শুক্রবার, ৯ এপ্রিল, ২০১০

দুই ভিন্ন শিল্পের সাধনসূত্র : স্থাপত্য ও কবিতা

সফিউল আজম মঞ্জু
দুই ভিন্ন শিল্পের সাধনসূত্র : স্থাপত্য ও কবিতা


১. প্রারম্ভ
আদি পিতা কি রোদ-বৃষ্টির উন্মথিত প্রান্তরে পথ খুঁজেই জীবনের ইতি টেনেছিলেন, নাকি বৃক্ষ-কোটরে, গুহার কন্দরে, পাথরের শরীরে শরীর এলিয়ে, পাথরের বেদনার আথে আপন বেদনার সংগতি খুঁজেছিলেন, সে কথা বলা কঠিন। তবু জন্মাদি-জন্ম পুরুষ-পরমপরায় সৃষ্টি হয়েছে-মহেঞ্জোদারো, বেবিলন, টায়ার, এথেন্স, ইলিয়াড, ওডিসি, মহাভারত কিম্বা আরব্যরজনীর জমকালো জীবনবিন্যাস। এই সৃষ্টিপ্রক্রিয়ায় কারা ছিল? কে আগে, কে পরে? না কবি, না স্থপতি, এরা কেউ নয়, ছিল শুধু চেতনার বিস্ময়কর দর্শন সে হোক কবিতা অথবা স্থাপত্য।
২. কবিতা ও স্থাপত্য
কবিতা শিল্পের আদিমতম, বিশুদ্ধ ও সুন্দরতম রূপ হিসেবে গণ্য। পাশাপাশি স্থাপত্য প্রযুক্তিনির্ভর হলেও, এ আরও প্রাচীন বলে দাবি করা যেতে পারে। কারণ মানুষ তার শুরু থেকেই চেষ্টা করছিল অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের প্রাথমিক চাহিদা নিশ্চিত করতে। স্থাপত্য তার কর্ম-পরিধি বাড়ালেও মানুষের আদিম বাসস্থান থেকেই যে তারা যাত্রা শুরু হয়েছিল, সে কথা মোটামুটি নিশ্চিত করে বলা যায়। তাই মানব জাতির আত্মিক ও মৌলিক চাহিদা পুরণের দুইটি ভিন্ন মাধ্যম হলেও উভয়ের যাত্রাকাল প্রায় সমসাময়িক এবং এদের উৎসরণ এক জায়গা থেকেই। আমাদের মেধায়-চেতনায়। সেখানেই শুরু হয় এদের আত্মীয়তার, এদের সৌন্দর্যের বোধন, এদের মিলনের সাধনসূত্র।
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন-“আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ”। আসলে সব বোধের শীর্ষ আমাদের চেতনায় এক হয়ে গেলেও বস্তুজগৎ গড়ে উঠেছে ভিন্ন ভিন্ন বস্তুগত স্বাতন্ত্র্য নিয়ে। সেখানে স্থাপত্য আর কবিতার ভিন্ন ভিন্ন সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে হয়। কবিরা কবিতা লেখেন, স্থপতিরা স্থাপত্য করেন আপন স্বকীয়তায় কিন্তু সেখানেও ব্যক্তি, সমাজ, মানবতার দায়বদ্ধতায় কবি ও স্থপতিকে একই পৃথিবীর মানুষ হতে হয়; তাদের হৃদয়কে উজ্জীবিত করতে হয় সত্যের সুমহান বারিধারায়।
যদিও চার হাত-পায়ে কবি স্থপতি সাদা-কালো মানুষ, তাদের হৃদয়ের, মননের, বুদ্ধির গতি আছে, আছে দুর্গতি। তাঁরা বেঁচে থাকেন কবিতা ও স্থাপত্যের জন্য। তাঁরা যোগানদারের কাজ করে যান। কারণ কবিতা ও স্থাপত্য স্বয়ম্ভূ। তারা আপন সময় থেকে জন্ম নেয়, আপন গতিতেই এগিয়ে যায়। ধন্য কবি ও স্থপতির হৃদয়Ñ সেখানে দেবীর মত তারা উদ্ভাসিত হয়। কবি ও স্থপতির নশ্বর হাত যন্ত্রের মত সে উদ্ভাসের শরীর গড়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়। কবির ভাষায় বলতে হয়Ñ
মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব-
থেকে যায়.....
আজকের আগের যেই জীবনের ভিড় জমেছিলো।
তারা মরে গেছে;
প্রতিটি মানুষ তার নিজের স্বতন্ত্র সত্তা নিয়ে অন্ধকারে হারায়েছে;
তবুও তারা আজকের আলোর ভিতরে
সঞ্চারিত হয়ে উঠে আজকের মানুষের সুরে
যখন প্রেমের কথা বলে
অথবা জ্ঞানের কথা বলে
(জীবনান্দ দাশ, ‘মানুষের মৃত্যু হলে’)১










এই সত্যদর্শন মূলত আবেগ, মনন-এর পতাকাবাহী। বুদ্ধিকে বুদ্ধি, বিত্তকে বিত্ত পর্যদুস্ত করবার জন্য সদাব্যস্ত। কিন্তু আবেগের কোন প্রতিযোগী নেই; তাই আবেগের অরুদ্ধ গতি মানুষকে নিয়ত মানবিক করে তোলে আর মনন মানবকে করে তোলে পরিশীলিত দ্রষ্টা। যে প্রকৃতির ভাষা বোঝে, সৈকতে একটি ধুলিকণা অথবা নভমণ্ডলের মৃতনক্ষত্রটিও যার কাছে অর্থবহ, তিনিই মানুষের নেতা, তাঁর বাক্যই কবিতা; তাঁর নির্মাণই স্থাপত্য! তিনি দেখেন এবং রেখে যান তাঁর দৃষ্টির অনুকৃতি। তিনি গড়ে তোলেন সময় ও স্থানের সম্পর্ক। এই সম্পর্ক প্রকৃতিকে অনুকরণের ফসল। কিন্তু শুধুই কি অনুকরণ? ঠিক তা নয়, তাহলে প্লেটোর কর্মকার আর দ্রষ্টা এক হয়ে যাবে।
তবুও অনুকরণ শিল্পের সামান্য ধর্ম, বোধের প্রকাশ। এরিস্টটল বলেছেন “অৎঃ রসরঃধঃবং হধঃঁৎব”২ কিন্তু এই প্রকৃতি হচ্ছে সৃজনীশক্তি সৃষ্টির নিয়মতন্ত্র। সৃষ্টি তার আপন নিয়মেই স্বাধীনতার দাবিদার, সেজন্য কাউকে অধীন বা বিনাশ করা সৃষ্টির উদ্দেশ্য নয়। পারস্পরিক সহমর্মিতা, পাশাপাশি দাঁড়ানোর জন্যই থাকে সৃষ্টি প্রচেষ্টা, এর জন্য চাই সৃষ্টির আপন অধীনতা। কবিতা ও স্থাপত্যের শরীর এই আপন অধীনতায় নত হয়ে বেড়ে ওঠে। এই আপন অধীনতার সংকেতন হচ্ছে-স্থান, কাল, রূপ, সুর, ছন্দ ইত্যাদি, যা সমস্ত বিশ্ব-প্রকৃতি মেনে চলছে। কিন্তু প্রকৃতির এই নিয়মানুবর্তিতা যন্ত্রের অনুরূপ নয়। যন্ত্র সামগ্রিকভাবে একটি সম্পন্ন বিষয়ে অথবা সমাপ্ত বিষয়Ñ যতক্ষণ না সে সমাপ্ত হচ্ছে ততক্ষণ সে যন্ত্র নয়। সুতরাং প্রকৃতি যন্ত্র নয়; প্রত্যেক মুহূর্তে প্রকৃতি রূপ পাল্টাচ্ছেÑ সকালে সে এক ভাষায় কথা বলে, বিকালে অন্য ভাষায়। নিয়ত তার পরিবর্তন হচ্ছে, তার গতি সময়ের সমান্তরাল, আর সময় হচ্ছে এক মহাচক্র, যার কোন কেন্দ্র নেই, আদি বা অন্ত নেই, আছে অভিঘাত, যে অভিঘাত থেকে জন্ম নেয় নীহারিকা, ছায়াপথ, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড, মানব-মহামানব, সভ্যতা। সভ্যতার প্রাঞ্জল-দলিল কবিতা ও স্থাপত্য সময়ের চক্রলতায় ফোটা ফুল; তারা সময়ের সৌরভ, বর্ণ নিয়ে ফুটে থাকে। যাঁরা দ্রষ্টা, গতিমান, তাঁরা সময়ের চাহিদা মোতাবেক প্রকৃতির মূর্তি এনে হাজির করেন মানুষে চত্বরে। তখন আমরা বলে উঠি, এই তো সেই কবিতা বা সৌধ, যা আমাদের হৃদয়ের সমান।
৩. কবিতা ও স্থাপত্য- পারস্পরিক সম্পর্ক
কবিতা ও স্থাপত্যের পারস্পরিক সম্পর্ক তাদের পাদপিঠ, স্থাপন, কাল, রূপ (ঋড়ৎস), সুর, ছন্দ ইত্যাদির ভেতর। আদি বাক্য-ধারা সময়ের সাথে সাথে যেমন রূপ পাল্টিয়েছে, আধুনিক থেকে অতি-আধুনিক হয়ে উঠেছে, ঠিক একই রকম অগ্রযাত্রা ঘটেছে স্থাপত্যেওÑ গুহা কিংম্বা স্টোন-হেঞ্জের যুগ পার হয়ে, কালে-কালে ক্লাসিক, মডার্ন, পোস্ট-মডার্ন ও বিনির্মাণের যুগে এসে উপনীত হয়েছে। যদিও একটি কবিতা সামান্য দ্বিমাত্রিক ক্ষেত্রে তৈরী হয়, কিন্তু এর প্রেক্ষাপট স্থাপত্যের মত ত্রিমাত্রিক। কখনো সময়কে আয়ত্ত করে তা চতুর্মাত্রিকতাও পেয়ে যায়। তাই সময়ের পরম্পরায় স্থান (ংঢ়ধপব) কবিতা ও স্থাপত্যে রূপনির্ধারক হয়ে এসেছে। এক অর্থে ব্যবহার









উপযোগী স্থান বা পরিসর (ংঢ়ধপব) নকশা করাই স্থাপত্যের উদ্দেশ্য। কিন্তু স্থানের সংজ্ঞা কি? আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছেন যে শক্তির ঘনীভূত রূপ হচ্ছে বস্তুনিচয়, আর মহাশূন্য হলো শক্তির দুর্বল গ্রন্থি। কিন্তু বস্তুনিচয় আর মহাশূন্যের পার্থক্য গুণগত দিকের চেয়ে পরিমাণগত ভাবে বেশি প্রকাশিত।৪
বোঝাই যাচ্ছে আমাদের ভাব জগৎ এখানে গাণিতিকভাবে পরিমিত। কিন্তু এটা হচ্ছে একটা দিক। অন্য দিকে প্লেটো বলেছেন যে ‘ংঢ়ধপব’ হচ্ছে বিশ্ব-প্রকৃতি, যে সমস্ত বস্তুনিচয় ধারণ করেও একই রূপে থাকে, বস্তুনিচয় ধারণ কালে সে নিজে রূপ থেকে বিচ্ছিন্ন হয় না; এবং কখনো গ্রহণ করে না তার ভিতরে ঢুকে-পরা বস্তুনিচয়ের রূপ; সে সকল বিষয়ের সহজাত ধারক এবং এই সকল বিষয় দ্বারাই সে সঞ্জীবিত এবং এদের কারণেই কালে-কালে এর রূপ ভেদ ঘটে।৫
প্লেটোর মহাশূন্য যেন ডিমের অন্তর্লোকে এলবুমিনসহ ভাসমান কুসুম। কুসুম হচ্ছে বস্তু-নিচয়ের উপমা। আমরা সেই কোন এক বস্তুনিচয় পৃথিবীর বাসিন্দা। মহাকর্ষে আটকে-থাকা দেহ ছেড়ে আমাদের মন উড়ে বেড়ায় দূর-ছায়াপথে। তারপর অজানার রহস্য এনে, কোন চিরশান্তির সম্ভাবনা নিয়ে পৃথিবীর মাটিতে কবিতার শেকড় গাড়ি; অথবা ছায়াপথের কোন নীল নক্ষত্রের দিকে চেয়ে অসীমকে আত্মীয় করে পিরামিড গড়ি।
৪. স্থাপত্য ও কবিতা: তুলনামূলক বিশ্লেষণ
কবিতা ও স্থাপত্যের পারস্পরিক তুলনামূলক বিশ্লেষণ করতে যাওয়ার আগেই জেনে নেয়া দরকার কবিতা ও স্থাপত্য কি? স্থাপত্য সম্পর্কে এর উত্তর যতটা সহজ কবিতা সম্বন্ধে ঠিক ততটা নয়। কবিতার বৈধ অর্থের সংখ্যা এত বেশি যে এর স্বভাব কিম্বা সুস্পষ্ট কোন সংজ্ঞা নির্ধারণ করা প্রায় অসম্ভব। যেমন ওয়ার্ডসওয়ার্থ বলেছেন “চড়বঃৎু রং ঃযব ংঢ়ড়হঃধহবড়ঁং ড়াবৎভষড়ি ড়ভ ঢ়ড়বিৎভঁষ ভববষরহমং” যখন কোলরিজ বলেছেন কবিতা হচ্ছে-“ইবংঃ ড়িৎফং রহ ঃযব নবংঃ ড়ৎফবৎ.” আবার কেউ কেউ বলেছেন কবিতা হচ্ছে শব্দ এবং শব্দই কবিতা।৬
কবিতা সম্পর্কে এই বিভ্রম প্রাচ্য কাব্যতাত্ত্বিকদের মধ্যেও বিদ্যমান, তবু তাঁরা স্বীকার করেন, যে কথায় রস থাকে, তাই কাব্য বা কবিতা, আর এখানেই কবিতা ও স্থাপত্যের সবচেয়ে বড় সম্পর্কটি সৃষ্টি হয়েছে।








৫. কবিতা ও স্থাপত্য : কয়েকটি সাধারণ বিষয়-এর আলোচনা
কবিতা বা স্থাপত্যে অভিজ্ঞতাকে সংহত ভাবে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ইমেজের জন্ম হয়েছে। ইংরেজি ইমেজ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত কৃত বাংলারূপ চিত্রকল্প, প্রকৃত অর্থে এক ধরনের চিত্রোপমা; ফরাসী সমালোচক দিদেরো একে বলেছেন “যবরৎড়মষুঢ়যরপ ঢ়ধরহঃরহম” অর্থাৎ “চধরহঃরহম হড়ঃ ঃড় ঃযব বুব নঁঃ ঃড় ঃযব রসধমরহধঃরড়হ.” আর শেলির কাছে ওসধমরহধঃরড়হ অমর ঈশ্বর, আর তিনি নিজে তাঁর প্রেরিত পুরুষ।৭ তাই ইমেজ কবি বা স্থপতির আত্মার গভীর সংকেত বহন করে। ইমেজ অন্তর্দৃষ্টির বা ইন্দ্রিয়বেদ্য অনুভূতির প্রকাশ। চিত্রকল্প তাই সাধারণ চিত্র নয় তারও অধিক। রবীন্দ্রনাথের চিত্রোপমার বিশ্লেষণ প্রসংগে বুদ্ধদেব বসুর উক্তিÑ “উপমা, উপেক্ষা, চিত্রকল্প এমন কি প্রতীকÑ এই সব গুলোই উপমার অভিজ্ঞানের মধ্যে ধরে নিতে হবে। শুধু মতো থাকলেই উপমা হলো তা নয়। ভাব যেখানে ছবি হয়ে উঠেছে, কিন্তু সেখানে স্পর্শসহরূপ নিল সেখানেই কোন না কোন, সূক্ষ্ম চতুর লুক্কায়িত উপায়ে উপমার ব্যবহার অনিবার্য।”৮ কিন্তু সাধারণ চিত্রগুলোকে ধরেই চিত্রকল্পের জন্ম, অনেকটা মাটিতে পা রেখেই আকাশ ছোঁয়ার সুযোগ করে দেয় চিত্রকল্প। আবুল হাসানের মিসট্রেসঃ ফ্রি স্কুল স্ট্রিট ‘কবিতার চিত্রোপমা’Ñ
প্রতিদিনই এরকম প্রতিটি পাখিকে,
যেন ক্লিপের মতোন
অই বনভূমি গেঁথে নেয় তার
স্নিগ্ধ সবুজ খোঁপায়, ভোর বেলা
ময়ূর পেখমের মতো খোলা রোদে বসে।৯
কবি পাখি আর প্রকৃতির সমম্বয় ঘটিয়েছেন ক্লিপের বন্ধনে, যে ক্লিপ কবির দয়িতার কাঁকন-কর্ষিত চুলে রূপের আরাধ্য, অথবা তিনি দয়িতার কেশচর্চার দৃশ্য হৃদয়ে প্রশস্ত করেছেন, প্রকৃতি দর্শনের উপমায়। এভাবে তিনি আমাদেরকে কয়েকটি দৃশ্যের ভিতর নিয়ে ছেড়ে দেন। তারপর আমরা নিজেরাই দৃশ্যের অর্থসঞ্চার করি, যার যে-রকম ইচ্ছে, যে যে-রকম ভাবে দেখতে ভালবাসি। তখনই সাধারণ দৃশ্যগুলো আরও বিশাল অর্থময়তা লাভ করে।
ইমেজ বা চিত্রকল্প দৃষ্টির কাজে কবি বা স্থপতি তাঁর কর্মে দৃশ্য (ংড়ষরফ) ও অদৃশ্য (াড়রফ) কে পাশাপাশি সাজিয়ে অভিনব দৃশ্যপাত ঘটান। যে দৃশ্য অবশ্যই সজীব, প্রাণময়-মহানের দিকে ধাবিত, সময় যার অনুষঙ্গ। বিশেষত স্থাপত্যের ক্ষেত্রে একথা বিশেষভাবে প্রযোজ্য।
একটি স্থাপত্যকর্ম প্রকৃতির প্রেক্ষাপটে নিজেকে ফুটিয়ে তোলে। দৃশ্যে ও অদৃশ্যে স্থাপত্যের প্রাথমিক শারীরিক প্রকাশ। দৃশ্য ও অদৃশ্যের সার্থক সমন্বয়ে স্থাপত্যের ইমেজে’র জন্ম। প্রাসংগিকভাবে লুই কানের সংসদ ভবন, ঢাকার কথাই বলা যেতে পারে। এই স্থাপত্যকর্মে ভবনের বলিষ্ঠ দেয়ালগুলোর শরীর যে বিরাট জামিতিক ছিদ্রগুলো করা হয়েছে তার প্রতিটির পিছনেই আছে ভিতর দেয়ালের অসংখ্য জানালা, যারা বহির্দৃশ্যের বিরাট ছিদ্রগুলো সমন্বিত করে সামগ্রিকভাবে এক বিশালত্বের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এইগুলো হচ্ছে ভবনের চোখ, যায় ভিতর দিয়ে ভবন ও প্রকৃতি নিকটবর্তী হয়েছে।
স্থাপত্য কবিতার মত শুধু ভাবের ত্রিমাত্রায় সীমাবদ্ধ নয়, তার প্রত্যক্ষ বাস্তবতা আছে। স্থাপত্যের ভিতর-বাহির প্রায়শই সমান গুরুত্ববাহী; তার বহিরাংশের মত ভিতরাংশও এক প্রকার কল্পনার বাস্তবতা। যে বাস্তবতার ভিতর আমরা ঘুমাই; ঘুরি, বসবাস করি।
জরপযধৎফ গবরবৎ বলেছেন. “অৎপযরঃবপঃঁৎব রং ারঃধষ ধহফ বহফঁৎরহম, নবপধঁংব রঃ পড়হঃধরহং ঁং, রঃ ংঁনংঃধহঃরধঃবং ঃযব ংঢ়ধপব বি ষরাব রহ, সড়াব ঃযৎড়ঁময ধহফ ঁংব”১০ সারকথা হচ্ছে আমাদের চেতনায় এর রয়েছে সার্বক্ষণিক প্রভাব। তাই স্থপতিকে এখানেও ভাবতে হয়, এখানেও তাকে দৃশ্যের অবতারণা করতে হয়। কারণ দর্শনেই জীবন শুরু। বহিরঙ্গে স্থাপত্য বিশ্বব্যাপি, সেখানে স্থাপত্য দিন ও রাত্রির ভুবন জোড়া আলো-অন্ধকারের ভিতর ব্যাপ্ত। কিন্তু ভিতরাঙ্গে সে সন্তরমান আলো-অন্ধকারের ধারক। লুই কান বলেছেন যে, স্থপতিরা অতিশয় শক্তিধর, তাঁরা দিনকে রাত এবং রাতকে দিন করতে পারেন। এখানে তিনি এই ভিতরঙ্গের কথাই নির্দেশ করেছেন। প্রায়শই ভিতরঙ্গের পরিসর নক্সা, দৃশ্য পাতন বহিরঙ্গের বিপরীত। বহিরঙ্গের বোধকে শরীর দিয়ে উজ্জীবিত করার চেষ্টা, চলে, ব্যবহারিক তলগুলো আনুভূমিক, উল্লম্ব তলগুলো আনুভূমিক তলগুলোকে সীমাবদ্ধ করে। ভিতর বাহির সৃষ্টি করে। আবার কোথাও কোথাও উল্লম্ব তল নাই হয়ে ভিতরকে অধিক উপযোগী করে তোলে, বাহিরের সাতে আত্মীয়তা ঘটিয়ে। আনুভূমিক, উলম্ব, কৌণিক ইত্যকার তল হচ্ছে স্থপতির কাঁচামাল, তাকে তিনি বস্তুগত চাহিদায় সাজান কল্পনার মাধুর্যে। এই জন্য যে-কোন স্থাপত্য কর্মই শুরুতে চেতনার জগতে থাকে, তারপর বাস্তবতা পায়। পরিশেষে সে নিজেই চেতনার নতুন জগৎ তৈরী করে অসীম হয়ে ওঠে। লুই কানের স্থাপত্য সম্বন্ধে এরকম ধারণকেই প্রকারান্তরে স্থাপত্যের চিত্রকল্পনির্ভরতা বলা যায়। জীবনানন্দ দাশ লিখেছেনÑ
ফাল্গুনের অন্ধকার নিয়ে আসে সেই সমুদ্র পারের কাহিনী,
অপরূপ খিলান ও গম্বুজের বেদনাময় রেখা.....
রামধনু রঙের কাচের জানালা,
ময়ূরের পেখমের মতো রঙিন পর্দায় পর্দায়
কক্ষ ও কক্ষান্তর থেকে আরো দুর কক্ষ ও কক্ষান্তরের
ক্ষণিক আভাসÑ
আয়ুহীন স্তব্ধতা ও বিস্ময়।
(নগ্ন নির্জন হাত, বনলতা সেন)১১
সার্থক স্থপতির চিত্রকল্প সৃষ্টি, খিলান ও গম্বুজের সাধারণ জ্যামিতিক পরিমিতি লয় হয়ে যখন জন্ম দিচ্ছে বেদনার, ভালাবাসার, সভ্যতার গভীর সংকেত।
স্থাপত্য ও কবিতার তুলনামূলক বিচারে নিদেনপক্ষে আরো একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। তা হচ্ছে প্রতীক কোন বিশেষ অর্থ নিয়ে যাত্রা শুরু করে, পরিশেষে তা বহু অর্থের ধ্বনি তোলে। এটাই প্রতীকের সার্থকতা।









উইলিয়াম গোল্ডিং তাঁর ‘স্পায়ার’ গল্পে পুরোহিতকে দিয়ে চার্চের উপর একটা স্পায়ার টাওয়ার বসাচ্ছেন। পুরোহিতের বিশ্বাস ঐ টাওয়ার ঈশ্বরের সার্বভৌমত্ব ঘোষণা করছে। কিন্তু এই স্থাপত্যকর্মটি প্রধান নির্মাতার কাছে ঈশ্বরের প্রতি উচ্ছ্রিত শিশ্ন। এ হচ্ছে স্থাপত্যের অতিপ্রতীকধর্মিতার এক রূপক-সাহিত্যিক প্রকাশ। যেমনটা উইলিয়াম গোল্ডিং তার ‘পিরামিড’ গল্পেও দেখিয়েছেন, যেখানে পিরামিড সামাজিক স্তরবিন্যাসের প্রতীক। প্রকৃতপক্ষে যে-কোন কবিতার মত স্থাপত্যের প্রতীকীকরণ যুগপৎভাবেই ঘটে যায়। এর ফলে, আবাসগৃহ, প্রাসাদ, ধর্মমন্দির বিবিধভাবে অলঙ্করণের পরেও আপন পরিচয় বিধৃত করে।
৫. কংক্রিট কবিতা : কবিতার স্থাপত্যের ব্যবহার
কবিতায় স্থাপত্যের নির্মাণশৈলী বিবিধভাবে ব্যবহৃত হয়েছে যুগে যুগে। কবিতায় স্তবকবিন্যাস, মুদ্রিত পৃষ্ঠায় ছোটবড় পঙক্তির অবস্থিতি কবিতাকে দৃশ্যগ্রাহ্য রূপ দেয়। অনেক সময় এই দৃশ্যগ্রাহ্যতাকে কবিতার বক্তব্যের চেয়েও মূল্যবান হিসাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা হয়েছে। কংক্রিট কবিতা (ঈড়হপৎবঃব চড়বঃৎু) এমন একটি প্রয়াস। খোন্দকার আশরাফ হোসেন একবিংশ-র একটি সংখ্যায় কংক্রিট কবিতা নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছিলেন।১২ সপ্তদশ শতকের কবি জর্জ হার্বার্ট তাঁর কবিতায় পঙক্তিবিন্যাসকে একধরনের স্থাপত্যিক নির্মিতি দিতে চেষ্টা করেছেন; তাঁর কালে অবশ্য এর নাম ছিল ঊসনষবস চড়বঃৎু. এখানে হেরিকের ঞযব চরষষধৎ কবিতাটি এবং বর্তমান কালের একটি কংক্রিট কবিতার উদাহারণ দেওয়া হচ্ছে।
৬. কবিতা, স্থাপত্য ও তাদের দর্শন
দর্শনের উদ্দেশ্য দৃষ্টিপাত করা। রহস্যের ঘোমটা খুলে সত্যে উপনীত হওয়াই দর্শনের কাজ। সত্যকে সে ব্যক্ত করে সহজ, সরল সাবলীল ভাষায়। কিন্তু এখানেই শিল্পময় শাখাগুলোর সাথে অন্যদের তফাৎ রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ স্পষ্টতই বলেছেন, “মানুষের বুদ্ধিসাধনার ভাষা আপন পূর্ণতা দেখিয়েছে দর্শনে বিজ্ঞানে, হৃদয়বৃত্তির চূড়ান্ত প্রকাশ কাব্যে। দুইয়ের ভাষায় অনেক তফাৎ: জ্ঞানের ভাষা যতদুর সম্ভব পরিষ্কার হওয়া চাই তাতে ঠিক কথার ঠিক মানে থাকা দরকার। সাজসজ্জার বাহুল্যে সে যেন আচ্ছন্ন না হয়।”১৩
একথা মেনে নিয়েও বলা চলে যে কাব্যে হৃদয়বৃত্তির চুড়ান্ত প্রকাশ ঘটলেও দর্শন-বিজ্ঞানও কবিতার বিষয়ীভূত, এবং যেহেতু কবিতার বিষয় বলে কোন স্বতন্ত্র বিষয় নেই সে কারণে দর্শন-বিজ্ঞানেরও কবিতার বিষয় হতে কোন বাধা নেই, কেননা জগৎ চরাচরে সবকিছুই কবিতার উপজীব্য হতে পারে, যদি কাব্য রচয়িতার কবিতাজননের শক্তি থাকে। কিন্তু স্থাপত্যে বিজ্ঞানের বিষয় যেভাবে ধরা দেয় ঠিক সেভাবে নয়। স্থাপত্যের কাজ শুধু আনন্দ দেয়া নয়, ব্যবহারিক প্রয়োজনকে অনুপুঙ্খ সহজ সরল ভাবে বিন্যস্ত করাই স্থাপত্যের কাজ।


স্থাপত্যের মূল লক্ষ্য কোন বিশেষ প্রয়োজনকে সাধন করা এবং এর উদ্দেশ্য প্রকাশ করা হলেও, কবিতার পক্ষে এমন উদ্দেশ্য প্রবল হয়ে ওঠা বিচিত্র কিছু নয়। তাহলে এদের মধ্যে মূলগত পার্থক্য কোথায়? এ প্রশ্নের বহুবিধ উত্তর হতে পারে, তবে সহজ কথায় বলা যায় স্থাপত্য বরাবরই কোন বিশেষ উদ্দেশ্য পুরণের জন্য যাত্রা শুরু করে যেখানে কবিতা প্রায় ক্ষেত্রেই অভিজ্ঞতাসঞ্জাত আবেগ ও অনুভূতির দৈবাৎ স্ফুরণ। যুক্তি ও শৃঙ্খলাবোধ এক্ষেত্রে কোন অপরিহার্য আবশ্যিক শর্ত নয়। কিন্তু স্থাপত্যের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অনেকটা বিপরীত। স্বপ্ন কল্পনা, আবেগ অনুপ্রেরণার পথ ধরে আসা স্থাপত্যের জন্য অপরিহার্য নয়, যদিও এ পথে এলে স্থাপত্য অনেক সময় প্রাণবান এবং শিল্পরূপময় হয়ে ওঠে। প্রধানত যুক্তি-শৃংখলা মেনে অগ্রসর হওয়াই স্থাপত্যে আবশ্যিক। কবিতা জীবন ও সমাজের প্রতিচ্ছবি। কারণ কবিতা শুধুই আদি শিল্পরূপ নয়, এ চিরকালই অন্যান্য মাধ্যমের চেয়ে গভীরভাবে জীবন ও সমাজের কথা বলেছে। কিন্তু স্থাপত্য চিরকাল সবার জন্য ছিল না। এ কেবল সমাজের বিত্তশালী, রাজা, মহারাজা, সম্রাটদের আওতাধীন ছিল। কালক্রমে ‘গণমানুষের স্থাপত্য’ ‘সবার জন্য স্থাপত্য’ ইত্যাদি সার্বজনীন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তবে তার সার্থকতা মোটেও তর্কাতীত নয়।
কবিতা যদিও কবির ব্যক্তিমানসের উপর নির্ভর করেই প্রকাশিত হয় এবং কবিতার জন্মমুহূর্তে যদিও কবি একান্তভাবে নিঃসঙ্গ ও আপনজগতের বাসিন্দা, সামাজিক পরিবেশেই তার চেতনার ভিত স্থিত। যার ফলে তাদের কাব্যে বৃহত্তর প্রাকৃতিক, সামাজিক ও মানবিক দিক প্রতিফলিত হয়েছে। এই সামাজিক জীবনের প্রতিফলন নির্ভর করে কবি ও তার সমাজের পারস্পরিক সম্পর্কের ব্যাপ্তি ও গাঢ়ত্বের উপর।
এদিক দিয়ে স্থপতিকে সব সময় সমাজ সচেতন থাকতে হয়। কারণ একটি স্থাপত্য কর্মকে ঘিরেই মানুষের জীবন যাপন। বলা যায় আরও বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে একটি শহরই নির্ধারণ করে তার নাগরিক জীবনব্যবস্থা। যদিও শহরের জন্ম হয় এর বিপরীত ক্রমে, অর্থাৎ নাগরিকগণই প্রথমে নগর গড়ে তোলেন। তাই গতিশীল স্থাপত্য সমাজের প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনার দ্বারা প্রভাবিত হয়। এরই ফলে স্থাপত্যে ক্যাম্প, নন ক্যাম্প, পপ, নন পপ, আন্দোলনগুলো স্থান করে নিয়েছিল।
কবিতা ও স্থাপত্য ধর্মতত্ত্ব, সামাজিক বিশ্বাস, ঐতিহ্য বিবিধ আঞ্চলিক প্রভাবকে আত্মস্থ করে এক উজ্জ্বল বর্তমান ও সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের নির্দেশনা দেয়। তাদের উদ্দেশ্য অভিন্ন বলে, তারা ভিন্ন মাধ্যমেও একই কথা বলে। জরপযধৎফ গবরবৎ তাঁর অৎপযরঃবপঃ গ্রন্থের মুখবন্ধে বলেছেন, তার পুত্র সবুজ রং পছন্দ করে কারণ বিশ্বপ্রকৃতি সবুজে অবগুণ্ঠিত। তাঁর কন্যার পছন্দ আকাশের নীল রং। কিন্তু তিনি স্থাপত্যকর্মে সাদাকে প্রাধান্য দিয়েছেন, যেহেতু সাদার প্রেক্ষাপটেই সব রং প্রকৃত ভাবে ফুটে ওঠে। এমনকি রংধনুও। সাধা স্বয়ম্ভর, শান্তি ও ঐতিহ্যময়।১৪ দেখা যাচ্ছে তিনি সাদার বিশ্বজনীন আবেদনকে গভীরভাবে মূল্যায়ন করে স্থাপত্যের সার্বজনীন বিশ্বাস ও ঐতিহ্যকে বেগবান করেছেন। আমাদের বাংলার যে ইতিহাস সামাজিক বিশ্বাস, ধর্মবোধ ইত্যাদি কালে-কালে বিদ্যাপতি, মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের লেখার প্রেক্ষাপট যুগিয়েছে সেই প্রেক্ষাপটেই গড়ে উঠেছে পাহাড়পুর, মহাস্থানগড়, গৌড়, কিংবা কান্তজীর মন্দির ও জোড় বাংলাঘরের মত অজস্র মৃত্তিকার স্থাপত্য।
কবিতা হচ্ছে মুখের ভাষা আর স্থাপত্য হচ্ছে দৃষ্টির ভাষা। কিন্তু এর দু’জনেই একই সাথে ভাবের ভাষা। স্থাপত্যের ভাষা কবিতার ভাষার চেয়ে অনেক বেশি ইঙ্গিগতময় এবং প্রতীকাশ্রিত। কবিতায় জানালা, আলো, সূর্য, জীবন ইত্যাদি অনেকগুলি শব্দ যে বক্তব্য পেশ করে, সেখানে স্থাপত্যকর্মের কোন একটি উপযুক্ত পাঞ্চ (ঢ়ঁহপয)-ই যথেষ্ট।
কবিতায় ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে শব্দচেতনার কথা আসে। উল্লেখনীয় যে, শব্দ কথাটিও বলতে গেলে ধ্বনিরই অন্য নাম। এই ধ্বনিকে আশ্রয় করেই কবিতাকে চলতে হয়, তার শারীরিক অস্তিত্বে রং, সুর, প্রকৃতি, দৃশ্য, অদৃশ্য ইত্যাকার সবকিছুকেই ছন্দোবদ্ধভাবে ধ্বনিত হওয়া ব্যতিরেকে দ্বিতীয় কোন প্রকাশ অসম্ভব। তদুপরি কবিতার ভাষা কোন জাতিগোষ্ঠির ভাষা। স্থাপত্যের ভাষা আন্তর্জাতিক, অনেকটা হাসি-কান্নার মত, ফুলের সৌন্দর্য্যরে মত, নৈঃশব্দের শব্দ।
কাব্যের উৎকর্ষ যেমন একটি বিশিষ্ট সমাজ বা জাতির আবেগের গভীরতা, চৈতন্যের তীক্ষ্মধার অনুভূতি এবং আকৃতির ব্যাপ্তিকেই সপ্রমাণ করে, তেমনি স্থাপত্যের বিকাশ, সমৃদ্ধি ও উৎকর্ষে রূপ পায় তার মনীষার পরিচয়।
দর্শনেই স্থাপত্যের শুরু। মহাজাগতিক চেতনা কিম্বা মানবিক চাহিদা অথবা নিত্যদিনের ব্যবহারিক চাহিদার ধরনই স্থাপত্যের রূপ (ভড়ৎস) দেয়। গড়ে উঠে ঘর-বাড়ি, শহর, দুর্গ অথবা তাজমহলের মত হিমায়িত সংগীতÑ যার গম্বুজগুলো অবতল আকাশের সমান্তরাল হয়ে উঠা এক আকাক্সক্ষা; যে আকাশের নীচে থাকে রৌদ্র-জোৎস্না। মানুষের চিরায়ত সুখ-দুঃখের কাহিনীময় জীবন। কিম্বা যে আকাশের গায়ে পেরেকবিদ্ধ জোনাকির মত জ্বলছে স্বাতি, ধ্র“ব, লুব্ধক, আর লাবণ্যময়ী চাঁদ, তাদের কাছে কিংবা তাদেরকে ফেলে আরো দুর ছায়াপথে উড়ে যাবে মিনারগুলো।
৭. উপসংহার
সূর্যের সাত রঙ এক হয়ে যে জীবনদায়িনী শুভালোক সৃষ্টি করেছে স্থাপত্য ও কবিতার সৃষ্টিশীল কল্যাণমুখী ব্যাপ্তি সেই আলোকের উচ্চকিত প্রতিধ্বনি। এরা উভয়ে সময়ে সাক্ষ্যবাহী। ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনের উত্থান-পতনের রূপময় স্মৃতি। তাই কবিতাও স্থাপত্য তাদের ব্যাপ্তির সমস্ত পথে লতার মত জড়িয়ে আছে। কোন ফুল যেমন তার, রূপ, রং, মধু, সৌরভ দিয়ে শুধু নিজেকেই গৌরী করে তোলে না, তার পারিপার্শ্বকেও মহিমান্বিত করে তোলে। স্থাপত্য ও কবিতাও অনুরূপ। তারা আমাদের মেধা ও মননের সুমহান পরিচায়। স্থপতি সারেনিন এর মত সকল স্থপতির কাম্য হোক শিল্পের চূড়ান্ত শীর্ষ। যেকানে স্থাপত্য হয়ে উঠবে কাব্যময় আর কবিতা হবে সভ্যতার নির্মাণের স্বাক্ষর।
তথ্যসূত্র :
১. জীবনানন্দ দাশ কাব্য সমগ্র, আবদুল মান্নান সৈয়দ সম্পাদিত, অবসর, ঢাকা, ১৯৯৪
২. ডঃ সাধন কুমার ভট্টাচার্য, এরিস্টটলের পোয়েটিক্স ও সাহিত্যতত্ত্ব, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা।
৩. ঔড়ৎমবং খড়ঁরং ইড়ৎমবং, ‘ঈরৎপঁষধৎ জঁরহ’
৪. জ.এ.ঈড়ষষরহম ডড়ড়ফ, ঞয ওফবধ ড়ভ ঘধঃঁৎব
৫. ঐ
৬. হেলাল আহমেদ, সাম্প্র্রতিক বাংলা কবিতায় অলঙ্কার জিজ্ঞাসা, রূপম প্রকাশনী, ঢাকা।
৭. ঐ
৮. ঐ
৯. ঐ
১০. জরপযধৎফ গবরবৎ. অৎপযরঃবপঃ
১১. জীবনানন্দ দাশ কাব্য সমগ্র, পূর্বোক্ত।
১২. খোন্দকার আশরাফ হোসেন, ‘শাস্ত্রবিরোধী কবিতা, ঝড়ঁহফ, ঋড়ঁহফ, ঈড়হপৎবঃব’ একবিংশ, মার্চ-১৯৯২, পৃ. ৫২-৭২
১৩. মোহাম্মদ মাহফুজুল্লাহ, কবিতা ও প্রসঙ্গ কথা
১৪. জরপযধৎফ গবরবৎ, অৎপযরঃবপঃ.

(একবিংশ ১৪/ফেব্রুয়ারি ১৯৯৫ সংখ্যা থেকে পুনর্মুদ্রিত)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন