শুক্রবার, ৯ এপ্রিল, ২০১০

খোন্দকার আশরাফ হোসেন : ইঙ্গ-মার্কিন কবিতায় আধুনিকবাদ


ইঙ্গ-মার্কিন কবিতায় আধুনিকবাদ
প্রেক্ষাপট

ইংরেজি কবিতায় আধুনিকবাদের আর¤ভ বিশশতকের শুরুতে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমসময়ে, যখন এজরা পাউন্ডের নেতৃত্বে ইমেজিস্ট আন্দোলনের সূচনা হয়। ঊনিশশতকের প্রথমার্দ্ধে রোমান্টিক কবিতার প্রধান পুরুষরা কাব্যসিদ্ধির যে-জায়গায় পৌঁছেছিলেন, মধ্য ও শেষ ভাগের ভিক্টোরীয় কবিগণ সেই চূড়া স্পর্শ করতে পারেননি। শেষোক্তরা কবিতায় মূলত রোমান্টিকতার অনুধ্যানই করেছেন, কিন্তু সে-রোমান্টিকতা শেলি-কীটসের প্রাণবন্ত ঐকান্তিকতা থেকে ছিল বঞ্চিত। আলফ্রেড লর্ড টেনিসন (Alfred Lord Tennyson), ম্যাথ্যু আর্নল্ড (Matthew Arnold) কবিতায় চিত্তাকর্ষক অনেক উপাদান যোগ করেন : আর্নল্ডের ক্ষেত্রে দার্শনিক বিষাদ কবিতার দেহে যুক্ত করেছিল ভিক্টোরীয় সমাজের অনপনেয় হতাশা ও অনির্দেশ্যতাকে।
বিপরীতে টেনিসন ছিলেন উদ্বায়ী ও আশাবাদী, গীতিময় কিন্তু শিশুসুলভ ও অগভীর। কেবল রবার্ট ব্রাউনিঙের (Robert Browning) মধ্যে আঙ্গিকগত দৃঢ়তার সাথে চিন্তার দার্ঢ্য সংযুক্ত হয়েছিল। এঁরা ছাড়া, এবং সম্ভবত জেরার্ড ম্যানলি হপকিন্স (Gerard Manley Hopkins) বাদে, অন্য কবিরা সমর্পিত ছিলেন আবেগের অতিরেক, চিন্তার শিথিলতা, আতি-ছান্দসিক মিষ্টতায়। ফলে শতাব্দী শেষে ভিক্টোরীয় কবিতা হয়ে উঠেছিল বোদ্ধা পাঠকদের হাসি-ঠাট্টার খোরাক। তরুণ কবিদের মনে বিদ্রোহ পাকিয়ে উঠছিল ক্রমশ : তাঁরা ভিক্টোরীয় কবিতার প্রথাগত আঙ্গিক, অতি-অলংকৃত কাব্যভাষা এবং আবেগের অতিরেকের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছিলেন তাঁদের লেখায়। যেমন ফোর্ড ম্যাডক্স ফোর্ড (Ford Madox Ford) ১৯১৩ সালে লেখেন : ''...the song of birds, moonlight—these the poet playing for safety and the critic trying to find something to praise, will deem the sure cards of the poetic pack. They seem the safe things to sentimentalise over and it is taken for granted that sentimentalty is the business of poetry.”1 (Jones:১৪) ঊনিশ-শতকের শেষার্দ্ধের কবিদের এই মিষ্ট এবং অলংকৃত কাব্যশৈলীর বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া দানা বাঁধছিল আটলান্টিকের দু’পারেই। টমাস হার্ডি, রবিনসন, রবার্ট ফ্রস্ট, ডব্লু বি ইয়েটস, এবং কিছু-কিছু জর্জীয় কবির কবিতায় পেশীমন্ত চলিত ভাষার প্রয়োগ প্রকাশভঙ্গিতে যুক্ত করছিল মননশীলতা ও নাট্যগুণ। রুডইয়ার্ড কিপলিঙ (Rudyard Kipling), জন মেসফিল্ড (John Masefield) এবং কার্ল স্যান্ডবার্গ (Carl Sandburg)-রা আরো এক ধাপ এগিয়ে কথ্যভাষার প্রয়োগ করছিলেন তাদের প্রধানত ন্যারেটিভ কবিতাগুলোতে। অন্যদিকে, কিয়ৎকাল পরে, পাউন্ড-এমি লাওয়েলদের নেতৃত্বে ইমেজিস্টরা ভাষাকে সংকুচিত-সংহত করে চিত্রকল্পকে করে তুলছিলেন স্ফটিকীত ও লক্ষভেদী। সমসময়ে য়ুরোপের নানা খণ্ডে মনস্তত্ত্ব, নৃবিজ্ঞান ও সমাজতত্ত্বে যেসব আলোড়ন চলছিল তারও প্রবল সংক্রাম ঘটে ইঙ্গ-মার্কিন কবিতায়। বিশেষত ফ্রয়েডের মনোবিকলতত্ত্ব, তাঁর খাবনামা The Interpretation of Dreams, জেমস ফ্রেজারের লোকবিশ্বাস ও মিথ-সম্পর্কিত যুগান্তকারী রচনা The Golden Bough-এর প্রভাব আমূল পাল্টে দিচ্ছিল তরুণ কবিদের বিশ্ববীক্ষা ও জীবনভাবনা। চেতনার পরম্পরাহীন কিন্তু অনুষঙ্গসঞ্চারী প্রবহমানতা, নিউরোসিস, অবচেতন মন, যৌথ নির্জ্ঞানের ধারণা, স্বপ্নের গূঢ়তা, মিথের বৈশ্বিক তাৎপর্য প্রভৃতিকে আমলে নিয়ে বিশ-শতকের নতুন সাহিত্য নবীন ভাষায় ও নবচেতনায় জেগে উঠছিল। জেমস জয়েসের উপন্যাসে চেতনাপ্রবাহরীতি (Stream of Consciousness Method), ডি এইচ লরেন্সের উপন্যাসে ফ্রয়েডীয় তত্ত্বের প্রয়োগ, এলিয়টের The Waste Land কাব্যে মিথের ব্যাপক ব্যবহার এবং বর্ণনাশৈলীতে চেতনাপ্রবাহ রীতির প্রয়োগ-- নানা নিরীক্ষায় উচ্চকিত শতাব্দীর প্রথম দুই দশক।
সাহিত্যের ইতিহাসকারগণ অনেকসময়, কিছুটা খেয়ালিভাবেই একটি তারিখকে বেছে নেন একটি সাহিত্যান্দোলনের আরম্ভ-বিন্দু হিসেবে। সেই কারণে ইংরেজি কবিতার একটি বিশাল উপপ্লবের, রোমান্টিকতার পুনর্জন্মের, সূচনাকাল হিসেবে ধরা হয় ১৭৯৮ সালকে-- এ বছর প্রকাশিত হয়েছিল ওয়ার্ডসওয়ার্থ-কোলরিজের যুগ্ম কাব্যসংকলন Literary Ballads. ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাসে আরেকটি চরম বাঁক আধুনিকবাদ। এর উত্থান-বিন্দুকে যদি একটি নির্দিষ্ট তারিখ দিয়ে চিহ্নিত করতেই হয় সে তারিখটি সম্ভবত হবে ১৯১২ সাল : ঐ বছর শিকাগোতে প্রকাশিত হয় হ্যারিয়েট মনরোর সম্পাদনায় সাহিত্যপত্র পোয়েট্রি। আধুনিক ইঙ্গ-মার্কিন কবিতার ধাত্রীমাতা বলা যায় কাগজটিকে। পোয়েট্রি ম্যাগাজিনে মনরো ঘোষণা করেছিলেন যে, তাঁর পত্রিকাটি কবিদের দেবে “a chance to be heard in their own place, without the limitations imposed by the popular magazine.” আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শুরুর তারিখ ১৯১৪ সাল, যে-বছর এজরা পাউন্ড বিখ্যাত Der Imagistes সংকলনটি সম্পাদনা করেন এবং নিউইয়র্কে এটি প্রকাশ করেন মার্কিনী কবি, তখনকার অখ্যাত তরুণ, আলফ্রেড ক্রেইমবর্গ। ১৯১২ থেকে ১৯১৭--এই ছয় বছরের মধ্যে ইঙ্গ-মার্কিন আধুনিকবাদের পুরোধাদের, তথা ফ্রস্ট, এমি লাওয়েল, কার্ল স্যান্ডবার্গ, উইলিয়াম কার্লোস উইলিয়ামস এবং এলিয়টের প্রথম অথবা প্রথম-গুরুত্বপূর্ণ কাব্যগুলো প্রকাশিত হয়। এই প্রাথমিক পর্বের শেষবিন্দু ধরা যায় ১৯২২ সালকে, যখন প্রকাশিত হয় আধুনিকবাদী কবিতার সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ অবদান, এলিয়টের The Waste Land. ১৯২০ সালের মধ্যে ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় আধুনিকবাদ সপ্রতিষ্ঠ; বিশের দশক থেকে পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত এর দুর্দমনীয় কাল, যাকে ইংরেজিতে বলা হয়ে থাকে High Modernism ।
আমেরিকা থেকে ভেনিস ঘুরে লন্ডনে এসে পৌঁছলেন এজরা পাউন্ড, ১৯০৮ সালে। উদ্দেশ্য ছিল প্রধানত ইয়েটসের সাথে সাক্ষাৎ করা। কিন্তু তাঁর এই আগমনটি, শত বছরের দূরত্ব থেকে দেখলে মনে হয়, এক মহাকাব্যিক পদার্পণের মতো। আধুনিক ইংরেজি কবিতা যেন এক মুক্তিদূতের অপেক্ষায় ছিল। এজরা পাউন্ড এলেন এবং ঘুরিয়ে দিলেন ইংরেজি কবিতার অভিমুখ; দর্শনীয়ভাবে আলাদা হয়ে গেল ইংরেজি কবিতা অব্যবহিত আগের ভিক্টোরীয়-এডওয়ার্ডীয় কবিতা থেকে। ছয় বছর পর, ১৯১৪ সালে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তখন শুরু হয়ে গেছে, এলেন আরেকজন বৃহত্তর মুক্তিদাতা, প্রশান্ত মহাসাগর পেরিয়ে, সেই আমেরিকা থেকেই : টি এস এলিয়ট। বলা হয়ে থাকে, ১৯১০-এর পর ইংরেজি কবিতায় যা কিছু ভালো কাজ হয়েছে তা মার্কিনীদেরই কৃতকর্ম। শুধু কবিতা নয়, সৃষ্টিশীল অন্যান্য মাধ্যমের লেখকরাও লন্ডনে এসে পৌঁছাচ্ছিলেন সমসময়ে: এই ‘বিদেশী’রা মূলত লন্ডনকে বেছে নিয়েছিলেন, আধুনিকবাদী অন্য কেন্দ্র প্যারিসের পরিবর্তে, একারণে যে, লন্ডন ছিল তুলনায় অধিকতর কসমোপলিটান, এবং ইংরেজি ভাষাভাষী। এঁরা সবাই এখানে স্থায়ী আসন গাড়েননি শেষ পর্যন্ত, এলিয়ট ছাড়া। অনেকে পরে পাড়ি জমিয়েছেন প্যারিসে।
১৮৭০ থেকে ভিক্টোরীয় সাহিত্যাদর্শের প্রপতন আরম্ভ হয়ে যায়। ডিকেন্স মারা যান ১৮৭০-এ; আশির দশকে প্রয়াত হন আর্নল্ড ও ব্রাউনিঙ। রোমান্টিক মতাদর্শ, স্থির ট্রাডিশনের ধারণা ইত্যাদির পুনর্মূল্যায়নের প্রয়োজন অনুভূত হতে থাকে, প্রধানত ইউরোপের অন্যান্য দেশে ঘটমান পরিবর্তনের প্রভাবে। নরওয়ের নাট্যকার ইবসেনের ন্যাচারালিস্ট নাট্যাবলীর প্রভাব পড়ে জর্জ বার্নার্ড শ’র ওপর; ফরাসি প্রতীকবাদীদের প্রভাবে, তার সাথে দৈশিক প্রি- র‌াফায়েলাইটদের (Pre-Raphaelites) কবিতাদর্শের মিশ্র-সংক্রামে গড়ে উঠতে থাকেন ইয়েট্স (W B Yeats)। এই সময়পর্বে যাঁদের কর্ম ও চিন্তা ভিক্টোরীয় আদর্শকে প্রবলভাবে সংশোধিত করে নবতর নন্দন গড়ে তোলার ইন্ধন যুগিয়েছিল তাদের মধ্যে ছিলেন টমাস হার্ডি (Thomas Hardy), স্যামুয়েল বাটলার (Samuel Butler), জর্জ গিসিং (George Gissing), আর্নেস্ট ডসন (Ernest Dawson), আর্থার সাইমন্স (Arthur Symons), ডি এইচ লরেন্স (D H Lawrence), ই এম ফরস্টার (E M Forster), আর্নল্ড বেনেট (Arnold Bennet), এইচ জি ওয়েলস (H G Wells), টি ই হিউম (T E Hulme), লিটন স্ট্রাচি (Lytton Strachey), ভার্জিনিয়া উল্ফ (Virginia Woolf) ও ডরোথি রিচার্ডসন (Dorothy Richardson)। ইংল্যান্ডের লেখক-শিল্পীকুল চ্যানেল পাড়ি দিয়ে প্যারিস যাচ্ছিলেন শিক্ষানবিশির জন্য-- আধুনিকবাদের নানা আন্দোলনের পরম্পরা চলছিল তখন প্যারিসে: ন্যাচারালিজম, সিম্বলিজম, ডেকাডেন্স, নন্দনসারবাদ (Aestheticism), ইম্প্রেশনিজম, ফভিজম (Fauvism), কিউবিজম, নানা প্রপঞ্চ উন্মুখর রাখছিল শতাব্দী-ক্রান্তির প্যারিসকে। স্বদেশে ফিরে ঐসব আদর্শকে দেশীয় ঐতিহ্যের সাথে মিশিয়ে নতুন ধরনের আদর্শের জনন করতে চাইছিলেন অনেকে। বিরোধ ও সংকরায়ণ, দুই-ই চলছিল : একদিকে ঐতিহ্যিক ইংরেজ মধ্যবিত্ত নতুন ধারণাগুলোকে প্রতিরোধ করছিল, অন্যদিকে চলছিল নতুনকে আবাহনের প্রেষণা। বার্নার্ড শ, গলসওয়ার্দি (John Galsworthy) ও জয়েস যখন ইউরোপের নতুন ন্যাচারালিজমের ঢেউ তথা ইবসেনবাদকে অনুসরণ করছিলেন, ঠিক সেসময় ওয়াল্টার পেটার (Walter Pater) প্রকাশ করছিলেন তাঁর নন্দনসারবাদ তথা ঈস্থেটিসিজমের ধারণা যা ন্যাচারালিজমের বিপরীত এবং ফরাসি প্রতীকবাদের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ। অস্কার ওয়াইল্ড (Oscar Wilde)-এর The Picture of Dorian Gray এই নান্দনিকবাদেরই সাহিত্য প্রয়োগ।
সুতরাং পাউন্ড এবং এলিয়ট মডার্নিস্ট ধারার সূত্রপাত করলেও প্রদীপের সলতে-পাকানোর পর্বটি চলছিল ১৮৮০এর দশক থেকেই।

নান্দনিকবাদ, কলাকৈবল্য ও ডেকাডেন্স
প্রায অভিন্ন তিনটি আন্দোলন, অথবা একই আন্দোলনের তিন নাম ভিন্ন-ভিন্ন দেশে। ফ্রান্সে সিম্বলিজমের সমসময়ে এবং পাশাপাশি একটি আন্দোলন চলছিল, যার নাম ডেকাডেন্স বা অবক্ষয়বাদ। বলাবাহুল্য নামটি প্রশংসাসূচক ছিল না আদিতে, কিন্তু অচিরকালের মধ্যে এই আন্দোলনের অনুগামীরা ডেকাডেন্ট উপাধিটি সগর্বপরিধেয় করে তোলেন। এঁরা ছিলেন নন্দনসারবাদী তথা আর্ট ফর আর্টস সেক (L’art pour l’art)-এ বিশ্বাসী। (এমনকি বহু পূর্বে, অষ্টাদশ শতকেও ‘ডেকাডেন্ট’ শব্দটি নিন্দার্থে রোমান্টিকদের প্রসঙ্গে ব্যবহৃত হয়েছে, যেমন ভিক্তর হুগোকে বলা হয়েছে ডেকাডেন্ট।) বোদলেয়ার, তেয়োফিল গোতিয়ে (Théophile Gautier) প্রমুখ শেষ-ঊনিশশতকী ফরাসি লেখক কলাকৈবল্যবাদের পরহেজগার ছিলেন অলজ্জভাবেই। ১৮৮০-এর দশকে একদল ফরাসি লেখক খোলাখুলি নিজেদের ‘ডেকাডেন্ট গ্র“প’ নামে অভিহিত করেন। এই গ্রুপের সদস্য য়রিস-কার্ল হুইসম্ন্সা (Joris-Karl Huysmans)-এর উপন্যাস Against Nature-কে প্রথম ডেকাডেন্ট রচনার শিরোপা দেয়া হয়ে থাকে। সিম্বলিস্ট কবিদের মধ্যে বেশকয়েকজন এই অভিধায় পরিচিত হতে আপত্তি করেননি, যেমন আর্তুর র‌্যাঁেবা, জেরার দ্য নেরভাল ও পল ভেরলেন। কিন্তু অনেকে, যেমন মালার্মে ও জঁ মারেয়াস, এটিকে অস্বীকার করেন। সিম্বলিজম ও ডেকাডেন্সের মধ্যে চেতনাগত অনেক মিল থাকলেও দুটিকে পৃথক আন্দোলন হিসেবে ভেবে থাকেন প্রায সবাই। ইতালিতে ডেকাডেন্ট আন্দোলনকে বলা হতো ‘ডেকাডেন্টিসমো’।
বৃটেনে ডেকাডেন্ট আন্দোলনের নাম হয় কলাকৈবল্যবাদ অথবা নান্দনিকবাদ (Aestheticism)। এর গুরু ওয়াল্টার পেটার-- অক্সফোর্ডে অস্কার ওয়াইল্ডের শিক্ষক, নন্দনতাত্বিক ও গদ্যকার। ইংল্যান্ডের মধ্য-ভিক্টোরীয় প্রি-র‌্যাফায়েলাইট কবিরা ছিল তাঁর বন্ধু। তাঁর প্রতিপাদ্য ছিল শিল্পের জন্য শিল্প : শিল্পের সাথে সমাজতত্ত্ব বা নৈতিকতার কোনো যোগ নেই। বিশুদ্ধ আনন্দ, ইন্দ্রিয়জ ও কামজ, শিল্পীর অনুধ্যেয় বস্তু। সন্দেহ কি, অর্ধ-শতাব্দী আগের পরমরোমান্টিক কবি কীট্সের সাথে তাঁর চিন্তার মিল : কীট্স বলেছিলেন, “Beauty is Truth, Truth Beauty, that’s all/Ye know on earth, and all ye need to know.” পেটার ১৮৭৩ সালে প্রকাশ করেন তাঁর Studies in the History of the Renaissance প্রকাশ করেন, যে-গ্রন্থটি ভিক্টোরীয় যুগের তরুণ শিল্পবোদ্ধাদের অবশ্যপাঠ্য হয়ে ওঠে।
ইংল্যান্ডে কলাকৈবল্যবাদের প্রধান উদ্গাতা হয়ে ওঠেন অস্কার ওয়াইল্ড। ছাত্রজীবনে তিনি যেমন একদিকে পেটারের ধারণা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন, তেমনি অ্যাডগার অ্যালান পো ও অ্যালগারনন চার্লস সুইনবার্ন তাঁকে প্রভাবিত করেন। বোদলেয়ারের মতো ওয়াইল্ডও ছিলেন পরম ড্যান্ডি, সকল প্রথাগত নৈতিকতা ও সামাজিক দায়বোধ অস্বীকারকারী ও ভিক্টোরীয় উপযোগিতাবাদের কট্টর বিরোধী। তাঁর বর্ণিল জীবনকে তিনি মনে করতেন তাঁর সৃষ্টির চেয়ে মহত্তর-- যেকোনো শিল্পীই তাঁর কীর্তির চেয়ে মহান-- আর আর্ট প্রকৃতির চেয়ে উৎকৃষ্টতর, কেননা প্রকৃতিতে আর্টের শীলন ও সুমিতি নেই। সত্যিকরের ‘ঈসথেট’ একজন নির্বচিত সন্ত, পার্থিব নৈতিক মানদণ্ড তার জন্য প্রযোজ্য নয়। ‘'The Decay of Lying’ প্রবন্ধে তিনি বলেন, সৃজনধর্মী কর্ম হিসাবে আর্ট এবং খুনের মধ্যে কোনো ফারাক নেই। শিল্পী কখনো পরবেন মুখোশ, কিন্তু তাঁর মুখোশ হবে মুখশ্রীর চেয়ে অধিকতর প্রকাশক্ষম। ওয়াইল্ডের প্রবন্ধ ‘The Critic as an Artist’ রচিত হয়েছিল ম্যাথ্যু আর্নল্ডের ‘The Function of Criticism at the Present Time’-এর জবাবে।

চিত্রকল্পবাদ (Imagisme)
কবিতাকে ভিক্টোরীয় এবং এডওয়ার্ডীয় যুগের সেন্টিমেন্টালিজম, বাগবাহুল্য ও অতিসৌকর্য থেকে মুক্ত করার প্রথম প্রয়াস আসে ইমেজিস্টদের কাছ থেকে। এই সময়ে ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় শ্রেষ্ঠ কবি ভাবা হতো যথাক্রমে টেনিসন এবং লঙফেলোকে। সাধারণ পাঠক এঁদের কবিতার নীতিকথা ও গীতলতাকে আদরণীয় ভাবতো। ইমেজিস্টরা এসে জোর দিলেন ক্লাসিক্যাল সংহতি, স্বল্পবাকতা এবং অপরিচিত এমনকি ভিনদেশি ছন্দপ্রকরণ ও শৈলীর ওপর।
বিশশতকের সাহিত্য-আন্দোলনগুলোর মধ্যে ডাডাবাদের মতোই কৌতূহলোদ্দীপক হচ্ছে ইমেজিস্ট আন্দোলন। এটির জন্ম অবশ্য ফ্রান্সে নয়, ইংল্যান্ডে; এর প্রধান কুশীলবরা ইংরেজিভাষী। চারজন মার্কিনী -- এজরা পাউন্ড (Ezra Pound), এইচ. ডি. অর্থাৎ হিলডা ডুলিট্ল (H.D.: Hilda Doolittle), জন গোল্ড ফ্লেচার (John Gould Fletcher) ও এমি লাওয়েল (Amy Lowell), এবং তিনজন বৃটিশ-- রিচার্ড অলডিংটন (Richard Aldington), এফ এস ফ্লিন্ট (F. S. Flint), ও টি ই হিউম (T. E. Hulme)। ইমেজিস্টদের প্রতিপাদ্য ছিল যে কবিতা গড়ে উঠবে এক বা একাধিক স্বচ্ছ ও কঠিন ইমেজ বা চিত্রকল্পকে ঘিরে। কবিতায় ব্যবহৃত হবে দৈনন্দিন ভাষা, ফ্রি ভার্স; বিষয়বস্তু নির্বাচনে কবির থাকবে অবারিত স্বাধীনতা। ১৯১৪ থেকে ১৯১৭-এর মধ্যে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রথম চার বছরে ইমেজিস্টরা চারটি বার্ষিক সংকলন বের করেন, পঞ্চমটি প্রকাশিত হয় ১৯৩০ সালে, গ্রুপটি ভেঙে যাওয়ার ১৩ বছর পর, অনেকটা পুনর্মিলনীর ধরনে। ১৯১৫ সালে বেরোয় ইমেজিস্ট মেনিফেস্টো। তবে তারও আগে ১৯১৩ সালে এফ এস ফ্লিন্ট ‘Imagisme’ এবং এজরা পাউন্ড ‘A Few Don’ts by an Imagiste’ নামের প্রবন্ধে এই আন্দোলনের রূপরেখা ঘোষণা করেন। ফ্লিন্টের ইমেজিজম বিষয়ক নোটে তিনটি বিধি ছিল এরকম:
1. Direct treatment of the ‘thing’ whether subjective or objective.
2. To use absolutely no word that did not contribute to presentation.
3. As regarding the rhythm: to compose in sequence of the musical phrase not in sequence of a metronome.২

“ইমেজিস্টদের জন্য কয়েকটি বর্জনীয়” নিবন্ধে পাউন্ড ‘ইমেজ’-এর সংজ্ঞা দেন এভাবে:
An “Image” is that which presents an intellectual and emotional complex in an instant of time. I use the term “complex” rather in the technical sense employed by the newer psychologists, such as Hart, though we might not agree absolutely in our application.
… … …
It is better to present one Image in a lifetime than to produce voluminous works.৩

কবিতার ভাষা সম্পর্কে তাঁর পরামর্শ এরকম:
Use no superfluous word, no adjective, which does not reveal something….
Go in fear of abstractions. Don’t retell in mediocre verse what has already been done in good prose. …
It is not necessary that a poem should rely on its music, but if it does rely on its music that music must be such as will delight the experts. …
Don’t be “viewy”—leave that to the writers of pretty little philosophic essays. Don’t be descriptive; remember that the painter can describe a landscape much better than you can, and that he has to know a deal more about it.৪
ইংরেজি ভাষায় প্রথম সংগঠিত আধুনিকবাদী সাহিত্যান্দোলন ইমেজিজম। টি. এস. এলিয়টের মতে, “The point de repère usually and conveniently taken as the starting point of modern poetry is the group denominated ‘imagists’ in London about 1910.” সমসময়ে চিত্রকলায় চলছিল আভাঁ-গার্দ বিশেষত কিউবিজমের চর্চা, যেখানে বস্তুকে তার আপন স্বরূপে দেখার জন্য একে নানা জ্যামিতিক ফর্মে ভাঙার প্রবণতা বিদ্যমান। এজরা পাউন্ডও অনেকগুলো কংক্রিট দৃশ্যকণাকে পাশাপাশি উপস্থাপন করে একটি বিমূর্ত চিত্র আঁকার কথা বললেন। পদ্ধতিটি অনেকটাই বিবিধ পারস্পেকটিভ বা প্রেক্ষা ব্যবহারের মাধ্যমে একটি একক ইমেজ গড়ে তোলার কিউবিস্ট পদ্ধতির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
ইমেজিস্ট আন্দোলনের সাথে যাদের নাম যুক্ত তারা সবাই যে একইরকম আত্যন্তিকতা বা ঐকমত্য পোষণ করতেন তা নয়। এফ. এস ফ্লিন্ট, যিনি টি. ই. হিউম এবং পাউন্ড দুজনের সাথেই কাজ করেছেন, একসময় এমন অভিযোগও করেন যে পাউন্ডের নিজের কবিতাই ইমেজিস্ট কবিতা নয়। পাউন্ড আবার ফ্লিন্ট এবং ডি. এইচ লরেন্স (শেষোক্তকে ইমেজিস্ট সংকলনে নেয়া হয়েছিল অনেকটা আন্দোলনের উদারতার পরাকাষ্ঠা হিসাবে) উভয়কে বলেছেন ‘ইমপ্রেশনিস্ট’। পাউন্ড পরবর্তীকালে ইমেজিস্টদের সঙ্গ পরিত্যাগ করেন পুরোপুরি। তখন এর হাল ধরেন এমি লাওয়েল। সুতরাং ইমেজিস্ট আন্দোলনের তিনটি আলাদা পর্যায় চিহ্নিত করা যায়:
১. হিউম-পর্ব : ১৯০৯ সালে গঠিত টি. ই. হিউমের নেতৃত্বাধীন গ্রুপ-- এঁরা নিয়মিত লন্ডনের সোহো এলাকার আইফেল টাওয়ার রেস্টুরেন্টে বসে কবিতার নতুনতর শৈলী ও ভাষা সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করতেন। তাঁরা সমকালীন কবিতায় প্রাণ ফিরিয়ে আনার জন্য ফ্রিভার্সের ব্যবহার, জাপানি তানকা ও হাইকুর অনুসরণ এবং কবিতা থেকে বাগবাহুল্য সরিয়ে দেয়ার কথা বলতেন। মার্কিনী কবি পাউন্ড এই গ্রুপের সাথে পরিচিত হন ১৯০৯ এর এপ্রিলে; তাঁর নিজের চিন্তাভাবনার সাথে ফ্লিন্ট ও হিউমের চিন্তার মিল দেখে তাঁদের সাথে ভিড়ে যান। পাউন্ড এসময় জাপানী কবিতার স্বচ্ছতা ও নিরলঙ্কার উপস্থাপনা দ্বারা আকৃষ্ট হচ্ছিলেন। চীনা কবিতাও তাঁর অনুশীলনের বস্তু হয়েছিল। পাউন্ড ১৯১১ সালে দুজন নতুন সদস্যকে আইফেল টাওয়ার গ্রুপে যুক্ত করেন : এঁরা হলেন তাঁর প্রাক্তন প্রেমিকা হিলডা ডুলিট্ল এবং তাঁর ভবিষ্যৎ স্বামী রিচার্ড এল্ডিংটন। এই দুটিতে মিলে গ্রিক কবিতায় বিশেষত স্যাফোর রচনায় কাব্যিক সংহতির সন্ধান করছিলেন। বলাবাহুল্য, স্যাফোর প্রতি পাউন্ডেরও আগ্রহ ছিল।
২. পাউন্ড-পর্ব : ১৯১২ সালে পাউন্ড প্রথম ইমেজিস্ট শব্দটি ব্যবহার করলেন এবং হিলডা ও এলডিংটনের নাম দিলেন “Imagiste”. হিলডা ডুলিটলের নাম সংক্ষেপ করে তাঁকে নাম দিলেন H.D. Imagiste. মূলত এইচ. ডি. এবং এলডিংটনের রচনার পৃষ্ঠপোষণার জন্য পাউন্ড ১৯১৪ সালে Des Imagiste নামে সংকলনটি প্রকাশ করেন । এতে এঁদের ছাড়া আর যাঁদের কবিতা ছিল তাঁরা হলেন ফ্লিন্ট, স্কিপউইথ ক্যানেল (Skipwith Cannell), এমি লাওয়েল, উইলিয়াম কার্লেস উইলিয়ামস (William Carlos Williams), জেমস জয়েস্ (James Joyce), ফোর্ড ম্যাডক্স ফোর্ড (Ford Madox Ford), অ্যালেন আপওয়ার্ড (Allen Upward) ও জন কোর্নোস (John Cournos)। এঁদের অনেকেরই আইফেল টাওয়ারের আড্ডার সাথে কোনো যোগ ছিল না, কিন্তু পাউন্ড মনে করেছিলেন যে এঁদের রচনায় ইমেজিস্ট ধারণার অনুবর্তী উপাদান রয়েছে।
৩.লাওয়েল-পর্ব: ১৯১৫ সালে ফ্লিন্টের সাথে পাউন্ডের মতান্তর ঘটে। পাউন্ডের মনে হয় যে ফ্লিন্ট তাঁর আইফেল টাওয়ার বন্ধুদের বেশি গুরুত্ব দিতে চাইছেন, যার ফলে ইমেজিস্ট কবিতার মূল বৈশিষ্ট্য, যাকে তিনি বলতেন ‘Hellenic hardness’, হারিয়ে যাচ্ছে। পাউন্ড ইমেজিস্টদের সংস্রব ত্যাগ করে বন্ধু লেখক-চিত্রকর উইন্ডহ্যাম ল্যুইসের সাথে মিলে ভর্টিসিস্ট (Vorticists) আন্দোলনের পত্তন করেন। পাউন্ড চলে যাওয়ার পর এমি লাওয়েলের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে পাউন্ড-পরবর্তী ইমেজিস্ট দল, যাঁদের পাউন্ড রঙ্গ করে ডাকতেন, এমি লাওয়েলের নামানুসারে, ‘এমিজিস্ট’ (Amygist) বলে। লাওয়েল Some Imagist Poets নামে তিনটি ইমেজিস্ট সংকলন সম্পাদনা করেন-- প্রকাশিত হয় ১৯১৫, ১৯১৬ ও ১৯১৭ সালে।
শুদ্ধ এবং নিরাভরণ কবিতা গড়ে উঠবে একটি মাত্র ইমেজকে ঘিরে-- হিউম থেকে লাওয়েল পর্যন্ত সবার বক্তব্য ছিল এটিই। টি ই হিউমের নিচের কবিতাটিতে লক্ষ করা যাবে সকল অকাব্যিক প্রসঙ্গ থেকে বিযুক্ত একটি স্ফটিক-স্বচ্ছ চিত্রকল্পের উদ্ভাসন:
Above the Dock
Above the quiet dock in midnight,
Tangled in the tall mast’s corded height,
Hangs the moon. What seemed so far away
Is but a child’s balloon, forgotten after play.

তবে সবচেয়ে বিখ্যাত এজরা পাউন্ডের এই কবিতাটি: দেড় পঙক্তির মধ্যে লুক্কায়িত সংহত চিত্রকল্পের বিদ্যুচ্চমক-- আধুনিক নগর-জনতার ভিড়ে নাম-না-জানা মানুষদের মুখচ্ছবির এই হৃদ্য-করুণ চিত্রায়ণ মর্মান্তিকভাবে যথাযথ ও বাক্সময়।
In a Station of the Metro
The apparition of these faces in the crowd;
Petals on a wet, black bough.

এমি লাওয়েলের কোনো-কোনো কবিতাকে মনে হবে জাপানি হাইকুর ঘনত্বকে ধরার চেষ্টা, জাপানি কবিতারই ধরনে :
Yoshiwara Lament
Golden peacocks
Under blossoming cherry-trees,
But on all the wide sea
There is no boat.

(এ প্রসঙ্গে হ্যারিয়েট মনরো-সম্পাদিত বিখ্যাত মাসিকপত্র Poetry-এর ভূমিকা অবশ্য স্মরণীয়। আমেরিকার শিকাগো শহরে ১৯১১ সালে এই পত্রিকাটির জন্ম : আধুনিকবাদী কবিতার লালন-পরিচর্যায় এই পত্রিকাটির ভূমিকা প্রবাদে পরিণত এখন। ইংল্যান্ড-প্রবাসী মার্কিন কবি এজরা পাউন্ডকে বিদেশ-সম্পাদকের দায়িত্ব দেন মনরো। পাউন্ডও সম্ভাবনাময় তরুণ কবির সাক্ষাৎ পেলে তাদের কবিতা নিয়ে পাঠাতেন পোয়েট্রি-তে ছাপানোর জন্যে। এভাবেই তিনি তখনকার আরেক ভাগ্যান্বেষী মার্কিন তরুণ টি. এস. এলিয়টের কবিতা (পরবর্তীতে জগদ্বিখ্যাত) ‘The Lovesong of J Alfred Prufrock’ হ্যারিয়েট মনরোর পত্রিকায় পাঠিয়েছিলেন। এইচ ডি এবং এলডিংটনের কবিতাকে ইমেজিস্ট নাম দিয়ে এই পত্রিকায় ছাপানোর ব্যবস্থা করেন পাউন্ড।‘পোয়েট্রি’র ১৯১৩-এর এপ্রিল সংখ্যায় বেরোয় পাউন্ডের উপরোদ্ধৃত হাইকু-গড়নের কবিতা, ‘In a Station of the Metro.’) ১৯১৫ সালে ইমেজিস্ট কবিতার যে সংকলন বেরোয় তার ভূমিকায় এলডিংটন ইমেজিস্ট কবিতার ছয়টি সূত্র প্রদান করেন। নিচে তাদের একটি সারসংক্ষেপ :
১. সাধারণ কথ্যভাষা ব্যবহৃত হবে, কিন্তু সর্বদা ব্যবহৃত হবে “exact word, not the nearly exact, nor the merely decorative word.”
২. নতুন তাল (rhythm) সৃষ্টি করতে হবে। ফ্রি ভার্সের ব্যবহার করা উচিৎ কেননা একজন কবির ব্যক্তিত্ব ফ্রি-ভার্সের মাধ্যমে অধিকতর ভালোভাবে প্রকাশিত হতে পারে।
৩. বিষয়বস্তুর নির্বাচনে কবির থাকবে অবাধ স্বাধীনতা। “We believe passionately in the artistic value of modern life, but we wish to point out that there is nothing so uninspiring nor so old-fashioned as an aeroplane of the year 1911.”
৪. কবিতার উচিৎ অনির্দেশ্য অস্পষ্তা পরিহার কর, তা যতই কিনা মনোহর ও গীতময় হোক না কেন। “We oppose the cosmic poet, who seem to us to shirk the real difficulties of his art”
৫. লিখতে হবে এমন কবিতা যা কঠিন ও স্পষ্ট, কখনই আবছা বা অনির্দিষ্ট নয়।
৬. সর্বোপরি, কবিতার মূল সার হচ্ছে সংক্ষিপ্ততা।৫
ইমেজিস্ট কবিতায় ভাষার কী রকম সংহত রূপ, ইমেজের কী ধরনের যথার্থতা ও ইডিওমেটিক রূপ এঁদের প্রার্থিত ছিল তা বোঝা যাবে তৎকালীন প্রচলিত এলিয়ে-পড়া, পৃথুল ও বাগবহুল কবিতাশৈলেিত রচিত জন মেইসফিল্ডের একটি কবিতা এবং এলডিংটনের একটি ‘ইমেজিস্ট’ কবিতা পাশাপাশি পড়লে :
It’s a warm wind, the west wind, full of bird’s cries;
I never hear the west wind but tears are in my eyes.
For it comes from the west lands, the old brown hills,
And April’s in the west wind, and daffodils --
( John Masefield: ‘The West Wind’)

She has new leaves
After her dead flowers,
Like the little almond-tree
Which the frost hurt.
(Richard Aldington: ‘New Love’)

ইমেজিজম চাবুকের মতো, অথবা হঠাৎ ঝলসে-ওঠা শাণিত ছুরি মতো এক-একটি চিত্রকল্প পাঠকের সামনে নাচিয়ে তোলে। কোনো অস্পষ্টতার মোহন হাতছানি নয়, কবিতা কংক্রিট ও স্পর্শযোগ্য। সম্ভবত আর্কিবল্ড ম্যকলিশ (Archibald MacLeish) তাঁর ‘Ars Poetica’ কবিতায় যা বলেছেন তা-ই ইমেজজিস্ট কবিতার যথার্থ সংজ্ঞা : কবিতা হবে “pulpable and mute”; কবিতা “দুঃখের ইতিহাস” বলতে যায় না দীর্ঘ সময় ধরে, বরং কংক্রিট চিত্রকল্পের মাধ্যমে জাগিয়ে তোলে দুঃখের প্রতিভাস :

For all the history of grief
An empty doorway and a maple leaf
For love
The leaning grasses and two lights above the sea--
A poem should not mean
But be.

১৯১৫ সালের পর ইমজিজমের বিরুদ্ধে আক্রমণ আসতে থাকে। পাউন্ড ও অন্যান্যরা যে ফ্রি-ভার্সের কথা বলছেন, তা কি আদৌ কবিতা, এ প্রশ্নও উঠেছে। দ্বিতীয়ত, অনেকেই দেখালেন যে, ইমেজিস্ট কবিতার সাফল্য সীমিত আকারের হতে বাধ্য, কেননা, কনরাড আইকেনের মতে, ইমেজিস্টরা “gives us frail pictures--whiffs of windy beaches, marshes, meadows, city streets, disheveled leaves; pictures pleasant and suggestive enough. But seldom is any of them more than a nice description, coolly sensuous, a rustle to the ear, a ripple to the eye. Of organic movement there is practically none.” ৪

ভর্টিসিজম
ভর্টিসিজম চিত্রকলার একটি বিশেষ স্টাইলের নাম-- কিউবিজম থেকে এর উত্থান, তবে আধুনিক যন্ত্রযুগের অনুধাবনে এর পরম উৎসাহ একে ভবিষ্যবাদ তথা ফিউচারিজমের সাথেই বেশি লগ্ন করেছে। ভর্টিসিজম কথাটি এসেছে ‘Vortex’(ঘূর্ণিকেন্দ্র) থেকে। ভর্টিসিস্ট চিত্রকলায় দৃঢ় রেখা এবং কড়া রঙের সমাবেশ দর্শকের চোখকে টেনে নেয় ছবির কেন্দ্রস্থলের দিকে। এজরা পাউন্ড এই আন্দোলনেরও নামকরণ করেন। ভর্টিসিস্টদের সাহিত্যের কাগজ Blast উইন্ডহ্যাম ল্যুইসের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। এতে চিত্রশিল্পীদের ছবি ও লেখা ছাড়াও পাউন্ড ও টি এস এলিয়টের লেখা মুদ্রিত হয়েছিল।
১৯১৪ সালে পাউন্ড ‘ডেস ইমেজিস্টেস’ প্রকাশ করেন। এসময়টাতে তাঁর মনে হয় ইমেজিস্ট আন্দোলন তাঁকে সীমাবদ্ধ করে ফেলছে। ইমেজিস্ট আন্দোলনের ভার এমি লাওয়েলের হাতে ছেড়ে দিয়ে তিনি উইন্ডহ্যাম লুইস-প্রতিষ্ঠিত ভর্টিসিস্ট আন্দোলনে যোগ দেন। পাউন্ডের আজীবন আগ্রহ ছিল প্রাচীন মিথ এবং রিচ্যুয়ালে। ভর্টিসিস্টদের সাথে তাঁর এই বিষয়ে সাযুজ্য তাঁকে আকৃষ্ট করে। ভর্টিসিস্ট শিল্পীরা আবেগকে চিত্রকলা, স্থাপত্য, সংগীত ও কবিতার রীতিবদ্ধ কাঠামোর মধ্যে বিমূর্তায়িত করে নিতে চেয়েছিলেন। পাউন্ড এই চেষ্টার মধ্যে দেখতে পেয়েছিলেন ইমেজিজমের মূল ভাবনাকে অন্য শিল্পমাধ্যমে প্রয়োগের সম্ভাবনা। ওয়াল্টার পেটার যেমন বলতেন, “all arts approach the condition of music”, তেমনি পাউন্ডও ভাবতেন, সকল শিল্পের গতি একটি ঘূর্ণিকেন্দ্রের দিকে যেখানে এসে সব পার্থক্য, সব বিভেদ মুছে যায়। পাউন্ড তাই ইমেজের নতুন সংজ্ঞা দিলেন এবার : “a radiant node or cluster; it is what I can, and must perforce, call a VORTEX, from which, and through which, and into which, ideas are constantly rushing.”
১৯১৫ সালে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অভিঘাতে, এই আন্দোলনের মৃত্যু ঘটে।

আধুনিকবাদের প্রতিভূরা -১ : পাউন্ড ও এলিয়ট
এজরা পাউন্ডের কৃতি ও প্রভাবসম্পাত

ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় মডার্নিজমের প্রতিষ্ঠা ও বিস্তারে এজরা পাউন্ডের ভূমিকা বিশাল। তাঁর অবদান এতই ব্যাপক যে তাঁর বিরুদ্ধবাদীরাও তাঁকে অস্বীকার করতে পারেননি। বিশ-শতকের দ্বিতীয় দশকে এক অবাক কাণ্ড ঘটছিল : আটলান্টিকের দুইপারের মধ্যে যেন চলছিল সাহিত্যের টেনিস-খেলা। আমেরিকা থেকে সাহিত্যিক ভাগ্যান্বেষণে লন্ডনে আসছিলেন মার্কিনী তরুণরা, এলিয়ট যেমন, এবং ফ্রস্ট। অন্যদিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অভিঘাতে য়ূরোপ থেকে পালানো শিল্পীরা জড়ো হচ্ছিলেন নিউইয়র্কে। লন্ডনে আসা মার্কিনী তরুণ কবিদের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছিলেন পাউন্ড, যিনি নিজেও ছিলেন সেখানে কিয়ৎকাল আগে-আসা অভিবাসী। পাউন্ড এলিয়ট প্রমুখ তরুণদের কাছ থেকে কবিতা সংগ্রহ করে ছাপানোর জন্য পাঠাচ্ছিলেন শিকাগোয়, হ্যারিয়েট মনরো সম্পাদিত পোয়েট্রি পত্রিকায়। এই আদানপ্রদান-যোগাযোগের এক বিরাট অনুঘটক হয়ে উঠেছিলেন এজরা পাউন্ড।
এজরা পাউন্ডের সামগ্রিক কৃতির উল্লেখযোগ্য দিক তিনটি : অসাধারণ কবি; তীক্ষèধী সমালোচক; এবং জায়মান আধুনিকবাদের পৃষ্ঠপোষক ও অভিভাবক। তাঁর অভিভাবনার কৃতি প্রায়শ অন্য দিকগুলোকে ম্লান করে দিতে চাইলেও অভিনিবিষ্ট পাঠকমাত্রেরই পাউন্ডের প্রতিভার সবগুলো দিক মনে রাখা উচিত। আধুনিকবাদী কবিতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দশবছর (১৯১২-১৯২২) পাউন্ডময় : তিনিই রাজত্ব করেছেন ইঙ্গ-মার্কিন বুধমণ্ডলীর। (১৯২২ থেকে ১৯৫০-এর দশক পর্যন্ত রাজদণ্ড ধারণ করেন পাউন্ড-শিষ্য এলিয়ট।) তাঁর তুখোড় সমালোচনার বিষয়ে সতর্ক-সশঙ্ক ছিলেন কবিকুল; কবিতার জন্য নতুন স্টাইল, গদ্যছন্দ এবং বিষয়ব্যাপ্তির কথা বলেছেন সমালোচনায়; ইমেজিস্ট আন্দোলনের মাধ্যমে এডওয়ার্ডীয় কবিতার শিথিলবন্ধ প্রগলভতার বিরুদ্ধে করেছেন জেহাদ; শনাক্ত ও পরিচিত করিয়েছেন তদবধি-অখ্যাত প্রতিভাবানদের, যাদের মধ্যে রয়েছেন ফ্রস্ট এবং এলিয়ট; সারাজীবন ক্লাসিকীয় শুদ্ধতার অনুসন্ধানে ভ্রমণ করেছেন প্রাচীন থেকে সাম্প্রতিক যুগের সাহিত্য : স্যাফো থেকে দান্তে; হোমার থেকে অ্যাংলো স্যাক্সন গীতিকবিতা; জাপানি হাইকু থেকে চীনা কবিতা পর্যন্ত তাঁর অভিনিবেশ ও অনুরাগ বিস্তৃত ছিল। তাঁর প্রবল প্রাণনায় সাহিত্যক্ষেত্রে যাঁরা উজ্জীবিত হয়েছিলেন তাঁেদর মধ্যে আছেন এইচ ডি, উইলিয়াম কার্লোস উইলিয়ামস, রবার্ট ফ্রস্ট, এলিয়ট, জেমস জয়েস, আর্নেস্ট হেমিঙওয়ে এবং ই ই কামিংস। এঁরা সবাই তাঁর প্রত্যক্ষ পরিমণ্ডলভুক্ত ছিলেন না, এবং কারো-কারো বিষয়ে পাউন্ড বীতরাগও ছিলেন।
পাউন্ডের জন্ম আমেরিকার খনি-শহর ইডাহোতে, ১৮৮৫ সালে। পরে তাঁদের পরিবার ফিলাডেলফিয়ার শহরতলিতে স্থানান্তরিত হয়। আকৈশোর সাহিত্যমগ্ন পাউন্ডের কলেজ শিক্ষার বেশিরভাগ জুড়ে ছিল ইতালীয়, ফরাসি প্রভৃতি রোমান্স ভাষার মধ্যযুগ ও রেনেসাঁসকালীন সাহিত্য। পাউন্ডের আন্তজার্তিকতাবোধ গড়ে উঠছিল য়ুরোপের বিভিন্ন ভাষার সাহিত্যের অধ্যয়নের মাধ্যমে। তিনি আবিষ্কার করছিলেন এক ঐক্যসূত্র যা অতীতকে বর্তমানের সাথে যুক্ত করে। তাঁর গড়ে উঠছিল সেই অনিবার্য কালচেতনা যার ভিত্তি, এলিয়টের ভাষায়, historical sense বস্তুত, পাউন্ড এবং এলিয়টের মধ্যে পরবর্তীকালে যখন সখ্য গড়ে ওঠে, দুই প্রতিভাবান পত্রবিনিময় এবং পারস্পরিক সমালোচনার মাধ্যমে নিজেদের চিন্তার অভিমুখ, সাযুজ্য ও পার্থক্যগুলো যাচাই করে নিয়েছেন। সাহিত্যের ইতিহাসে এ ধরনের যুগ্ম-অনুধ্যানের তুলনাও সহজে পাওয়া ভার। ফ্রান্সের প্রভাঁস এলাকার চারণ-ত্র“বাদুরদের কাব্যগীতি থেকে দান্তে পর্যন্ত কীভাবে য়ুরোপীয় কবিতার আন্তর্জাতিকতা পরিব্যাপ্ত হচ্ছিল, সাগ্রহে লক্ষ করেন পাউন্ড। এলিয়ট তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ Tradition and the Individual Talent-এ যেন পাউন্ডের ভাবনারই প্রতিফলন ঘটিয়েছেন একথা বলে যে, প্রত্যেক ব্যক্তি-প্রতিভাকে তাঁর হাড়ে-মজ্জায় ধারণ করতে হবে হোমার থেকে বর্তমান পর্যন্ত তাবৎ য়ুরোপীয় সাহিত্যের ট্রাডিশনকে, সেই সাথে তাঁর নিজের দেশের সাহিত্যের মূলধারাকেও : “The poet) must be aware that the mind of Europe -- the mind of his own country – a mind which he learns in time to be much more important than his own private mind-- ... which abandons nothing en rute, which does not superannuate either Shakespeare or Homer, or the rock drawing of the Magdalenian draughtsman”১
পাউন্ড লন্ডনে আসেন ১৯০৮ সালের সেপ্টেম্বরে, সঙ্গে তাঁর প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ A Lume Spento-এর অল্প কয়েকটি কপি এবং নগদ তিন পাউন্ড । এসেই লন্ডনের সাহিত্যমহলে মেলামেশা শুরু করেন : ফোর্ড ম্যাডক্স হোয়েফার (ফোর্ড)-এর সাথে ঘনঘন দেখা করেন; যোগ দেন ইয়েট্সের সান্ধ্য আড্ডায়, পোয়েটস ক্লাবে, বিশেষ করে সোহো-এলাকার আইফেল টাওয়ার রেস্তোরাঁর সান্ধ্য আয়োজনে। পরের চার বছরে পাউন্ডের চারটি বই বেরোয় :A Quinzaine for this Yule (1908), Personae (1909), Exultations (১৯০৮), Canzoni (১৯০৯),Bertran de Born (১৯০৯), এবং François Villon (১৯১১)। পাউন্ডের এই প্রথম যুগের গ্রন্থগুলোয় আধুনিকতার চেয়ে সমকালীন এডওয়ার্ডীয় যুগের কবিতার বৈশিষ্ট্যই ছিল বেশি। প্রায়শ ব্যবহৃত হয়েছে অতীত কবিদের শৈলী, যাঁদের মধ্যে রয়েছে ইবৎঃৎধহ ফব ইড়ৎহ এবং ঋৎধহম্ফড়রং ঠরষষড়হ; তিনি অতীত ইতিহাস ও চরিত্রের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। শুধু তাই নয়, তিনি তাঁর প্রশংসিত অতীত কবিদের মতো করে লিখতেও চেয়েছেন। পরবর্তী পনেরো বছরে পাউন্ড যা লিখেছেন তার মধ্যেও এরকম সচেতন প্রয়াস লক্ষ করা যাবে, বিশেষত তাঁর ঈধঃযধু, “Cathay, “Homage to Sextus Propertius,” “Hugh Selwyn Mauberley,” এবং প্রাথমিক Cantos-এ।
পাউন্ড আধুনিকবাদী কবিতার উদ্গাতা হলেও তাঁর নিজের কবিতার ‘আধুনিকায়নে’ ভূমিকা ছিল সমকালীন কয়েকজনের, যাদের মধ্যে পূর্বোল্লিখিত ফোর্ড ম্যাডক্স ফোর্ড : ১৯১৩ সালে পাউন্ড বলেন, “I would rather talk about poetry with Ford Madox Hueffer than with any man in London.” ম্যাডক্স ফোর্ড পাউন্ডকে বুঝিয়েছিলেন, “Poetry must be as well written as prose. Its language must be a fine language, departing in no ther way from speech save by heightened intensity (i.e. simplicity). There must be no book words, no periphrases, no inversions. It must be as simple as De Maupassant’s best prose, and as hard as Stendhal’s.”২ এরই সাথে যুক্ত হয়েছিল টি ই হিউমের প্রণোদনাও। টি ই হিউম আইফেল টাওয়ার রেস্তোরাঁয় জড়ো করেছিলেন একদল কবিকে-- যাদের মধ্যে ছিলেন F. S. Flint, Francis Trancred, Edwarf Storer, Florence Farr, Joseph Cambell. পাউন্ড এসে এই কবিসংঘে যোগ দেন, এবং বলা বাহুল্য, এর প্রকৃত নেতায় পরিণত হন। আইফেল টাওয়ারের কবিসভায় যাঁরা যোগ দিয়েছিলন তাঁরা সবাই সমকালীন ইংরেজি কবিতার গতিপ্রকৃতি নিয়ে তেতোবিরক্ত ও হতাশ ছিলেন; তাঁরা খুঁজছিলেন কবিতার জন্য নতুন ভাষা ও নতুন আঙ্গিক। এ থেকেই ইমেজিজমের সূত্রপাত। ফ্লিন্ট সেই গোড়ার দিককার কথা লিখেছেন ১৯১৫ সালে Egoist পত্রিকায়:
What brought the real nucleus of this group together was a dissatisfaction with English poetry as it was then (and still is, alas!) being written. We proposed at various times to replace it by pure vers libre; by the Japanese tanka and haiku; ... in all this Hulme was ringleader. He insisted too an absolutely accurate presentation and no verbiage. ... There was a lot of talk and practice among us ... of what we called the Image.৩
বোঝা যাচ্ছে, পাউন্ড এমন একটি রণক্ষেত্রে সৈনাপত্য গ্রহণ করেছিলেন যেখানে যুদ্ধের প্রস্তুতি আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। বস্তুতপক্ষে, পাউন্ড যখন প্রথম লন্ডনে আসেন তখন তিনি ভিক্টোরীয় কবিদের গুণমুগ্ধ-- ব্রাউনিঙ, রসেটি, সুইনবার্ন, আর্থার সাইমন্স আর ইয়েটসের কবিতার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আইফেল টাওয়ারের কবিসংসর্গই তাঁকে পাল্টে দিয়েছিল আমূল, এবং অচিরে তিনি তাঁর প্রবাদপ্রতিম কর্মতৎপরতা ও সাংগঠনিক ক্ষমতাবলে ইমেজিজমের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রচারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। (এ সম্পর্কে আগে আলোচনা করা হয়েছে।) ১৯১২-১৩ সালের মধ্যে পাউন্ডের কবিতায় এল বিশাল পরিবর্তন। তিনি এসময় ফরাসি কবিতায় ঘটে যাওয়া ও ঘটমান সিম্বলিজম, সুররিয়ালিজম,ভবিষ্যবাদ প্রভৃতি সম্পর্কে জ্ঞাত হন; আবিষ্কার করেন প্রাচীন গ্রিক কবি স্যাফোর কবিতার অসংলগ্ন ইমেজের মধ্য দিয়ে অনুভূতি প্রকাশের আশ্চর্য কৌশল। কিন্তু পাউন্ডকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছিল এর্নেস্ত ফেনোলোসা [Ernest Fenollosa : (১৮৫৩-১৯০৮)] -র নোটবুক ও কাগজপত্র, যা ১৯১৩ সালে তাঁর হস্তগত হয়। প্রসঙ্গত, ফেনোলোসা ছিলেন ম্যসাচুসেটসের দার্শনিক, তিনি জাপানে শিক্ষকতা করতেন এবং জাপানি ও চীনা চিত্রকলা ও কবিতার সংগ্রাহক ছিলেন। ১৯১৩-১৪ সালের শীতে পাউন্ড ফেনোলোসার পাণ্ডুলিপি নিয়ে কাজ করেন; তাঁর অনূদিত জাপানি নোহ্ নাটকককে কবিতায় রূপান্তর করেন। এই কাজ করতে গিয়ে ফেনোলোসার নোটবুকে কিছু প্রাচীন চীনা কবিতার প্রতিবর্ণীকরণ ও অনুবাদ পান। এমন একটি কবিতায় দেখা যায় কয়েকটি বিচ্ছিন্ন শব্দে গড়ে তোলা হয়েছে একটি ইমেজ। যেমন একটি কবিতায় (পাউন্ড যাকে অনুবাদ করেছেন ‘Lament of the Frontier Guard’ নামে) কয়েকটি মাত্র শব্দে শীতার্ত বিচ্ছিন্ন মানুষের বেদনার যেন স্ফটীকিত রূপ দেয়া হয়েছে যেন :
tree fall autumn grass yellow
এই পঙক্তির পাউন্ড-কৃত অনুবাদ : “Trees fall, the grass goes yellow with autumn’ দেখাল যে প্রকৃতির মধ্যে ব্যাকরণ কিংবা সিন্টেক্সের বালাই নেই, এজন্য চীনা কবিতাও আমাদেরকে আক্রান্ত করে, যেভাবে করে প্রকৃতি। পাউন্ড চীনা কবিতার এই সংক্ষিপ্ততা ও ইঙ্গিতময়তাকে প্রয়োগ করলেন তাঁর বিখ্যাত ‘Essay on the Chinese Written Character’ কবিতায়--
The apparition of these faces in the crowd;
Petals on a wet, black bough.

১৯১৬ সালে প্রকাশিত হয় Lustra ফ্রি-ভার্সে কবিতা ও সমাজ বিষয়ে অনুচিন্তন; এদের মধ্যে আছে ব্যঙ্গ, রোমান কবিদের অনুসরণে প্রবচন, স্যাফোর কবিতা, জাপানি হাইকু ইত্যাদি থেকে টুকরা-টাকরা। একটি উদাহরণ দিই-- যেমন ‘Encounter’ (সাক্ষাৎ) কবিতা-- শেষ পঙক্তির ইমেজটি লক্ষণীয়--
All the while they were talking the new morality
Her eyes explored me.
And when I arose to go
Her fingers were like the tissue
Of a Japanese paper napkin.

১৯১৫ থেকে ১৯২০-এর মধ্যে পাউন্ড প্রথম সাতটি Cantos এবং Hugh Selwyn Mauberley রচনা সম্পন্ন করেন। এই রচনাগুলোর বেশিরভাগে প্রথম পর্বের ইমেজিস্টিক স্টাইল নয়, বরং তীর্যক, পাণ্ডিত্যপূর্ণ, উল্লেখ-অনুষঙ্গনির্ভর একটি শৈলি অবলম্বিত হয়েছে, যার সাথে কিয়ৎকাল পরে (১৯২২ সালে) রচিত এলিয়টের The Waste Land -এর স্টাইলের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এলিয়টের মতোই পাউন্ডও নানা ঐতিহাসিক, ভৌগোলিক, সাহিত্যিক, আত্মজৈবনিক প্রসঙ্গের উল্লেখ এবং বিবিধ বিদেশী ভাষা থেকে বাক্যাংশ ব্যবহার করেছেন। কিন্তু এলিয়টের সাথে পার্থক্য হল, পাউন্ড সেসবের কোনো ব্যাখ্যা বা নোট বা অনুবাদ দেননি। “Homage to Sextus Propertius” এর মতো ঈধহঃড়ং-এও মূল কথক পাউন্ড নিজেই, যদিও বিভিন্ন ঢ়বৎংড়হধ ব্যবহৃত-- এই উপস্থাপনার কৌশলের কারণে বিচিত্রমাত্রিক ভাববস্তুর মধ্যে ঐক্য স্থাপন সম্ভব হয়েছে, এবং বৈবিধতা ও বৈপরীত্যগুলোও পেয়েছে মনস্তাত্ত্বিক গ্রাহ্যতা। ঠিক একই কৌশল এলিয়ট অবলম্বন করেন The Waste Land-এ, ত্রিকালদর্শী টিরেসিয়াসের চরিত্রের মাধ্যমে। ঐ কবিতায় যা-কিছু বলা হয়, এবং যার মুখ দিয়েই বলা হোক না কেন, সবই টিরেসিয়াসের কথন। Hugh Selwyn Mauberley দুটি কবিতা-পরম্পরা : এতে বিশের দশকের লন্ডনের একজন কবির জীবন, চরিত্র, সময় এবং রচনার প্রতিচিত্র আঁকা হয়েছে। মবার্লি আর পাউন্ডের মধ্যকার সম্পর্কটি একটু জটিল; কেউ-কেউ বলেন ঐ চরিত্রের মধ্যে পাউন্ড তাঁর “negative identity” প্রক্ষেপণ করেছেন। মবার্লির ভেতর পাউন্ড নিজেকে দেখতে পাচ্ছেন, কিন্তু তাকে আবার প্রত্যাখ্যানও করতে চাইছেন। ঈধহঃড়ং রচিত হয়েছে প্রায় পঞ্চান্ন বছর ধরে; ১০৯টি কবিতায় আছে প্রায় ২৩,০০০ পঙক্তি। মিল্টনের প্যারাডাইজ লস্টের পঙক্তিসংখ্যা যেখানে ১০,৪৬৫, এবং দ্য ওয়েস্টল্যান্ডের মাত্র ৪৩৩। Cantos এর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল বিবিধ সভ্যতার উপস্থাপনা-- প্রাচীন গ্রিস, অষ্টাদশ শতাব্দীর আমেরিকা, রেনেসাঁস, হোমারীয় গ্রিস, মধ্যযুগ, সমকালীন য়ুরোপ ও আমেরিকা। আছে বিভিন্ন ব্যক্তির জীবন, নানা কাহিনীর উল্লেখ, বিবিধ কাল ও যুগের, বিভিন্ন ভাষার কবিতার অনুবাদ ও অনুকৃতি, চৈনিক আইনি সূত্র, মধ্যযুগের ভেনিসের বর্ণনা, আরো কত কি! Cantos বিংশ শতাব্দীতে রচিত কবিতাপ্রচেষ্টার মধ্যে সর্বাধিক উচ্চাকাক্সক্ষী, এবং দীর্ঘতম।

এলিয়টের আবির্ভাব, প্রসার ও পরিণতি
ইংরেজি সাহিত্যে আধুনিকবাদের প্রাণপ্রতিষ্ঠাকারী ও প্রাণপুরুষ হলেন টি এস এলিয়ট। বিশের দশক থেকে মডার্নিজমের অন্য নাম এলিয়ট-সূত্র : এলিয়টের কাব্যকর্ম, কাব্যবিষয়কতত্ত্ব এবং কাব্যসমালোচনা অপ্রতিহতভাবে রাজত্ব করেছে প্রায় চল্লিশ বছর। এমনকি বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকেও এলিয়টীয় কবিতার প্রভাব নিঃশেষিত হয়নি। বাংলা সাহিত্যে আশির দশকের আগে পর্যন্ত এলিয়টীয় কাব্যচিন্তা ছিল অনেকটা অলঙঘনীয় শাস্ত্রের মতো। তাঁর প্রধান প্রভাবসম্পাতী কাব্যগ্রন্থ The Waste Land প্রকাশিত হয় ১৯২২ সালে। তারপর থেকে এটি বিবেচিত হয়ে এসেছে আধুনিক নগরজীবনের ভাষ্য হিসেবে। ঐ কবিতায় যে-পোড়োজমির উদ্ভাস তার উষ্ণ প্রশ্বাসে মরুময় কণ্টকময় হয়ে উঠেছে শুধু ইংরেজি কবিতা নয়, বিশ্বের নানা দেশের কবিতা-ভূগোল। তিরিশের দশকের বাঙালি কবিরা এলিয়টের প্রত্যক্ষ প্রভাবে কবিতা রচনা শুরু করেন। এলিয়টের অনুকরণে কলকাতা নগরীকে তাঁরা ভাবতে শুরু করেন ভিড়াক্রান্ত লন্ডন নগরীর অশুভ পাপময়তা-পচনশীলতার এতদ্দেশীয় প্রতিরূপ হিসেবে। (এলিয়টের লন্ডন নিজেই ছিল আধুনিকবাদের আদিগুরু বোদলেয়ারের প্যারিসের প্রতিরূপ।) তারপর থেকে দীর্ঘ দিন বাঙালি কবির কাছে আকাশ মানেই ছিল বিধ্বস্ত নীলিমা, বাতাস মানেই অসুস্থ বিকারগ্রস্ত পঙ্গু মানুষের ঘামের গন্ধে বিষাক্ত, বিষণœ। জীবনানন্দের রাত্রি কবিতায় দেখি “হাইড্র্যান্ট খুলে দিয়ে কুষ্ঠরোগী চেটে নেয় জল/... থামে ঠেস দিয়ে লোল নিগ্রো হাসে/নগরীর মহৎ রাত্রিকে তার মনে হয় লিবিয়ার জঙ্গলের মতো।”-- এরকম বর্ণনা এলিয়টভাবিত ও প্রভাবিত। এলিয়টের আগে ও পরে আর কোনো ইংরেজ কবি এত দীর্ঘ দিন ধরে এত বিশাল ভূগোল জুড়ে প্রবলপরাক্রমে রাজত্ব করেননি। শুধু দ্য ওয়েস্টল্যান্ড নয়, এলিয়ট তাঁর গদ্যে যেসকল কাব্যবিষয়ক তত্ত্ব প্রচার করেছেন সেগুলো শ্রদ্ধায় ও বিনম্র সম্ভ্রমে সকল অ্যাকাডেমিয়াতে উচ্চারিত ও উৎকলিত হয়েছে। তিনি অনেক স্বীকৃত মহামান্যকে জলাঞ্জলি দিয়ে নতুনভাবে বন্দ্য করে তুলেছেন অনেক বিস্মৃত উপেক্ষিতকে। মূলত তারই কারণে তিরিশের দশকে সমালোচক-পাঠকের আগ্রহের কেন্দ্রে চলে আসেন সপ্তদশ শতকের জন ডান ইত্যাদি মেটাফিজিক্যাল কবিরা; আগ্রহহীনতার হিমঘরে চলে যায় বিখ্যাত রোমান্টিক কবিকুল। ওয়ার্ডসওয়ার্থের কাব্যসংজ্ঞা - “Poetry is the spontaneous overflow of powerful emotions” -কে নাকচ করে 'Tradition and the Individual Talent’ নামক প্রবন্ধে ঘোষণা করেন “Poetry is not a turning loose of emotion, but an escape from emotion; it is not the expression of personality, but an escape from personality”৪
এলিয়টের প্রভাব ব্যাপক হয়েছিল তাঁর উত্তরসূরীদের উপর, যার তুলনা চলে বাংলা কবিতায় রবীন্দ্রনানুসারীদের ওপর রবীন্দ্রনাথের প্রভাবের সঙ্গে। স্টিফেন স্পেন্ডার, তিরিশের কবি লিখেছেন, “To our generation, Eliot was the poet of poets.” আর্কিবল্ড ম্যাকলিশ তাঁর এক বন্ধুকে নাকি লিখেছিলেন, এলিয়টের পরে “আরো এলিয়ট” ছাড়া কিছু রচনা সম্ভব নয়। মার্কিনী কবি স্ট্যানলি ক্যুনিটজ সম্ভবত সবচেয়ে ভালোভাবে বোঝাতে পেরেছেন এলিয়টের অনিবার্যতা: “প্রায় তিন দশক এমন কোনো তরুণ কবির কবিতা খুঁজে পাওয়া অসম্ভব ছিল যার পেছনে তাঁর (এলিয়টের) কণ্ঠস্বর শোনা যেত না। বিশের ও তিরিশের দশকে খ্যাতি অথবা শ্রোতা জোটাতে হলে এলিয়টকে অনুসরণ করতেই হতো।”৫
টমাস স্ট্যার্নস এলিয়ট জন্মগ্রহণ করেন আমেরিকার নিউ ইংল্যান্ড এলাকার সেন্ট লুই-তে, ১৮৮৮ সালে। তাঁর পরিবার ছিল ঐ অঞ্চলে আদি বসতিস্থাপনকারীদের উত্তরসূরী, অভিজাত, উচ্চমন্য ও শিক্ষিত (এলিয়টের পিতামহ পূজ্যপাদ উইলিয়াম গ্রিনলিফ এলিয়ট প্রতিষ্ঠা করেন সেন্ট লুই-র প্রথম ইউনিটারিয়ান চার্চ এবং ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি)। লাজুক, পড়–য়া ও আত্মনিমগ্ন বালক এলিয়ট সেন্ট লুই-এর স্মিথ একাডেমি এবং ম্যাসাচুসেটসের মিল্টন অ্যাকাডেমিতে পড়াশোনা করেন; ১৯০৬ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন, ১৯১১-তে হন স্নাতকোত্তর দর্শনের ছাত্র : তাঁর শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন জর্জ সান্ত্যায়ানা (George Santayana) এবং আরভিং ব্যাবিট (Irving Babbitt)। সান্ত্যায়ানার কাছে দীক্ষা পান আধুনিক দর্শনশাস্ত্রে, অন্যদিকে ব্যাবিটের কাছে পান ক্লাসিক্যাল যুক্তিশীলতা ও সুষম-সংহতি বিষয়ক ধারণা। প্রসঙ্গত, ব্যাবিট ছিলেন তুখোড় শিক্ষক; তাঁর বক্তৃতায় তিনি সাহিত্যিক উল্লেখ আনতেন দূর-দূর মিথ থেকে, লাতিন-ফরাসি সাহিত্য থেকে, চমক লাগিয়ে দিতেন ছাত্রদের। আরভিং ব্যাবিটের কাছ থেকে এলিয়ট পাণ্ডিত্যপূর্ণ উল্লেখের স্বভাবটি অর্জন করেন, এবং তার পূর্ণ প্রয়োগ করেন The Waste Land কাব্যে। পরিপাটি পোশাক-পরা (তাঁর সৃষ্ট প্রুফ্রক চরিত্রের মতোই -“Ònecktie rich and modest, asserted with a simple pin”), অত্যন্ত কেতাদুরস্ত, অতিসুসভ্য, কিন্তু উচ্ছলতাহীন ও গম্ভীর-- এই ছিল এলিয়টের ছাত্রজীবনের প্রতিমূর্তি, যা পরবর্তী জীবনে আরো স্পষ্ট হয়েছে। ক্লাসিক বিয়গুলোতে তাঁর পাণ্ডিত্য, ফরাসি সাহিত্যের ওপর তাঁর অধিকার দেখে বার্ট্রান্ড রাসেল (ইনি সমসময়ে হার্ভার্ডে অতিথি-অধ্যাপক ছিলেন) পর্যন্ত ইমপ্রেস্ড হয়েছিলেন। হার্ভার্ডেই এলিয়ট পড়েন সংস্কৃত, এবং পরিচিত হন বেদ ও উপনিষদের সাথে। তাঁর বেদজ্ঞান খুব মর্মসঞ্চারী হয়েছিল বলে জানা না গেলেও বেদ ও উপনিষদ অন্তত পাণ্ডিত্যপূর্ণ উল্লেখ ও দর্শনচিন্তা-সমান্তরলতার নিয়ামক হয়েছিল। The Waste Land-এ বৃহদারণ্যক উপনিষদের ব্যবহার, Four Quartets-এ ভগবদ্গীতা ও ঋগে¦দের দর্শনপ্রতীতির ব্যবহার উল্লেখযোগ্য। সংস্কৃত ভাষা ও পালি শিক্ষা করেন ভারতীয় ও বৌদ্ধ দর্শন পড়ার জন্য। এলিয়ট চিলির বৌদ্ধধর্মবিশ্বাসী কবি গ্যাব্রিয়েল মিস্ত্রালকে বলেছিলেন যে, দ্য ওয়েস্টল্যান্ড রচনাকালে তিনি প্রায় বৌদ্ধই হয়ে গিয়েছিলেন। (Stephen Spender, Eliot, Glasgow, Fontana/ Collins , 1975, p.২৬)
এলিয়টের কাব্যজীবনের শুরু শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে, হার্ভার্ডে ছাত্রাবস্থায়। ১৯১০-১১-তে লিখেন “Portrait of a Lady”, “Rhapsody on a Windy Night”, এবং “The Lovesong of J Alfred Prufrock”--শেষোক্তটি প্রকাশিত হয় অবশ্য ১৯১৫ সালে, এজরা পাউন্ডের মধ্যস্থতায়, হ্যারিয়েট মনরো সম্পাদিত পোয়েট্রি পত্রিকায়, এবং এলিয়টের বিশ্বখ্যাতির শুভসূচনা করে। সমকালীন মার্কিনী এবং উত্তরভিক্টোরীয় ইংরেজি কবিতার সাথে এ কবিতাগুলোর পার্থক্য ছিল স্পষ্ট; বোঝা যাচ্ছিল এক নতুন আঙ্গিক ও নতুন ভাবনাদীপ্ত কবিতার জন্ম হয়েছে। মহাদেশীয় ইউরোপে যে আধুনিকবাদী কবিতার উদ্ভব ও পরিপুষ্টি ঘটেছিল পার্নেশীয় কবিকুল ও ভের্লেন-ভালেরির হাতে, তার সাথে দেখা গেল সাযুজ্য; রচিত হল ইঙ্গ-মার্কিন কবিতার সাথে ইউরোপীয় আধুনিক কবিতার সেতুবন্ধ।
এই সেতুবন্ধ রচনায় প্রধান ভূমিকা ফরাসি মডার্নিস্ট কবিতার বিশেষত জুলে লাফর্গের। লাফর্গ তাঁর কবিতায় বিলম্বিত রোমান্টিক কবিতার প্রথাগত বিষয়, আবেগ ও মনোভঙ্গিই ব্যবহার করেন, কিন্তু ভাষার ভেতর ভরে দেন আয়রনিক পরিহাস, ভাষার নানারকম বিসঙ্গতি এবং কথ্যভাষার দ্যুতি। আর্থার সাইমন্স তাঁর বিখ্যাত The Symbolist Movement in Literature গ্রন্থে লাফর্গের যুগস্রষ্টা কাব্যভঙ্গি সম্পর্কে ঘোষণা দিয়েছিলেন --“The old cadences, the old eloquence, the ingenuous seriousness of poetry, are all banished… . Here, if ever, is modern verse.” লাফর্গের কবিতার প্রেমিক তার সরল প্রেমাবেগ পূর্বাপর সঙ্গতিপূর্ণ ও অনুমানযোগ্য ভঙ্গিতে প্রকাশ করে না; সে অবলম্বন করে নাট্যিক নানা ভঙ্গিমা; পরিহাস, ছদ্ম-অনুনয়, অতিপ্রজ বাকবিভূতি ইত্যাদি দ্বারা প্রেমিকাকে ভোলাতে চায়। লাফর্গের প্রেমিকের সাথে জন ডানের প্রেমের কবিতার কথক-নায়কের অনেক মিল। এলিয়টের ব্যর্থ-পিপাসার্ত-মদনবাণজর্জরিত ‘হতে-পাত্তেম’-নায়ক প্রুফ্রক লাফর্গের নায়ক-কথকের আদলে গড়া, শুধু লাফর্গীয় উপাদানগুলো আরো উচ্চকিতভাবে উপস্থিত তার ভেতর। লাফর্গের মাধ্যমে এলিয়ট যুক্ত হতে চাইলেন একটি ট্রাডিশনের সাথে, যে-ট্রাডিশনের শুরু ফরাসি প্রতীকবাদ ও উত্তর-প্রতীকবাদের মধ্যে, যে-ট্রাডিশন ইঙ্গমার্কিনী নয়, বহির্দেশীয়: সমকালীন ইঙ্গ-মার্কিন কবিতার জোলো ভিক্টোরীয় রোমান্টিক-অবশেষের সাথে বিপ্রতীপ। The Lovesong of J Alfred Prufrock কবিতায় ব্যবহৃত ইনটেরিয়র মনোলগ লাফর্গের আদলে নির্মিত। লাফর্গ তাঁর কবিতায় পরিহাস ও ব্যঙ্গের মাধ্যমে সিরিয়াস কথা বলতে চাইতেন, যেমনটি দেখা যায় সপ্তদশ-শতকী মেটাফিজিক্যার কবি অ্যান্ড্রু মার্ভেলের কবিতয় : দুজনের মধ্যে সাযুজ্য আবিষ্কার করেন এলিয়ট, কেননা দুজনেই রয়েছে “alliance of levity and seriousness (by which the seriousness is intensified৬
১৯১২ থেকে ১৯১৫, এই চারবছর এলিয়ট কবিতার চেয়ে দর্শনের পশ্চাদ্ধাবনে বেশি শ্রম ব্যয় করেন। অক্সফোর্ডে এফ এইচ ব্রাডলির (F. H. Bradley) ওপর পিএইচডি অভিসন্দর্ভ রচনা করেন। তাঁর ইংল্যান্ডবাসের এইসময়ের প্রধান ঘটনা ১৯১৪ সালে কনরাড আইকেনের (Conrad Aiken) সহায়তায় এজরা পাউন্ডের সাক্ষাৎ ও প্রীতি লাভ। পাউন্ড এই স্বদেশী তরুণের মধ্যে প্রতিভা ও প্রস্তুতির লক্ষণ শনাক্ত করেন; এলিয়টের “The Lovesong of J Alfred Prufrock” কবিতাটি সুপারিশসহ পাঠিয়ে দেন শিকাগোনিবাসিনী হ্যারিয়েট মনরো সম্পাদিত Poetry Magazine-এ। কবিতাটি কথিত প্রেমসঙ্গীত, কিন্তু মূলত একজন মধ্যবয়সী প্রেমরিক্ত কিন্তু প্রেমপিয়াসী মানুষের হাস্যকর-করুণ বর্ণনা, যে-মানুষটি নানা দিক দিয়ে ‘আধুনিক’ মানুষের প্রতিভূ। সে নিজের ভেতরে বিভক্ত, দ্বিধাগ্রস্ত, নিজের শারীরিক দীনতা সম্পর্কে আত্মসচেতন। উচ্চকোটির লাস্যময়ী, সংস্কৃতিমন্য নারীদের আনাগোনার স্থলে যথা ক্লাবে-রেস্তোরাঁয় প্রুফ্রকের গতায়াত। “In the room the women come and go/Talking of Michelangelo.” কাউকে প্রেমনিবেদনের সাহস তার নেই, কেননা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের গতিকে বিন্দুমাত্র প্রভাবিত কররার And indeed there will be time
To wonder, ‘Do I dare? and, ‘Do I dare?’
Time to turn back and descend the stair,
With a bald spot in the middle of my hair_
(They will say: ‘How his hair is growing thin!’)
My morning coat, my collar mounting firmlyto the chin,
My necktie rich anf modest, but asserted by a simple pin_
(They will say: ‘But how his arms and legs are thin!’)
Do I dare
Disturb the universe?

মদালসা, প্রাণহীন সন্ধ্যাবেলাকে প্রুফ্রক তথা এলিয়ট বর্ণনা করে একটি বিখ্যাত উপমায়: অ্যানেস্থিয়াগ্রস্ত রোগি যেন টেবিলে লম্বমান। সঙ্গীকে (অথবা পাঠককে অথবা নিজেরই প্রতিসত্তাকে) প্রুফ্রক আহ্বান করে একটি ভ্রমণের, যে-ভ্রমণ আবার বহুঅর্থজ্ঞাপক: হতে পারে প্রদোষকালীন লন্ডনের ঘিঞ্জি হোটেল-অধ্যুষিত বেপাড়ার শীর্ণ-প্যাঁচালো পথে শারীরিক ভ্রমণ অথবা মনের অবচেতন প্রদেশে অন্তর্জলিযাত্রা।
Let us go then, you and I,
When the evening is spread out against the sky
Like a patient etherized upon a table…

১৯১৫-তে এলিয়ট বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন ভিভিয়েন হেই-উডের (Vivien Heigh-Wood) সাথে। এলিয়টের বিবাহজীবন ছিল প্রথম দিকে মধুর (ভিভিয়েন ছিলেন এলিয়টের কবিতার অনুরাগী পাঠক, সংবেদনশীল ও প্রাণোচ্ছল), পরে অম্লমধুর (প্রধানত বেকারত্ব ও স্থির উপার্জনহীনতার কারণে) এবং পরে তিক্ত। ভিভিয়েনের মানসিক ভারসাম্যহীনতা ও এলিয়টের বর্ধমান আত্মকরুণার কারণে সম্পর্ক শীতলতায় গড়ায়। পাউন্ড লিখেছেন, এলিয়টের বাড়িটি হয়েছিল একটি “madhouse”-এর নামান্তর। (ভিভিয়েন স্বামীর জন্যে গর্বিত ছিলেন; নিজের অসুখকে লুকিয়ে রেখেছিলেন অনেকদিন স্বামীর লেখার ক্ষতি হবে বলে। এলিয়টের অনেক কবিতার প্রথম পাঠক ও সমঝদার ভিভিয়ান। ভিভিয়ানের সাথে এলিয়ট বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটান ১৯৩২ সালে, তাঁর আমেরিকা সফরের সময়। বহু অননুনয় সত্ত্বেও তাঁর সঙ্গে আর দেখা করেননি অ্যালিয়ট; ১৯৩৮-এ ভিভিয়ানকে বেসরকারি মানসিক আশ্রমে পাঠানো হয়, সেখানেই ১৯৪৮ সালে মারা যান তিনি।) ১৯১৫ থেকে ১৯২৫ এলিয়টের জীবনের দুঃসময়; এরই মধ্যে এলিয়ট স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন, অক্সফোর্ড ও লন্ডন ইউনিভার্সিটিতে খুচরো লেকচার দিয়েছেন ফরাসি ও ইংরেজি সাহিত্য বিশেষ করে ভিক্টোরীয় কবিতার ওপর। পাউন্ড লন্ডনের বিদ্বৎসমাজের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন এলিয়টকে, প্রথমত নিজ ইমেজিস্ট সাহিত্যচক্রের সাথেÑ এর সদস্যরা ছিলেন উইন্ডহ্যাম ল্যুইস্, এইচ. ডি., রিচার্ড এলডিংটন, হ্যারিয়েট উইভার এবং ফোর্ড ম্যাডক্স ফোর্ড। বার্ট্রান্ড রাসেলের মধ্যস্থতায় লেডি অটোলাইন মরেল (Lady Ottoline Morrell)-এর বাড়ির সাহিত্য-আড্ডায় পরিচিত হন ক্যাথারিন ম্যাসফিল্ড, ক্লাইভ বেল ও অলডাস হাক্সলির সাথে। বিখ্যাত ‘ব্লুমসবেরি গ্রুপ’-এর লেনার্ড উল্ফ (Leonard Woolf) ও ভার্জিনিয়া উল্ফ (Virginia Woolf) এবং লিটন স্ট্র্যাচির সংস্পর্শে আসেন। ১৯১৭ থেকে ১৯২৫ পর্যন্ত লয়েড্স ব্যাংকে কেরানীর কাজ করেছেন। (১৯২৫ থেকে বাকি জীবন চাকরি করেছন বিখ্যাত প্রকাশক Faber and Faber-এ। তাঁর অর্থকষ্ট কেটে যায়; সামাজিক প্রতিপত্তি ও সম্মান আসতে থাকে।) বিড়ম্বিত প্রথম জীবন এলিয়টের সবচেয়ে সৃজনশীল পর্যায়ও বটে। এসময় তিনি তাঁর বিখ্যাত সমালোচকমূলক গদ্যগুলো লেখেন-- লেখেন “Sweeney Among the Nightingales”, “Whispers of Immortality”, “Dans le Restaurant”, “ Mr. Eliot’s Sunday Morning Service”-এর মতো কবিতা। আধুনিক নগরজীবনের নানা উদ্ভাস, মানুষের বিচ্ছিন্নতা, মানসিক খণ্ডায়ন, নির্বেদ ও একাকীত্বের মতো আধুনিকবাদী প্রপঞ্চ তাঁর কবিতায় প্রকাশিত হচ্ছিল। ১৯১৭ সালে প্রথম কবিতা-সংকলন Prufrock and Other Observations, ১৯২০-এ গদ্যরচনার সংকলন The Sacred Wood প্রকাশিত হয়। শেষোক্ত গ্রন্থেই সংকলিত হয়েছে এলিয়টের বিখ্যাত দুটি প্রবন্ধ: “THamlet and his Problems” এবং “Tradition and the Individual Talent”. দুটো প্রবন্ধেরই প্রভাব হয়েছিল তাৎক্ষণিক এবং স্থায়ী; বিশেষত “Tradition”–এর সাথে ব্যক্তি-কবির সম্পর্ক ও শিল্পীর নৈর্বক্তিকতা সম্পর্কে এলিয়টের ধারণাগুলো আপ্তবাক্যের মতো গৃহীত হয়েছিল সাহিত্যপাঠক-শিক্ষার্থী মহলে।
আধুনিকবাদী নন্দনের একরকম ম্যানিফেস্টো হিসেবে “Tradition and the Individual Talent”-এর মূল্য অবসিত হওয়ার সম্ভাবনা কম। এলিয়টের প্রতিপাদ্য হল, ব্যক্তি-কবি স্বাধিকারপ্রমত্ত নন; তিনি একাকী মূল্যবানও নন, তাঁর মূল্য নির্ধারিত হয় তিনি যে ট্রাডিশনের ভেতর লিখছেন তার দ্বারা। “You cannot value him alone; you must set him for contrast and comparison, among the dead.” একজন যথার্থ নতুন কবি/শিল্পী তাঁর অস্থিমজ্জায় ধারণ করেন ট্রাডিশনের ধারণা। কালের ভাটিতে বেয়ে আসা সোনার তরীতে ব্যক্তি তাঁর ‘রাশি-রাশি ভারা’ শ্রমের ধান তুলে দেন, নৌকা চলে যায় কালের ভাটিতে, কূলে পড়ে থাকেন নিঃস্ব কৃষক, যার জন্যে ”ঠাইঁ নেই, ঠাঁই নেই” ছোট্ট সে-তরীতে। রবীন্দ্রনাথের উপমাটি পুরোপুরি লাগসই হয়তো নয়, তবু মহাকালব্যাপী গড়ে ওঠা ট্রাডিশনের সাথে ব্যক্তির সম্পর্কটি বোঝানোর জন্য তা ব্যবহার করা হল। অতীত ব্যক্তি-কবির কাছে নেহায়েৎ অতীত নয়, বরং বর্তমানের মধ্যে সে বর্তমান। বর্তমান কবির বিচার হবে অতীতে যারা যারা এই ট্রাডিশনের ভেতর কবিতা লিখেছে সবার প্রেক্ষিতে। একইভাবে অতীত কবি বর্তমান কবির আবির্ভাবের প্রেক্ষিতে পুনর্মূল্যায়িত হবেন। এটি একটি দ্বিমুখী প্রক্রিয়া। ধরা যাক রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দের কথা। জীবনানন্দ কবিতা লিখেছেন রবীন্দ্রনাথের পরে; সুতরাং রবীন্দ্রনাথের প্রেক্ষিতে জীবনানন্দের কবিতার মূল্যবিচার হবে। অন্য দিকে, জীবনানন্দের কবিতা প্রকাশের পর রবীন্দ্রকবিতার পূর্বতন মূল্যায়ন পাল্টে যেতে বাধ্য : তিনি এখন তাঁর উত্তরসূরীর প্রেক্ষিতে পুনর্মূল্যায়িত হবেন। এই পালা চলছে, চলবে। “It is a judgement, a comparison in which two things are measured by each other.” তদুপরি, কবিকে জানতে হবে তার দেশের সাহিত্যের মূলধারা কোনটি : মূলধারাটি যে সবসময় বিখ্যাত কবিদের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে এসেছে তা না-ও হতে পারে। কবি সেই মূলধারায় নিজেকে শুধু সম্পৃক্ত করবেন তা-ই নয়, তিনি তাঁর ব্যক্তিসত্তাকে নির্জিত করে মিশে যাবেন তাতে, কেননা, এলিয়টের মতে, “What happens is a continual surrender of himself as he is at the moment to something which is more valuable. The progress of an artist is a continual self-sacrifice, a continual extinction of personality.”৭ এই নিমজ্জনের জন্য ব্যক্তি-কবি অর্জন করতে হবে “ইতিহাসজ্ঞান”, আর ইতিহাসজ্ঞান অর্জিত হবে না যতক্ষণ না তিনি “নৈর্ব্যক্তিকতা” আয়ত্ত করেন।
সুতরাং Tradition and the Individual Talent প্রবন্ধে এলিয়ট ব্যক্তি-কবিকে দেখছেন দুটি প্রেক্ষিত থেকে: (১) কবির সাথে অতীত-কবিদের সম্পর্ক, এবং (২) কবির সাথে তাঁর নিজের রচনার সম্পর্ক। এই শেষোক্ত সম্পর্কটি বোঝাতে গিয়ে এলিয়ট ব্যবহার করেছেন সেই বিখ্যাত প্লাটিনাম পাতের উপমা। কবির মনের ব্যক্তিগত আবেগানুভূতি সরাসরি তাঁর কবিতায় প্রকাশিত হয় না। কবি-মন নিরপেক্ষ ও নিষ্ক্রিয়, এই অর্থে যে, সে শুধু নানা আবেগ, অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা ধারণ করার একটি আধার মাত্র। তার মনের উপস্থিতিটি জরুরি, কেননা তা না হলে ঐসব উপাদান একত্রে মিলত কোথায় ও কী শর্তে?“The poet’s mind is in fact a receptacle for seizing and storing up numberless feelings, phrases, images, which remain there until all the particles which can unite to form a new compound are present together.”৮ এখানেই প্লাটিনাম পাতের তুলনা। যদি অক্সিজেন ও সালফার ডায়অক্সাইড ভর্তি একটি কাচের জারের ভেতর প্লাটিনাম পাত ঢোকানো হয়, তবে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় সালফিউরাস এসিড উৎপন্ন হবে। নতুন এই যৌগের উৎপাদন প্লাটিনাম পাতের উপস্থিতি ছাড়া সম্ভব হতো না, কিন্তু তার ভেতর প্লাটিনাম পাতের কোনো অংশ যুক্ত হয়নি। প¬াটিনাম পাতটি শুধু প্রভাবকের (catalyst) কাজ করেছে। কবির মন ঐ প্লাটিনাম পাতের মতো; সে শুধু অনুঘটক। ফলত, যে-ব্যক্তি অনুভব করে, আর যে-ব্যক্তি তা কবিতায় রূপায়িত করে তারা এক নয়, আলাদা। কবির ব্যক্তিসত্তা ও তাঁর কবিতার মধ্যে এই দূরায়ণই কাব্যিক নৈর্ব্যক্তিকতা। আর তারপর সেই এলিয়টীয় আপ্তবাক্য -- “The more perfect the artist, the more completely separate in him will be the man who suffers and the mind which creates; the more perfectly will the mind digest and transmute the passions which are its material.”৯
এলিয়টের কাব্যকৃতির মূলস্তম্ভ The Waste Land । যা কিছু এলিয়টীয় নন্দন হিসেবে স্বীকৃত, যা কিছু আধুনিকবাদী কবিতার কুললক্ষণ হিসেবে গৃহীত হয়েছে তার প্রায় সবই দ্য ওয়েস্টল্যান্ড থেকে পাওয়া। এই কাব্যটির প্রভাব পরবর্তী ইংরেজি কবিতাতে তো বটেই, এমনকি তিরিশ-চল্লিশ-পঞ্চাশ-ষাটের দশকের বাংলা কবিতাতেও দুর্দমনীয় হয়ে উঠেছিল।
The Waste Land প্রকাশিত হয় ১৯২২ সালে, প্রথমত Criterion পত্রিকায়, এবং পরে Dial-এ। আধুনিক নগরজীবনের হতাশা, নির্বেদ, নৈরাশ্য-নৈরাজ্য; আধুনিক মানুষের চিন্তার পারম্পর্যহীনতা-অসংলগ্নতা; সভ্যতার বিপর্যয় সম্পর্কে পয়গম্বরসুলভ ভবিষ্যৎবাণী; মিথ-ইতিহাস-সাহিত্য-খ্রিষ্টিীয়-বৌদ্ধ-হিন্দু দর্শনের বিপুল সংঘট্ট-সংগমে গড়ে ওঠা এক জটিল আঙ্গিক ও বর্ণনা-কৌশলে রচিত ‘মহাকাব্যিক’ কবিতা এটি। কবিতার মূলভাব, শিরোনাম এবং প্রতীক তিনি আহরণ করেছেন দুটো বই থেকে। এলিয়টের নিজ স্বীকারোক্তি দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ডের টীকায়: “Not only the title, but the plan and a good deal of the symbolism of the poem were suggested by Miss Jessie L. Weston’s book on the Grail legend: From Ritual to Romance… To another work of anthropology I am indebted in general, one which has influenced our generation profoundly; I mean The Golden Bough …”১০ স্যার জেম্স ফ্রেজারের দ্য গোল্ডেন বাউ থেকে তিনি সংগ্রহ করেন পোড়োজমি সম্পর্কিত মিথ এবং ওয়েস্টনের বই থেকে Grail Legend-এর মেছোরাজার উপকথা । ফ্রেজারের দ্য গোল্ডেন বাউ তাঁকে দিয়েছ তাঁর বিখ্যাত Mythic technique বা মিথীয় কৌশল। জেমস জয়েস্ তাঁর ইউলিসিস উপন্যাসে এরকম টেকনিক ব্যবহার করেছিলেন উল্লেখ করে এলিয়ট করেন এই বিখ্যাত উক্তি: “It is simply a way of controlling, of ordering, of giving a shape and a significance to the immense panorama of futility and anarchy which is contemporary history.”১১ পাঁচপর্বে বিভক্ত এই দীর্ঘ কবিতা : পর্বগুলোর নাম-- The Burial of the Dead (মৃতের সৎকার), A Game of Chess (পাশাখেলা), The Fire Sermon (অগ্নিসূত্র),Death by Water (সলিল সমাধি) ও What the Thunder Said (বজ্র কী বলেছিল)। ১৯২২ সালে বর্তমান রূপে প্রকাশিত হলেও এলিয়ট এর পরিকল্পনা করছিলেন সেই ১৯১৪ থেকে; লিখে চলছিলেন টুকরো-টাকরা, ছোটছোট নানা ভাবের কবিতা, যেগুলো শেষ খসড়ায় ঢুকিয়ে দিয়েছেন। ১৯১৯ এর ডিসেম্বরে মাকে লেখা চিঠিতে জানাচ্ছেন , “My New Year’s resolution is to write a long poem I have had on my mind for a long time….”১২ দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড কবিতার মূল প্রতীক “পোড়োজমি” মেছোরাজার কিংবদন্তী থেকে আহৃত। Fisher King বা মেছোরাজা তার যৌন অমিতাচারের কারণে দেবতার কোপে পড়েন। দেবতার অভিশাপে শারীরিক পঙ্গুত্ব তথা পুরুষত্বহীনতা ভর করে রাজার ওপর-- তিনি প্রজননক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। শুধু রাজা নয়, তার রাজত্বের সকল পশুপাখি বন্ধ্যা হয়ে পড়ে, সকল জমি হয়ে পড়ে নিষ্ফলা; জলরহিত মরুময় তরুলতাহীন সেই বিরানভূমিতে কোনো পাখি গায় না, ফুল ফোটে না, শুধু জন্মে বিষম, বিষণ্ন ক্যাকটাস। ইংলন্ডীয় মধ্যযুগের রাজা আর্থার, তাঁর বিখ্যাত গোলটেবিল ও দ্বাদশ অশ্বারোহী অমাত্যকে ঘিরে যে আর্থারীয় কিংবদন্তী তার সাথেও জড়িয়ে আছে মেছোরাজা আর তার পোড়োজমির কাহিনী। কথিত আছে, আর্থারের অন্যতম বীর-পারিষদ স্যর পার্সিভাল যিশুর পবিত্র পানপাত্র তথা Holy Grail- এর খোঁজে মেছোরাজার দেশে আসবেন। সেখানে রয়েছে একটি ভাঙা, প্রেত-অধ্যুষিত গীর্জা, Chapel Perilous : সেখানে দাঁড়িয়ে পার্সিভাল হোলি গ্রেইল এবং যিশুর পার্শ্বদেশবিদীর্ণকারী বর্শা সম্পর্কে কিছু যাজ্ঞিক প্রশ্ন আওড়াবেন, আর তাতেই রুদ্ধ স্রোতোস্বিনীর উৎসমুখ খুলে যাবে; জলের বন্যায় পুনরায় উর্বরা শস্যময়ী হয়ে উঠবে মরুময় প্রান্তর, মেছোরাজা ফিরে পাবেন তাঁর স্বাস্থ্য, পশুপাখি ফিরে পাবে তাদের স্বাভাবিক প্রজনন ক্ষমতা। বন্ধ্যাত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে সকলে। এলিয়ট এই মিথকাহিনীকে আধুনিক নগরসভ্যতার পরিণতির প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করলেন। তাঁর মতে আধুনিক মানুষের পরির্প্শ্বা তথা নগর পোড়োজমিতে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। এখানে নেই শান্তির বারি, পিপাসার জল, রৌদ্রতাপ থেকে আশ্রয় নেয়ার মতো পান্থপাদপ; তার জীবনে ভালোবাসার হায়াসিন্থ ফোটে না, শুধু সন্দেহ, অবিশ্বাস, ঘৃণা ও ভয়ের ফণিমনসারা জেগে থাকে। কেন এই পরিণতি? মেছোরাজার মতোই মূলত যৌন অনাচারের পাতক বর্তমান মানুষ, আর এই অনাচার ইতিহাসবাহিত, এমনকি মিথের দূরবর্তীকালেও একইরকম অসংযম ও অমিতাচার মানুষের সঙ্গী ছিল। আর তাই ওয়েস্টল্যান্ডের বিশাল মরু-উপত্যকায় দাঁড়িয়ে বাইবেলের প্রফেট ঈজিকিয়েল মানুষকে আহ্বান করেন যিশুরূপী লালপাহাড়ের ছায়াতলে আশ্রয় নেয়ার জন্যে :
What are the roots that clutch, what branches grow
Out of this stony rubbish? Son of man,
You cannot say, or guess, for you know only
A heap of broken images, where the sun beats,
And the dead tree gives no shelter, the cricket no relief,
And the dry stone no sound of water. Only
There is shadow under this red rock,
(Come in under the shadow of this red rock),
… … …
I will show you fear in a handful of dust.
(The Burial of the Dead)

কবিতাটির করণকৌশল নানা কারণে অভিনব। এলিয়ট সরাসরি বর্ণনা না করে ছোট ছোট আখ্যানে ভাগ করেছেন সমগ্র কবিতাকে, অথবা, উল্টোভাবে দেখলে, অনেকগুলো পরস্পর-অসংলগ্ন আখ্যানকে এক সূত্রে গাঁথার চেষ্টা করেছেন। আখ্যানগুলির প্রত্যেকটি একজন কথকের জবানিতে উচ্চারিত। কথকদের মধ্যে, উদাহরণত, আছে মেরী নামের এক মধ্যবয়সী জার্মান মহিলা, প্রফেট ঈজিকিয়েল, মাদাম সসস্ট্রিজ নামের এক ভবিষ্যৎবক্তা, গ্রিক মিথের ত্রিকালজ্ঞ অন্ধ মুনি টিরেসিয়াস, উচ্চবংশীয়া ভোগবিলাসিনী নারী, বারমেইড একজন, টেমস নদীপারের বেশ্যা রমণীকুল (তিন টেম্স কন্যা), গৌতম বুদ্ধ, সন্ত আগস্তিন, প্রজাপতি ব্রহ্মা, এবং আরো অনেকে। কারো কারো মতে, টিরেসিয়াসই মূল কথক, ভিন্ন-ভিন্ন বেশে। এর সমর্থন মেলে এই তথ্যে যে, এলিয়ট কবিতাটির নাম প্রথমে দিয়েছিলেন He Do the Police in Different Voices’. টিরেসিয়াসের প্রতীক চরিত্র অন্যসব প্রতীককে শাসন করে এবং ‘ভগ্ন চিত্রকল্পের ¯তূপ’ বলে কথিত এই কবিতাকে একটি সূত্রে ঐক্যবদ্ধ করে। সূত্রটি ইতিহাস-দর্শনের ও ভবিষ্যভাবনার। এলিয়ট কবিতাটির দুরূহ উল্লেখকে কিছুটা প্রাঞ্জল করার জন্য বিস্তারিত টীকা জুড়ে দিয়েছেন। সেখানে টিরেসিয়াস সম্পর্কে তাঁর উক্তি:
Tiresias, although a mere spectator and not indeed a “character”, is yet the most important personage in the poem, uniting all the rest. Just as the one-eyed merchant, seller of currants, melts into the Phoenician Sailor, and the latter is not wholly distinct from Ferdinand, Prince of Naples, so all the women are one woman, and the two sexes meet in Tiresias. What Tiresias sees, in fact, is the substance of the poem.”১৩
এজরা পাউন্ডের হাতে এলিয়ট ১৯২২ সালে যে-দীর্ঘ কবিতা তুলে দেন, পাউন্ড সেটিকে অতুলনীয় ধৈর্য্য, প্রজ্ঞা ও ‘নিষ্ঠুরতা’র সাথে সম্পাদনা করেন। তিনিই এর নাম বদলে দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড করার পরামর্শ দেন এবং অর্ধেকের বেশি লাইন ছেঁটে ফেলার জন্য বলেন। এলিয়ট গুরু-আজ্ঞা মাথা পেতে নেন এবং কবিতাটির বর্তমান রূপ দেন। সাহিত্যিক অভিভাবনা ও পথনির্দেশ মহৎ সাহিত্যের ক্ষেত্রে কীরকম ফলবান হতে পারে তার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ এই ঘটনা।
দ্য ওয়েস্টল্যান্ডের বিষয়বস্তু কী? এত চরিত্র, ঘটনা, মিথ-দর্শন-নৃতত্ত্ব-ইতিহাসের জটিলজটাজালের মধ্য দিয়ে কী সত্য দেখাতে চান কবি? একটি অনুমান হচ্ছে, যেমন আগে বলেছি, এলিয়ট আধুনিক নগরসভ্যতার পাপ-পচন-পতন তথা নাগরিকদের বিচ্ছিন্নতা-নিঃসঙ্গতা-বিষণœতার ভয়াল প্রতিচিত্র (কোলাজ ছবির ধরনে) আঁকতে চেয়েছেন। অন্য একটি ধারণা, দ্য ওয়েস্টল্যান্ডের মূল বিষয় মৃত্যু ও পুনর্জীবন। যিশু অথবা আদিবাসী ধর্মে যে-দেবতাকে প্রতিবছর প্রতীকীভাবে কবর দেয়া হয় শস্যঋতুর মৃত্যুর প্রতীক হিসেবে, তার পুনর্জীবন ও পুনরুত্থানকে শস্যচক্রের পুনরাগমন, শীতের মৃত্যুর পর বসন্তের আবির্ভাব তথা জীবনের পুনর্নবায়ন হিসেবে ভাবা হয়। এই অর্থে দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড একইসাথে নৃতাত্ত্বিক ও খ্রিস্টভাবিত কবিতা। ক্লিন্থ ব্র“কসের (Cleanth Brooks) মতে কবিতাটিতে রয়েছে দু’ধরনের মৃত্যু ও দু’ধরনের জীবন। এক দিকে, যে-জীবনের অর্থ নেই সে-জীবন মৃত্যুর নামান্তর; অন্য দিকে, আত্ম্ৎোসর্গমূলক মৃত্যু হলো জীবনদায়িনী, পুনর্জীবনসহায়িকা। এরকম একটি প্যারাডক্সের যুগ্ম-পিস্টনে আবর্তিত কবিতাটির অর্থমহিমা। দ্য ওয়েস্টল্যান্ড একটি সঙ্কর কবিতা; এর আঙ্গিক বিভিন্ন ফর্ম ও জেনারের সমবায়ী; এতে রয়েছে চিন্তামূলক গীতিকবিতা, আধ্যাত্মিক আত্মকাহিনী, রোমান্স, শোকগাথা, মহাকাব্য, জ্যাকবীয় নাটক, গোয়েন্দা উপন্যাস, মিউজিক হল কমেডি থেকে আহৃত উপাদান। একে বলা হয়েছে নানা বিষম স্বরের ঐকতান সঙ্গীত; বিবিধ কালিক প্রেক্ষার সমন্বয়ে গঠিত কিউবিস্ট চিত্রোপম রচনা; একটি চলচ্চিত্রিক মন্তাজ; একটি নাট্যকবিতা যেখানে নানা কণ্ঠস্বর, চরিত্র ও ঘটনাস্থলের সমাবেশ; একটি সুররিয়ালিস্ট কবিতা যেখানে অবচেতন ভয়, উৎকণ্ঠা আর বাসনানিচয় অসংলগ্ন প্রতীকাদির মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, যেমনটা হয় স্বপ্নে।১৪
দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড কবিতায় এলিয়ট দুটি প্রধান কৌশল অবলম্বন করেছেন। প্রথমটির নাম মিথীয় কৌশল: নানা মিথের ব্যবহারের মধ্য দিয়ে একটি ভাবের চিত্র গড়ে তোলা, যে সম্পর্কে আগে বলা হয়েছে। দ্বিতীয় কৌশলটির নাম উল্লেখ-উদ্ধৃতি: ৪৩৩ পঙক্তির এই কবিতায় ৩৮টি সাহিত্যকর্মের উল্লেখ অথবা উদ্ধৃতি রয়েছে। এর মধ্যে আছে বাইবেল, শেক্সপীয়ার, ভার্জিল, ভাগনার, ওভিদ, বোদলেয়ার, সপ্তদশশতকী নাট্যকার ক্রিস্টোফার মিডলটন ও জন ওয়েবস্টার, বুদ্ধের অগ্নিসূত্র, ভেরলেনের পার্সিফল, জেরার দ্য নেরভাল। যেসব ভাষা থেকে আহৃত সেগুলো হচ্ছে গ্রিক, লাতিন, ইংরেজি, জার্মান, ফরাসি, ইতালিয়ান, এবং সংস্কৃত।
দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ডের প্রকাশ ছিল একটি বিপ্লব: ওয়ার্ডসওয়ার্থ, শেলি, কীট্স, হুইটম্যান, টেনিসন, ইয়েট্সের কবিতাপাঠে অভ্যস্ত পাঠকরা এর জটিল বিন্যাস, অসংলগ্নতায় আকীর্ণ শরীর, এর কঠিন উল্লেখ ও দুর্বোধ্য মিথপ্রপঞ্চের সামনে বিমূঢ় হয়ে পড়ে। কিন্তু কবিতাটির শক্তি, নতুনত্ব ও এর ভেতরকার জগদ্দর্শনটিও ছিল অনস্বীকার্য। কবিতাটিকে কোনো জানা আঙ্গিকের কুঠুরিতে রাখা যাচ্ছিল না : এতে নেই কোনো পূর্বাপর বর্ণনা বা বর্ণনাকারী, নেই চিন্তা বা আবেগের ঐক্য; যাকে বলে ‘অর্গানিক ইউনিটি’, তার প্রতি চরম অবজ্ঞা এতে প্রকাশিত। কিন্তু যে-পাঠকরা ফরাসি প্রতীকবাদী কবিতার সাথে পরিচিত ছিলেন, যারা জায়মান কিউবিস্ট চিত্রাঙ্কনপদ্ধতি অথবা জয়েস্ ইত্যাদির উপন্যাসে অবলম্বিত ‘চেতনাপ্রবাহ রীতি’র সাথে সম্যক পরিচিত হচ্ছিলেন, যারা সিগমুন্ড ফ্রয়েডের সদ্যপ্রচারিত মনোবিকলন তত্ত্বের সুলুকসন্ধান জানতেন, তাঁদের কাছে দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড সমাদৃত হলো নতুন যুগের সাহিত্য হিসেবে-- সে যুগটির নাম আধুিনক যুগ, আর সে-সাহিত্যের নাম আধুনিকবাদী সাহিত্য।
১৯২০ সালের পর থেকে এলিয়ট ক্রমাগত নাটকের দিকে ঝুঁকে পড়েন। মূলত কাব্যনাটকের অঙ্গিককে ফিরিয়ে আনার জন্য ক্রাইটেরিয়ন পত্রিকায় কয়েকটি ক্ষুদ্র নাটক লেখেন ১৯২৬ ও ১৯২৭ সালে। তবে তাঁর বিখ্যাত কাব্যনাটকগুলো : Murder in the Cathedral (1935), The Family Reunion(1939), The Coktail Party(1949), The Confidential Clerk (1953), এবং The Elder Statesman (১৯৫৮)
এলিয়টের খ্যাতির অন্যতম ভিত্তি তাঁর পরিণত বয়সের রচনা Four Quartets; দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে রচিত এই দীর্ঘ কবিতায় এলিয়টের বিশ্ববীক্ষার বিশাল পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। পোড়োজমির হতাশ্বাস নয়, নয় মানবজীবনের হতাশ ভবিষ্যতের পয়গম্বিরতা; বরং এই কবিতায় বিধৃত এলিয়টের শান্তসমাহিত দার্শনক ভাবনা-- কাল, জীবন ও মহাজীবন, মৃত্যুময়তা ও আর্ট নিয়ে। কবিতার টেকনিকেও বিরাট পরিবর্তন: উল্লেখ-অনুষঙ্গের জায়গায় বিশ্লেষণ। দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ডের ছিল আনুভূমিক বিস্তৃতি; ফোর কোয়ার্টেটস যেন আলম্বভাবে প্রসৃত, গভীর ও আশাময়। আশার আলোকটি যে তাঁর সদ্যপ্রাপ্ত অ্যাংলো-ক্যাথলিক ধর্মবিশ্বাস থেকে আহৃত তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। (প্রসঙ্গত, এলিয়ট সালে তাঁর পূর্বতন ধর্মমত পাল্টে অ্যাংলো-ক্যাথলিসিজম গ্রহণ করেন।) আধুনিক সভ্যতার ধ্বংস নিয়ে আর শংকিত নন এলিয়ট; মানুষ আর্টের এবং আধ্যাত্মিকতার ভেতর দিয়ে নিজেকে পুনর্গঠন করতে পারে বলে তিনি বিশ্বাস করছেন। ‘ফোর কোয়ার্টেটস’ চারটি চতুষ্কের সমাহার: “Burnt Norton”, “East Coker”, “The Dry Salvages”,এবং “Little Gidding”. কবিতাটির মূল প্রক্ষেপণ মানুষের সাথে ঈশ্বর, ব্রহ্মাণ্ড এবং কালের সম্পর্ক। ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমান একে অপরের মধ্যে প্রবিষ্ট, মানুষ কালের গণ্ডির বাইরে যেতে পারে না, এবং তার মুক্তিও মেলে না। এই কবিতায় এলিয়ট খ্রিস্টিয় ধর্মতত্ত্ব, পাশ্চাত্য সাহিত্য, প্রাচ্যদর্শন তথা ভগবদ্গীতার বাণী এবং দান্তের ডিভাইন কমেডিকে একপাত্রে মিশ্রিত করেছেন।
Time present and time past
Are both perhaps present in time future,
And time future contained in time past.
If all time is eternally present
All time is unredeemable.
* * *
At the stiff point of the turning world. Neither flesh nor fleshless.
Neither from nor towards; at the still point, there the dance.
But neither arrest nor movement. And do not call it fixity
Where past and future are gathered. Neither from nor towards,
Neither ascent nor decline. Except for the point, the still point,
There would be no dance, and there is only the dance.
(Burnt Norton)

এলিয়ট ফোর কোয়ার্টেটসের চারটি পর্বকে চারটি ভৌত (বষবসবহঃ) বস্তুর সাথে সম্পর্কিত করতে চেয়েছেন: বার্নট নর্টন (বায়ু), ইস্ট কোকার (মাটি), দ্য ড্রাই স্যালভেজেস (জল) এবং লিটল গিডিং(আগুন)। প্রসঙ্গত, দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ডের প্রথম চারটি পর্বও যথাক্রমে মাটি, বায়ু, অগ্নি ও জলকে ঘিরে আবর্তিত। কবিতাটিকে অনেক সমালোচক দার্শনিক ও ধর্মীয় কবিতার পরাকাষ্ঠা বলে মনে করেন। ১৯৪৪ সালে প্রকাশিত এই কবিতা এলিয়টের প্রতিভার শেষ উদ্ভাসন বলেও মনে করা হয়। এলিয়টের সাথে রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়াশীলতা ও ধর্মকেন্দ্রিক রক্ষণশীলতার অভিযোগ জড়িয়ে আছে। যখন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে স্পন্দিত সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপ, এলিয়ট তখন আঁকড়ে ধরেছেন ধর্মীয় দর্শনকে, যেন পলায়মান একটি বিশ্বকে ধরে রাখবার জন্য। তিনি অলজ্জভাবে ঘোষণা করেন: ''I am royalist in politics, classicist in literature, anglo-catholic in religion.”

আধুনিকবাদের প্রতিভূরা-২ : ইয়েটস ও ফ্রস্ট
শতাব্দী-ক্রান্তি ও লন্ডন আভা-গাঁর্দ

ঊনিশ-শতকের শেষ দশক তথা ১৮৯০-এর দশক ইংরেজি সাহিত্যের ফ্যাঁ-দ্য-সিক্ল বা শতাব্দী-ক্রান্তি হিসেবে চিহ্নিত। এ সময়টা ভিক্টোরীয় কাব্যঐতিহ্য থেকে সচেতন বিযুক্তি ও জায়মান আধুনিকবাদের সাথে নানা মাত্রায় সংযোগায়নের প্রয়াস দ্বারা চিহ্নিত। ইতোপূর্বে আমরা নন্দনসারবাদী ও ডেকাডেন্টদের বিষয়ে কিছুটা আলোচনা করেছি। এক্ষণে এই ক্রান্তি-কালের আরো কয়েকজন দিকপালের কথা বলতে পারি। ঈস্থেট্ ও ডেকাডেন্টদের মতো এঁরাও তথাকথিত লন্ডন আভাঁ-গার্দের সদস্য : ডব্লিউ বি ইয়েটস, আর্নেস্ট ড’সন, লায়নেল জনসন এবং আর্থার সাইমন্স। এঁদের মধ্যে প্রধানতম ইয়েটস : ১৮৮৯ থেকে ১৮৯৯ সালের মধ্যে তিনি তিনটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেন। শতাব্দীর শেষবছর অতিক্রান্ত হওয়ার আগেই কবি হিসেবে তাঁর অগ্রগণ্যতা প্রতিষ্ঠিত। এই আভাঁ-গার্দ কবিরা শুধু যে ভিক্টোরীয় কবিতার ন্যারেটিভ-প্রবণতা, নীতিবাগীশতা ও অন্যান্য বৈশিষ্ট্য বর্জন করলেন তাই নয়, তাঁরা সচেতনভাবে আবাহন করলেন সমকালীন ফরাসি কবিদের আধুনিকবাদী কাব্যধারাকে। বিশেস নমস্য হয়ে উঠলেন সিম্বলিস্ট কবিরা : বোদলেয়ার, মালার্মে, ভেরলেন প্রভৃতির কবিতা থেকে সূত্র ও পদ্ধতি উভয়ই চয়ন করতে চাইলেন এঁরা। এর আগে নন্দনসারবাদীরা ভিক্টোরীয় নীতিনিষ্ঠাকে জলে সমর্পণ করেছিলেন; এবার কবিতার সংবেদন ও অভিমুখ পাল্টানোর পালা। ভিক্টোরীয় কবিরা মধ্যবিত্ত পাঠকের সুরুচি, দায়িত্ববোধ ও নৈতিকতাকে অল্ঘংনীয় ভেবেছিলেন। ঈস্থেট্, ডেকাডেন্ট ও আভাঁগার্দরা মিলে ভিক্টোরীয় মূল্যবোধকে আক্রমণ করলেন। এঁরা সবাই শিল্পের স্বায়ত্তশাসনে বিশ্বাসী, যদিও বেনীআসহকলার মতো এঁদের বিদ্রোহের রঙ নানামাত্রিক। আর্ট ফর আর্টস সেক-এ বিশ্বাসী ওয়াল্টার পেটারের চরম নন্দনবাদিতা থেকে ইয়েটসের আইরিশ ঐতিহ্যাভিসারের মধ্যে নিশ্চয়ই উল্লেখযোগ্য পার্থক্য আছে।
ঈস্থেট, ডেকাডেন্ট এবং সিম্বলিস্টদের মধ্যে পার্থক্য করা একটু কঠিন, এই কারণে যে, তাঁদের মানসপ্রবণতা ও উচ্চারণের মধ্যে অনেক মিল । ঈস্থেট্ বা নন্দনসারবাদীরা মনে করতেন শিল্প শুধু সার্বভৌম নয়, এর একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে সৌন্দর্য সৃজন ও সৌন্দর্যের অনুধ্যান। ডেকাডেন্টরা এর সাথে যুক্ত করলেন নতুন মাত্রা--সৌন্দর্য শুধু সুন্দর বস্তুনিচয়ের মধ্যে প্রাপণীয় নয় : সৌন্দর্যকে খুঁজতে হবে কুৎসিৎ, ভয়াবহ, এবং বৈনাশিকের মধ্যেও। পচনধরা, কৃমিক্লিষ্ট শবদেহের মধ্যে ডেকাডেন্ট খুঁজে পেতে পারেন সবুজ দুর্বাদল কিংবা নীলাকাশের চেয়ে মোহনীয় সৌন্দর্য। স্বভাবতই বোদলেয়ারের কবিতা এঁদের কাছে আদরণীয়, কেননা বোদলেয়ারই তো তাঁর কাব্যের নাম রেখেছিলেন ‘ক্লেদজ কুসুম’ বা Les Fleurs du Mal.
সিম্বলিস্টরা, অন্য দিকে, ঝুঁকলেন প্রতীক খোঁজার দিকে; আর প্রতীকের অনুসন্ধান তাঁদের নিয়ে গেল নানা গন্তব্যে-- নব্য-প্লাতনিক দর্শন, আলকেমি থেকে শুরু করে অতিপ্রাকৃত লোকবিশ্বাস, ফোকলোর পর্যন্ত। তাঁরা চাইলেন প্রতীকের মাধ্যমে এমন একটি অধরা কিন্তু অনুভবযোগ্য বাস্তবতাকে ধরতে যাকে নিত্যদিনের রুটিনকাজের মধ্যে এবং প্রচল রুটিন ভাষায় ধরা সম্ভব নয়। এই বাস্তবতার অবস্থান দৈনন্দিন নানা প্রধাবনা তথা বাণিজ্য, যুদ্ধ, রাজনীতি এমনকি জন্ম-মৃত্যুর মতো প্রাত্যহিকতার ঊর্ধ্বে। এক অর্থে প্রতীকবাদ ও মরমিয়াবাদ হয়ে দাঁড়াল অভিন্ন। বিশেষত ইয়েটসের কবিতায়, আমরা দেখব, প্রতীকের সাথে আধ্যাত্মিকতা ও মরমিয়াতত্ত্ব জড়িয়ে-প্যাঁচিয়ে নতুন রসায়ন হয়ে উঠেছে।

ডব্লিউ বি ইয়েটস
ঊনিশ-শতকের শেষপাদে লন্ডন আভাঁ-গার্দের অন্যতম মিলনক্ষেত্র ছিল রাইমার্স ক্লাব। ১৮৯০ সালে বন্ধু আর্নেস্ট রাইসের (Ernest Rhys) সাথে মিলে ইয়েটস প্রতিষ্ঠা করেন এই ক্লাব। সদস্যদের মধ্যে ছিলেন অস্কার ওয়াইল্ড, রিচার্ড লে গিলিয়েন(Richard Le Gillienne), লায়নেল জনসন, আর্থার সাইমন্স ও আর্নেস্ট ড’সন। গোড়ার দিকে এটি ছিল মূলত ভোজনরসিকদের একটি সংগঠন : ফ্লিট স্ট্রিটের চেশায়ার চিজ্ নামের রেস্তরাঁর দোতলায় এঁরা মিলিত হতেন, প্রধানত ভোজনের জন্য, কিন্তু সেই সাথে স্বরচিত কবিতাপাঠ ও কাব্যবিষয়ক নানা আলোচনায় ব্যাপৃত হতেন এঁরা। রাইমার্স ক্লাবের কবিরা দুটি সংকলন প্রকাশ করেন। এঁদের কোনো ঘোষিত ম্যানিফেস্টো না থাকলেও এঁরা ছিলেন বোদলেয়ারের ভক্ত এবং সাধারণভাবে সিম্বলিজমের অনুসারী। প্রি-র‌্যাফায়েলাইট কবিকুল এবং নন্দনতাত্ত্বিক ওয়াল্টার পেটার এঁেদর কাছে অনুসরণীয় ছিল। ইয়েটসের নিজের কবিতার প্রথম পর্যায়ে প্রি-র‌্যাফায়েলাইট চিত্রকর-কবিদের প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষযোগ্য। ইয়েট্স পরবর্তীকালে তাঁর আত্মজীবনীতে রাইমার্স ক্লাবের কবিদের নাম দিয়েছেন “tragic generation”. এই কবিরা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পাঠাভ্যাস, তাদের মূল্যবোধ ও জীবনাচরণকে ঘৃণা করতেন। তবে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জীবনকে উপেক্ষা থেকে তার পৌঁছে গিয়েছিলেন স্বাবাবিক জীবনের অভিজ্ঞতা ও আবেগেরও বিপরীতে: আর্ট ফর আর্টস সেক-এর উন্মার্গচিন্তা শেষপর্যন্ত তাঁদের শিল্প থেকে শুষে নিয়েছিল প্রাণরস। কবি হিসেবে তাঁরা ব্যর্থ হলেও এঁদের কাছেই ইয়েট্স শিখেছিলেন শৈল্পিক নিষ্ঠা ও ধৈর্য।
সাধারণভাবে এই শতাব্দী-ক্রান্তির কবিদের কবিতার ওপর একধরনের মন্ময় চিত্তবৃত্তি ও রোমান্টিক সংবেদনের কুয়াশা-চাদর ছড়িয়ে অছে। ইন্দ্রিয়-ঘনত্ব, আলস্য-জড়ানো নির্বেদ ও পলায়নী চিদাকাক্সক্ষা এঁদের কবিতার সাধারণ বৈশিষ্ট্য। ইয়েটসের প্রথমভাগের অনেক প্রেমের কবিতা এবং রোমান্টিক-কুহক জড়ানো কবিতা The Lake Isle of Innisfree এর উদাহরণ।
The Lake Isle of Innisfree
I will arise and go now, and go to Innisfree,
And a small cabin build there, of clay and wattles made:
Nine bean-rows will I have there, a hive for the honey-bee,
And live alone in the bee-loud glade.

And I shall have some peace there, for peace comes dropping slow,
Dropping from the veils of the morning to where the crickets sings;
There midnight’s all a glimmer, and noon a purple glow,
And evening full of the linnet’s wings.

I will arise and go now, for always night and day
I hear lake water lapping with low sounds by the shore;
While I stand on the roadway, or on the pavement grey,
I hear it in the deep heart’s core.

আভাঁ-গার্দ কবিদের বেশিরভাগ ফরাসি প্রতীকবাদীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন, যদিও প্রতীকবাদ বা সিম্বলিজম আসলে কী বোঝায় সে-সম্পর্কে তাঁদের ধারণা খুব স্পষ্ট ছিল না। ড’সনের কাছে প্রতীকবাদী কবিতার মানে ছিল mere sound, and music, with just a suggestion of sense, or hardly that. অস্কার ওয়াইল্ড বুঝেছেন শুধু আঙ্গিকের ভিন্নতা -- “that curious jewelled style, vivid and obscure at once, full of argot and of archaisms, of technical expressions...” ফরাসি Symbolisme সম্পর্কে প্রথম নিষ্ঠাবান আলোচনা করেন আর্থার সাইমন্স তাঁর বিখ্যাত The Symbolist Movement in Literature (১৮৯৯) গ্রন্থে। সাইমন্স বস্তুত ইংলিশ চ্যানেলের ওপারে ঘটমান কবিতা-আন্দোলনের ওপর দীর্ঘদিন ধরে নজর রাখছিলেন। ১৮৯৫ থেকে ১৮৯৮ সালের মধ্যে তিনি হুইসমান্স, মালার্মে, নেরভাল, র‌্যাঁবো, ভিলিয়ার দ্য’লিল অ্যাডাম, ভেরলেন এবং মেটারলিঙ্কের ওপর প্রবন্ধ লিখেছিলেন। তখনও তিনি এঁদেরকে সিম্বলিস্ট হিসেবে একসূত্রে গাঁথার কথা ভাবেনি। মূলত ইয়েটসই তাঁকে একথা বোঝান যে, উপর্যুক্ত কবিদের ভেতর দিয়ে ফরাসিদেশে এক যুগান্তকারী কাব্যান্দোলনের জন্ম হয়েছে, ইয়েটসের ভাষায় যাকে বলা যায় সিম্বলিক্যাল মুভমেন্ট। ইয়েটসের প্রণোদনায় সাইমন্স এই বিচিত্র ধরনের কবির মধ্যে আবিষ্কার করলেন প্রতীকের ঐক্যসূত্র। প্রকাশিত প্রবন্ধগুলো একত্রিত করে, তার সাথে লাফর্গ সম্পর্কে একটি নতুন রচনা, একটি ভূমিকা ও উপসংহার জুড়ে দিয়ে গ্রন্থিত হলো শতাব্দী-ক্রান্তিকালের শ্রেষ্ঠতম কাব্যালোচনা। ইংরেজ আধুনিকবাদী তরুণ কবিদের কাছে বাইবেলস্বরূপ হয়ে উঠেছিল সাইমন্সের বইটি। টি এস এলিয়ট স্মৃতিচারণায় বলেছেন, সাইমন্সের ''The Symbolist Movement in Literature bv co‡j “I should not, in the year 1908, have heard of Laforgue or Rimbaud; I should probably not have begun to read Verlaine, I should not have heard of Corbière.''
ইয়েটসের কাছে সিম্বলিজমের অর্থ ছিল একটি স্বাতিক্রমী বাস্তবতাকে অনুসন্ধানের অপর নাম। ইয়েটসের মতে একটি চিত্রকল্প তখনই প্রতীক হয়ে ওঠে যখন সে একটি ঐতিহ্যের মধ্যে স্থাপিত হয়। আর সে ঐতিহ্যটি হতে পারে সাহিত্যের, ধর্মের, অকাল্ট বিশ্বাসপ্রপঞ্চের, কিংবা লৌকিক কল্পনার। ঐতিহ্যিক সিম্বল যেহেতু বহুবার বহু প্রসঙ্গে ব্যবহৃত হয়েছে সেহেতু তার ব্যবহারমাত্র আমাদের মনে উঠে আসে অর্থ, আবেগ ও সন্নিহিত অর্থাবলির এক বিশাল নেটওয়ার্ক। যেমন ‘গোলাপ’ একটি বহুব্যবহৃত ঐতিহ্যিক প্রতীক। ইয়েটস এর ব্যাপক ও কেন্দ্রীয় ব্যবহার করেন তাঁর ১৮৯৩ সালে প্রকাশিত কাব্য The Rose-এ। ইয়েটস কাব্যে প্লাতনিক চিরন্তন কিছু আইডিয়া যেমন সৌন্দর্য, প্রেম, বীরত্ব, ইত্যাদিকে ইতিহাসের, বিশেষত আইরিশ ইতিহাস ও কিংবদন্তীর নানা ব্যক্তিচরিত্রের সাথে যুক্ত করলেন। কালহীন ঐসব আদর্শ একটি নিরঞ্জন ঊর্ধ্বলোকের অধিবাসী হলেও তারা পরিস্ফুট কিংবদন্তীর চরিত্রাবলির মাধ্যমে:
Red Rose, proud Rose, sad Rose of all my days!
Come near me, while I sing the ancient ways:
Cuchulain battling with the bitter tide;
The Druid, grey, wood-nurtured, wuiet-eyed,
Who castround Fergus dreams, and ruin untold; ...

তবে প্রতীক শুধু ঐতিহ্য নয়; এর রয়েছে অনির্বচনীয় এবং অতীন্দ্রিয়ের সাথে গভীর ও অব্যাখাযোগ্য যোগাযোগ। একটি প্রতীক এ কারণেই বারংবার ব্যবহৃত হয়েও “শুয়ারের মাংস” হয়ে যায় না, কেননা, ইয়েটস মনে করেন, প্রতীকের গূঢ়ার্থ অনিঃশেষ; কেনো একটি প্রজন্মের কাছে সে তার পুরো অর্থ উজাড় করে দেয় না। প্রতীকিতাই কবিতাকে দেয় গভীরতা, রহস্য এবং প্রাচুর্য। শেলির কবিতা আলোচনা প্রসঙ্গে ইয়েটস যা বলেছিলেন তা প্রণিধানযোগ্য: “The poet of essences and pure ideas must seek in the half-lights that glimmer from symbol to symbol as if to the ends of the earth, all that the epic and dramatic poet finds of mystery and shadow in the accidental circumstances of life.”
The Wind Among the Reeds (১৮৯৯) কাব্যে ইয়েটসের ওপর উইলিয়াম ব্লেকের মরমীয়াতত্ত্বের প্রভাব লক্ষিত হয়। নৃতাত্ত্বিক স্মৃতিসত্তার সাথে বিশ্বজনীন ’মন’-এর মিলনে অনেকটা ইয়ুঙ-কথিত যৌথ নির্জ্ঞানের ধরনে তৈরি হয় প্রতীকের অর্থ। এ পর্যায়ে দার্শনিক বোয়েমে (Boehme) এবং সুইডেনবর্গ (Swedenborg)-এর প্রভাবের সাথে সাথে মালার্মে, ভেরলেন, ভিলিয়ার দ্য লিল্ অ্যাডাম এবং মেটারলিঙ্কের প্রভাব পড়েছে ইয়েটসের কবিতায়। মহাদেশীয় আধুনিকবাদের সংযোগ স্থাপিত হয়েছে প্রান্তীয়-রোমান্টিক ইয়েটসের। তাঁর প্রথম-পর্বের মেদুর রোমান্টিক প্রকৃতিভাবনা, ইন্দ্রিয়ঘন আসঙ্গকাতর প্রেমভাবনার জগৎ পরিভ্রমণ প্রায় শেষ।
প্রতীকের সিঁড়ি বেয়ে প্রাকৃতিক থেকে অতিপ্রাকৃতিকে পৌঁছানোর প্রচেষ্টার পেছনে ক্রিয়মান ছিল ইয়েটসের ইতিহাস-চিন্তা। এখানেও তিনি মিশিয়েছিলেন মরমিয়াতত্ত্ব: মানুষ একটি ঘোরানো সিঁিড় ধরে গতহাজার বছর ধরে ক্রমাগত নেমে এসেছে প্রাকৃতিকতা, বাস্তবতা ও সাধারণ অভিজ্ঞতার মাটির কাছাকাছি। এবার উল্টোমুখে যাত্রা তথা ঊর্ধ্বারোহনের পালা: শিল্প এখন বহির্পৃথিবীর বাস্তবতা তথা বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা, নৈতিক দায়িত্ব, রাজনৈতিক আবেগ প্রভৃতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে নিজের নাভিমূলের দিকে; প্রাত্যহিকতার আবিলতা থেকে ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে তার যাত্রা অতিবাস্তবের দিকে, প্রকৃতি থেকে অতিপ্রকৃতির দিকে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, প্রথম পর্বের ইয়েটসের কবিতায় প্রশ্নহীন নন্দনসারবাদিতার এবং উদ্দীপিত সংবেদনার ঐকিকতার প্রভাব থাকলেও অচিরকালেরমধ্যেই তিনি তা পরিহার করেন। প্রকৃতি-প্রেম, ওয়ার্ডসওয়ার্থের মতো, ইয়েটসের কবিতায় নেই: তিনিও ব¯তুত শেলির মত বাহ্যপ্রকৃতির প্রতি মুগ্ধতাকে পরিহার করেছেন দ্রুত, এবং শেষপর্যন্ত ইয়েটস প্রকৃতিকে নির্বাসন দেন, নমস্য করেন প্রকৃতির বিপরীতে শিল্পের কৃত্রিমতাকে। কবির কাজ প্রকৃতির অনুকরণ করা (স্মর্তব্য আরিস্ততলের মাইমেসিস তত্ত্ব); কিন্তু ঐ একই কারণে বলা যায় , প্রকৃতিকে বণনা করা অনাবশ্যক কাজÑ প্রকৃতি যা করে রেখেছে তা পুনঃসৃজন করে লাভ কী? শেলি যেমন প্রকৃতি থেকে নিয়েছিলেন তাঁর বিপ্লব ও ভবিষ্যচিন্তার সহগামী চিত্রকল্প, ইয়েটস সংগ্রহ করেন বৌদ্ধিক রূপকসমূহ। প্রকৃতি ইয়েটসের কবিতায় নিজেই অনুধ্যয় নয়, বরং অনুধ্যানের মাধ্যম। তাঁর বিখ্যাত ‘Sailing to Byzantium’ কবিতায় রয়েছে তাঁর আকাক্সক্ষার কথা: একবার এই প্রকৃতি-বাস্তবতা থেকে (মৃত্যুর মাধ্যমে) মুক্তি পেলে তিনি আর কখনও ফিরবেন না মৃত্যুময়তা-ঘেরা প্রকৃতি জগতে;
Once out of nature I shall never take
My bodily form brom any natural thing—
But such a form as Grecian goldsmiths make
Of hammered gold and gold enamelling
To keep a drwsy emperor awake;

জীবনানন্দ দাশ আশা করেছিলেন, “আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে--এই বাংলায় / হয়তো মানুষ নয়-- হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে;/ হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে ...” ইয়েটস মানুষ তো নয়ই, এমনকি কোন প্রাণী হয়েও ফিরতে চান না, কেননা “Fish, flesh, fowl, commend all summer long/ whatever is begotten, born and dies.” তার চেয়ে ভালো শিল্পের নিরাসক্ত, বৈদেহীতার মধ্যে আত্মীকৃত হওয়া; বাইজেন্টীয় শিল্পীদের চিত্র-ভাষ্কর্যের মধ্যে পরিণত ইয়েটস খুঁজেছিলেন তাঁর পরম নির্বাণ।
ইয়েট্সের প্রথম পর্বের কবিতার পেছনে একটি প্রণোদনা ছিল তাঁর আইরিশ জাতীয়তাবাদ। ইংল্যান্ডের অধীনে যুগ-যুগ ধরে শোষিত ও নিষ্পেষিত হয়ে আসছিল আয়ারল্যান্ড। সমসময়ে আইরিশ জাতীয়তাবাদী একটি উত্থান ঘটেছিল রাজনীতিতে, এবং পার্নেল প্রমুখ জাতীয়তাবাদী নেতারা গণচেতনার উত্থান ঘটিয়েছিলেন। পাশাপাশি সহিংস পন্থায় ইংরেজ শাসন থেকে মুক্তিলাভের জন্য গড়ে ওঠে অনেক গুপ্ত সংগঠন। ইয়েট্স সশস্ত্র পন্থাতে অবিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু আইরিশ জাতীয়তাবাদের আবেগটি তিনি পূর্ণভাবে ধারণ করেছিলেন। আয়ার্ল্যান্ডের রাজইৈতক সংঘাত ও উন্মত্ততা তাঁকে কবিতা লেখায় অনুপ্রাণিত করেছিল বলে লিখেছিলেন ডব্ল্যু এইচ অডেন তাঁর বিখ্যাত এলিজি ‘In Memory of W. B. Yeats’ নামের কবিতায় : “Mad Ireland hurt you into poetry.” গেইলিক ভাষা জানলে সে-ভাষাতেই হয়তো কবিতা লিখতেন ইয়েট্স। ইংরেজিতে কবিতা লিখেছেন তিনি, কিন্তু ইংরেজ কবি নয়, আইরিশ কবি হিসেবে পরিচিত হতে চেয়েছেন, আর চেয়েছেন কবিতায় চিরন্তন আয়ারল্যান্ডকে রূপায়িত করতে, তার ইতিহাস-ঐতিহ্য, ফোকলোর, লোকবিশ্বাস, বীরত্বগাথা-ট্র্যাজেডিকাহিনীপরম্পরাসহ। আয়ারল্যান্ডের কিংবদন্তীর বীর Cuchulain ও অন্যান্য চরিত্র নিয়ে কবিতা, বিভিন্ন স্থান নাম যেমন Slievanamon. Knocknarea ইত্যাদির ব্যবহার করে একটি প্রাচীন ঐতিহ্যময় কেল্টিীয় আবহ সৃষ্টি করতে চেয়েছেন কবিতায়, “so that, as in classical Greece, the local features of the landscape would have imaginative resonance for the people who lived there, and upto a point at least, a shared imaginative lore would once again unite the poet with a whole people, as it had in the heroic ages of the past.”14 ‘Cuchulain’s Fight with the Sea’, ‘The Song of Wandering Aengus’, ‘Red Hanrahan’s Song about Ireland’, প্রভৃতি ১৯০৪ সাল পর্যন্ত রচিত কবিতায় আইরিশ ইহিাস ও লোকপুরাণের প্রবল ব্যবহার দেখা যায়। আইরিশ জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রবল টান তাঁকে নিয়ে আসে সাংস্কৃতিক সংগঠক ও পুনর্গঠকের ভূমিকায়। ইয়েট্স প্রতিষ্ঠা করেন আইরিশ লিটারারি সোসাইটি (১৮৯১) এবং ন্যাশনাল লিটারারি সোসাইটি (১৮৯২)। জন্ম হয় প্রখর রাজনীতিসচেতন কবি ও মুখর বাগ্মী ইয়েটসের: গদ্যে-কবিতায়, বক্তৃতায় তিনি প্রচার করতে থাকেন জাতীয়তাবাদের মন্ত্র,; ১৮৯৬ সালে যোগ দেন আইরিশ রিপাবলিকান ব্রাদারহুড-এ। আয়ারল্যান্ডের রাজনীতিতে ইয়েট্সের যোগদানের পেছনে দেশপ্রেমই একমাত্র প্রেরণা ছিল না অবশ্য -- এক সুন্দরী রমণীর প্রণয়াকাক্সক্ষাও ছিল দায়ী। মড্ গন্ (Maud Gonne) নামের অপূর্ব সুন্দরী (যার সৌন্দর্যবর্ণনা করেছেন ইয়েট্স ‘No Second Troy’ কবিতায়-- “ beauty like a tightened bow, a kind/That is not natural in an age like thisÕ) মহিলা ছিলেন বিপ্লবী, উচ্চমন্য, ও ইয়েট্সের চোখে হঠকারী, “with a mind/ That nobleness made simple as fire”; ইয়েটসের প্রেমের আহ্বানে তিনি সাড়া দেননি; বিয়ে করেন সহ-বিপ্লবী অবসরপ্রাপ্ত মেজর ম্যাকব্রাইডকে। ইয়েটসের প্রথম যৌবনের মায়া-মরীচিকা এই মড্ গনের প্রসঙ্গ নানাভাবে এসেছে ইয়েট্সের বহু কবিতায়, এমনকি পড়ন্ত বয়সের কবিতা ‘A Prayer for My Daughter’-এ রয়েছে অম্লমধুর উল্লেখ:
Have I not seen the loveliest woman born
Out of the mouth of plenty’s horn,
Because of her opinionated mind
Barter that horn and every good
By quiet natures understood
For an old bellows full of angry wind?

বলা বাহুল্য শেষ পঙক্তিটি মড্ গনের বদমেজাজি প্রাক্তন-মিলিটারি স্বামী মেজর ম্যাকব্রাইডের প্রতি ক্রোধ থেকে উচ্চারিত। মড্ গনের প্রতি ইয়েটসের প্রেম বিফল হলেও সফল হয়েছিল তাঁর প্রেমের কবিতা। বস্তুত ইয়েটসের প্রেমের কবিতাসম্ভার মোটেই তুচ্ছ নয়: রোমান্টিক প্রণয়াকাক্সক্ষার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আধুনিক মানসসঞ্জাত হতাশা ও নির্বেদ। ইয়েটসের রাজনীতি-ভাবিত কবিতার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন ‘Easter 1916’ (Michael Robertes and the Dancer: 1921) (গরপযধবষ জড়নবৎঃবং ধহফ ঃযব উধহপবৎ: ১৯২১) বিখ্যাত ইস্টার অভ্যুত্থানে নিহত আইরিশ বিপ্লবীদের স্মরণে রচিত। ততদিনে ইয়েট্স অবশ্য রাজননৈতিক প্রাত্যহিকতার আবাহন থেকে দূরে প্রতীকময়তার জগতে নিজেকে অপসারিত করে নিয়েছেন। কিন্তু তা-সত্ত্বেও তাঁর গভীর দেশপ্রেম আপাত-নির্লিপ্তির নির্মোক ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। এই বিপ্লবীদের নিয়ে একদিন পরিহাস করতেন তিনি, ভাবতেন তাদের সমস্ত শ্রম সাহসের অভাবে ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে । কিন্তু এক্ষণে তাঁদের শহিদী মৃত্যু পাল্টে দিয়েছে সব কিছু : এমনকি মডগনের স্বামী মেজর ম্যাকব্রাইড, যাকে ইয়েট্স a drunken, vainglorious lout’ ছাড়া কিছু ভাবতেন না, গরিমাময় মৃত্যু তাকেও পাল্টে দিয়েছে --
He, too, has been changed in his turn,
Transformed utterly;
A terrible beauty is born

ইয়েটসের কবিতার দ্বিতীয় পর্যায় ১৮৯৯-এ The Wind among the Reeds প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত । এসময়টাতে ইয়েট্স এক ধনী জমিদারের বিধবা পত্নী লেডি গ্রেগরীর সহায়তায় এবং জন মিলিংটন সিঙারের সাহচর্যে আইরিশ নাট্য আন্দোলন সংগঠনে ব্যস্ত থাকেন। তাঁর কবিতায় বাস্তব পৃথিবী এবং মানুষের মুখের ভাষার কাছাকাছি ভাষা বিম্বিত হতে থাকে। বস্তুত ইয়েটসের কবিতায় পূর্বাপর দুটো প্রান্তের মধ্যে টেনশন বিরাজমান ছিল-- এক প্রান্তে শৈল্পিক বিযুক্তি ও নন্দনবাদীতা তথা ‘intellect’ও ‘wisdom’অন্যদিকে বাস্তব জীবনের ‘passion এবং ‘life’ -- তাঁর কাব্যজীবনের বিভিন্ন স্তরে ইয়েটস এই দুটো প্রান্তকে বিধি অনুপাতে মেশাতে চেষ্টা করেছেন। ১৯১৪ সালে প্রকাশিত হয় Responsibilities, ১৯১৯-তে The Wild Swans at Coole, এরপর Michael Robertes and the Dancer(১৯২১) এবং The Tower(১৯২৮)।
১৯২০-এর দশকে ইয়েটস পুরোপুরি তাঁর আধিবিদ্যক প্রতীকিতার জগতে প্রবেশ করেন। এসময়ের রচনা A Vision এই পাণ্ডিত্যপূর্ণ গদ্যরচনায় ইয়েট্স তাঁর অকাল্ট সিস্টেমটি তুলে ধরেন। ইতিহাস তাঁর কাছে একটি নিরন্তর ঘূর্ণ্যমান gyre ঘূর্ণিচক্র: প্রতি দুই হাজার বছরে তার এক-একটি আবর্তন। ইতিহাসের সেই gyre-এর আবর্তন মানুষকে মুখোমখি করেছে সম্ভাব্য ধ্বংসের। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের রক্কাক্ত ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনা দেখেছিলেন ইয়েট্স আরো কেটি রক্ত-বন্যার ¯ম্ভাবনায়; ইতিহাসের আঁিধি থেকে জন্ম নিচ্ছে একটি ভযাবহ বিধ্বংসী স্ফিংক্স-এর। ইয়েট্স তাঁর বিখ্যাত ‘‘The Second Coming’ কবিতায় ইতহাসের ঘূর্ণন থেকে উঠে আসতে দেখেছিলেন বর্তমান ও ভবিষ্যতের দুঃস্বপ্নময় ারংরড়হ :
Things fall apart; the centre cannot hold;
Mere anarchy is loosed upon the world,
The blood-dimmed tide is loosed, and everywhere
The ceremony of innocence is drowned;

ইতিহাস ছাড়াও অন্য মানব-ক্ষেত্রেও ইয়েটসের জটিল আধিবিদ্যক ব্যাখ্যা রয়েছে, যেমন মানুষের ব্যক্তিত্বের রয়েছে ২৬টি টাইপ-- চন্দ্রকলার আঠাশটি থেকে দুই কম, কেননা কোনো মানুষের চরিত্রে পূর্ণিমা বা অমাবশ্যার চরমতা লক্ষণীয় নয়। ইয়েটসের এই অকাল্ট-ভাবনার প্যাটার্ন অত্যন্ত জটিল, এবং রোমান্টিক কবিদের পুরোধা ব্লেইকের মতোই তাঁর এই প্রাইভেট মিথলজি পাঠকের কাছে দুর্বোধ্য মনে হয়। ইয়েটসের অন্যতম অকাল্ট সিম্বল হচ্ছে রাজহাঁস। তাই ''The Wild Swans at Coole’কবিতার ‘nine and fifty swans’ আর সাধারণ রাজহাঁস থাকে না, হয়ে ওঠে আতিপ্রাকৃত রহস্যের আকর ও প্রতিফলক । উনিশ হেমন্ত আগে তাদের দেখেছিলেন কুল-পার্কের স্থির জলে ভাসমান, আজ ঊনিশ হেমন্ত পরেও তারা একই ভাবে সুন্দর, পরস্পরনিবদ্ধ; মনে হয় যেন অমরতা ও চিরযৌবনের রহস্য তাদের অধিগত, যেন তারা ঊর্ধ্বতম জ্ঞানের সন্ধান-পাওয়া যোগীর দল:
Their hearts have not grown old;
Passion or conquest, wander wherever they will,
Attend upon them still.
But now they drift on the still water,
mysterious, beautiful; ...

‘রাজহাঁস’ প্রতীকটি ব্যবহৃত হয়েছে বারবার, ‘The Tower’, ‘Nineteen Hundred and Nineteen,’ ‘Among School Children,’ ‘Leda and the Swan,’ ‘Coole Park and Ballylee, 1931’ প্রভৃতি কবিতায়। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ইয়েট্সীয় প্রতীক টাওয়ার। ইয়েটসের মধ্য পর্যায়ের কবিতায় টাওয়ার সেছে ঘোরানো সিঁড়ির অনুষঙ্গ হিসেবে। টাওয়ারের প্রসঙ্গ এসেছে বাস্তব টাওয়ার (যেমন ইয়েট্স Thoor Ballylee বা ব্যালিলি টাওয়ার কিনে সেখানে বাস করছিলেন, যে টাওয়ারের ওপর আছড়ে পড়া আটলান্টিক মহাসাগরের ঝোড়ো বাতাসের বর্ণনা পাওয়া যাবে ‘A Prayer for My Daughter’ কবিতার শুরুতে), প্রত্নিতহাস অথবা মিথের টাওয়ার ( যেমন ‘Leda and the Swan’ কবিতায় ট্রয়নগরীর “burning roof and tower ) ব্যাবিলনের জ্যোতিষরা যে-টাওয়ার থেকে নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করতেন। The Tower নামের কাব্যগ্রন্থ যেমন তাঁর টাওয়ার প্রতীককে সামনে আনে, তেমনি মৃত্যুর মাত্র সাত দিন আগে রচিত “The Black tower’ কবিতাটিও। ইয়েটসের শেষ পর্যায়ের বিস্তৃতি ১৯২৮ ( The Tower-এর প্রকাশকাল) থেকে ১৯৩৯-এ তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত বিস্তৃত। এ পর্যায়ের কাব্যগ্রন্থ ঞThe Winding Stair and Other Poems (1933), Words for Music Perhaps এবং Last Poems (১৯৩৬-১৯৩৯)।
আধুনিকবাদী কবিতার প্রগ্রসরণে ইয়েটসের স্থান ও অবদান গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর কবিতার শুরু কেল্টীয় পুনর্জাগরণের বাতাবরণের মধ্যে, এবং কেল্টীয় পুনর্জাগরণ ছিল মূলত বিলম্বিত রোমান্টিসিজম। প্রান্তিক ভিক্টোরীয় কবিকুল তথা সুইনবার্ন, রসেটি, মরিস প্রভৃতির রূপলালিত্যের ছন্দোময় আকর্ষণ তাঁকে ব্যাপৃত রাখে কিছুটা সময়। এরপর তিনি ১৮৯০-এর দশকে সংস্পর্শে আসেন তথাকথিত লন্ডন আভাঁ-গার্দের। এই কবিদের কাব্যদর্শনের অভিঘাতে ইয়েট্সের কেল্টিক রোমান্টিসিজম কিছুটা টাল খায়। তাঁর মনে নতুন ধারণা জন্মে যে, আর্ট হচ্ছে এমন এক নৈর্ব্যক্তিক সৌন্দর্যের অনুধ্যান যার সাথে লোক-মানস, মিথ, রাজনীতি, অথবা ব্যক্তিগত জীবনের কোনো সম্পর্ক নেই। বৃটিশ কবিতার নন্দনবাদী-পর্যায়ের প্রভাব ভালোমতোই পড়েছিল ইয়েটসের ওপর। এর সাথে, আর্থার সাইমন্সের গ্রন্থ The Symbolist Movement in Literature--এর দূতিয়ালিতে তাঁর পরিচয় ঘটে য়ুরোপীয় আধুনিকবাদের গুরু তথা বোদলেয়ার, মালার্মে, নেরভাল, ভালেরি ও অন্যান্য কবিদের সাথে। ইয়েটস তাঁর প্রিয় উপমা ঘোরানো সিঁড়ি ব্যবহার করে লিখেছেন, একসময় সাহিত্য ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসেছিল নিত্য বাস্তবতার কাছাকাছি, এখন আবার সে উঠে যাচ্ছে বাস্তববাদ ছেড়ে “essences and pure ideas” এর দিকে। ১৯১২ থেকে ১৯১৬ এর মধ্যে অনেকবার তাঁর দেখা হয়েছে পাউন্ডের সাথে। পাউন্ডের ইমেজিস্ট আন্দোলনের বাকসংহতি ও ইঙ্গিতধর্মীতা ইয়েটসের বাগবাহুল্যকে শমিত করতে সাহায্য করে। নিঃসন্দেহে ইয়েটস পাউন্ডের কাছ থেকে জায়মান আধুনিকবদের পুরোধা কবিকুল তথা এলিয়ট, উইন্ডহ্যাম ল্যুইস প্রভৃতি সম্পর্কেও জেনে থাকবেন। ইয়েট্স অবশ্য পুরোপুরি পাউন্ডীয়-এলিয়টীয় ডক্ট্রিন গলাধঃকরণ করতে রাজি হননি: তিনি বরং মৃদু হেসে একটু দূরত্বই বজায় রেখেছেন। আর নাগরিক প্রতিবেশের উষর মরুময়তার রূপক অবলম্বন করে নিরন্তর কাব্যবয়ন করা ইয়েটসের মতো জীবনের বহুবর্ণিল চিত্ররূপরসময়তার অনুধ্যানী কবির পক্ষে সম্ভবপর ছিল না আদৌ। কিন্তু তা সত্ত্বেও, অনেকটা আধুনিকবাদী ধারার চাপে অনেকটা নিজের বিরুদ্ধে গিয়েই মধ্যযুগীয় ও কিংবদন্তীর আয়ারল্যান্ডের রূপায়ণ থেকে সরে আসেন ইয়েটস। Responsibilities কাব্যে ইয়েটসের আধুনিকবাদী লক্ষণ সনাক্ত করেন পাউন্ড, এবং বলেন, “There is a new robustness, there is the tooth of satire which is, in Mr. Yeats’s case, too good a tooth to keep hidden.”

রবার্ট ফ্রস্ট : দুই ভুবনের বাসিন্দা
ফ্রস্ট তাঁর জীবৎকালে আমেরিকার প্রায়-‘জাতীয়’ কবি হিসাবে পরিগণিত হয়েছিলেন্ তাঁর কবিতা আমেরিকার নিউ ইংল্যান্ডের মাটি থেকে উঠে-আসা এবং স্বস্তিকরভাবে ‘ইয়াঙ্কি’ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বলে ভাবা হত, এবং তিনি রক্ষণশীল দেশপ্রেমের প্রতীকও হয়ে উঠেছিলেন্ জন এফ কেনেডির প্রেসিডেন্ট পদে অভিষেকের অনুষ্ঠানে তিনি আমন্ত্রিত হন কবিতা পড়ার জন্য্ ফ্রস্ট নিজেও তাঁর এই ভাবমূর্তি সযতেœ রক্ষা করতেন। তাঁর সম্পর্কে সমকালীন আমেরিকনদের মনোভাব বোঝা যাবে নিচের এই খবরের কাগজের উদ্ধৃতি থেকে :
Robert Frost is a poet whose work and personal appearance have moved thousands of Americans to a demonstrativeness that might easily be associated with the presence of a heroic athlete or movie star.... he is like no statesman, celebrity or ordinary human being ... Robert Frost is quietly and but unmistakably overwhelming.

কৌতুককর মনে হয় এ ঘটনা যে, পাউন্ড এবং এলিয়টের মতো মার্কিনী কবি ফ্রস্টকেও তরুণ বয়সে পাড়ি জমাতে হয়েছিল ইংল্যান্ডেই, তাঁর কাব্যকৃতির প্রকাশ ঘটানোর জন্য। ম্যাসাচুসেটসের বোস্টন এলাকার গ্রামে জন্মগ্রহণকারী (১৮৭৪) ফ্রস্ট তাঁর প্রথম জীবনে লেখা কবিতার জন্য স্বদেশে স্বীকৃতি পাননি; উপরন্তু তাঁকে ভাবা হতো চাষা-কবি, সরল গ্রামীণ জীবনের নানা অনুষঙ্গ সাধারণ মানুষের বোধগম্য ভাষায় লেখা তাঁর কবিতাকে সিরিয়াস পাঠক-সমালোচকের মনোযোগের অযোগ্য ভাবা হতো। ফ্রস্ট চলে এলেন লন্ডনে, ১৯১৩ সালে এখানে প্রকাশিত হলো তাঁর প্রথম কবিতার বই, A Boy’s Will. দৃষ্টি আকৃষ্ট হলো এজরা পাউন্ডের; এই স্বদেশী কবির কাব্যগ্রন্থের সাদর রিভিউ করলেন তিনি। প্রায় সমসময়ে এলিয়টের কবিতার পৃষ্ঠপোষকতাও করছিলেন পাউন্ড। কিন্তু ফ্রস্টের প্রতি পাউন্ডের এই অনুরাগ বেশিদিন টিকেনি : রবার্ট ফ্রস্টকে আদৌ আধুনিক কবি বলা সঙ্গত কি না এই দীর্ঘস্থায়ী বিতর্কের সূত্রপাত হলে দুই কবির সম্পর্কে চিড় ধরে। যে হ্যারিয়েট মনরো-র পোয়েট্রি পত্রিকায় ফ্রস্টের A Boy’s Will এর প্রশংসা করেছিলেন পাউন্ড, কয়েকমাস পর সেখানেই তিনি চিঠি লিখেন মার্কিনী ‘প্রভিন্সিয়ালিজম’-কে গালমন্দ করে। ফ্রস্ট, পাউন্ডের মতে ঘোরতর প্রভিন্সিয়াল, আর পাউন্ডের ধারণা, “all great art is born of the metropolis (or in the metropolis)” (Letters, 7 November 1913)
ফ্রস্টের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ বেরোয় এক বছর পর লন্ডন থেকেই: North of Boston. ফ্রস্টের কবিতার ‘সারল্য’ প্রশংসিত হলেও সেখানেও ছিল কূটাভাস: তাঁর কবিতা সরল সুতরাং অনাধুনিক ও ট্রাডিশনাল-- এই অভিযোগ সারাজীবনই শুনতে হয়েছে তাঁকে। অন্যদিকে, তাঁর ভক্তরা তাঁর কবিতার আপাতসারল্যের মধ্যে খুঁজে পেয়েছেন মানসজটিলতা এবং মননধর্মীতা যা আধুনিক কবিতার গুণ। সুতরাং ফ্রস্ট রয়ে গেছেন দুই ভুবনের বাসিন্দা : : “Antagonistic critics viewed the ‘simple’ Frost as a traditional poet: pastoral, anachronistic in his technique, and merely a purveyor of homespun verities; whereas those emphasized his ‘subtlety’ regarded his stark portraits and ambivalent responses to an indifferent universe as essentially modern.”1১৫ ফ্রস্টের কবিতায় পল্লী-প্রকৃতি, গ্রামবাসীদের নানা ক্রিয়াকর্ম, ফসল-কাটা, আপেল তোলা, খেতের ভেঙে যাওয়া পাথুরে দেয়াল সারাই করা, কাঠচেরাই মেশিনে লাকড়ি কাটা, বরফ-ঢাকা বনভূমির ভেতর তিয়ে একাকী ঘোড়সওয়ারের যাত্রা, ইত্যাদি বর্ণনা যেমন একাধারে যথাযথ ও বাস্তব, তেমনি তাঁর এই সরল বর্ণনার মধ্যে তিনি যোগ করেছেন কখনো-কখনো দার্শনিক প্রতীতি, গভীর মনোবিশ্লেষণ, আধুনিক মানসের অর্ন্তদ্বন্দ্ব ও দ্বিধাবিভক্তি, সংশয়, ভয়, আত্কং, নৈরাশ্য ও নির্বেদ। তাঁর ব্যবহৃত ভাষার সারল্য অনেকাংশে প্রতারক। ফ্রস্টের একটি বহুবিখ্যাত কবিতা “Stopping by Woods on a Snowy Evening”--
Whose woods these are I think I know.
His house is in the village, though;
He will not see me stopping here
To watch his woods fill up with snow.
My little horse must think it queer
To stop without a farmhouse near
Between the woods and frozen lake
The darkest evening of the year.

He gives his harness bells a shake
To ask if there is some mistake.
The only other sound's the sweep
Of easy wind and downy flake.

The woods are lovely, dark, and deep,
But I have promises to keep,
And miles to go before I sleep,
And miles to go before I sleep.

ফ্রস্ট নিজে এই কবিতাকে বলেছেন “a tricky poem”; এই চাতুর্য তাঁর কবিতায় যদিও সাধারণভাবে প্রাপ্য। ঘোড়সওয়ার যাচ্ছিলেন তুষার-ঝরা সন্ধ্যায়, বনভূমির ভেতর দিয়ে। সাদা তুষারে ভরে উঠছে বনস্থলী; কে মালিক এই বনভূমির তিনি জানেন না, তার বাড়ি যদিও কাছাকাছি গ্রামেই। কিন্তু কি তাৎপর্য এই কথার, যখন ঘোড়সওয়ার বলেন, বনের মালিক জানবে না তাঁর ঘোড়া থামিয়ে বনভূমির সৌন্দর্য দেখার এই ঘটনাটি। এই না-জানার ব্যাপারটি কি তাঁর কাছে স্বস্তিদায়ক? কেন? একধরনের কুহকাচ্ছন্নতার ভেতর থেকে তাঁকে জাগিয়ে তোলে তার ঘোড়ার গলায়-ঝোলানো ঘুন্টির আওয়াজ : হঠাৎ তাঁর মনে পড়ে যায় তাঁর গন্তব্যের কথা-- বেলাবেলি তাঁকে পৌঁছুতে হবে সেখানে; যেতে হবে বহু মাইল, ঘুমোবার আগে; রক্ষা করতে হবে বহু প্রতিশ্র“তি; তারপর ঘুম, তারপর বিরতি এ যাত্রার। পাঠক ইচ্ছে করলে কবিতাটিকে পড়তে পারেন একটি চমৎকার প্রকৃতি-বর্ণনার কবিতা হিসেবে। আবার তিনি এতে খুঁজতে পারেন রূপক অর্থ-ও : ঐ বনভূমি মৃত্যুর হিমশীতল হাতছানি, তার ভয়াল সৌন্দর্যের প্রতীক সম্ভবত; পথিক চিরকালের যাত্রী, রবীন্দ্রনাথের গানের সেই চিরচেনা পথিক, যে চলেছে নিরন্তর। থামার অবকাশ তার নেই; কেননা জীবনের নানা প্রতিশ্র“তি ও প্রত্যাশা, নিজের কাছে নিজের ও অন্যের কাছে, তাকে পূরণ করতে হবে। তবু অবসর বা ঘুম (মৃত্যু) তাকে হাতছানি দিয়ে থামতে বলে। বনভূমি হয়তো সেই মৃত্যর প্রতীক, যার ভয়াল আকর্ষণ ঘোড়সওয়ারকে কিয়ৎকালের জন্যে বিমনা করে তোলে। তিনি গ্রস্ত হন মৃত্যুর কুহকে; আর কিছুক্ষণ এভাবে থাকলে, এবং ঘোড়ার ঘুন্টি (“জীবনের অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগ”!) তার চটকা না ভাঙালে, তিনি হয়তো এই কুহকিনী-সন্ধ্যায় আত্মঘাতী হতেন। অবশেষে জীবনের দাবীরই জয় হয়; পথিক আবার চলতে শুরু করেন, যদিও তাঁর ক্লান্তির দীর্ঘশ্বাসটি অশ্রুত থাকে না: “And miles to go before I sleep” কথাটির দ্বিরুচ্চারণ এই ক্লান্তি ও বিবিক্তিকে সোচ্চার করে তোলে। ফ্রস্টের এই কবিতায় তাহলে গভীর দার্শনিকতা প্রাপ্য যেটি এক অর্থে তাঁকে হয়তো ট্রাডিশনাল কবিদের সাথে যুক্ত করেছে কিন্তু অন্য অর্থে তাঁর কবিতাকে তথাকথিত প্রাদেশিকতার অভিযোগ থেকে মুক্ত করে যুক্ত করেছে বৈশ্বিকতার সাথে। আধুনিক মানুষের মনের অর্ন্তদ্বন্দ্ব, গন্তব্য-কর্তব্য নির্ধারণে দোদুল্যমান মানসও এতে পরিস্ফুট। ফ্রস্টের আধুনিকতা তাই অনস্বীকার্য হয়ে ওঠে। তাঁর বেশ কিছু নাট্যিক গুণান্বিত কবিতা, যথা- “Home Burial”, “Death of the Hired Man”,“The Hill Wife”–এ পটভূমি কৃষক-জীবন হলেও চরিত্রগুলোর মানসের চিত্রায়ণ আধুনিক মনস্তত্ত্ব-সম্মত। নাগরিক জীবনে মানুষের যে বিসঙ্গতির বোধ, একাকীত্ব ও অ্যালিয়েনেশেন তার চিত্র দেখা যায় এই আপাত সরল গ্রামবাসীদের মধ্যে। মানুষে-মানুষে বিচ্ছিন্নতা, পরিবারের ভেতর, দম্পতির মধ্যে, প্রকৃতির সাথে। শহর ও গ্রামের বিভেদ সেখানে নেই। “Home Burial” কবিতায় একমাত্র সন্তানের মৃত্যুকে ঘিরে স্বামী-স্ত্রীর মানস-সংঘাত তীব্র হয়ে উঠেছে। তাদের মধ্যে প্রধান সমস্যা কম্যুনিকেশনের: স্বামীকে বলছেন স্ত্রী-- তুমি বুঝবে না আমার মনে কী শোক চলছে, কারণ তুমি জান না, জানতে চাও না। স্বামী বলে, তুমি সাহায্য কর আমাকে। আর দয়া করে “Do not carry it to someone else this time.” যোগাযোগের গভীর সমস্যায় আক্রান্ত এই দম্পতির মধ্যে বিচ্ছেদ অনিবার্য হয়ে ওঠে যখন স্বামীর নিষেধ ও হুমকি উপেক্ষা করে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য দরজার ছিটকিনিতে হাত রাখে স্ত্রী। এই মানবিক সমস্যা মূলত নাগরিক জীবনের অনুষঙ্গ এবং ফ্রস্ট এর রূপায়নের মধ্য দিয়ে স্পর্শ করেছেন আধুনিকবাদী কবিতার একটি কেন্দ্রীয় প্রধাবনাকে। মনোরোগ, বিষাদ, উন্মত্ততা প্রভৃতি অনুষঙ্গ ফ্রস্টের কবিতায় লক্ষণীয়। “A Servant to Servants” কবিতার কথক -মহিলাটি মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত। (প্রসঙ্গত, মানসিক ব্যাধি, উন্মত্ততা পরবর্তী মার্কিনী কবিতায়, বিশেষত সিলভিয়া প্লাথ, আ্যান সেক্সটন কিংবা জন ব্যারিম্যান তথা কনফেশনাল কবিদের কবিতায় কেন্দ্রীয় স্থান করেছে পরবর্তী কালে।) নিজের অনুভূতি থেকেও সে বিযুক্ত--
It’s got so I don’t even know for sure
Whether I am glad, sorry, or anything.
There’s nothing but a voice-like left inside
That seems to tell me how I ought to feel,
And would feel if I wasn’t all gone wrong.

ফ্রস্টের কবিতায় এতসব আধুনিকবাদী উপাদান থাকা সত্ত্বেও তাঁকে অনেক সমসাময়িক সমালোচক অনাধুনিক, গ্রাম্য এবং বিংশ শতাব্দীর মাননিক উন্মন্থন-উপপ্লব থেকে বিযুক্ত প্রাদেশিক কবি হিসেবে চিহ্নিত করায় তৎপর ছিলেন। তবে ফ্রস্টের কবিতার আধুনিকতাকে সামনে আনেন চল্লিশের দশকের নিউ ক্রিটিকরা: ক্লিন্থ ব্রুকস (Cleanth Brooks), রবার্ট পেন ওয়ারেন (Robert Penn Warren) এবং র‌্যান্ডাল জ্যারেল (Randall Jarrell) প্রমুখ আমুণ্ডু এলিয়ট-প্রভাবিত কবিগণ ফ্রস্টের কবিতার আধুনিকতাকে চিহ্নিত করেন। ক্লিন্থ ব্রুকস ফ্রস্টের কবিতায় শনাক্ত করেছেন “symbolist metaphysical” সংগঠন, আর জ্যারেলের মতে রবার্ট ফ্রস্ট হলেন ট্রাজিক জগদ্দর্শনের কবি।

আধুনিকবাদের প্রতিভূরা-৩ : উইলিয়ামস ও স্টিভেন্স
নিউইয়র্ক আভাঁ-গার্দ

মার্কিন ভূখণ্ডে আধুনিকবাদের বিকাশের পেছনে ওয়াল্ট হুইটম্যান ও এমার্সনের অবদান স্বীকার্য। Transcendentalism বা বিশ্বাতিক্রমণবাদ মানবমনের আত্যন্তিক রূপান্তরক্ষমতার জয়গান গেয়েছিল; হুইটম্যান তাঁর কবিতায় ঘোষণা করেছিলেন আত্মার ভেতরে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রসারতা-গভীরতার কথা; এমার্সন ভেবেছেন প্রকৃতির মধ্যে এমন স্পন্দনের অস্তিমানতা যা ব্রহ্মাণ্ডকে রূপান্তরিত করতে পারে মহাসমুদ্রে, ঠিক যেমনটি ছিল সৃষ্টির প্রাক্কালে, বলেছিলেন, ”চলো, আমরা এখান থেকে আমাদের নিজ নিজ পৃথিবীকে পুনঃসৃজন করি।” কিন্তু আত্মার এই বিশ্ববিস্তারী অধিক্রমণের নীট্ ফল হলো এই, মানুষ শেষপর্যন্ত তার সত্তা নিয়ে বিপুল-বিশাল মহাবিশ্বে হয়ে পড়লো নিঃসঙ্গ নাবিকের মতো। হুইটম্যানের Song of Myself সেই একাকীত্বের সঙ্গীত। টি এস এলিয়ট এই একাকী মানুষের আত্মার সঙ্গীতকে আধুনিকবাদী আঙ্গিকে ধরেছেন, যে-আঙ্গিকে ট্র্যাজিক দ্যোতনার জায়গা নিয়েছে আয়রনি ও পরিহাস। তাঁর সৃষ্ট চরিত্রসমূহ, টিরেসিয়াস, জেরোনশন কিংবা প্রফ্রক, বিষণ্ন-করুণ-হাস্যকর একাকী, আধুনিক মানুষ।
In the early work of Eliot, all objects and values have been psychologized and the individual left in an impenetrable isolation. An insurmountable gap opens between subject and object and the result is the disintegration of the individual consciousness. “The Waete Land” internalizes-- and shatters—the action of the traditional epic poem. “The Lovesong of J. Alfred Prufrock” shows that if the perceiving mind transforms everything, then a man can connect himself with nothing. If philosophic idealism began by asserting the unity of “each” with “all,” it ended by leaving the individual isolated, abstracted, and fragmented.”16১৬
১৯১২ থেকে ১৯২২Ñএই একদশক মার্কিনী কবিতায় আধুনিকবাদের প্রথম পর্যায়। অন্যভাবে বলতে গেলে, হ্যারিয়েট মনরো সম্পাদিত ‘পোয়েট্রি’ পত্রিকার প্রকাশ থেকে এলিয়টের দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ডের প্রকাশকাল পর্যন্ত এর বিস্তৃতি। আটলান্টিকের দুইপারে, সুতরাং, একইসময়ে আধুনিকবাদের দুই ভূগোল ও ইতিহাস রচিত হচ্ছিল, এবং মজার ব্যাপার, একই কুশীলবদের নেতৃত্বে। তবে মার্কিনী অংশে আরো কয়েকজন কবির অবদান ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এদেরকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়: একদিকে এমি লাওয়েল , কার্ল স্যান্ডবার্গ এবং রবার্ট ফ্রস্টের মতো ইতোমধ্যে বিখ্যাত, এবং আধুনিকবাদ-পূর্ব কাল থেকে লিখতে শুরু-করা কবিকুল, অন্যদিকে উইলিয়াম কার্লোস উইলিয়ামস, ওয়ালেস স্টিভেন্স, ম্যাক্সওয়েল বডেনহাইম, ম্যারিয়্যান মূরের মতো নবীনরা। এই শেষোক্তদের নিউইয়র্ক আভাঁ-গার্দ নামেও ডাকা হয়। এসময় নিউইয়র্ক এবং আশেপাশের এলাকা থেকে অনেক লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়: Others, Rogue,Camera Work, 291, The Seven Arts, Broom, The Dial, The Little Review,BZ¨vw`| ইত্যাদি।

ওয়ালেস স্টিভেন্স
মার্কিন ভূখণ্ডে মডার্নিজমের উদ্গাতাদের একজন ওয়ালেস স্টিভেন্স। তাঁর জন্ম অক্টোবর ২, ১৮৭৯ তারিখে, পেনস্যালভিনিয়ার রেডিং-এ। এলিয়টের মতো স্টিভেন্সও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন, বিষয় আইনশাস্ত্র । এলিয়টের গুরু জর্জ সান্ত্যায়ানার সাথে স্টিভেন্সের যোগাযোগ ছিল আজীবন, যার শুরু আন্ডারগ্র্যাজুয়েট কাল থেকে। এলিয়টের মতো তাঁরও প্রথম উল্লেখযোগ্য কবিতা বের হয় হ্যারিয়েট মনরো সম্পাদিত পোয়েট্রি কাগজে, ১৯১৪ সালে। সে-বিচারে স্টিভেন্সের কাব্যক্ষেত্রে পদার্পণ এলিয়টের একবছর আগে। (এলিয়টের প্র“ফ্রক বেরিয়েছিল পোয়েট্রিতে ১৯১৫ সালে।) স্টিভেন্সের বয়স তখন পয়তিরিশ: কোনো পাশ্চাত্য লেখক তাঁর আগে এত বয়সে কবিতা লেখা শুরু করেননি। অথচ বিখ্যাত মার্কিন সমালোচক হ্যারল্ড ব্লুম তাঁকে বলেছেন তাঁর কালের শ্রেষ্ঠতম এবং প্রতিনিধিত্বশীল মার্কিনী কবি। স্টিভেন্সের প্রথম কবিতার বই হার্মোনিয়াম প্রকাশিত হয় ১৯২৩-এ, যখন স্টিভেন্সের বয়স চুয়াল্লিশ, আর তাঁর প্রধান বইগুলো প্রকাশ পায় তাঁর বয়স যখন পঞ্চাশের কোঠায়।
স্টিভেন্স ছিলেন পোয়েট্রি পত্রিকার একনিষ্ঠ পাঠক, এবং এজরা পাউন্ড এবং ইমেজিস্টদের কাব্যশৈলীর অনুরাগী। তিনি যদিও পাউন্ড বা এমি লাওয়েলের ইমেজিস্ট সংঘে যোগ দেননি, তাঁর ওপর জায়মান আধুনিকবাদের প্রভাব তথা ইমেজিজমের ছায়াপাত ঘটেছে। হার্মোনিয়াম-এর কবিতাগুলোত দেখা যায় আঁটোসাটো, ইন্দ্রিয়ঘন চিত্ররূপময় ক্ষণিক বর্ণনা। ‘The Snowman’ কবিতায় যেমন বরফাবৃত জুনিপার গাছ কিংবা রোদেলা শীতদিনের চকিতচিত্র:
One must have a mind of winter
To regard the frost and the boughs
Of the pine-trees crusted with snow;
And have been cold a long time
To behold the junipers shagged with ice,
The spruces rough in the distant glitter
Of the January sun; and not to think
Of any misery in the sound of the wind,
In the sound of a few leaves,
Which is the sound of the land
Full of the same wind
That is blowing in the same bare place
For the listener, who listens in the snow,
And, nothing himself, beholds
Nothing that is not there and the nothing that is.
(The Snow Man)

সমকালীন মডার্নিস্ট কবিদের মতোই স্টিভেন্সের আগ্রহ ছিল চিত্রকলার আধুনিকবাদী টেকনিকের দিকে। এই টেকনিক ন্যাচারালিজম অথবা ইলিউশনিজম ছেড়ে বিমূর্ততাকে নমস্য করেছিল। আধুনিকবাদী কবিতাও বর্ণনায় আনতে চাইল বিমূর্ততা, ন্যাচারালিজমের বিপরীতে। । বাস্তবতার প্রতিফলন যেহেতু নানা কলুষের আকর হতে পারে তাই বিমূর্ততা হচ্ছে বিশুদ্ধতার অন্য নামÑ এরকম বিশ্বাস শিল্পীদের মতো কবিদের মনেও দানা বাঁধতে শুরু করে। স্টিভেন্সের ‘দ্য অ্যনেকডোট্ অব আ জার’ কবিতায় ইমেজিস্টসুলভ সংক্ষেপায়ন এবং বিমূর্ত চিত্রকলাসুলভ সংকেতায়ন লক্ষণীয়:
I placed a jar in Tennessee,
And round it was, upon a hill.
It made the slovenly wilderness,
Surround that hill.

The wilderness rose up to it,
And sprawled around, no longer wild.
The jar was round upon the ground
And tall and of a port in air.

It took dominion everywhere.
The jar was gray and bare.
It did not give of bird or bush,
Like nothing else in Tennessee.
(‘Anecdote of the Jar’)

স্টিভেন্সের কবিতার প্রধান বিষয় বাহ্যপৃথিবীর সাথে আমাদের মানসকল্পনায় ধৃত বাস্তবতার সম্পর্ক নির্ণয়। আমাদের কল্পনা যে প্রক্রিয়ায় বাস্তবতাকে অর্ন্তদৃষ্টির আলোকে দেখে স্টিভেন্স চেয়েছেন সেই প্রক্রিয়াকে কবিতায় পুনর্সৃজন করতে। এলিয়ট ও পাউন্ডের সর্বগ্রাসী রমরমার কালে স্টিভেন্সের কবিতার এই দিকটি সাধারণের নজরে না এলেও ক্রমে তিনি হয়ে উঠেছেন অপ্রতিরোধ্য কবি। এলিয়ট ও পাউন্ডের প্রভাব তাঁর ওপর পড়েনি; নিজের কবিতার শুদ্ধতা রক্ষার ব্যাপারে তিনি ছিলেন নিরাপোষ : বলেছেন, “Eliot and I are dead opposites and I have been doing about everything that he would not be likely to do.” লন্ডন-ভিত্তিক মডার্নিস্টদের সংঘে যোগ দিতে অস্বীকার করেন তিনি: একে বলেছেন মার্কিনী রিফিউজিদের ক্লাব। তিনি এবং উইলিয়াম কার্লোস উইলিয়ামস নিজেদেরকে বিশ্লিষ্ট রেখেছেন পাউন্ড-এলিয়টের খবরদারি থেকে। বিশেষত এলিয়টের ট্রাডিশনাল গ্রেকো-রোমান মিথ ব্যবহারের ঘোর সমালোচক ছিলেন স্টিভেন্স। অন্যদিকে তিনি সৃষ্টি করে নিয়েছিলেন নিজস্ব মিথ, বাস্তবতার সাথে আয়রনি ও লঘু পরিহাস মিশিয়ে: “The Comedian as the Letter C”, “The Owl in the Sarcophagus” প্রভৃতি কবিতা এর উদাহরণ। কবিতাকে তিনি বলেছেন “supreme fiction” : সকল ঐতিহ্যিক মিথ এবং ধর্মের কল্পকথাকে সরিয়ে একটু পরিসর সৃষ্টি করতে হবে নতুন অনুধাবনা ও নতুন অর্থের জন্য । “Notes Towards a Supreme Fiction”-এ তাঁর বক্তব্য--
The death of one god is the death of all. . .
Phoebus is dead, ephebe. But Phoebus was
A name for something that never could be named
...........
The poem refreshes life so that we share,
For a moment, the first idea . . . It satisfies
Belief in an immaculate beginning

And sends, winged by an unconscious will,
To an immaculate end.

মৃত্যুর পর ওয়ালেস স্টিভেন্সের খ্যাতি আরো ব্যাপকতা পায়। হ্যারল্ড ব্লুম, হেলেন ভেন্ডলার, ফ্রাঙ্ক কারমোডের মতো সমালোচকরা তাকে বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ কবির শিরোপা দিতে চান: পরবর্তী কবিদের মধ্যে তাঁর প্রভাব পড়েছে জন অ্যাশবেরি (John Ashberry), জরি গ্রাহাম (Jorie Graham), জন হল্যান্ডার (John Hollander) ও মার্ক স্ট্রান্ড (Mark Strand), প্রভৃতি কবির ওপর।

উইলিয়াম কার্লোস উইলিয়ামস
উইলিয়াম কার্লোস উইলিয়ামস জন্মগ্রহণ করেন নিউজার্সির রাদারফোর্ডে, ১৮৮৩ সালে। টি এস এলিয়ট বা পাউন্ড যেখানে মার্কিন দেশে জন্মেও ছিলেন চিরউদ্বাস্তু, উইলিয়াম কার্লোস উইলিয়ামস সেখানে স্বদেশের মাটিতে দৃঢ়মূল এবং স্থানীয় ঐতিহ্য ও প্রতিবেশের প্রতি বিশ্বস্ত। তিনি য়ুনিভার্সিটি অব পেনসিলভ্যানিয়া থেকে ডাক্তারি পাশ করেন, এবং সারাজীবন চিকিৎসা পেশায় নিবেদিত ছিলেন। ডাক্তারির ছাত্র থাকাকালেই পাউন্ড এবং হিল্ডা ডুলিটলের (এইচ ডি) সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন। জার্মানি থেকে পেডিয়াট্রিক্সে উচ্চতর শিক্ষাগ্রহণ শেষে নিজের ছোট শহর রাদারফোর্ডে পসার জমিয়ে তোলেন। পরবর্তীকালে নিকটবর্তী প্যাটারসন শহরের জেনারেল হাসপাতালের প্রধান শিশুরোগবিশেষজ্ঞ নিযুক্ত হন। এই প্যাটারসন নিয়ে তাঁর একটি গুরুত্বপূর্ণ কাব্যগ্রন্থ রয়েছে ।
সমসময়ে নিউইয়র্ক শহরে আভাঁগার্দ কাব্য-আন্দোলন চলছিল জোরেশোরে। উইকয়েন্ডের দিনগুলো নিউইয়র্কে কাটাতেন উইলিয়ামস; আড্ডা দিতেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে ইউরোপ থেকে অভিবাসিত আধুনিকবাদী, বিশেষত ডাডাবাদী শিল্পীকুল যথা মান্ রে, ফ্রান্সিস পিকাবিয়া এবং মার্শেল দ্যুশ্যাম্প প্রভৃতির সাথে। উইলিয়ামস এই আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়েন এবং অচিরে এর প্রধান উদ্গাতায় পরিণত হন। নিউইয়র্কের কবি-শিল্পীদের গ্র“প দি আদার্স-এর সাথে সম্পৃক্ত হন: এখানে অন্য বিখ্যাত আধুনিকবাদী কবি ওয়ালেস স্টিভেন্স, আলফ্রেড ক্রেমবর্গ ((Alfred Keymborg), ), ম্যাক্সওয়েল বডেনহাইম (Maxwell Bodenheim) এডনা সেন্ট ভিনসেন্ট মিলে (Edna St. Vincent Millay), মিনা লয় (Mina Loy) ও মারিঅ্যান মূরের (Marianne Moore) সাথে তাঁর সখ্য গড়ে ওঠে। ইউরোপীয় ডাডাবাদের নির্বাসিত প্রবক্তাদের সাহচর্য উইলিয়ামসকে আধুনিকবাদের প্রাণস্পন্দনের সাথে যুক্ত করে এবং তাঁর প্রথম দিককার কবিতায় ডাডাবাদী ও পরাবাস্তববাদী ভাবনা ও চিত্রকল্পের প্রাচুর্য দেখা যায়। পাউন্ড আর এলিয়ট যখন য়ুরোপখণ্ড জয়ে নিরত, মার্কিন ভূখণ্ডে আধুনিকবাদের ঝান্ডাটি তখন উইলয়ামসের হাতে। তিনি এবং ওয়ালেস স্টিভেন্স মিলে ইংরেজি আধুনিকবাদের প্রতিস্পর্ধী মার্কিন আধুনিকবাদের স্তম্ভ গড়ে তোলেন। এলিয়টের উত্থান ও প্রসার নিয়ে তিনি ঈর্ষিত ও ক্ষুব্ধ ছিলেন, বিশেষত এলিয়টের স্বদেশ ও স্বধর্মত্যাগ এবং রাজতন্ত্র-অনুরাগ উইলিয়ামসের কাছে ছিল অগ্রহণযোগ্য। পাউন্ডের সাথে বন্ধুত্ব থাকলেও উইলিয়ামস পাউন্ডের (এবং এলিয়টের) ইউরোপমনস্কতাকে গ্রহণ করতে রাজি ছিলেন না। তিনি চাইছিলেন আমেরিকায় নিজবাসভূমে আমেরিকার জীবন ও প্রতিবেশ নিয়ে আমেরিকার ইডিয়মে সাহিত্য রচনা করতে। পাউন্ড এবং এলিয়টের বিশ্বসাহিত্যপরিগ্রাহিতা ও উল্লেখের অতিরেক ক্ষুব্ধ করে তাঁকে, এবং তিনি এলিয়টের দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ডের জবাবে তাঁর নিজস্ব কাব্যচিন্তার অনুসরণে একটি আধুনিকবাদী মহাকাব্য লিখেন :Paterson. মার্কিন জনজীবনের বৈচিত্র, তার ইতিহাস-ঐতিহ্য থেকে উৎসারিত সতেজ ও প্রাণবন্ত এক চলতি ভাষায তিনি কবিতা রচনা করতে চাইলেন , দেখালেন আধুনিকবাদী কবিতার এমন একটি সরণী যে-পথ এলিয়ট বা পাউণ্ড কখনো মাড়াননি। উইলিয়ামসের একটি বিখ্যাত কবিতা “The Red Wheelbarrow” অনেকটা পাউণ্ডের ইমেজিস্ট কবিতার কথা মনে পড়াবে, যদিও এটি যখন প্রকাশিত হয়, সেই ১৯২৩ সালে পাউন্ড নিজেও ইমেজিস্ট আন্দোলনের সাথে সম্পর্ক পরিত্যাগ করেছেন।

The Red Wheelbarrow
so much depends
upon

a red wheel
barrow

glazed with rain
water

beside the white
chickens

শুধু এই কবিতায় নয, কবিতার পর কবিতায় উইলিয়ামস উপহার দিয়েছেন চিত্রকল্প: “a young horse with a green bed-quilt/on his withers shaking his head,” “a big young bareheaded woman/in an apron,” “Flowers through the window/lavener and yellow/changed by white curtains.” কবিতায় কোনো নীতিকথা বা এলিয়টের মতো ইতিহাসবোধ নয়, উইলিয়ামস দেখাতে চান বস্তুকে বস্তু হিসেবেই। রূপক অর্থ থেকে মুক্ত বস্তুসত্তাই আসে সামনে : তাঁর নিজের কথায় , “no ideas but things.”
এলিয়টের চেয়ে বসে বড়ো এই মার্কিনী কবি তাঁর এলিয়ট-বিরোধিতার জন্য খ্যাত; কিন্তু একটি বিষয়ে চেতনাগত ঐক্য রয়েছে তাঁদের মধ্যে। তাঁরা উভয়েই কালকে দেখতে চেয়েছেন, রৈখিক প্রগ্রসরমানতারূপে নয়, বর্তমান মুহূর্তের সর্বগ্রাসিতা রূপে। এলিয়টের মতে অতীতকাল বর্তমান মুহূর্তের মধ্যে বর্তমান, ভবিষ্যৎকালও। শুধু সত্য বর্তমান মুহূর্তটি: বর্তমানই আরম্ভবিন্দু, এবং সবকিছু এর মধ্যে চংক্রমাণ। উইলিয়ামসও মুহূর্তকে অনন্তজ্ঞান করেছেন। কিন্তু পার্থক্য, দুরতিক্রম্য ও বিরাট, রয়েছে স্পেস্-এর চিন্তায়। উইলিয়ামস এলিয়টের মতো ভূগোল পরিক্রমায় নিজের সার্থকতা খোঁজেননি, বরং রাদারফোর্ডের মতো ছোট্ট জায়গায় কাটিয়ে দিয়েছেন জীবনের প্রায় সবগুলো বছর। বর্তমান মুহূর্ত যেমন অনন্তকালকে ধারণ করে, ক্ষুদ্র এক স্থানখণ্ডও ধারণ করতে পারে সমগ্র পৃথিবী। উইলিয়ামস বলেছেন, “the place of my birth is the place where the world begins.”
উইলিয়ামস শুরুতে জন কীটসের সংহতি এবং এলিজাবেথীয় সনেটকারদের পদলালিত্যকে অনুকরণ করতে চেষ্টা করেন। ১৯০৯ সালে প্রকাশিত ‘পোয়েমস’-এর কবিতাগুলো এক তরুণ কবির নন্দনসাধনার পরিচয়বাহী, ঠিক যেরকম তরুণ ইয়েট্স চেয়েছিলেন প্রি-র‌্যাফায়েলাইট কবিদের চিত্রময়তা ও লিরিকলালিত্যকে ধরতে। উইলিয়ামসের বাল্যবন্ধু এজরা পাউন্ড এই প্রথম কাব্যপ্রয়াস সম্পর্কে এক চিঠিতে লিখেন-- “Individual, original [the book] is not. Poetic it is… but nowhere do you add anything to the poets you have used as models.” অপিচ ঐ প্রথম কাব্যগ্রন্থের 'The Uses of Poetry’ সনেটে কীটসের কণ্ঠস্বর শোনা যায়, তেম্নি দূরাগত প্রতিধ্বনি (অথবা সমান্তরাল স্বর) শোনা যায় ‘The Lake Isle of Innisfree’-এর নবীন ইয়েটসেরও। পাউন্ডের বান্ধবী, তাঁর ইমেজিস্ট ক্লাবের সদস্য হিল্ডা ডুলিটল (এইচ ডি)-এর উদ্দেশে লেখা উইলয়ম কার্লোস উইলিয়ামসের এই কবিতায় তিনি তাঁর কাব্য-অন্বিষ্ট সম্পর্কে বর্ণনা দিয়েছেন।
I have fond anticipation of a day
O’erfilled with pure diversion presently,
For I must read a lady poesy
The while we glide by many a leafy bay,
Hid deep in rushes, where at random play
the glossy black winged Man-flies, or whence flee
Hush throated nestlings in alarm,
Whom we have idly frightened with our boats long sway.

For, lest o’ersaddened by such woes as spring
To rural eace from our meek onward trend,
What else more fit? We’ll draw the light latch-string

And close the door of sense; then satiate wend,
On Poesy’s transforming giant wing,
To worlds afar whose fruits all anguish mend.

উইলিয়ামস মার্কিনী জনগণের নিজস্ব চেতনাকে ধারণ করতে পেরেছিলেন অনেকটা ফ্রস্টেরই মতো, এবং এভাবে তিনি হুইটম্যানের সাথেও সাযুজ্য স্থাপন করতে পেরেছিলেন। মার্কিনী জনগণের নিজস্ব বাকভঙ্গি ও বাক্ছন্দ তাঁর কবিতায় যতটা স্বতস্ফূর্ত অন্য অনেকের কবিতায় ততটা নয়। এই গুণের কারণেই তিনি অনুকরণীয় মডেল হয়ে ওঠেন পরবর্তী মার্কিন কবিকুলের: তাঁর প্রভাব পড়েছে যেসব উত্তরসূরীর ওপর তাঁদের মধ্যে রয়েছেন অ্যালেন গিন্সবার্গ (Allen Ginsberg), রবার্ট লাওয়েল (Robert Lowell) ও পল ব্ল্যাকবার্ন (Paul Blackburn)। মার্কিনী কথ্য ইংরেজি ভাষার স্বাভাবিক যতিপাতকে তিনি তাঁর কবিতার ছন্দে যুক্ত করতে চেয়েছেন : এ ধরনের যতি জ্যাজ্ সঙ্গীতেও লক্ষ করা যায়। কবিতার লাইনের গঠন নিয়ে নানা নিরীক্ষা করার পর তিনি পৌঁছান ত্রি-স্তরবিশিষ্ট, সিঁড়ির আদলে গড়া, লাইনে। একে উইলিয়ামস নাম দেন “stepped triadic line.” Journey to Love গ্রন্থের “Shadows” কবিতা থেকে একটি উদাহরণ --
Shadows cast by the street light
under the stars,
the head is tilted back,
the long shadow of the legs
presumes a world taken for granted
on which the cricket trills

বস্তুত মুখের ভাষা তথা চলতি বুলিকে কবিতার ভাষা করার প্রণোদনা উইলিয়াম কার্লোস উইলিয়ামস থেকে সঞ্চারিত হয়েছে য়ুরোপ আমেরিকার বাইরেও নানা ভাষার কবিতায়।
গদ্য-পদ্য মিশিয়ে মন্তাজ রচনা করেছেন কয়েকটি গ্রন্থে : যেমন Improvisations (1920), Sour Grapes (1921); Spring and All (1923) ;The Descent of Winter (1927) উইলিয়ামসের Collected Poems 1921-1931 প্রকাশিত হয় ১৯৩৬ সালে। কবিতা ছাড়াও প্রচুর ছোটগল্প ও উপন্যাস রচনা করেছেন উইলিয়ামস। ১৯৪৬ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর মহাকাব্যিক দীর্ঘ কবিতা Paterson, যেটিকে তিনি এলিয়টের দ্য ওয়েস্টল্যান্ডের জবাব হিসেবে উপস্থাপন করেন। ১৯৬৩ সালের ৪ মার্চ নিউজার্সির রাদারফোর্ডে নিজ বাড়িতে ঊনসত্তর বছর বয়সে মারা যান উইলিয়াম কার্লোস উইলিয়ামস। দু’মাস পর তাঁকে মরণোত্তর পুলিৎজার পুরস্কার দেয়া হয় তাঁর Pictures from Breughel and Other Poems (১৯৬২)-এর জন্য।


উল্লেখপঞ্জি--
১.1. T.S. Eliot, Selected Prose, Penguin Books, 1953, p. 25
2. David Perkins, A History of Modern Poety: From the 1890s to the High Modernist Mode, Harvard UP/ABS India, 1987, p. 458

৩. ঐ. পৃ. ৪৫৯
৪. T.S. Eliot পূর্বোক্ত, পৃ. ৩০
৫. 5. David Perkins, পূর্বোক্ত
6. T.S. Eliot, ‘Andrew Marvell’, Selected Essays, Faber, London, 1969, p. 296
7. T.S. Eliot, Selected Prose, Penguin Books, 1953, p. 26

10. T.S. Eliot, Collected Poems 1909-1962, Harcourt Brace & World Inc, New York, 1963, p. 70
11. ‘Ulysses, Order and Myth’, Dial, 75, No. 5 (November 1923), p. 283
12. Manju Jain, A Citical Reading of the Selected Poems of T.S. Eliot, OUP, Delhi, 1992, p. 124
13. Valerie Eliot ed. The Waste Land: A Facsimile and Transcript of the Original Drafts including the annotations of Ezra pound, Faber, London, 1971, pp. xvii-xviii
14. David Perkins, A History of Modern Peoty, Blknap, Harvard, 1976, p. 571
15. Lilian Feder, ‘The Litrary Scene’, Boris Ford ed. The New Pelican guide to English Literature, vol. 9. Penguin, London, 1967, p. 309
16. James E. Breslin, William Carlos Williams: An American Artist, OUP, New York, 1970

২টি মন্তব্য: