তিক। অভিমন্যুর এই ভূমিকায় আজকের কবি, কারণ তাঁর কোনো বিকল্প লক্ষ্য ও পথ নেই। যেহেতু কবিতাই তাঁর যুদ্ধের মাধ্যমে, তাঁর স্বপ্ন ও যন্ত্রণার আশ্রয়, তার আত্মপরিক্রমা ও বিশ্বপর্যটনের অবলম্বন কবিত্ব, কাব্যভাষা, কাব্য আকরণ অর্থাৎ এক কথায় সৃজনী চেতনা তাঁর কাছে বেঁচে থাকার এবং জীবন-সংলগ্নতার প্রধান শর্ত হয়ে উঠেছে। জীবনানন্দ-পরবর্তী বাংলা কবিতা বহু খাতে বইতে বইতে আর বহু বাঁক ফেরার অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ হতে হতে এখন যে বিন্দুতে পৌঁছেছে সেখানে সময়-চেতনায় প্রচ্ছন্ন কূটাভাস বা প্যারাডক্স সম্পর্কে অবহিত না হয়ে উপায় নেই কোনো। একটু আগে দেশ-কাল-স্থান এর প্রেক্ষাপটে প্রতিফলিত যে অনেকান্তিক দ্বন্দ্ব সংঘর্ষের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছি, তারই অনিবার্য ফলশ্রুতি হিশেবে একই কালে একই স্থানে রয়েছেন এমন কবিদের কাছেও সময় ভিন্ন ভিন্ন উপলব্ধির সূচক হয়ে থাকে। কেউ বা সাম্প্রতিকের বর্ণিল মুখোশে বিভ্রান্ত হয়ে সময়ের দ্বান্দ্বিকতা সম্পর্কে নিশ্চেতন থাকেন, কেউ বা সাম্প্রতিকের অবয়বে জরাজীর্ণ অভ্যাসের সমর্থনই পেতে চান। একই কালের কবিতার মধ্যে কখনো তাই দেখা যায় রক্তশূন্য শব্দের মিছিল, কখনো বা ভঙ্গিসর্বস্ব শূন্যগর্ভ সপ্রতিভতা, কখনো বা গন্তব্যহীন যাত্রার অপচয়।
সৃজনশীল কবির কাছে আপাত-সময় ও প্রকৃত সময়ের দ্বন্দ্ব সবসময়ই নান্দনিক সমাধান দাবি করে। সৃষ্টিশীলতাকে নিয়ত সময়স্বভাব ও সমাজসংবিদের সঙ্গে সমন্বিত কণ্ঠস্বর খুঁজে পান। প্রকৃতপক্ষে এই সন্ধানের প্রাসঙ্গিকতাই তাঁর অভীষ্ট, তাঁর উপার্জন। সাম্প্রতিক ক্ষোভ-দ্রোহ-স্বপ্ন-বেদনায় মথিত ‘পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞান’ এর সঙ্গে সুরসাম্যে না পৌঁছলে কবিতা যতই মেধাবী হোক, যতই দার্শনিক দ্যুতি বিকীরণ করুক, জীবন যুদ্ধের কৌণিকতায় অভিজ্ঞ পাঠক ঐ কবিতাকে প্রত্যাখান করবেন। বহু শক্তিশালী কবিকে আপাত-সময়ের মোহময় ফাঁদে জড়িয়ে পড়তে দেখেছি কেননা উত্তর-জীবনানন্দ বাংলা কবিতার কিছু কিছু জনপ্রিয় বিভ্রান্তি সোনার হরিণের মতো তাঁদের অনবরত লুব্ধ করেছে। আপাত-সময় আসলে সংকীর্ণ ও বৈনাশিক সময় যেহেতু তাঁর উৎস বুদ্বুদধর্মী তাৎক্ষণিকতায়। এই জন্যে চরিত্রগতভাবে এইটে অদ্বান্দ্বিক। মহাকালের প্রবহমান দর্পণে নিজেকে যাচাই করে, গ্রহণ ও বর্জনের মধ্যে দিয়ে ঐতিহ্যের ইতিবাচক উপাদানগুলিকে অনবরত আত্মস্থ করে নেয়। অর্থাৎ স্বভাবধর্মে এই সৃজনী উত্তাপে শীলিত সময় দ্বান্দ্বিক, আর এ জন্যে তার শৈল্পিক সম্ভবনা অনন্ত। শুধুমাত্র সাপ্রতিকের প্রতি বিশ্বস্ত থাকার মধ্যে প্রকৃত-সময়ের পতাবাহী কবি কোনো তাৎপর্য খুঁজে পান না কখনো। বস্তুত সাম্প্রতিকের দাবী মেটানোর জন্যে কবিত্বের ব্যবহার তাঁর কাছে শোচনীয় অপচয় মাত্র কেননা সৃজনাত্মক চেতনাকে তিনি জানেন তিমিরাবিনাশী আলোর প্রতিমান হিসেবে, এর ব্যতিক্রম তিমিরবিলাস ছাড়া অন্য কিছুই নয়। অবশ্য এর মানে এই নয় যে ব্যাখ্যাতীত ও ঝাপসা মহাসময়ের ধ্বজদণ্ড বইতে গিয়ে রক্তকরবীর রাজার মতো স্বরচিত জালের আড়ালে থাকতে হবে তাঁকে। বরং যে ঐতিহ্যচেতনাকে তিনি প্রকৃত-সময়ের আশ্রয় বলে জেনেছেন, তারই দর্পণে নিজস্ব গ্রন্থিল পরিপ্রেক্ষিত ও খণ্ডকালের তাৎপর্যকে তিনি আরো গভীরভাবে বুঝতে পারেন। এভাবেই কবি রিক্ততা ও ব্যর্থতার খণ্ডিত বোধকে অতিক্রম করার উপযোগী সৃজনী-চেতনার ব্যাপ্তিও লাভ করেন, এর অভ্রান্ত সংকেত পাই নির্মিত--আঙ্গিক ও মূল্যবোধ আর আকরণ ও বিষয়ভাবনার সুষম বিন্যাসে। কান্ট যদিও ইতিহাস বিচ্ছিন্ন সাব্লাইমের কল্পনা করেছিলেন, একুশশতক থেকে মাত্র আট বছর আগের এই কাল-পর্যায়ে দাঁড়িয়ে আমরা আজ আর ফর্ম বা কনটেন্টের ক্ষেত্রে কোনো বৃন্তহীন পুষ্পসম আপনাতে-আপনি-বিকশিত সার্বভৌম উর্ধ্বশীল-সত্তার অভিব্যক্তি ভাবতেই পারি না।

তবু অন্য একটি প্রশ্ন থেকেই যায়। আপাত--সময় ও প্রকৃত সময় যে দ্বান্দ্বিক অভিঘাতের আবহ তৈরী করছে অহরহ, স্থানিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী তাতে কতদূর মাত্রাভেদ দেখা দিতে পারে? বাংলা ভাষার বিস্তৃত ভূগোল যেহেতু বিচিত্র উচ্চাবচতা নিয়ে গড়ে উঠেছে, তার মধ্যে লক্ষ করি সমাজ-বাস্তবতার ইতিহাস। নির্দিষ্ট ভিন্নতা আর সেই সঙ্গে অভিজ্ঞতা ও সংবেদনার অসংখ্য স্তরবিন্যাস। একদিকে যখন মহানাগরিক অভিজ্ঞতা চরম বিচ্ছিন্নতাবোধ, আত্মখণ্ডন ও যান্ত্রিক আকরণবাদের জটিল বুনন তৈরী করছে তখনই হয়তো অন্যদিকে রাঙামাটি ও খোলা প্রান্তরের অনুভব বাংলা কবিতায় নিয়ে আসছে আশ্চর্য সজীবতার প্রতিশ্রুতি। নাগরিক বৈদগ্ধ্য ও মনন যখন প্রকাশরীতির চাতুর্যে দিগভ্রান্তিকে লুকিয়ে রাখতে চাইছে, ঠিক সেই মুহূর্তেই হয়তো সহজ সুরে নিবিড় প্রত্যক্ষতা দিয়ে মানবিক অস্তিত্বের আনন্দ-বেদনাকে কবিতায় সঞ্চারিত করছেন ঢাকা ও রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও শ্রীহট্ট, পুরুলিয়া ও কোচবিহার, শিলচর ও গৌহাটিতে ছড়িয়ে থাকা বাংলা ভাষার কবি। কলকাতা ও ঢাকার মহানাগরিক জীবনে যে শিকড়হীনতা যান্ত্রিকতা রয়েছে, পশ্চিমবাংলা বা বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কবির কাছে সেইটে একইভাবে অনুভূতি হতে পারে না। সুতরাং কোনো কল্পিত সাহিত্য-কেন্দ্রের প্রচ্ছায়ায় স্বকীয়তা ও স্বাবলম্বিতাকে বিসর্জন দেয়ার প্রশ্ন নেই। সাম্প্রতিক উৎপাদন ব্যবস্থার নিরিখে সর্বগ্রাসী পুঁজিবাদ যে সমস্ত অঞ্চলে গভীরতর সন্ত্রাসের থাবা বসিয়েছে, সেসব ক্ষেত্রে ক্ষত-লাঞ্ছনার বিভাজিকা ব্যক্তিসত্তায় যতখানি প্রত্যক্ষ, পিছিয়ে-পড়া অঞ্চলগুলিতে সে-তুলনায় আলো-হাওয়া-রৌদ্র-মাটি এখনো অনেকখানি প্রাসঙ্গিক বলে মহানাগরিক ব্যক্তিসত্তার আত্মবিলুপ্তি সে-সব ক্ষেত্রে সত্য হতে পারে না। ফলে অনিকেত চেতনার ত্রাসও সেখানে তত নিরঙ্কুশ নয়। কবিত্বে কাব্যভাষায় কবিতার আকরণে এই ভিন্নতাগুলি স্পষ্টভাবেই ধরা পড়বে, এইটে প্রত্যাশিত। একই সময়-পরিধিতে থেকেও কলকাতায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর ঢাকার শামসুর রাহমান তাই দুটি আলাদা শিখরের প্রতিনিধিত্ব করেন। শিলচরে শক্তিপদ ব্রহ্মচারী ও কলকাতায় প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত কিংবা পুরুলিয়ায় নির্মল হালদার ও শিলচরে মনোতোষ চক্রবর্তী অথবা কলকতায় গৌতম বসু ও শিলচরে শঙ্করজ্যোতি দেব কিংবা গৌহাটিতে তপন রায় ও বর্ধমানে সঞ্চয়িতা কুণ্ডু পুরোপুরি ভিন্ন চোখে জীবনকে দেখছেন। একই বাংলা ভাষার জমিতে তাঁরা চাষ করছেন যদিও, মূল্যাবোধের নিরিখটা এতোই আলাদা যে কার্যত তাঁরা পরস্পর ভিন্ন পরিমণ্ডলের অধিবাসী হওয়াতে তাঁদের ফসলের চরিত্র ও সিদ্ধি এক নয়। অর্থ-সামাজিক পরিকাঠামোর ক্ষেত্রে আঞ্চলিক অনগ্রসরতা যেহেতু সাংস্কৃতিক উপকরণ, আকরণ ও অন্তঃসারে প্রতিফলিত হয়, পুঁজিবাদ ও সামন্তবাদের চতুর আঁতাতের অভিব্যক্তিতে দেখা দেয় স্পষ্ট পার্থক্য- কবিদের সময়-চেতনায় সামাজিক পরিবেশের এবং উচ্চাবচতা অমোঘ মাত্রাভেদের উৎস হয়ে উঠছে।
অতএব স্থানভেদে মাত্রাভেদ অবশ্য স্বীকার্য। আরো লক্ষণীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সমাজ ও সংস্কৃতির বিপ্লল উথালপাথাল কলকাতায় ও ঢাকায়, সহজবোধ্য কারণে, যেভাবে দ্রুত ধরা পড়ে এবং ফলে চিন্তা-চেতনায় যুগান্তরে ইশারা জেগে ওঠে সেই তরঙ্গভঙ্গ একই বাংলা ভাষার ভূগোলে থাকা সত্ত্বেও, গৌহাটি ও শিলচরে উৎসুক কবিমনে সমান ব্যপ্তিতে ও সমান দ্রুততায় আবর্ত তোলে না। নদীয়া বা মেদিনীপুর বা পুরুলিয়ার কবির পক্ষে উত্তাপকেন্দ্রের সঙ্গে যে নৈকট্য সম্ভব, আসামের বাংলাভাষী কবিরা তাকে অনুভব করতে পারেন শুধু অধ্যবসায়ী আতসকাঁচের মধ্য দিয়ে। দেবশিস তরফদার বা গৌতম মিত্র এর মতো কোনা তরুণ কবি যদিবা সপ্রতিভ ভাবে ঐ উত্তাপকেন্দ্রের আকর্ষণে নিজস্ব কক্ষপথ থেকে ছিটকে বেরিয়ে গিয়ে মহানাগরিক কবিতা-বলয়ে নিজেদের রচনাশৈলীকে স্থাপিত করেন, তাঁদের জন্যে আত্মবিরোধী কূটাভাস তীব্র ও শাণিত হয়ে ওঠে আরো।
আপাত-সময় ও প্রকৃত সময় এর দ্বান্দ্বিকতা স্ববিরোধিতার জন্ম দিতে বাধ্য যদি কখনো কোনো কবি নিজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা-লালিত উপলব্ধির বাইরে গিয়ে চতুর বৈদগ্ধের সচেতন আত্মীকরণের আকাক্সক্ষার সৃজনশীল ভাষাকে নিছক যন্ত্রগণকের প্রাক্নির্ধারিত তথ্য হিসেবে ব্যবহার করতে চান। সুনির্দিষ্ট কিছু নির্মিতি ও আকরণের অবলম্বন হিসেবে ভাষাকে ভুলভাবে অর্থাৎ শুধুই প্রায়োগিক উপাদান হিশেবে গ্রহণ করার সম্ভাবনা তখনই দেখা দেয় যদি অন্য কোনো সৃজন-নিপুণ কবির সার্থক কৃতিতে প্রসঙ্গবিচ্ছিন্ন ভাবে অনুসরণ করে এবং নিজস্ব সাংস্কৃতিক আবহ-লালিত কর্ষণ-ভূমির গুরুত্বকে ভূলে গিয়ে কোনো কবি শুধুমাত্র পঠিত ও অনুশীলিত প্রকরণের অভ্যাসকেই বরণ করেন। অথচ উত্তাধিকার ও সামাজিক পরিবেশের দ্বান্দ্বিকতায় প্রত্যক্ষ ও স্বোপার্জিত অনুভূতির প্রামাণিকতাকে গুরুত্ব না দিয়ে কোনো সৃষ্টিশীল কবিসত্তা-পা রাখবার নিজস্ব ভূমি খুঁজে পায়নি কখনো। কিন্তু তার মানে এই নয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতার স্বাতন্ত্র্যকে অজুহাত হিশেবে উপস্থাপিত করে এই উদ্ভট দাবি করতে পারি যে বিস্তৃত এই বাংলা সাহিত্যের ভূগোলে যেহেতু ছোট-বড়ো অনেক শিখর অনেক উপত্যকা, প্রত্যেকের জন্যে থাকবে আলাদা-আলাদা মানদণ্ড! না, এই দাবি উত্থাপনের সুযোগই নেই কোনো। বাংলাভাষায় যাঁরা আজ কবিতা লিখছেন আসামে বাংলাদেশে বা বিহারে বা পশ্চিমেবঙ্গে, প্রত্যেকের জন্যে একই মাপকাঠি। স্বোপার্জিত অনুভূতির প্রামাণিকতা যখন কবির রচনায় প্রত্যাশা করি, তার মানে, পাঠকের এই সামান্য আকাক্সক্ষা সমস্ত সঞ্চলে চেতনা-ঋদ্ধ কবিদের কাছে নিবেদন করতে চাই যে তাঁদের কবিতা দায়বদ্ব হোক সত্যেরই কাছে-- যে সত্য বিমূর্ত বা ধোঁয়াশা-কুহেলিতে অস্পষ্ট বা সময়-নিরপেক্ষ নয় এবং এই সত্য গতিহীনতা ও মন্থরতায় আবিল নয়, অভিজ্ঞতা-প্রসূত চিন্তা ও উদ্যমী কল্পনায় তাকে বারবার নতুন ভাবে জেনে নিতে হয়।

দুই

আসামের বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে তাই কোনো আলাদা মাপকাঠি ব্যবহারের প্রশ্ন নেই। নয়া উপনিবেশবাদের যে চক্রান্ত দেশজুড়ে অবারিত, আসামের অধিবাসীদের জন্যে তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরো কিছু ইতিহাস-নিয়ন্ত্রিত সমস্যা। ভেুৗগোলিক বিচ্ছিন্নতা ও সার্বিক অনগ্রসরতায় ন্যূব্জ উপেক্ষিত অন্তেবাসীর যন্ত্রণায় পীড়িত আসামে গত তিন দশক ধরে নানা ধরনের বিকৃতির অভিব্যক্তি দেখা যাচ্ছে। অতি-সম্প্রতি মুষলপর্বের রক্তস্নান ও সন্ত্রাসের বিভীষিকার একটি মর্মন্তুদ কালো অধ্যায় শেষ হলো। সাংস্কৃতিক উপনিবেশবাদের সাঁড়াশী আক্রমণ সাধারণভাবে আসামের অধিবাসী এবং বিশেষভাবে বাঙলা ভাষাবাষীর ক্ষেত্রে বহুমুখী। তবু সমস্ত ধরনের ক্ষয় ও স্খলনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সৃজনশীল মন কবিতার গভীরতর সত্যের কাছে দায়বদ্ধ হচ্ছে বারবার। অজস্র খণ্ডতা ও নেতিবাদের আস্ফালন যে প্রত্যাহ্বান ছুড়ে দিচ্ছে অহরহ, তার মোকাবিলা করার বদলে অনেক কবিই বহ্নিচক্র থেকে নিরাপদ দুরত্বে সরে যাওয়ার জন্যে পলায়নবাদী মানসিকতায় অভ্যাসের ঘেরাটোপ গড়ে তুলছেন কবিতায়। গ্রহণ ও বর্জনের দ্বন্দ্বময় যে-নাটক জীবনে প্রতিনিয়ত আলো ও অন্ধকারের জটিল চলচ্ছবি নির্মাণ করছে, তাকে মহানাগরিক কবিদের মতো শাণিত, তীব্র ও সার্বিক ভাবে আসামের মন্থর প্রেক্ষিতে অনুভব করা সম্ভব নয়। তবু প্রমত্ততা, অস্থিরতা ও আত্মোদ্রোহের মাত্রাগত ভিন্নতা সত্ত্বেও ক্ষণবাদী সময়ের দোলচল ও রিক্ততায় আক্রান্ত হচ্ছেন আসামের কবিরাই। বাংলা কবিতায় বৃহত্তর প্রেক্ষিতে যুক্ত হওয়ার তাগিদে, ভুল প্রতিক্রিয়ায়, কেউ কেউ আত্মবিরোধিতার শিকার হচ্ছেন। তাঁদের কাছে সত্যবোধ ও সত্যভ্রম-এর ব্যবধান লুপ্ত, স্বকীয় চলন রপ্ত করার বদলে তাঁরা অনুকৃতিকে বেশি কাম্য বলে মনে করছেন। আরো বিশ্লেষণের প্রয়োজনে বাংলা কবিতায় সামপ্রতিক পরিস্থিতির প্রতি দৃষ্টিপাত করা যেতে পারে। ১৯৮৮-তে জয় গোস্বামী ‘ভূতুম ভগবান’ বইতে বাংলা কবিতার পাঠকমণ্ডলীকে সচকিত, সম্ভবত কিছুটা অসাড়, করে-দিয়ে লিখলেন--

যতক্ষণ শ্বাস রয়েছে-ততক্ষণই আশ
এই আসে তো এই ভেঙ্গে যায়, ঈশ্বরে বিশ্বাস।
ততক্ষণই কলঙ্কভয়, মুখে ঝ্যাটার বাড়ি
যতক্ষণ না সবার সামনে ন্যাংটো হতে পারি।
আকাশমুখো কুত্তা আমার ঘেউ ঘেউ ঘেউ ডাকে
সুযোগ পেলেই কামড়ে দেবে ঈশ্বরো আল্লাকে। (শীর্ষাসন)


এই নির্মম আত্মবিদারক শ্লেষ, পরমতার অবসান-জনিত যন্ত্রণা, বিক্ততাবোধের বেপরোয়া প্রকাশ যে সমাজ-পরিবেশে সম্ভব, তার গোত্রচিহ্ন হলো অমেয় বিচ্ছিন্নতাবোধ। আধুনিকতার বিষয় সংকট এখানে নিরর্গলভাবে উপস্থিত। জয়ের ‘আমি’ আসলে ‘না-আমি’র দহনে ক্লিষ্ট ও বিপন্ন। তাই তাঁর কাব্যবীজ ও রচনাশৈলীতে যেন দান্তের ইনফার্ণো-সম্ভূত নিচ্ছিদ্র অন্ধকার প্রতিফলিত হচ্ছে। বাকপ্রকরণে আহত কৌতুক যেভাবে ফুটে উঠেছে তাতে মনে হয়, এইটে আসলে নিরাপত্তাহীন আশ্রয়হীন ‘আধুনিক’ জীবনের হিংস্রতা ও আত্মলোপ-প্রবণ সন্ত্রাসের অন্য পিঠ। আধুনিক চিত্রকলার সবশ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি পাবলো পিকাসো যেমন ভেবেছিলেন নিজের শিল্পরীতি সম্পর্কে : ‘My art alternates between gracefulness and horror, comedy and violence reflecting two extremes of society today” তেমনি জয়ের কবিতা রীতিতেও লক্ষ করি বিপরীত উপাদানের ঐক্য। কলকাতা মহানগরের সঙ্গে তাঁর সান্নিধ্য স্পষ্টতই নিছক ভৌগোলিক নয়, জৈবসত্তায় অমূল নিহিত। যে-আধুনিক মনন আজ আর এগানোর পথ খুঁজে না-পেয়ে নিষ্ফল আক্রোশে ও বেদনায় বারবার শুধু নিজেকেই আঘাত করছে, জয় তার শ্রেণ্ঠ প্রতিনিধি--

আমরা সব জারজ সন্তান
আমরা সব বুদ্ধু সব ভুতুম বগবান
আমরা যা-ই বলি ব্রহ্ম তা-ই, আজ ব্রহ্ম তা-ইব্রহ্ম তা-ই, ব্রহ্ম তা-ই
আমরা ঘরে ঘুরে পঙ্গু বাপ আর অন্ধ ভাই
আমরা যা-ই বলি ব্রহ্ম তা-ই কালব্রহ্ম তা-ই বালব্রহ্ম তা-ই
আমরা নিজেদের জায়গা চাই।
(জয় গোস্বামী, ‘ভুতুমভগবান’)


কবিতার আকরণকে ভেঙেচুরে ফেটে পড়ে যে-প্রমত্ততা, তাকে ছিন্নমূল মহানাগরিক সমাজের বাইরে পাওয়া অসম্ভব। ছত্রে-ছত্রে ফুটে ওঠে যে বিস্ফোরণের সংকেত, সেইটে অপ্রতিষ্ঠ আধুনিকতার মর্মছেঁড়া যন্ত্রণা ও পরিণতিহীন শূন্যতার ফসল। র্যাঁবোর মাতাল নৌকোর সঙ্গে তুলনীয় এ-হেন কবিতার আধারে প্রকৃতপক্ষে ‘explosion of a society beneath the repressive anguish of an antiquated morality” হিশেবেই গণ্য।

আবার বিমানবায়নের প্রবণতায় ক্লান্ত, জীবনানন্দ-কথিত ‘নিখিল প্রপঞ্চের উদ্ভাস’ সম্ভাবনা থেকে বিপরীত মেরুতে নির্বাসিত, ছিন্নভিন্ন মূহূর্তের খণ্ডতায় ভঙ্গুর এই আধুনিকতাকে প্রত্যাখান করার সচেতন প্রয়াসও দেখা যাচ্ছে গত দশ বছরের বাংলা কবিতায়। কেউ কেউ অবার শুভ মানসিকতার ভোর সন্ধানের জন্যে নতুন বিশ্ব^বীক্ষা গড়ে তুলতে চাইছেন। কবিতায় যে নান্দনিক দর্শন অপ্রাসঙ্গিক বলে বিবেচিত হয়েছিল, মহাসময় ও ঐতিহ্য-ভাবনার সূত্রে তার পুনঃপ্রতিষ্ঠার আয়োজন দেখতে পাচ্ছি ইদানিং। উত্তরণের আকাক্সক্ষা নিয়ে গড়ে উঠেছে নতুন নন্দন-প্রস্থান ‘উত্তর- আধুনিকতা’ নাম নিয়ে। কবিতার আকরণে, ভাষায়, বিষয়-সন্ধানে, আঙ্গিক-বিন্যাসে, নিয়ন্ত্রক চেতনায়, অণুবিশ্বে উত্তর-আধুনিকতার প্রবক্তারা (অভিতাভ গুপ্ত, অঞ্জন সেন, উদয়নারায়ণ সিংহ প্রমুখ) যে প্রাগ্রসর সংবেদনার স্ফুরণ দেখতে চাইছেন, তার ভিত্তিমূলে রয়েছে মানুষের ইতিহাসভাবনা ও কালজ্ঞানের পুরোপুরি নতুন মূল্যায়নের আকাক্সক্ষা। জীবন ও সমাজ থেকে যে চরম বিযুক্তি ঘটে যাওয়াতে ঐতিহ্যের চলিষ্ণুতা সম্পর্কে উদাসীন থেকে পরম্পরাহীন সাম্প্রতিকের একদেশদর্শী উপস্থাপনাই ‘আধুনিক’ কবির অভীষ্ট ছিল এতদিন, তাকে তাত্ত্বিকভাবে প্রত্যাখান করার প্রণালীবদ্ধ চেষ্টাও শুরু হয়েছে। এই নতুন পত্যয়ের উদ্ভাসন দেখা যাচ্ছে বেশ কিছু তরুণ কবির রচনায় (যেমন অমিতাভ গুপ্ত, অঞ্জন সেন, গৌতম বসু, অনুরাধা মহাপাত্র, নির্মল হালদার, অনির্বাণ লাহিড়ী, এবং আরো কয়েকজন) যাদের কবিতা প্রখর বিষয়-ভাবনা, আঙ্গিকচেতনা, মূল্যবোধ পুনরাবিষ্কার, ঐতিহ্যমনষ্কতা, ভাসার নতুন স্পন্দন নির্মাণ, বিপুল বৈচিত্র্য ও সংশ্লেষণপ্রবণতার দৃষ্টান্তস্থল হয়ে উঠেছে। উত্তরে হবে শ্রেয়োবোধের কবিতা এবং সার্বিক অসাড়তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কবিতা কারণ কবিতা রচনা আসলে ‘ক্ষয়িষ্ণুতার বিরুদ্ধে এগিয়ে যাওয়ার যুদ্ধ’। ‘উত্তর আদুনিক কবিতা’ নামক সংকলনের ‘নিবেদন’ শীর্ষক রচনায় অমিতাভ লিখেছেন: ‘মধ্যযুগ পেরিয়ে আধুনিক যুগে পৌঁছানো, আধুনিকতাবাদ পেরিয়ে উত্তর-আধুনিক যুগের দিকে যাওয়া ওই পরম শিল্পের দিকেই যাওয়া।..... উত্তর-আধুনিকতা একটি নতুন ইঙ্গিত, উত্তর-আধুনিকতা একটি প্রতিষ্ঠার অগ্নি। .... মানুষের জীবনস্রোত আজ আবার একটি সন্ধিমুহূর্তের স্পন্দনে হয়ে উঠেছে কালো শ্যাওলা আর ধূসর রঙের ছত্রাক, তার সেদিনের বিচিত্র আশার ও আনন্দের চিহ্নে আজ এক জরাতুর স্থবিরতা। তথাকথিত নতুন পৃথিবী আজ পৃথুল প্রাচীনতার মধ্যে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে, অন্য-এক মঞ্চের যবনিকা সরে যাচ্ছে যেন একটি স্বপ্নের মতো. একটি অর্ন্তগূঢ় আকাক্সক্ষার মতো’। (পৃষ্ঠা ১৭২-১৭৩)

সন্দেহ নেই যে, ক্রমবর্ধমান পণ্যায়নের এই যুগে এদেশের মানুষ যখন সাংস্কৃতিক উপনিবেশবাদীদের আগ্রাসনে কিংকর্তব্যবিমূঢ়, প্রতিক্রিয়াশীলদের নির্বোধ মত্ততা নিরংকুশ, সে সময় ‘জরাতুর স্থবিরতা’ ও ‘পুথুল প্রাচীনতা’র বিরুদ্ধে একমাত্রিক প্রতিবাদ যথেষ্ট নয়। যে ‘অন্তর্গূঢ় আকাক্সক্ষা’ উত্তর-আধুনিক কবিতায় ফুটে উঠতে চাইছে, বহমান সময়-সমাজের দ্বান্দ্বিকতা থেকেই শুভ আস্তিক্যবোধে তার প্রয়াণ ঘটতে পারে। অনন্ত সময়ের পটভূমিতে খণ্ডকালের অভিজ্ঞতাকে নতুন তাৎপর্যে বুঝতে চান তাই অঞ্জন সেন-এর মতো কবি। তাঁর ‘পাঠ ভারতবর্ষ’ সংকলনটি অমিতাভ গুপ্তর ‘খরা ও যমুনা’ ও ‘মাতা ও মৃত্তিকা’র মতো, অবশ্যপাঠ্য। অঞ্জন মহাসময়ের বিপুল মাত্রাকে প্রতœকথার ইঙ্গিতে ধরতে চেয়েছেন, ফলে স্বদেশ ও স্বকাল নিবিড়তরভাবে পাকের কাছে ধরা পড়েছে। যেমন ‘গরুঢ়’ কবিতার শেষ অংশটি :

বোবা দেশ জুড়ে সর্পাহতের ভিড়
কেঁদেও কাঁদে না বুঝেও বোঝে না
কিছুই বলে না প্রাণভরে
শ্বাসভরে খালি বিষ টেনে নেওয়া
কাল ও মাত্রা বিষক্রিয়ায় ভরা।

তুমি নেমে এসো অধিলোক থেকে
বলী বিহঙ্গম
নষ্ট করো বিষ
আমরা যেন সুস্থভাবে নিঃশ্বাস নিতে পারি’।

উত্তর-আধুনিক জীবনভাবনা কিভাবে নতুন কবিতা-প্রস্থান গড়ে তুলছে, তার নির্ভূল প্রকাশ দেখি ‘অগ্নিবিষয়ক’ কবিতায়--
এসো আগুন আনন্দে জন্য এসো
হিমে আচ্ছন্ন হিম ত্রাসে জমে থাকা
এসো আগুন চওড়া হয়ে এসো
অন্ধকারে ঢাকা অন্ধকার খোয়াড়
চিহ্নহীন জলমগ্ন
সমস্ত শব্দ আজ কাঠ হয়ে আছে
এসো বাক্ মেঘের গর্জন নিয়ে এসো
অক্ষরে
এসো আগুন আনন্দের জন্য এসো।


স্বাভাবিক ভাবেই বাংলা কবিতার ভাষা এখন নতুন নন্দনতাত্ত্বিক প্রবণতার বার্তাবহ হয়ে উঠেছে। এর একটি অসামান্য প্রকাশ দেখি ‘বাংলা ভাষা’ নামক অভিতাভ গুপ্তর কবিতায়--

আকাশে ছড়ানো এই ভাষা
এই ভাষা আলো আর ভ্রুণ
ভোরবেলা যখন জাগেনি
আর কেউ, বিবাহ সংকেত
ছুঁয়ে গেল শিশুর কাকলি
আমি গর্ভের আগুন
আমি ওর আভার সিঁদুর।


কবিতার নির্মিতিতে এই অভিনব বাক্চেনা চমৎকার সুরসাম্য রচনা করছে। নতুন নিরুক্তির আশ্চর্য সম্ভাবনা সঞ্চারিত হয় অকারণে, শব্দ হয়ে ওঠে অনির্বচনীয়, সাঙ্গীতিক আবহের সংকেত প্রত্যক্ষ হতে থাকে। গৌতম বসুর কবিতা থেকে এর কিছু বিশিষ্ট দৃষ্টান্ত চয়ন করা যেতে পারে। যেমন ‘অন্নপূর্ণা ও শুভকাল’ কবিতার অন্তিম অংশটুকু--

শিকল দেখে আবার মনে পড়লো শব্দের কথা শিকল
রূপান্তরিত জল, আর দর্শক যখন অতীত
তখনও অনেক ভূমিকা থেকে যাবে
এই জল প্রকৃত শ্মশানবন্ধু, এই জল রামপ্রসাদ সেন।


তাছাড়া ‘অতিশয় তৃণাংকুর পথে’ সংকলনের বেশ কিছু কবিতা এর অসামান্য দৃষ্টান্ত। ‘বিশ্রামতলা’, ‘বহুরু’, বা ‘স্কুল রোড’ এর মতো কবিতাকে সম্পূর্ণ উদ্ধত না করে সাংকেপৃতিকতায় ঋদ্ধ নতুন কাব্যভাষার প্রকৃত পরিচয় সম্ভব নয়। উত্তর--আধুনিক কবিতা-চেতনার এই বিশিষ্ট দিকটি আজ অনেক তরুণ কবির কাছে অভ্যাসের নির্মোক-মোচনের প্রত্যাহ্বান নিয়ে এসেছে। অনুরাধা মহাপাত্র, অনির্বাণ লাহিড়ী ছাড়াও সুতপা সেনগুপ্ত, সঞ্জয়িতা কুণ্ডু, জহর সেন মজুমদার, কল্লোলশ্রী মজুমদার, দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিবেক চট্টোপাধ্যায় এর মতো কবি বিপর্যস্ত সমকালীন অস্তিত্বের অভিজ্ঞতাকে শাব্দিক সংক্রান্তির আকর করে তুলেছেন। তাঁদের রচনায় মূর্ত হয়ে উঠছে যদিও নবীন ‘কল্পনার প্রতিজ্ঞা’, তবু ‘ভৌগোলিক সীমার বাইরে আকাশের অসীমতায় মানুষের অসীমতায় মহাকালের পটে আঁকা ভারতবর্ষ, এর কাব্যপ্রতিমা নির্মাণের যে-উচ্চাকাংক্ষা অমিতাভের গদ্য-প্রয়াসে ফুটে উঠেছে সাধারণ বৈশিষ্ট্য হিশেবে উত্তর-আধুনিক কবিতাচর্চায় তার যথার্থ স্ফুরণ এখনো ঘটেনি। বরং ইতিমধ্যে সাম্প্রতিক ভারতবর্ষে ধর্মীয় ভাবনার কুহেলী যেভাবে ঐতিহ্যবাদের অপব্যাখ্যাকে আশ্রয় করে ঘড়ির কাঁটাকে উল্টো পাকে ঘুরিয়ে দিতে চাইছে, তাতে কোনো কোনো তরুণ কবি প্রগতি-বিরোধী অচলায়তনটির পুনরুজ্জীবনের মোহে পথভ্রষ্টতার আশংকাই জাগিয়ে তুলছেন। মহাসময়ও ইতিহাসবিচ্ছিন্ন হয়, সুতরাং প্রসঙ্গ-চ্যুত ঐতিহ্যকে নির্বিচারে গ্রহণের ভ্রম মারাত্মক পরিণতি নিয়ে আসতে পারে। গ্রহণ ও বর্জনের দ্বান্দ্বিকতা ছাড়া জীবনবোধ সুপ্রতিষ্ঠ হতে পারে না, ঐতিহ্যের স্বভাবে ও চলিষ্ণুতায় নিহিত সম্ভাবনাও মুকুলিত হবে না। তবু, সন্দেহ নেই, উত্তর-আধুনিক শ্রেয়োচেতনা নিয়ে তরুণ কবিরা এই মুহূর্তে ‘অস্পষ্ট ভোরের জানালা খুলে’ দেখছেন ‘মেঘ ও শ্রাবণ কীভাবে মুছে দেয় সব অসমাপ্ত ধূলিরেখা’। প্রত্যেকের কবিতায় সমানভাবে যদিও অভ্যাস-শৃঙ্খল থেকে মুক্তির আর্তি জাগেনি এখনো, বাক্-প্রকরণ ও মূল্যবোধের সংগনে নবীন প্রত্যয়ের সূচনা এখনো নিরঙ্কুশ নয় তত, তবু এই সময়ের প্রধান তরুণ কবিদের মধ্যে যে সমগ্রতা- সন্ধানী নান্দনিকতা ও জীবন-চেতনা পুনরুজ্জীবনের উচ্চাকাক্সক্ষা দেখা যাচ্ছে, তাকে স্বীকৃতি না দিয়ে উপায় নেই। অমিতাভ-র প্রাগুক্ত গদ্য-প্রয়াসে উত্তর-আধুনিক চেতনার লক্ষ্য এভাবে বিবৃত হয়েছে: ‘ইতিহাসের মধ্যে বিপুল গতিসঞ্চার হতে হতে, জীবনের সব লাবণ্য ও শ্রী ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে করতে একদিন, অবক্ষয়ীদের পুঁজির উপর বয়ে যাবে প্রমিথিউসের প্লাবন।’ (পৃষ্ঠা ১৭৮)
বাংলা কবিতার তটরেখা নিৎসন্দেহে এখন জোয়ারে উচ্ছাসে কম্পমান। অবশ্য জীবনানন্দ-পরবর্তী কবিতার বহুধাবিদীর্ণ ধারায় পূর্বজদের অনুসৃতিও লক্ষণীয়। গত দশ বছরের পদ্য-প্রচেষ্টায় ছিন্নবিছিন্ন সাম্প্রতিকের পাণ্ডুর ছায়া বেশি স্পষ্ট, ব্যক্তিসত্তা নেতির মহানিষ্ক্রমণে বেরিয়ে, ক্লান্তি ও অবসাদের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে, আত্মহনন আর মূল্য-খণ্ডনে সম্ভাব্য সমস্ত প্রকরণকে আঁকড়ে ধরতে চাইছে। প্রায় তিন দশক আগে যে সমস্ত শক্তিশালী কবি স্বেচ্ছাচারী প্রতিভার দোহাই দিয়ে ভাঙনের প্রবক্তা হয়ে উঠেছিলেন, ইদানিং তাঁরা নির্বাপিত, নিছক অভ্যাসের তাড়নায় নিজেদের অনুকরণ করে চলেছেন। আধুনিকতাকে এঁরাই নৈরাজ্যের নামান্তর বলে চালিয়ে দিতে পেরেছেন স্থিতাবস্থার পক্ষপাতী পুঁজিবিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলির প্রত্যক্ষ সহায়তায়। এই কবিদের পণ্যশোভন ভূমিকায় ঐতিহ্য প্রত্যাখ্যাত, মনন ও গভীরতা উপহসিত, শ্রেয়োচেতনা আক্রান্ত এবং তরুণতর কবিদের স্বাতন্ত্র্য-আকাক্সক্ষা বিপর্যস্ত হয়েছে বারবার। স্থানগত ও কালগত বিবর্তনের ফলে বাংলা কবিতায় যে স্বাভাবিক জঙ্গমতা প্রত্যাশিত, তার গতিকে রুদ্ধ করার জন্য ছাঁচেঢালা মেকি জগৎ তৈরি হতে থাকলো। কোনো-কোনো তরুণতর কবি অবশ্য রিক্ততা ও ভণ্ডামির এই উৎকট বাড়াবাড়ির প্রতিক্রিয়ায় পারিপার্শ্বিক জুড়ে দেখতে পেলেন শুধুই অ্যাবসার্ডিটি ও স্বাবিরোধিতার প্রদর্শনী। এই না-পৃথিবীর মধ্যে কোনো স্থির বিষয় খুঁজে পেলেন না তাঁরা, আঙ্গিঁক ও কাব্যভাষায় প্রায়োগিক নৈপুণ্যের চরম অভিব্যক্তি সন্ধানই হলো তাঁদের আধুনিকতার সারাৎসার। কিন্তু এক দশক পেরোতে-না-পেরোতে প্রতীচ্য-প্রভাবিত এই উৎকেন্দ্রিকতা থিতিয়ে এলো। বাংলা কবিতার এই ধারাটি আজ শুধু ইতিহাসের মহাফেজখানোয় লভ্য। আজ থেকে দু’দশক আগে বাঙালি সমাজের একটি টালমাটাল অধ্যায়ে হাওয়ায় যখন শুধুই বারুদের গন্ধ এবং ‘হীরের টুকরো ছেলেরা সব অশ্বমেধের বলি’-সেসময় যাঁদের কবিতা-রচনায় হাতে খড়ি হয়েছিল, কালের মাত্রা সম্পর্কে ক্রমশ তাঁদের ধ্যানধারণা বিচিত্রভাবে ব্যক্ত হতে থাকলো। পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল, নিশীথ ভড়, রণজিৎ দাশ এর মতো কবি বিশিষ্ট স্বাতন্ত্রদীপ্ত পথে সময় পরিক্রমা করতে চাইছেন। এঁরা পূর্বজ কবিদের বিষয়হীনতা থেকে নিশ্চিত প্রত্যাবর্তনের ভাড়নায় এই সমাজের উদ্ভট স্ববিরোধিতার মধ্যো দোলাচলময় বিষয়-ভাবনার সূত্র খুঁজে পেয়েছেন। খণ্ড সময়ের মৌল আদিকল্প সন্ধানের জন্যে পার্থপ্রতিমের যাত্রা ‘দেবী’ থেকে ‘রাত্রি চর্তুদশী’তে। তবু অস্তিত্বের কূটাভাস সম্পর্কে সচেতন হয়েও সাম্প্রতিক জীবনচর্যার আকরণকে তিনি কখনো ত্যাগ করেন না। নিশীথের কবিতা, পার্থপ্রতিমের সঙ্গে তুলনায়, নিশ্চিতভাবেই তত ঐতিহ্যসচেতন নয়, তবু পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা অনেক বেশি প্রত্যক্ষ। অন্যদিকে রণজিৎ এর কবিতায় মহানাগরিক চাতুর্য, নির্মম বিষাদ, আত্মঘাতী কৌতুক, মৌন অনুষঙ্গ, বিশ্বাসহীনতা, প্রখর নিরীক্ষা-প্রবণ আঙ্গিক-চেতনা ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে ফুটে ওঠে ‘এক বিস্ফোরিত আত্মনাট্য’। ‘আমাদের লাজুক কবিতা’ ‘জিপসীদের তাঁবু’ এবং ‘সময় সবুজ ডাইনি’ এর ক্যাব্যভাষায় যেন গত দুই দশকের ছিন্নমূল তরুণ মনের ভূকম্পরেখাচিত্র দেখা যায়।

বস্তুত পার্থপ্রতিম, নিশীথ কিংবা সামান্য অদূরবর্তী সময়ের কবি মৃদুল দাশগুপ্ত, সুবোধ সরকার, মল্লিকা সেনগুপ্ত-এর তুলনায় রণজিৎ অনেক পূর্ণতরভাবে সাম্প্রতিক দ্বিধা নিয়ে মডার্ন জীবনভাবনার প্রতিনিধিত্ব করছেন। কবিতার আকরণ ও ভাববীজ এর দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক নিয়ে তাঁর ভাবনার গভীরতা সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ নেই, যদিও স্থিতিহীন বিশ্বাসহীন জগতের প্রতি একদেশদর্শী প্রতিক্রিয়ায় তিনি বিষয় ব্যাপ্তির প্রতি মনোযোগী হতে পারেননি। এক ধরনের পৌনঃপুনিকতায় রণজিৎ-এর অণুবিশ্ব আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে। কবি লিখেছেন : ‘সত্য কী, আমরা জানি না। অথচ মিথ্যাকে জানি। .... খুব সম্ভবত আমরা মাতৃগর্ভ থেকে মিথ্যাকে জানি।’ আর এইজন্যেই হয়তো, আশ্চর্য সন্ধান-প্রবণতা সত্ত্বেও, নিগূঢ় মনস্তান্ত্বিক কারণে রণজিৎ-এর কবিতা বিপন্ন ব্যক্তি-সত্তার পলায়নমনস্কতাকে ঝকঝকে নতুন কিছু অস্থির চিত্রমালার সাংকেতিকতার মধ্যে দরে রাখে। ‘গ্রীষ্ম ১৯৮৮ নামক বিশেষ তাৎপর্যবহ কবিতার কিছু অংশ এখানে তুলে ধরছি--

কোথাও আগুন নেই। শুধু উজ্জ্বলতা। নিঃশ্বাসমোচন।
প্রতিটি রাস্তার বাঁকে
ছোট ছোট ঘূর্ণি, যেন বাতাসবালিকা, তার স্কুলবালকের
হাত ধরে নিয়ে যায় দিশাহীন রৌদ্রে, তেপান্তরে।
আমাকেও নিয়েছিল। পঞ্চাশ বছর
সেই তেপান্তরে থেকে, বাতাসের আড়কাঠি হয়ে
ফিরে এসে দেখি সেই একই গ্রীষ্ম, ট্রাফিক-আলোয়
মরুশৃগালের চোখ আজও জ্বলে-নেভে।
পঞ্চাশ বছর আমি ঘুরে ঘুরে যা দেখেছি সমস্ত রূপকÑ
কোনো বাস্তবতা দেখি নি কোথাও।
ধাইবুড়ি, ফেরিঘাট, সূর্যাস্ত, মদের ভাঁটি, উল্কি ও গণ্ডুষ
যেটুকু বাস্তব তা রূপকের বাস্তবতা :
ভিন্ন ভিন্ন অর্থে ও বিভ্রমে
কাকতাডুয়ার মতো দৃশ্যমান, শূন্যতার আনাচে-কানাচে।
(রণজিৎ দাশ, ‘গ্রীষ্ম ১৯৮৮’)

নিজের প্রজন্মের কবি ও কবিতা সম্পর্কে রণজিৎ এর ধারণার কথা আমরা জানি: ‘অগ্রজদের শঠতায় স্তম্ভিত অনুজদের এক প্রজন্ম। .... এই প্রজন্ম বাক্সংযমী কঠোর, ভণ্ডামির বিষয়ে স্পর্শকাতর হয়তো একটু বেশি।’ কিন্তু যে-কথাটি তিনি জানান নি, তা হলো এই প্রজন্মের উত্তরনহীন স্ববিরোধিতা, গন্তব্যহীন যাত্রা ও পরিণতিহীন আত্মপরিক্রমা। এই সঙ্গে রয়েছে মহানাগরিক জীবনের অসামঞ্জস্যবোধ ও উদ্ভট যান্ত্রিকতা। রণজিৎ এর কৈশোর ও প্রথম যৌবন কেটেছে আসামের আলোয়-উত্তাপে, পরে কলকাতার মহানাগরিক জীবনপ্রণালী তাঁকে নতুন করে ভেঙেছে এবং গড়েছে। ফলে একই কালসীমায় রণজিৎ প্রকৃতপক্ষে দুই কাল, দুই প্রেক্ষিত, দুই জগৎ, দুই মূল্যবোধ এর উদ্ভাসন লক্ষ করার সুযোগ পেয়েছেন। তাঁর চেতনায় আত্মবিরোধিতা যে ধূপছায়ার বলয় তৈরি করে, তাকে অনবরত প্রত্যাখ্যান করতে-করতে রণজিৎ এর কাব্যভাষা, স্থির কেন্দ্রের অভাবে, উৎকেন্দ্রিক সাংকেতিকতার ঝোঁকে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। এক সময় তিনি এই লক্ষণীয় স্বীকারোক্তি করেছিলেন : ‘কোনো বিষন্ন ভাটিয়ালি গানের মত নিঃঝুম ব্যাকরণহীন জীবন চেয়েছিলাম। একই সঙ্গে চেয়েছিলাম ক্যাবারে নর্তকীর পরচুলার মত উদ্দাম ঝলমলে ব্লন্ড জীবন। চেয়েছিলাম ক্রিয়াপদটির বাঙালী এ্যাপিল ছাড়া এই বাক্য দুটির আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। ..... এর মধ্যেই সব কিছু স্মৃতি বিস্মৃতি, যৌন অবসেশন, মুর্গ মসুল্লম, কাশ্মীর ভ্রমণ, বৌ, বই, চর্মরোগ, পেতিবুর্জোয়া শ্রেণী-চরিত্র, টর্চলাইট এবং এমন কি আত্মানুসন্ধাদেন....।’ এই ঝকঝকে নাগরিক সপ্রতিভতা রণজিৎ এর নব্য আধুনিক অবস্থানকে চিনিয়ে দেয়, তাঁর বুদ্ধির চমকও অনুভূতির সত্ত্বেও সাম্প্রতিকের শৃঙ্খল কবিতার অগ্রগমণকে স্তিমিত করে দেয়। ‘সময় সমুজ ডাইনি’ রণজিৎ এর কবিজীবনের সন্ধিকাল ও নাগরিক মেধার সংকটকে প্রকট করে তুলেছে। এই সংকট একটু ভিন্ন ভাবে প্রকাশিত হয়েছে মৃদুল দাশগুপ্ত, সুবোধ সরকার, মল্লিকা সেনগুপ্তদের কবিতায়। তবে ‘জলপাইকাঠের এসরাজ’ ‘ধমেষকথা’ আমি সিন্ধুর মেয়ে’ আবহ আকরণ, ভাষা-পরিকল্পনার ক্ষেত্রে যে পরিশীলিত চাতুর্য-প্রবণতা দেখিয়েছে, সেইটে এই মুহূর্তে বাংলা কবিতার বিস্তৃত ভূগোলে বহু কবির আশ্রয়স্থল। ফলে নির্বোধভাবে মুদ্রাদোষের চাষ হচ্ছে সর্বত্র, বানিয়ে-তোলা যৌথ কণ্ঠস্বরের পেষণে ব্যক্তিচেতনার অনন্যতা হারিয়ে যাচ্ছে। ক্ষয়িষ্ণু আধুনিকতার বিষ-বীজাণুর সংক্রমণে ‘চৈতন্যে মড়ক’ এর চলছবি হিশেবে যেন দেখা দিচ্ছে তরুণ কবিদের রচনা। তবু, এরই মধ্যে কারো কারো কবিতা স্বতন্ত্র পথে এগোছে, প্রকরণ বা বিষয়গত ভাবনায় নিজস্বতা স্পষ্ট হয়ে উঠছে সেসব ক্ষেত্রে। দৃষ্টান্ত হিশেবে জমিল সৈয়দ (নীলক্ষুর চন্দ্রাযান), বৈদ্যনাথ চক্রবর্তী (তৃণভূমি), জয়দেব বসু (ভ্রমণকাহিনী) এবং চিত্রভানু সরকার, সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায় ও প্রবুদ্ধসুন্দর কর এর নাম উল্লেখ করা যেতে পারে।

তিন.

বাংলা সাহিত্যের দ্বিতীয় ভূবন গড়ে উঠেছে বাংলাদেশে। রাষ্ট্রশক্তির পতন ও গভীরতম সামাজিক সংকটের প্রচ্ছায়ায় আধুনিকতাবাদ সেখানে ক্ষয় ও শূন্যতার জটিল অবয়বকে স্পষ্ট করে তুলেছে। শ্রেণীদ্বন্দ্বজর্জরিত বাঙালি সমাজে সামন্ততান্ত্রিক মূল্যবোধের শিকড় গভীরে প্রোথিত। অথচ নতুন উৎপাদন সম্পর্কের দ্রুত বিকাশের ফলে নগরকেন্দ্রিক সাহিতচর্চার অবভাসের ক্ষেত্র প্রসারিত হয়েছে ক্রমশ। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে নতুন জীবনস্বপ্ন কবিতায় যে সত্যবোধ ও সামাজিক অন্বয়ের সম্ভাবনাকে কর্ষণ করেছিল, দেশজ ঐতিহ্যের পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা সত্ত্বেও প্রত্যাশিত উত্তরণ ঘটলো না বরং পূর্বজদের আত্মরতি ও পলায়নমনস্কতার দুর্মর প্রভাবে সৃজনের স্রোতোধারা রুদ্ধ হয়ে এলো। শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদের কবিতার ভিন্নধর্মী বিবর্তনে সমাজ-সংলগ্নতার দুই পরস্পরবিরোধী অভিব্যক্তি লক্ষ করি। কিন্তু কবিতার আকরণে ও প্রকরণভাবনায় প্রকৃত নতুন উদ্ভাসন হলো না, শামসুরের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরও মুদ্রাদোষের প্রাবল্যে ঈপ্সিত মাত্রায় পৌঁছালো না। অন্যদিকে আল মাহমুদের কবিত্ব পশ্চাৎমুখিনতার ফলে লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো। জিয়া হায়দারের প্রখর কালচেতনা কবিতায় প্রতিফলিত হয়েছে, তবু সংকটাপন্ন মধ্যবিত্ত বর্গের দোলাচলে ক্লিষ্ট ও সমসাময়িক অস্তিত্বের অসঙ্গতিতে পীড়িত কবিমন আধুনিকতাবাদের আঁধি ও রিক্ততায় স্বেচ্ছাবন্দিত্ব স্বীকার করে নিয়েছে। বাংলাদেশে ইতিহাস তৈরি হচ্ছে যখন রক্তের অক্ষরে, সেসময় কবিতা বিবেক ও মূল্যবোধ, স্বপ্ন ও যুদ্ধের অন্য নাম। দ্বিধাদীর্ণ বুদ্ধিজীবী মহলে বিচিত্র তাৎপর্য নিয়ে এসেছে সময়ের অগ্নিবলয়। হায়াৎ মামুদ, রফিক আজাদ, মোহাম্মদ রফিক, নির্মলেন্দু গুণ প্রভৃতি পরবর্তী কবিরা উত্তরকালের কাছে গ্রহণীয় হওয়ার জন্যে ভাববীজ ও আঙ্গিক নির্বাচনে ক্ষেত্রে ঐতিহ্যমনস্ক ধারাবাহিকতা অক্ষুন্ন রাখতেই মনোযোগী হয়েছেন বেশী। এই পর্যায়ে প্রতিনিধি-স্থানীয় কবি রফিক আজাদের মধ্যে যে সমগ্র বাঙালীর সত্তার ধারাবাহিক এক স্মৃতি-পরম্পরা, বিশাল ব্যাপক এক কৃষি-পটভূমি দেখতে পেয়েছেন কেউ, সেইটে আংশিক সত্য।

কারণ, কবিতার বিষয়-বিন্যাসে আধুনিকতাবাদী রিক্ততাবোধ এবং প্রকরণে বিবৃতিমূলক তা মূলত অপরিবর্তিত-ই রয়ে গেছে। তার মানে, মূল্যবোধ ও বিশ্ববীক্ষায় বিভিন্ন কবিমন একটি নির্দিষ্ট বৃত্তের বাইরে যেতে পারেনি। আপাত-সময়ের চক্রব্যূহ ভেদ করতে পারেননি বলেই জিয়া হায়দার লিখেছেন--

এখন বোধ করি এমনই একটা সময়-- অতীত
নিশ্চিহ্ন, বর্তমান অন্ধত্বের রূপকল্প ভবিষ্যৎ
অভিধান-বহির্ভূত।
এমনই একটা সময়, আমি সামনের দিকে
দু’হাত হড়িয়ে দিয়ে হাতড়াচ্ছি, ভয়াবহ
শূন্যতা ছাড়া কিছুই হাতে লাগছে না, আর
পেছনে যতোবারই হাত রাখছি দেয়াল
ছাড়া আর কিছুই ঠেকছে না।’
(জিয়া হায়দার, ‘আমার সামনে পেছনে’)


এই উচ্চারণ-রীতির সঙ্গে রফিক আজাদের নিম্নোদ্ধৃত কবিতাংশের পার্থক্য নেই--

‘সত্য এতো বিশাস, ব্যাপক আর বিস্তারিত, যে,
আমার দু’হাত তাকে আঁকড়ে ধরতে পারে না,
আমার দুচোখ সত্য-ছবি ধরে রাখতে পারে না
সৈকতে ভাঁটার টানে যেমন পায়ের নিচ থেকে
বালি সরে যায়Ñ সত্যের মহান মাটি
আমার পায়ের তলা থেকে তেমনি সরে-সরে যায়।
(রফিক আজাদ, সত্য)


অর্থাৎ একই আত্মভুক প্রতি-চেতনা গ্রাস করছে দু’টি কবিসত্তাকে। এই আর্তি অনিবার্য কেননা মূলত ক্ষয়িষ্ণু আপাত-কালের অসাড়তায় বদ্ধ সাম্প্রতিকতা কবিদৃষ্টিকে রুদ্ধ করে। আধুনিকতাবাদী জীবনভাবনাকে প্রত্যাখান না-করা অবধি পরিত্রাণ নেই কবির। এই উপমহাদেশে বাংলা ভাষায় যাঁরাই লিখছেন, তাঁদের মধ্যে রাজনৈতিক কারণে যতই কৃত্রিম বিভাজন হয়ে থাকুক, অবক্ষয়ী আধুনিকতা শিকড় ছড়িয়েছে, তেমনি বাংলাদেশেও স্থিতাবস্থার পক্ষপাতীরা এর জঠরে আশ্রয় নিয়েছেন। আবার জীবনের প্রতি দায়বদ্ধতা পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের বাংলা কবিতায় যেভাবে উত্তরণ-চেতনায় দেখা যাচ্ছে কয়েক দশকের অন্ধকার কেটে যাওয়ার ইঙ্গিত, সেইটে ইদানিং বাংলাদেশের কবিতায়ও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। খুবই পরিতাপের কথা, বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন কেন্দ্রগুলিতে কয়েক বছরে যে ‘নতুন প্রতিজ্ঞার অগ্নি-উচ্ছ্বাস-এ আধুনিকতার কালো মুকুটচ্যুত’ হওয়ার লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, তার সম্পূর্ণ পরিচয় আমরা নিতে পারছি না, কৃত্রিম বিভাজনের ফলে পারস্পরিক আদানপ্রদানের সম্ভাবনা ব্যাহত হওয়ায়। তবু, যতটুকু আভাস পাচ্ছি, তাতে অরুণোদয়ের আলোকরেখাটি স্পষ্ট।
মোহাম্মদ রফিক এর ‘গাওদিয়া’ ও ‘স্বদেশী নিঃশ্বাস তুমিময়’ সংকলনে দেখতে পাই ঐ আলোর ইশারা। ঐতিহ্যের আয়তনে নতুন জীবনবীক্ষণ গভীর অর্থবহ হয়ে উঠেছে, কবিতার ভাষাও তাই সংকেতঋদ্ধ, উপভাষাও লোকায়ত অনুপুঙ্খর সদর্থক প্রয়োগে গড়ে উঠেছে মহাসময়ের দ্যোতনা। সব মিলিয়ে, সংকীর্ণ আধুনিকতাবাদ পরাভূত হওয়ার লক্ষণও স্পষ্টতর--

ক. ‘উপচে-পড়া দুধের গরম বাটি আহারের শেষে
প্রান্তদেশে নিভন্ত ক্ষুধায় মুচড়ে উঠে ভিন্ন স্বাদে,
শস্যের কবাট-দেয়া অন্তঃপুরে নিঝুম কুঠুরী,
পাতলে অচিন পুরু খাড়াখাদ নিরেট পাথুরে,
অনন্ত কাঙাল লোভী, হিমশ্বাস ফেলে শঙ্খচূড়।
রুপোর পালঙ্কে বন্দী রাজার কুমারী। ভোর হলো।
রাক্ষসী স্বপ্নের পেটে উষর মৃত্যুর তাপে পোড়া,
নীল কমলের নাঙা ঝলমল করে তরবারি।
(মোহাম্মদ রফিক, ‘রূপকথা, তাও নয়’ : গাওদিয়া)

খ. বহু আগে একদিন ঈশ্বর সর্পকে পাঠালেন
মানুষের পিছে-পিছে স্বর্গ থেকে দূর মর্ত্যদ্বারে,
রহিমের ঘরের মেঝেতে গর্ত খুঁড়ে বাসা বেঁধে
দীর্ঘদিন সেও আজ ডুকরে ওঠে ঘুমের বেঘোরে,
পেটেতে ক্ষুধার জ্বালা, হাড়ের কাঁপুনি, কড়া শীতে
বস্ত্র নেই, বিকলাঙ্গ, নূন আনতে পান্তাও ফুরালো।’
(মোহাম্মদ রফিক, ‘শক্রতার নৃতত্ত্ব’, স্বদেশী নিঃশ্বাস তুমিময়)


উত্তর-আধুনিক প্রকরণ-চিন্তা ছায়া লক্ষ করি ‘কাব্যকাহিনী’ নামক নিটোল, কবিতায়’ আকরণ-ভাবনার বিশেষত্ব ফুটে উঠেছে স্তবক ও শূন্যায়তনের বিন্যাসে। তবে ‘স্বদেশী নিঃশ্বাস তুমিময়’ নামক দীর্ঘ কবিতাটি (পৃষ্ঠা-৩৭-৭৯) ইদানীন্তন বাংলা কবিতাধারায় অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ এবং সেই জন্যে সানুপুঙ্খ বিশ্লেষণের উপযোগী। ভাষাচেতনা, সমাজ-সংবিদ, ঐতিহ্য মনস্কতা ও গভীর সংবেদনার এমন সমন্বয় দুর্লভ। এই একটি কবিতার জন্যেই মোহাম্মদ রফিকের শিল্পরীতি সাম্প্রতিক সন্ধিক্ষণের সৃজনী প্রক্রিয়ায় বারবার আলোচিত হতে পারে। ঐ র্দীঘ কবিতার সূচনাপর্বও লক্ষণীয়--
‘যেভাবে একটি জমি চাষ করা হয়

চালচিত্র স্থিরচিত্র ভেঙে-ভেঙে চিত্র গতিময়
ঘর থেকে ঘরে আঙিনায় সান্ধ্যদীপ হাতে
অন্ধকার আলো জ্বেলে পার হয় খালেকের বৌ
যেভাবে ব্যক্তির মুখে চর জাগে ভবিষ্যৎ মানুষ


তরুণতর কবিদের মধ্যে এখন ঐ জীবনপিপাসা আরো স্পষ্ট, কবিতার নির্মিতিতে পূর্বজদের শৈথিল্য কাটিয়ে উঠেছে এঁরা। কয়েকটি দৃষ্টান্ত বেছে নিচ্ছি। চিত্রল ভাষার আয়তনে কখনো বা কাজল শাহনেওয়াজের মতো কবি খুঁজে মগ্ন উচ্চারণের আধার : ‘আমাদের এখানে কর্মশালার পাশ দিয়ে দিগন্তের মাফলার হয়ে রেললাইন চলে গেছে বহুদুর’ (‘কর্মশালার পাশে’, রেললাইন) কিংবা খোন্দকার আশরাফ হোসেন-এর কবিতায় (‘নৈশভোজ’) ঐ একই উৎস হয়ে ওঠে স্মরণীয় অভিব্যক্তির মৌল প্রেরণা : ‘কৃপণ নিসর্গ আজ দাঁতের ভেতরে রাখে তৃষ্ণার আঙুর’। তবে শেষোক্ত কবির ঐতিহ্যমনস্কতাই তাঁকে আলাদাভাবে চিনিয়ে দেয়--

রাজার আসন কাঁপে, পদতলে মনসার ক্ষুধিত মোচড়,
দুয়ার লাগানো আছে, কোন ফাঁকে পালাবে চঞ্চল?
শানানো হয়েছে ছুরি, বন্ধ ঘরে চুল্লীর আগুন,
ক্ষুধিত অতিথি সব বসে আছে, পিপাসার পুরুতঠাকুর।
(খোন্দকার আশরাফ হোসেন : ‘নৈশভোজ’)


অবশ্য উচ্চকণ্ঠ ও বিবৃতিধর্মী বাকপ্রকরণেরও অভাব নেই। মোহাম্মদ সাদিক বিনা-ভণিতায়, রহস্যের অনুষঙ্গ ছাড়াই, সরাসরি পৌঁছে যেতে চেয়েছেন পাঠকের কাছে তাঁর যাবতীয় আর্তি, ক্ষোভ, ঘূণা ও ক্রোধ নিয়ে (পশ্চিমবঙ্গের কবি নবারুণ ভট্টাচার্যের মতোই অনেকটা)--

বন্দীশালাকে কখনো আমি স্বদেশ বলি না
এখনো আমার কোনো নিজ বাসভূমি নেই

কসাইখানাকে আমি কখনো স্বদেশ বলি না
ক’জন বখিল সারাদিন নীল নকশা আঁকে
সারাদিন ষড়যন্ত্র সারাদিন বিষবৃক্ষে জল
তারা সতীর্থের তলপেটে ধারালো ছুরি চালিয়ে বলে
ওম্ শান্তি ওম্ শান্তি

আমি যে স্বদেশ চিনি
সেখানে এমন উল্লোলিত হলাহল নেই
(মোহাম্মদ সাদিক, উদ্বাস্তু)


রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ এর কবিতা সম্পর্কেও একই বক্তব্য। অন্যদিকে মারুফ রায়হান, সরকার মাসুদ, সাজ্জাদ শরিফ, ফরিদ কবিরের রচনায় উত্তর-আধুনিক কবিতা-প্রকরণের আভাস পাই। সরকার মাসুদের অভিব্যক্তি মনোযোগ কেড়ে’ নেয় : ‘শিশুর চোখের শাদা অংশের মতো আলো’ বা ‘কুয়াশায় গুপ্তঘাতক দূর জংশন ষ্টেশনে বসে চা খায়’ (‘হতে পারে’)। ফরিদ কবিরের নিবিষ্ট উচ্চারণও আলাদা ভাবে উল্লেখ করার মতো--

পাথর পড়েছে জলে, নাকি জল পাথরে পড়েছে
এই নিয়ে দ্বিধায় রয়েছো
তোমার মগজ গেঁথে আছে পতনের দাগ
চতুষ্পার্শ্বে কোলাহল তিনশো তেরোটি শব্দ
তোমার দ্বিধায় তবু পানি ও পাথর
(ফরিদ কবির, ‘পাথর অথবা জল’)


একই ঘরানার কবি সাজ্জাদ শরিফও :

নিঘুম জাগর আমি দিগব্যাপী এ-জলমাতালে
দেখেছি উঠেছি জেগে সমাধিমহল--
একটি সে মালি, তাতে মনুষ্যচর্বির দীপগুলো
জ্বলে উঠছে একে একে আমাকে কি বেছে নিতে বলো
ও ডানা, ও পুনরাগমন?’
(সাজ্জাদ শরিফ, ‘ডানা’)


নতুন শব্দবন্ধ নির্মাণ বা বিশেষণের সূক্ষ্মতা-সন্ধানী প্রয়োগ, ক্রিয়াপদের দ্রুতি ইত্যাদির মধ্যে ফুটে ওঠে জায়মান অণুবিশ্বের নবীন প্রকৃতি। এখানেই সমিধ সংগ্রহ করে উত্তর-আধুনিকতার নন্দন-প্রস্থান। কামাল মাহমুদের মন্ত্রতুল্য উচ্চারণে আসন্ন উদ্ভাসনের প্রতিশ্র“তি ও রূপরেখাটি আশ্চর্য সরল লাবণ্যে বিধৃত হয়েছে--

‘ভাঙন পেছনে থাক সম্মুখে নির্মাণ
বাতাস কাঁদুক আমি বলি তাকে প্রকৃতির বাঁশী
আর্তের অসহায় হাতে গুঁজে দিই সাদা ফুল।

ভাঙন পেছনে থাক সম্মুখে নির্মাণ
ঘাসের সবুজ সাপ, যাক, চলে যাক
আমি তার সবুজেই সুখী, আমি ঘাসফুল গন্ধেই প্রীত
জানি ফুলে কাঁটাদের বিষ তো থাকেই
থাক, ভাঙন পেছনে থাক, সম্মুখে নির্মাণ’--
(কামাল মাহমুদ, ‘নির্মাণ’)


এই প্রত্যায়স্পন্দিত দৃঢ় পুনরাবৃত্তিময় উচ্চারণে উত্তর-আধুনিক জীবনভাবনার সারাৎসার উপস্থাপিত হয়েছে। আধুনিকতাবাদ নির্বাধ ভাঙন, ক্ষয় ও অবসাদের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত ছিল এতদিন, যা-কিছু প্রতিনিয়ত টুকরো করে আনে মানুষকে সেই পদ্ধতিতে তার উল্লাস। কিন্তু মানুষের সভ্যতাবিকাশের দ্বান্দ্বিক নিয়মে, ভাঙনকে পেছনে ফেলে, ‘সম্মুখে নির্মাণ’-এর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে মানুষের মৌল সত্তা-প্রতিষ্ঠার স্বপ্নময় আকাক্সক্ষা।
সাংস্কৃতিক উপনিবেশবাদ ও এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার বিরুদ্ধে উত্তর-আধুনিক জীবনদর্শনই হতে পারে সবচেয়ে জোরালো প্রতিবাদ। এই উপলব্ধি ধীরে ধীরে শক্তি সঞ্চয় করছে বাংলাভাষা-ব্যবহারকারী কবিদের মধ্যে-- যেমন ভারতের পশ্চিমবঙ্গে, আসামে, ত্রিপুরায় তেমনি বাংলাদেশে। যাত্রী সবাই একই তরণীর। বাংলা কবিতায় এই হলো আজকের পরিপ্রেক্ষিত স্পষ্টতই যাতে ব্যক্তিসত্তা ও সামাজিক সংবেদনার দ্বান্দ্বিকতা এবং বহমান সময় ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের আবর্তন বিচিত্র প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নানাধরনের মূল্যমান তৈরি করে চলেছে। নিঃসন্দেহে এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে আধুনিককতাবাদ সম্পর্কে তীক্ষ্ণ সংশয় ও অনিবার্য কিছু প্রশ্নের উপস্থাপনা।

(একবিংশ ১০/সেপ্টেম্বর ১৯৯২ সংখ্যা থেকে পুনর্মুদ্রিত)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন