শুক্রবার, ৯ এপ্রিল, ২০১০

একবিংশ : পঁচিশ বছরের দায় ও কৃতি : কামরুল ইসলাম

কামরুল ইসলাম
একবিংশ : পঁচিশ বছরের দায় ও কৃতি

লিটল ম্যগাজিনকে অনেকেই ছোট কাগজ বলে থাকেন। ‘ছোট কাগজ’ লিটল ম্যাগাজিনকে ধারণ করে কিনা জানি না, তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে লিটল ম্যাগাজিনকে ছোট কাগজ বলতে অনাগ্রহী। লিটল ম্যাগাজিন একটি বিশেষ ধাঁচের সাহিত্য পত্রিকা, যার বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্যও রয়েছে। সেসব বিষয়ে আলোচনায় না গিয়ে শুধু এটুকু বলা যায় যে, লিটল ম্যাগাজিন পরিবর্তনের, পালাবদলের,নতুনত্বের অঙ্গীকারে ঋদ্ধ। লিটল ম্যাগাজিন হিসেবে খোন্দকার আশরাফ হোসেন সম্পাদিত একবিংশ পঁচিশ বছর অতিক্রান্ত করেছে। একটি লিটল ম্যাগাজিন-এর পঁচিশ বছর পূর্তি একটি বিস্ময়কর ব্যাপারই বটে, যখন কাগজ কিংবা ছাপা-খরচের কথা আমাদের ভাবতে হয়। লিটল ম্যাগের সাথে অকাল মৃত্যুর একটি সম্পর্ক রয়েছে। আবার অনেক লিটল ম্যাগ অনেককাল টিকেও থাকে। অনেক পত্রিকাই ঢাক-ঢোল পিটিয়ে যাত্রা শুরু করে অকালেই ঝরে পড়ে। এই ঝরে পড়ার মধ্যে কোনো গ্লানি আছে বলেও আমার মনে হয় না। একটি/দুটি সংখ্যাও যদি শিল্প-সাহিত্যের কোনো এক ক্ষেত্রে একটু ঝাঁকি দিয়ে নিভে যায়, তাহলেও তার সেইটুকু প্রাপ্তিকে খাটো করে দেখার কোনো অবকাশই নেই। একথা বলাই বাহুল্য যে, সব পত্রিকাই প্রকৃত সাহিত্য পত্রিকা হয়ে ওঠে না। শিল্প-সাহিত্যের মতোই সাহিত্য পত্রিকা বা লিটল ম্যাগকে আমরা দুই ভাগে ভাগ করতে পারি। সৃষ্টিশীল সাহিত্য পত্রিকার একটি দায়বদ্ধতা থাকে। কিন্তু বাজারী সাহিত্য পত্রিকার তা থাকে না। এখানে বলে নেওয়া ভালো যে, সব সাহিত্য পত্রিকাকে লিটল ম্যাগ বলা যাবে না, সব লিটল ম্যাগকে সাহিত্য পত্রিকা বলা যাবে। লিটল ম্যাগের চরিত্র সাধারণ সাহিত্য পত্রিকার মতো নয় । এ নিয়েও রয়েছে নানা বিতর্ক। প্রতিষ্ঠান কিংবা প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার নানা কথা রয়েছে । সে-বিষয়ে না গিয়ে আজকে লিটল ম্যাগ হিসেবে একবিংশ-র দায় ও কৃতির কিছু চিত্র তুলে ধরতে চাই।

বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকা বাংলা কবিতার পালাবদলে যে ভূমিকা রেখেছিল তাকে ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখতে হবে আমাদের। বিস্ময়করভাবেই পত্রিকাটি অনেককাল টিকে ছিল এবং বাংলা কবিতার আধুনিকায়নে এর ভূমিকা ছিল অনন্য, তিরিশের প্রধান কবিরা চিহ্নিত ও বিকশিত হয়েছে এই পত্রিকার মাধ্যমে। তবে কোনো পত্রিকার টিকে থাকার ব্যাপারে পেছনের মানুষটির ভূমিকা ও যোগ্যতা বিশেষভাবে কাজ করে। শুধু কবিতা নিয়ে, আধুনিক কবিতা নিয়ে বুদ্ধদেব বসুর ভাবনা ও শ্রম, তার অভিভাবকত্ব কিংবা শিক্ষকতা আমাদের কাছে তাকে বিশেষ মর্যাদায় উন্নীত করেছে। বাংলা আধুনিক কবিতার বিকাশে ‘কবিতা’ পত্রিকাটি ছিল তার সকল স্বপ্নের উৎস। এবিষয়ে ‘সাহিত্যপত্র’ প্রবন্ধে তিনি বলেছেন : “সাহিত্যের অন্যান্য অঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন করে শুধুমাত্র কবিতার উপর এই জোর দেবার প্রয়োজন ছিলো, নয়তো সেই উঁচু জায়গাটি পাওয়া যেত না, সেখান থেকে উপেক্ষিতা কাব্যকলা লোকচক্ষের গোচর হতে পারে। ‘কবিতা’ যখন যাত্রা করেছিলো, সেই সময়কার সঙ্গে আজকের দিনের তুলনা করলে, একথা মানতেই হয় যে, কবিতা নামক একটি পদার্থের অস্তিত্বের বিষয়ে পাঠকসমাজ অনেক বেশি সচেতন হয়েছেন, সম্পাদকরাও একটু বেশি অবহিতÑ এমনকি সে এতদূর জাতে উঠেছে যে, কবিতার জন্য অর্থমুল্যও আজকের দিনে কল্পনার অতীত হয়ে নেই।” একবিংশ-র পঁচিশ বছর টিকে থাকা এবং কবিতা নিয়ে, কবিতার নতুন দিকবলয়ের অনুসন্ধানে, কবিতাকে কবিতা হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে এই পত্রিকার মাধ্যমে যে বিচিত্র সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ড সম্পাদিত হয়েছে, তার মূল্যায়ন যথাযথভাবে হওয়া উচিত।

খুব নির্মোহভাবে আমরা অনেকেই সেই ঔদার্যের জায়গাটায় পৌঁছতে পারি না বলেই হয়তো অনেককিছুর সঠিক মূল্যায়নে কার্পণ্য দেখাই। একবিংশ-র মূল্যায়নেও সেরকম বিষয় মাঝে মাঝে লক্ষ করা গেছে এবং তা কোনো শুভত্বের লক্ষণ নয়। খোন্দকার আশরাফ হোসেনকে আমার কখনো কখনো মনে হয়েছে এক নিঃসঙ্গ কর্ণধার, যিনি অনেকটা একাকীই তার ‘একবিংশ’ নামের তরণীটি বয়ে চলেছেন বিষম স্রোতধারায়। পঁচিশ বছর ধরেই চলছেন। মাঝেমাঝে ছেদ পড়লেও একেবারে থেমে যান নি। অনেকেই এসেছে এই তরণীর যাত্রী হয়ে । চলেও গেছেন। অনেক নতুন নতুন যাত্রীর কোলাহলে কখনো কখনো নতুন ও পুরনোর মিশ্রণে তার চলার গতি স্বচ্ছন্দ থেকেছে সতত। লিটল ম্যাগই মূলত সৃষ্টিশীল শিল্প-সাহিত্যের জায়গা। ১৯৮৫ সালের নভেম্বরে প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হবার পর যে আলোরেখায় তার সমূহ অবয়ব আচ্ছন্ন ছিল তাতে বুঝতে কোনো অসুবিধা হয়নি যে, এটি বাংলা কবিতার পালাবদলের অঙ্গীকার নিয়ে আবির্ভূত। আমরা আগেই বলেছি কোনো লিটল ম্যাগ কিংবা সাহিত্য পত্রিকার সৌন্দর্য-সৌকর্য কিংবা সৃষ্টিশীলতার কিংবা বেঁচে থাকার বিষয়টি অনেকখানিই নির্ভর করে সেই পত্রিকাটির পিছনের মানুষটির ওপর, যিনি সেই পত্রিকার সম্পাদক। খোন্দকার আশরাফ হোসেন ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক এবং আশির দশকের একজন উল্লেখযোগ্য কবি হিসেবে যে দায়িত্ব নিয়ে একবিংশ বের করতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেনÑ সেটি ছিল কবিতাকে প্রকৃত কবিতা করে তোলার অঙ্গীকার।

সত্তরের দশকের কবিদের কবিতা যে তরলীকৃত শব্দাচার, দ্রোহ, অকাব্যিক ন্যারেটিভ কিংবা সস্তা বাকবিন্যাসের স্রোতধারায় আচ্ছন্ন ছিল, সেটি বাংলা কবিতার জন্যে মোটেই শুভকর কোনো বিষয় ছিল না। জনপ্রিয় কবিদের একটা সময় গেছে তখন। আশির দশকে বাংলা কবিতায় একটি পরিবর্তনের হাওয়া লাগে। এসময়ে খোন্দকার আশরাফ হোসেনের উপলব্ধিতে আসে কবিতাচর্চায় শুভত্বের, সৃষ্টিশীলতার বিষয়টি। নিজে একজন সৎ কবি হিসেবে যে দায়িত্ব তিনি একবিংশ-র মাধ্যমে নিয়েছিলেন এবং আজ অবধি চালিয়ে যাচ্ছেন নিরলসভাবে কিংবা নির্ভীক ঔদার্যেÑ সে-বিষয়ে যে যা-ই ভাবুক না কেন, তার এই নিরন্তর প্রকাশনা এবং কবিতার নানা দিক নিয়ে, সাহিত্যতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা এবং বিশেষভাবে তরুণ কিংবা উদীয়মান প্রতিশ্র“তিশীল কবিদের তুলে ধরার বিষয়গুলো আলাদাভাবেই দেখতে হবে। এটি একটি দুরূহ কাজই বটে। বাংলাদেশে আর কোনো লিটল ম্যাগাজিন এরকম দায়িত্ব নিয়ে টিকে আছে কিনা আমার জানা নেই।

একবিংশ অনেক কবির জন্ম দিয়েছে। অনেক কবিই একবিংশ-র মাধ্যমে পরিচিতি পেয়েছে Ñ তাদের অনেকেই হয়তো আজ আর লিখছেন না, কিংবা দূরে সরে গেছেন, কিন্তু একবিংশ-র পালে হাওয়া লাগা থেমে যায়নি। নবীন-প্রবীণের সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ডে একবিংশ প্রতিটি প্রকাশনায় আলাদাভাবে আবির্ভূত হয়। আর এসব আলাদা কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে একবিংশ তৈরি করেছে রুচিশীল পাঠক। একবিংশ-র প্রথম সংখ্যায় সম্পাদক লিখেছিলেন, “... ভবিষ্যবাদী নামকরণের মধ্যে উপর্যুক্ত বোধটি কাজ করলেও স্বীকার করতে হবে, দৈশিক কবিতার হতাশাপূর্ণ বর্তমানই পত্রিকা প্রকাশের পেছনে মূল নিয়ামক ছিল। মনকে চোখ ঠেরে লাভ নেই; বাংলা কবিতার এখন প্রখর দুঃসময়। প্রতিভাদীপ্ত ঘোড়সওয়ারগণ বহু আগে নিস্ক্রান্ত; সুধী-জীবন-বুদ্ধের তিরিশী ত্র্যহস্পর্শ থেকে জেগে উঠলো না আর বাংলা কবিতা। কেউ কেউ বলেন, বাংলা কবিতার অনৈসর্গিক মৃত্যু ঘটেছিল কলকাতার ট্রামলাইনের উপর। অন্যরা, তুলনায় আশাবাদী, ঐ মৃত্যুর দিনক্ষণ সামনে ঠেলে কোনক্রমে পঞ্চাশ দশক পার করে দেন। সে যাই হোক, বাংলার কাব্য ক্ষেত্রটি বহুদিন প্রতিভারিক্ত আধিয়াদের দ্বারা অপকর্ষিত হচ্ছে । অন্তর্গত শ্রীহীনতাকে ঢেকে রাখছে রাজনীতির শিল্পবোধহীন চিৎকার। আমরা একটি হট্টগোলের হাটে আছি। আতœপৃষ্ঠকণ্ডূয়নের অসম্ভব যোগাভ্যাস, বামনাবতারদের কলহ, দলবাজি এবং স্বৈরাচারে অবরুদ্ধ প্রাণের স্ফুর্তি আবেগের আন্দোলন। ...একবিংশ’র প্রকাশ অপক্ষমতা ও স্বৈরাচারের শালীন জবাব; দেয়াল দ্বারা পথ বন্ধ দেখে তা ডিঙিয়ে যাবার স্পর্ধিত উল্লম্ফন বলুন আর প্রতিক্রমণ বলুন, একবিংশ’র অভীপ্সা তা-ই। একবিংশ কেবল নতুন প্রজন্মের কবি-লেখকদের জন্য নির্দিষ্ট। যারা অপ্রতিষ্ঠিত, যৌবনাবেগে টলমল, প্রতিভাবান, উদার, অভিনিবিষ্ট , শ্রমী এবং নির্ভয়, আমরা তাদের জন্য পাটাতন নির্মাণ করতে চাই...”

তরুণদের জন্য একটি মুখপত্রের অনুভব থেকে তিনি একবিংশ বের করেছিলেন এবং সুস্থধারার কবিতাচর্চার একটি পথ তৈরিতে নিজেকে অন্বিষ্ট রেখেছেন এই পত্রিকার প্রকাশনার সাথে বলতে গেলে দীর্ঘকালই। বাংলা কবিতার একটি বিশেষ সময়ের ব্যূহ থেকে বেরিয়ে আসার ক্ষেত্রে একবিংশ-র ভূমিকাকে ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখতে হবে।

একবিংশ শুধু বাংলাদেশের লেখকদের নিয়ে সন্তুষ্ট থাকেনি, ওপার বাংলার অনেক লেখকদেরও লেখা ছেপেছে। আমরা অনেকেই আগে আসাম কিংবা ত্রিপুরার বাংলা ভাষাভাষীদের লেখার সাথে পরিচিত ছিলাম না। ঐ অঞ্চলের লেখকরা এমনকি পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের কাছেও অবহেলিত, উপেক্ষিত ছিল। একবিংশই প্রথম আসাম-ত্রিপুরার কবিদের কবিতা ছাপিয়ে এবং ঐ অঞ্চলের পণ্ডিতদের তথ্যসমৃদ্ধ লেখা প্রকাশ করে তাদেরকে বৃহত্তর পরিসরে নিয়ে এসেছে। বরাক উপত্যকার বাংলা ভাষাভাষীদের সাহিত্যচর্চার বিষয়টি আমাদের নতুন ভাবনার ক্ষেত্রকে আরো বিস্তৃত করেছে বলে আমার বিশ্বাস। ঐ অঞ্চলে একদা যে ভাষা আন্দোলন হয়েছিল এবং এগারটি তাজা প্রাণ যে আত্মাহুতি দিয়েছিল, সে খবর আমারা একবিংশ-র মাধ্যমে আরো ব্যাপকভাবে জানতে পারি। আসামের কাছাড় জেলায় ১৯৬১ সালের ১৯ মে সংঘটিত ঘটনাটি তাই বাঙালির দ্বিতীয় ভাষা আন্দোলন হিসেবে ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে। একবিংশ এক্ষেত্রে যে দায়িত্বটি পালন করেছে, বাংলাদেশে প্রকাশিত আর কোনো লিটল ম্যাগাজিন সেটা করেছে বলে আমার জানা নেই। ‘বরাক উপত্যকার কবিতা: অতন্দ্র গোষ্ঠী’ নামক প্রবন্ধের গোড়াতেই তপোধীর ভট্টাচার্য বরাক উপত্যকাবাসী বাঙালির দুর্নিবার নিয়তিকে তুলে ধরেছেন, “বাঙালির উত্তাপবলয় থেকে সুদূরতম প্রান্তে বরাক উপত্যকার বঙ্গভাষীজনেরা যতটা তিনদিক ঘেরা পাহাড়ের পাহারায় বন্দী, তার চেয়ে ঢের বেশি নিমজ্জিত তারা স্বখাত সলিলে। মমতাবিহীন কালস্রোতে নির্বাসিত শ্রীভূমির কথা লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, ঐ ভূমি থেকে উৎখাত হওয়ার পরে ছিন্নমূল মানুষের স্বাভাবিক নিরাপত্তাহীনতা ও তজ্জনিত হীনমন্যতা হয়ে উঠলো বরাক উপত্যকাবাসী বাঙালির দুর্নিবার নিয়তি। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্যে এগারটি প্রাণ আহূতি দিয়েও শেষরক্ষা করতে পারলেন না। এরা আরম্ভ জানেন কিন্তু সমাপ্তিটা জানেন না। উনিশে মে তাই চৌত্রিশ বছর পরে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে অজ্ঞাতপরিচয়, আর তেতাল্লিশ বছর আগের একুশে ফেব্র“য়ারি প্রতিবেশী সমভাষীদের মধ্যে আজো জ্বলন্ত অগ্নিবলয়।” (একবিংশ, দশবছরপূর্তিসংখ্যা, নভেম্বর ১৯৯৬ )।

বাংলা সাহিত্যের রথি-মহারথিদের নিয়ে ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে একবিংশ একদিকে তাদের যেমন সম্মানিত করেছে, তেমনি তাদেরকে নতুনভাবে মূল্যায়নেরও ক্ষেত্র সৃষ্টি করেছে। তত্ত্ববিশ্বের নানা দিক ঠাঁই পেয়েছে একবিংশ-র বহুতল বুকে এবং এক্ষেত্রে এদেশের পণ্ডিতদের পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গ কিংবা আসাম-ত্রিপুরার প্রাজ্ঞজনেরাও লিখেছেন ব্যাপক পরিসরে। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, তপোধীর ভট্টাচার্য, অঞ্জন সেন, খোন্দকার আশরাফ হোসেন, আফজালুল বাসার, মঈন চৌধুরী প্রমুখের লেখার মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে তত্ত্ববিশ্বের নানা কথা। রোমান্টিক কবিতা ও রোমান্টিক আন্দোলন, উত্তর আধুনিকতা কিংবা আধুনিকবাদ নিয়ে সম্পাদক নিজে লিখেছেন বিস্তৃত তথ্যসমৃদ্ধ দীর্ঘ প্রবন্ধ। এছাড়া ইউরোপ-আমেরিকা-ল্যাটিন আমেরিকা-আফ্রিকার কবিদের কবিতার অনুবাদ ও আলোচনা পাঠককে দিয়েছে আলাদা তৃপ্তি। সব মিলিয়ে একবিংশ তার রন্ধনশালার ঔদার্যে রসনাতৃপ্তির নব নব আয়োজনে পাঠককুলকে যে পুষ্টিতে সমৃদ্ধ করেছে, সেই বিষয়টি আমাদের অনুভবের জগতে একধরনের আনন্দের সঞ্চার করে। এই আনন্দই শিল্পের নিভৃত সত্যকে জীবনের চারপাশে দাঁড়াতে সাহায্য করে। একবিংশ’র সফলতা এইখানে, এই আলোকিত অবগুন্ঠনে, এই বিভাসিত বিনম্র গুঞ্জনে।

১৯৯০ সালের ফেব্র“য়ারি মাসে প্রকাশিত একবিংশ-র ক্রোড়পত্র ধারণ করে আশির দশকের কবিদের কবিতা। ঐ ক্রোড়পত্রটি সম্পাদনা করেছিলেন সৈয়দ তারিক। ক্রোড়পত্রের শিরোনাম ছিল ‘অনিরুদ্ধ আশি: এক দশকের কবিতা’। ঐ ক্রোড়পত্রে ২৪ জন কবির প্রায় সকলেরই একাধিক কবিতা স্থান পেয়েছিল। এই কবিদের মধ্যে খোন্দকার আশরাফ হোসেন, রেজাউদ্দিন স্টালিন, মোহাম্মদ সাদিক, সরকার মাসুদ, শান্তনু চৌধুরী, মারুফ রায়হান, সুহিতা সুলতানা , মাসুদ খান সক্রিয় থাকলেও বাকিরা বেশ ম্রিয়মাণ এবং কেউ কেউ একেবারেই নিঃশব্দ। আশির দশকের কিছু সংখ্যাক কবির কবিতায় পালাবদলের ইঙ্গিত ছিল এবং পরবর্তীতে আশি ও নব্বইয়ের দশকের বেশ কিছু কবির কবিতায় জীবনানন্দ-উত্তর নতুন কবিতা চর্চার যে প্রণোদনা দেখা গেল তা আজকে নানাভাবে বিস্তৃত ও বিকশিত হয়েছে। আমরা আবারো বলতে চাই, বাংলা কবিতার পালাবদলে কিংবা সুস্থ ধারার কবিতাচর্চার ক্ষেত্রে একবিংশ’র ভূমিকাকে আলাদাভাবে ভাবার প্রয়োজন রয়েছে।

১৯৮৫ সালের নভেম্বর মাসে প্রকাশিত একবিংশ-র প্রথম সংখ্যাটি শুরু হয়েছিল সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের প্রবন্ধ দিয়ে। ঐ সংখ্যায় সাজ্জাদ শরীফ এবং সৈয়দ তারিকেরও প্রবন্ধ ছিল। খোন্দকার আশরাফ হোসেন, ইকবাল আজিজ এবং রেজাউদ্দিন স্টালিনের ছিল দীর্ঘ কবিতা। শামসুর রাহমানের ‘স্বাধীনতা তুমি’ সম্পর্কে আলোচনা করেছিলেন যথাক্রমে সৈয়দ তারিক, আহমদ মাযহার এবং আব্দুলাহ সাদী। একবিংশ-র ২৪তম সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়েছে ২০০৯-এর ফেব্র“য়ারিতে। এই সংখ্যাটি নানাদিক থেকেই গুরুত্বের দাবীদার। সম্পাদকের ভাষায় ‘একবিংশ-র বর্তমান সংখ্যাটির মূল প্রক্ষেপণ আধুনিকবাদ ও বুদ্ধদেব বসুর ওপর’। আধুনিকবাদ নিয়ে দীর্ঘ প্রবন্ধে খোন্দকার আশরাফ হোসেন স্পষ্ট করেছেন আধুনিকবাদী নানা আন্দোলন ও সেই কালখণ্ডের সামূহিক বিষয়কে। আলোচনার সাথে বেশকিছু আধুনিক ফরাসি কবির কবিতার অনুবাদ পাঠকের কাছে বাড়তি পাওনা হিসেবে মনে হয়েছে। বুদ্ধদেব বসুর জন্মশতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি হিসেবে তাঁকে নিয়ে রয়েছে ১১টি সুখপাঠ্য প্রবন্ধ। এই সংখ্যার সম্পাদকীয়-র বেশির অংশ জুড়েই রয়েছে আসামের কবি, প্রাবন্ধিক, সাহিত্যতত্ত্ববিদ তপোধীর ভট্টাচার্যকে নিয়ে আলোচনা, যাঁকে তিনি বলেছেন ‘তপস্যায় ধীর এক আচার্য’। এছাড়াও এ সংখ্যায় শূন্যের দশকের উল্লেখযোগ্য কয়েকজন কবির কবিতা মুদ্রিত হয়েছে।

অতঃপর ২৫ বছর পূর্তি সংখ্যার আয়োজন, সেই বিশাল আয়োজনে আমার এই ক্ষুদ্র লেখাটি একবিংশ-র দায় ও কৃতি নিয়ে খুব সামান্যই বলতে পেরেছে। একবিংশ-র কৃতি তার অসংখ্য সাহিত্যপ্রেমী পাঠক যারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে পত্রিকাটির পরবর্তী সংখ্যার জন্য। আমরা একবিংশ-র একশ বছর পূর্তির অপেক্ষায় থাকছি। জয়তু একবিংশ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন