শুক্রবার, ৯ এপ্রিল, ২০১০

আমাদের একবিংশ : অঞ্জন সেন

অঞ্জন সেন
আমাদের একবিংশ

একবিংশ পত্রিকার সঙ্গে আমার সম্পর্ক দু’দশকেরও বেশি। একবিংশ-র আশি দশকের সংখ্যাগুলি বাংলাদেশের তরুণ কবিদের কবিতার জন্য আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ঐ সময়ই প্রকাশিত হয় ‘অনিরুদ্ধ আশি’ কবিতা সংকলন। সংকলনটির পাঠ-প্রতিক্রিয়া জানিয়ে একবিংশ সম্পাদককে চিঠি লিখি তা ‘গৃহে ফেরে ভ্রামণিক চোখ’ নামে প্রকাশিত হয় এবং বর্দ্ধিত আকারে কলকাতার ‘রক্তকরবী’ পত্রিকায় কিছুদিন পর প্রকাশিত হয়। এরপর থেকে নিয়মিত যোগাযোগ। চিন্তার সাদৃশ্য থাকায় উত্তর আধুনিকতা বিষয়ে নিবন্ধ পাঠাই, তাও প্রকাশিত হয়। পশ্চিমের পোস্টমজার্নিজম এর চিন্তায় এ উপমহাদেশ প্লাবিত হওয়ার আগেই আমরা কয়েকজন দেশীয় উৎসের চিন্তাভাবনা থেকে লেখালেখি শুরু করি। ঔপনিবেশিক ও ইউরোকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনা থেকে সরে আসার জন্য। পশ্চিমবঙ্গে প্রবল বিরোধিতা হয়, কিন্তু সমর্থনও পাই। বাংলাদেশের একবিংশ পত্রিকা আমাদের উপেক্ষা করেনি, আগ্রহের সঙ্গে নিবন্ধগুলি ছেপেছিল। এরপর ‘প্রান্ত’ ও ‘লিরিক’ পত্রিকাতে উত্তর আধুনিক কবিতা বিষয়ে প্রবন্ধ ছাপা হতে থাকে। সমর্থন পাই এ কারণে যে, ঔপনিবেশিক সাহিত্যচিন্তা থেকে মুক্তির কথা বাংলাদেশের কিছু বন্ধুও ভেবেছিলেন। ঢাকাতে যাই ১৯৯৩ মে মাসে, ‘কবিতার ভাষা বিষয়ে বাঙালির চিন্তা’ বিষয়ে বক্তব্য রাখতে, যে বক্তব্যের একটি সংক্ষিপ্ত বয়ানও একবিংশে ছাপা হয়েছিল। ইতোমধ্যে একবিংশকে নিজের পত্রিকা ভাবতে শুরু করেছি। খোন্দকার আশরাফ হোসেনের সঙ্গে নিয়মিত পত্র-বিনিময় হয়, একবার আমার কবিতাও ছাপা হয়েছিল। এর মধ্যে একবিংশ পত্রিকায় উত্তর আধুনিকতা বিষয়ে কিছু বিতর্কও প্রকাশিত হয়Ñ তাতে পশ্চিমের দৃষ্টিকোণ থেকে উত্তর আধুনিকতা বিরোধী ভাষ্য সম্পর্কে আমরা অবগত হই। অন্যদিকে চট্টগ্রামের ‘লিরিক’ পত্রিকাও এ বিষয়ে ৫টি সংখ্যা প্রকাশ করেছে। তবে কোথাও কোথাও উত্তর আধুনিকতা পশ্চিমবঙ্গের চিন্তা বা ভারতের চিন্তা বলে দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা দেখা যায়। উত্তর আধুনিকতা আসলে এ উপমহাদেশের ঔপনিবেশিকতা ও ইউরোকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনার বিরোধিতা। এ উপমহাদেশের অনেকগুলি ভাষার সাহিত্যে এ চিন্তা প্রতিফলিত।

কবি অমিয় চক্রবর্তীর জন্মশতবর্ষে ২০০১-এ একবিংশের কাছে একটি বিশেষ সংখ্যার প্রস্তাব রাখি। সে প্রস্তাব সাদরে গৃহীত হয় এবং সুন্দর একটি অমিয় চক্রবর্তী বিষয়ক ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে একবিংশ। সে সময় পশ্চিমবঙ্গে এ বিষয়ে উদ্যোগ দেখা যায়নি। আমার একটি নিবন্ধ ও কবি অমিয় চক্রবর্তীর আমাকে লেখা ২২টি চিঠি ঐ সংকলনে প্রকাশিতহয়। আমি তখন গুজরাটের সুরাটের প্রবাসী।


একবিংশ এর আগে ‘নজরুল-জীবনানন্দ সংখ্যা’ প্রকাশ করেছে; সে সংখ্যাতেও লেখার সুযোগ হয়েছিল। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ওপর একটি ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হয় যাতে লিখতেনা পারলেও সাহায্য করতে পেরেছি। এভাবে একবিংশ-র সাথে আমার যোগাযোগ ও বন্ধুত্ব দৃঢ় হয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গের লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরী ও গবেষণাকেন্দ্রে একবিংশ-কে পুরস্কৃত ও সম্মানিত করে। সে সময়ে আমি প্রবাসী। গাঙ্গেয় পত্রের ৩০ বছর উপলক্ষে কলকাতার একটি আলোচনা চক্র আয়োজিত হয় ‘শ্রীচরণেষু’ পত্রিকার উদ্যেগে ২০০৪ আগস্টে। একবিংশ সম্পাদক সে আলোচনাচক্রে মনোজ্ঞ ভাষণ রাখেন। ঐ আলোচনা চক্রে ছিলেন তপোধীর ভট্টচার্য, সুমিতা চক্রবর্তী, অমিয় দেব, মনসুর মুসা, দিলীপ কুমার বসু, দিলীপ বন্দোপাধ্যায়, বীরেন্দ্র চক্রবর্তী প্রমুখেরা। খোন্দকারের মনোজ্ঞ ভাষণটির একটি পাঠ আমার সম্পাদিত গাঙ্গেয় পত্রে, আরেকটি পাঠ একবিংশে প্রকাশিত হয়।

আমার কবিতা বিষয়ে বাংলাদেশের প্রথম নিবন্ধটিও একবিংশে প্রকাশিত হয়। এরপর ‘উত্তর আধুনিক চাতালে, বিশেষ সংখ্যা আমার আনাড়ি হাতে অঙ্কিত একটি চিত্র প্রচ্ছদে ছাপা হয়। কোনো পত্রিকার প্রচ্ছদে এটিই আমার প্রথম মুদ্রিত চিত্র। ঐ সংখ্যাতেই আমার লেখালেখি বিষয়ে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। এ জন্য আমি গর্ববোধ করি।

একবিংশ পত্রিকা বিভিন্ন সংখ্যায় বহু গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ ও কবিতা প্রকাশ করে আমাদের কৃতজ্ঞতাভাজন। উন্নত মানের প্রবন্ধ ও কবিতা ছাপিয়ে পত্রিকাটি বাংলাভাষায় বিশেষ ভূমিকা নিয়েছে। এ পত্রিকার সাথে জড়িয়ে থেকে আমিও গৌরবান্বিত। পত্রিকার সম্পাদক খোন্দকার আশরাফ হোসেনের ষাটবছর পূর্তি হল, তাঁর বিপুল সাহিত্যকর্মময় জীবন এবং সৃজনকর্মের জন্য তাঁকে অভিনন্দন জানাই।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন