শুক্রবার, ৯ এপ্রিল, ২০১০

একবিংশের প্রথম যুগ : রফিক উল্লাহ খান

রফিক উল্লাহ খান
একবিংশের প্রথম যুগ
শিল্পের স্রোতোধারার আদ্যন্ত অবিচ্ছিন্নতার ইতিহাস বিশ্লেষণ করে নির্দ্ধিধায় বলা যায় : শিল্পের ইতিহাস আসলে কবিতার ইতিহাসÑ তার জন্ম-নবজন্ম-পুনর্জন্মের ইতিহাস। আদিমানবের সৃজনযন্ত্রণার সঙ্গে অনাদি যুগের সৃষ্টিসম্ভাবনার যোগসূত্র কেবল কবিতাই রচনা করতে পারে। আধুনিক বাংলা কবিতার পালাবদলের বিভিন্ন পর্যায়ে সাময়িকপত্র দিগদর্শনের ভূমিকা পালন করেছে। উল্লেখ্য যে, এইসব উদ্যোগে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গোষ্ঠী অপেক্ষা ব্যক্তির অবদানই মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। গোষ্ঠী-উদ্ভূত না হলেও এইসব পত্র-পত্রিকা অনেকসময় শিল্পের আদর্শ ও রীতি-ভিত্তিক গোষ্ঠীতেও পরিণত হয়েছে। কিন্তু স্বতন্ত্র ব্যক্তিসত্তা হিসেবেই একজন কবি বা শিল্পীকে আত্মপ্রকাশ করতে হয়। সমাজায়ত বিচিত্র অনুভূতির প্রকাশ সত্ত্বেও একজন কবির ব্যক্তি-অভিজ্ঞতার শিল্পিত, ব্যক্তিত্বচিহ্নিত প্রকাশই কবিতাকে দীর্ঘজীবী করে।

খোন্দকার আশরাফ হোসেন সম্পাদিত কবিতাপত্র ‘একবিংশ’-এর ২৫ বছরের সৃষ্টিসম্ভার সামনে রেখে এ-কথাগুলোই এসে গেল অনিবার্যভাবে। বিংশ-একবিংশ শতাব্দীর সন্ধিক্ষণ থেকে দেড় দশক পেছনে থেকেও ‘একবিংশ’ নামকরণের মধ্যে যে সদম্ভ আত্মঘোষণা আছে, তা প্রতি মুহূর্তের নবজন্মের সঙ্গে আগামী শতাব্দীর অন্তরঙ্গ যোগসূত্র রচনারই কেবল ইঙ্গিত দেয় না, বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের কবিরা একবিংশ শতাব্দীর উপযোগী কাব্য-ভূমিতলও যে সৃষ্টি করে চলেছে তা-ও সুষ্পষ্ট করে তোলে। আশির দশকের মধ্য পর্যায়ে ১৯৮৫-তে নতুন প্রজন্মের পত্রিকা ‘একবিংশ’-এর আত্মপ্রকাশ ঘটে। ফেব্র“য়ারী ২০০৯ -তে প্রকাশিত হয়েছে পত্রিকাটির ২৪ তম সংখ্যা। বিগত আড়াই দশকের বাঙালি তরুণ কবিদের আবেগজীবন ও মননঋদ্ধ শিল্পচর্যার নিগূঢ় ইতিহাস এই সংখ্যাগুলো থেকে অনুধাবন করা সম্ভব। তবে এই প্রবন্ধে আমি শুধু একবিংশ-র প্রথম ১২ বছরে প্রকাশিত সংখ্যাগুলো নিয়ে সামান্য আলোচনা করব।

‘একবিংশ’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যার সম্পাদকীয়-তে এর দৃষ্টিভঙ্গি ও আদর্শের প্রতিফলন ঘটেছে। একবিংশ শতকের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে, ‘নতুন শতাব্দী, নতুন সময় এবং নতুন অভিজ্ঞতার বোধন’-কে সামনে রেখে, বাংলা কবিতার ‘প্রখর দুঃসময়’ পীড়িত সময়খণ্ডের অনুভব থেকে সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছেÑ

‘একবিংশ’ কেবল নতুন প্রজন্মের কবি-লেখকদের জন্য নির্দিষ্ট। যারা অপ্রতিষ্ঠিত, যৌবনাবেগে টলমল, প্রতিভাবান, উদার অভিনিবিষ্ট, শ্রমী এবং নির্ভয়, আমরা তাদের জন্য পাটাতন নির্মাণ করতে চাই। কবিতা, শুধু কবিতা এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ক প্রবন্ধ, কবিতালোচনা, কাব্যগ্রন্থ ও কাব্য বিষয়কগ্রন্থ সমালোচনা প্রতি সংখ্যা একবিংশ-র সূচীতে থাকবে।

এক নতুন প্রজন্ম তৈরির সদম্ভ আত্মঘোষণা যে কেবল বাগাড়ম্বর নয়, পত্রিকার প্রথম সংখ্যা থেকেই তার পরিচয় পাওয়া যায়। এ-প্রসঙ্গে প্রথম সংখ্যার সূচী বিশ্লেষণ করে দেখা যেতে পারে। এ-সংখ্যায় তিনটি প্রবন্ধ অন্তর্ভুক্ত হয়। যেমন- ১. ‘শিল্পের প্রকাশ ও তার ভাষা, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম; ২. ‘ভিন্ন শিল্পের প্রয়োগসূত্রে কবিতা’ সাজ্জাদ শরীফ; ৩. ‘দুই বিঘা জমি’ঃ ঈদিপাস গূঢ়ৈষা ও অন্যান্য অনুষঙ্গ,’ সৈয়দ তারিক। প্রবন্ধগুলোর নামকরণের মধ্যেই এর নান্দনিক অভিরুচি ও বক্তব্যের অভিনবত্বের স্বাক্ষর সুষ্পষ্ট। খোন্দকার আশরাফ হোসেন, ইকবাল আজিজ ও রেজাউদ্দিন স্টালিনের দীর্ঘ কবিতা এবং মোহাম্মদ সাদিক, তুষার দাশ, রানু ইসলাম, ফখরে আলম, শান্তনু চৌধুরী, দাউদ আল হাফিজ, মোহাম্মদ কামাল, ফরিদ কবির, বদরুল হায়দার প্রমুখের কবিতায় যে সংরক্ত জীবনাবেগ অভিব্যক্ত হয়েছে, তা নিঃসন্দেহে সমকালস্পর্শী। ‘এই প্রজন্মের চোখ’- এ শামসুর রাহমানের ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতার নির্মোহ আলোচনার মধ্যেও কবিতাবিচারের একটি নতুন অভিনিবেশ প্রযুক্ত হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, ‘একবিংশ’ পত্রিকা যাত্রালগ্নেই তার প্রতিশ্র“তি বাস্তবায়নে অনেকাংশে সমর্থ হয়েছে।

দ্বিতীয় সংখ্যা থেকেই ‘একবিংশ’ কবিতার বিচিত্র উৎসে পরিভ্রমণ করেছে। বাংলাদেশে কবিখ্যাতি ও কাব্যসমালোচনার ক্ষেত্রে একটা দৈন্য বিভাগোত্তর কাল থেকে লক্ষ করা যায়। দু-একটি ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক কাব্যচেতনাপ্রবাহকে জাতীয় চেতনাশৃঙ্খলায় বিন্যস্ত করার ক্ষেত্রে যে অধ্যয়ন, মনোনিবেশ ও সর্ববন্ধনমুক্ত জীবনাবেগের প্রয়োজন সমাজ ও রাষ্ট্রের জাতিসত্তার মৌল চেতনাবিরোধী অবস্থানের ফলে তা বার বার বাধাগ্রস্ত হয়েছে। সীমাহীন সৃজনীসম্ভাবনা নিয়ে যে-সকল কবি বিভিন্ন দশকে যাত্রা শুরু করেছেন, খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠার মোহে তাঁদের অধিকাংশকেই আত্মবিক্রয় করতে হয়েছেÑ কখনো রাষ্ট্রের কাছে, কখনো মৌলবাদের কাছে। ফলে, আমাদের কবিতাও একধরনের আবেগহীন শব্দাভ্যাসে পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্র কিংবা মৌলবাদ যাঁদের গ্রহণ করেনি, তাদের আশ্রয় জুটেছে কখনো দৈনিক পত্রিকার বিশেষসংখ্যায়, কখনো বাংলা একাডেমীর বটতলায়, কখনো মা-লক্ষ্মীর প্রসাদগুণে বিদেশী সাহায্য সংস্থার পদ্যসম্মেলনে। ‘আবেগহীন শব্দাভ্যাস’ এ-কারণে বলছি যে, বাংলা কবিতার মান এখন এমন পর্যায়ে পৌছে গেছে, যে-কোনো স্বশিক্ষিত ব্যক্তির পক্ষেও জীবনানন্দীয় শব্দবিন্যাসÑকৌশল আয়ত্ত করা সম্ভব। ‘একবিংশ’ পত্রিকা আগামী শতাব্দীর জন্য যে কাব্যভূমিতল নির্মাণ করতে চায়, তার পেছনের ইতিহাসের অনুধাবন অত্যন্ত প্রয়োজনীয় মনে করেছেন সম্পাদক। আন্তর্দেশীয় শিল্পচেতনার আন্তঃক্রিয়া আমাদের কবিতাকে যে ঋদ্ধ করতে পারে, মাইকেল মধুসূদনের কাল থেকেই তা আমাদের জানা। দ্বিতীয় সংখ্যায় কবিতা ও শিল্প বিচারের একাধিক নতুন বিভাগ পরিকল্পিত হয়েছে। ‘বিদেশ বৈভব’ অংশে লোরকা, হাইনরিশ হাইনে, গাব্রিয়ালা মিসত্রাল প্রমুখের কবিতার অনুবাদ স্থান পেয়েছে। এবং যুক্ত হয়েছে ‘অনঘ এন্টেনা’ নামে পশ্চিম বাংলার তরুণ কবিদের কবিতার বিচিত্ররূপ উপস্থাপনা। পশ্চিম বাংলার নতুন প্রজন্মের কবিতার আলোচনা, ব্যক্তিকবির গুচ্ছ উচ্চারণ এবং সা¤প্রতিক বিশ্বকবিতার অভিনিবেশী পাঠকের সংখ্যা যে পূর্বের তুলনায় বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে পত্রিকার বিশ্বজনীন অভিজ্ঞতার অঙ্গীকার তিরিশি আধুনিকতার পর অনেকান্তচারী অন্যতর সম্ভাবনার পথ খুলে দিয়েছে। সে-পথ হয়তো বা উত্তরাধুনিকতার পথ, নয়তোবা কালধর্মের প্রয়োজন-উদ্ভূত সমাজতত্ত্ব, ইতিহাস ও রাজনীতির অনুশীলনকেও ‘একবিংশ’ অনিবার্য মনে করেছে। আধুনিকতা-উত্তর ইউরোপে বিজ্ঞান ও দর্শন যেখানে এক কেন্দ্রে এসে মিলিত হয়েছেÑ ঐতিহাসিকতা ও রাজনৈতিকতা হয়ে উঠেছে সাহিত্যের স্বরূপ নিরূপনের অন্যতম মাপকাঠিÑ সেখানে আমাদের কবিতা ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রশ্নে সংগ্রাম করেছে দুই দশকেরও অধিককাল ধরে। সত্যÑ ইতিহাসের প্রশ্নে রাষ্ট্র ও জনতার প্রতিদ্বন্দ্বী অবস্থান আমাদের শিল্পচর্চার ওপরও প্রভাব বিস্তার করেছে। প্রগতি ও প্রতিক্রিয়ার দ্বৈরথ অগ্রজ কবিদের চৈতন্যের খণ্ডিত, বিকৃত যে স্বরূপ উন্মোচন করেছে, তাতে প্রথানুরাগী কবিদের বিভ্রান্ত হবারই কথা। ‘একবিংশ’ সেই বিভ্রম-আশঙ্কার গহ্বর থেকে নতুন প্রজন্মের সৃজনক্ষমতাকে মুক্তচিন্তার খোলা হাওয়ায় আত্মপ্রকাশের সুযোগ করে দিয়েছে। এভাবেই ‘একবিংশ’র কবিগোষ্ঠী সমাজসত্তা ও সময়স্বভাবের শিল্পিত প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে। ‘গোষ্ঠী’ শব্দের সঙ্গে চেতনার যৌথায়ন শিল্পবিবেচনার ক্ষেত্রে বহুলাংশে প্রাসঙ্গিক কিন্তু ‘একবিংশ’ কোনো বিশেষ কবিগোষ্ঠী সৃষ্টির পরিকল্পনা নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেনি। কবির ব্যক্তিসত্তা, ব্যক্তি-অনুভূতি, মনন ও আবেগের প্রেম ও অপ্রেমের দ্রোহ ও ঘৃণার প্রকাশপ্রক্রিয়ায় অধিকাংশ কবিই স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত, ব্যক্তিত্বচিহ্নিত। বিচিত্র তত্ত্ব, জ্ঞান ও নন্দনচিন্তার আন্তরশৃঙ্খলার অঙ্গীকার তাঁদেরকে যেমন করেছে বৈচিত্রসন্ধানী, তেমনি, ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিত্বে পরিণতি লাভের ঐকান্তিকতায় অভিনিবেশী। পত্রিকার ফেব্র“য়ারী ১৯৯০ সংখ্যাটি বিশ্লেষণ করলে এ-সত্যের পরিচয় পাওয়া যেতে পারে। এ-সংখ্যায় সংযোজিত ‘অনিরুদ্ধ আশি ঃ এক দশকের কবিতা’ শীর্ষক ক্রোড়পত্রে নবীন প্রজন্মের তেইশ জন কবির নির্বাচিত কবিতা সংকলিত হয়েছে। আমার কবিতাপাঠের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এই তেইশ জন ছাড়াও এ-সময়ে চেতনার নবত্ব এবং রূপায়ণের স্বকীয় ব্যাকরণ নিয়ে বেশ কয়েকজন কবি আবির্ভুত হয়েছেন। তেইশ জন কবি সম্পর্কে চুড়ান্ত মূল্যায়নের সময় হয়তো এখনো আসেনি, অনেকেরই স্বকণ্ঠ যে দৃঢ় ভিত্তিমূল স্পর্শ করেছে, তা নিঃসংশয়ে বলা যায়। খোন্দকার আশরাফ হোসেন, রেজাউদ্দিন স্টালিন, কাজল শাহনেওয়াজ, সাজ্জাদ শরিফ, শান্তনু চৌধুরী এবং সৈয়দ তারিকের কবিতায় জীবনানুভবের স্ব-ক্ষেত্র নির্মাণের অনুরণন সুষ্পষ্ট। ষাটের দশকের কবিদের অনেকের সমবয়সী, অথচ আশির দশকের কাব্যযাত্রায় অংশগ্রহণ আশরাফ হোসেনের ক্ষেত্রে বয়স ও চেতনার সংকটময় দ্বৈরথ সৃষ্টি করতে পারতো। কিন্তু জাতিসত্তার মৌল ভূমিতলে পা রেখে এই কবি এক নিঃশিকড়, বিশুদ্ধ, অনুর্বর সময়খণ্ডে স্বপ্ন ও প্রত্যাশার পলিস্তর জমা করেছেন কবিতাশরীরে। মিথ ও ঐতিহ্যের সংবেদনশীল অনুভাবনার সঙ্গে তিনি যোগ করেছেন অধীতি ও শিল্প অভিজ্ঞতার বিচিত্র প্রান্ত।

আশির দশকের পরও ‘একবিংশ’ নব্বই-এর দশকের অর্ধেক কাল অতিক্রম করেছে। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নতুন কবির সমান্তরালে কবিতা বিশ্লেষণের ক্ষেত্রেও নতুন নতুন মাত্রাপ্রযুক্তির সন্ধানে মনোযোগী হয়েছেন কবি-সমালোচকরা। সৃজন-মননের যৌথায়নে আধুনিকতা-উত্তর নন্দনচিন্তার যে নতুন দিগন্তরেখা দেখা দিয়েছে ‘একবিংশ’ পত্রিকার পনোরোটি সংখ্যায় তার বিচিত্ররূপ প্রকাশ আমরা লক্ষ করবো। কেবল কবিতাকে নয়, কাব্য বিশ্লেষণকেও এঁরা গূঢ়ভাষিতা, বহু অর্থব্যাপকতা ও মানসিক জ্ঞানের বিবিধ উৎসের ব্যবহারে সমৃদ্ধ করতে সচেষ্ট হয়েছেন। এবং সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভারতীয় বাংলার মনন ও সৃজনাবেগের উপস্থাপনা। বাঙালি সংস্কৃতির হাজার বছরের স্রোতোধারার খণ্ডায়ন এখন ঐতিহাসিক ও রাষ্ট্রীয় ভাবে স্বীকৃত। আর্থ-উৎপাদনকাঠামোগত ভিন্নতা সত্ত্বেও ভাষিক ও সাংস্কৃতিক ঐক্য দুই বাংলার কবিতার সহযাত্রার গতি-প্রকৃতির সংযোজন ‘একবিংশ’ পত্রিকার অন্যতর বৈশিষ্ট্য। আধুনিক বাংলা কবিতার উদ্ভব অভিন্ন ভাবকেন্দ্র থেকে সূচিত হলেও প্রায় অর্ধ-শতাব্দীর রাষ্ট্রিক ভিন্নতায় বাঙালির সৃজন-মনন এখন দুই স্বতন্ত্র ধারায় বিদ্যমান। কিন্তু আধুনিকতা-উত্তর শিল্পের বিশ্বজনীন সম্পর্কায়নের চেতনা এই রাষ্ট্রিক দূরত্বকে অবলীলায় অতিক্রম করতে সক্ষম। সম্পাদক খোন্দকার আশরাফ হোসেন পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যা থেকেই ‘অনঘ এন্টেনার’র মাধ্যমে নবপ্রজন্মের পশ্চিম বাংলার কবিতা এবং কবিতা সংক্রান্ত অনুভবগুচ্ছকে বাংলাদেশের কাব্যপ্রেমীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেন। ফলে সংস্কৃতির বিশ্বজনীন আন্তঃসম্পর্কের এই যুগে আমাদের শিল্প-অভিজ্ঞতার ক্ষেত্র সুপ্রশস্ত হওয়ার সুযোগ পায়। ‘একবিংশ’-এর দশম সংখ্যায় (সেপ্টেম্বর, ১৯৯২) কবিচৈতন্যের বিশ্বায়নের প্রচেষ্টা সুষ্পষ্ট হয়ে উঠেছে। শিল্পসমালোচক তপাধীর ভট্টাচার্যের ‘তরুণ রচনার অগ্নি’ এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয়বাহী। সামসময়িককালের দুই বাংলার কবিতার মূল্যায়ন সূত্রে ‘দেশকাল পরিধি ও প্রবহমান সাংস্কৃতিক আবহে’র পটভূমিতে কবিতার শেকড় সঞ্চালনের বহুমুখী স্বভাবধর্মকে তিনি উন্মোচন করেনÑ

সাংস্কৃতিক উপনিবেশবাদ ও এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার বিরুদ্ধে উত্তর-আধুনিক জীবনদর্শনই হতে পারে সবচেয়ে জোরালো প্রতিবাদ। এই উপলব্ধি ধীরে ধীরে শক্তি সঞ্চয় করছে বাংলাভাষা ব্যবহারকারী কবিদের মধ্যেÑ যেমন ভারতের পশ্চিমবঙ্গে, আসামে, ত্রিপুরায়, তেমনি বাংলাদেশে। যাত্রী সবাই একই তরণীর। বাংলা কবিতায় এই হলো আজকের পরিপ্রেক্ষিত। স্পষ্টতই যাতে ব্যক্তিসত্তা ও সামাজিক সংবেদনার দ্বান্দ্বিক এবং বহমান সময় ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার আবর্তন বিচিত্র প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নানাধরনের মুল্যমান তৈরী করে চলেছে।

এই সম্ভাবনাকে সামনে রেখেই পত্রিকার পঞ্চম সংখ্যায় সৈয়দ তারিক ‘শিল্পতত্ত্বের আধুনিকতার সমস্যা’ ও তার সমাধানের সূত্র নির্দেশ করেছিলেনÑ ‘প্রাক্তন শৈল্পিক সংবেদন আর নতুন শিল্পধারা সৃষ্টি করতে পারছে না। সুতরাং শিল্পের স্বার্থে নতুন সংবেদশীলতার অন্বেষণ অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। এবং নতুন সংবেদনশীলতার জন্ম দিতে পারে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি। এই দৃষ্টিভঙ্গি নিঃসন্দেহে উত্তরাধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি।’ কবিতার শরীরে আদৌ উত্তরাধুনিকতার লেবেল এঁটে দেওয়া যায় কিনা, তা বিবেচনাসাপেক্ষ। কিন্তু কবিতা মূল্যায়নের ক্ষেত্রে যে এই দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগযোগ্য, বিগত দুই যুগের শিল্প-অভিজ্ঞতা থেকে তা নিঃসংশয়ে বলা যায়। বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের কবিদের কবিদের বহুচারী মন ও মনন উত্তরাধুনিক জীবনধারণ ও শিল্পজ্ঞানকে কবিতার অবয়বে কতোটা সাফল্যের সঙ্গে রূপায়িত করতে পেরেছেন, সময় তার বিচার করবে। ‘একবিংশ’ শীমাস হীনির ইন্দ্রিয় দিয়ে যখন সিলভিয়া প্লাথের অক্লান্ত শব্দক্ষুরধ্বনি শোনে, কিংবা নাজিম হিকমত, ওক্তাবিয়ো পাস এবং এমিলি ডিকিনসনের কাব্যলোককে বাংলা কবিতার শব্দশরীরে স্থাপন করে, তখন দৃষ্টিভঙ্গির অনিবার্য পরিবর্তন-প্রক্রিয়ার মধ্যেও বিশ্বশিল্পের উত্তরাধিকার গ্রহণের প্রশ্নে পত্রিকার নিঃসংশয় মনোভাব অগোচর থাকে না।

‘একবিংশ’ পত্রিকার ১৩, ১৪ ও ১৫ সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি বৈচিত্র্যপ্রবণ ও সমৃদ্ধ। টেরি ঈগলটনের অনুদিত প্রবন্ধ ‘সাহিত্য কী?, অঞ্জন সেনের ‘কবিতার ভাষা’, আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহর ‘দরোজা খেলার স্থাপত্য’, সালাহউদ্দীন আইউবের ‘পশ্চিমের পোস্টমডার্নিজম ও পশ্চিমবঙ্গের উত্তর আধুনিকতা’ ১৩শ সংখ্যার সমৃদ্ধ মননবৃত্তের পরিচয়বাহী। ১৪তম সংখ্যায় বিন্যস্ত রচনাসমূহের মধ্যে খোন্দকার আশরাফ হোসেনের ‘কবিতায় শহর’, সফিউল আজম মঞ্জুর ‘দুই ভিন্ন শিল্পের সাধনসূত্র : স্থাপত্য ও কবিতা’, সাজিদুল হকের ‘ইউরোপীয় সাংস্কৃতিক কাঠামোয় আধুনিকতা ও আমাদের চিন্তার মেরুদণ্ডহীনতা’ মননঋদ্ধ ও চিন্তা-সৃষ্টিকারী প্রবন্ধ। খোন্দকার আশরাফ হোসেনের ‘নির্বাচিত কবিতা’ বিষয়ে গ্রন্থালোচনা বিভাগে তুষার গায়েনের পূর্ণাঙ্গ প্রবন্ধ ‘স্বদেশের মর্ম থেকে উঠে-আসা কবি’ একটি উল্লেখযোগ্য রচনা। ফকরুল আলমের ‘এডওয়ার্ড সাইদ ও উত্তর ঔপনিবেশিক কাউন্টার ডিসকোর্স’ খোন্দকার আশরাফ হোসেনের ‘রোমান্টিক কবিতার স্বরূপ’ এবং শেমাস হীনির কবিতা’, আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহর ‘চেতনার ক্ষুরধ্বনি অথবা পথে-পাওয়া আলো’ নামক প্রবন্ধসমূহ ছাড়াও কবিতার জন্য নির্ধারিত হয়েছে বিভিন্ন বর্গ। কবিতা সপ্তপর্ণার কবিরা হলেন টোকন ঠাকুর, হাফিজ রশিদ খান, আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ, খলিল মজিদ এবং মিহির মুসাকী। গুচ্ছ কবিতার কবিরা হলেন: শামসুল আরেফিন, শশী হক, তুষার গায়েন, সুহিতা সুলতানা, কামরুল হাসান, পাঁশু প্রাপণ, সৌভিক রেজা, মুজিব মেহদী, সরকার মাসুদ এবং খোন্দকার আশরাফ হোসেন। ‘সনেট-সাইকেল”- এর অনুপম ‘বর্ষালী চতুর্দশী’ রচনা করেছেন বায়তুল্লাহ কাদেরী। এছাড়াও স্মরণ পর্যায়ে রয়েছে জন কীটস, সের্গেই ইয়েসেনিন, স্টিফেন স্পেণ্ডার এবং শক্তি চট্টোপাধ্যায়। ‘কবিতাবিশ্বে’ মাহবুব মাসুম ‘স্বীকারোক্তি মূলক কবিতার সাহসী সর্বনাম’ এর পথ ধরে সিলভিয়া প্লাথের শিল্পর্ভূখণ্ডে বিচরণ করেছেন। কল্পনা ও পরিকল্পনার মৌলিকত্বের সঙ্গে শ্রম ও শৃঙ্খলার সহযোগ ছাড়া এরূপ পত্রিকা বের করা অসম্ভব।

একটি দশককে ঘিরে ‘একবিংশ’ পত্রিকায় যে-সকল লেখক আবির্ভুত হয়েছে, সৃজন- মননের যৌথ রাগে তাঁরা যে শিল্প-ভূখণ্ড রচনা করেছেন, তা যে প্রত্যাশা-জাগানিয়া, এ-সত্য নিঃসংশয়ে উচ্চারণ করা যায়। ‘একবিংশ’ দীর্ঘজীবী হোকÑ এ আমাদের আন্তরিক প্রত্যাশা। সম্পাদকের কথার প্রতিধ্বনি করে আমরাও বলতে পারিÑ ‘চলতেই হবে সামনে। যতই দুর্বহ হোক বোঝা সিসিফাসের।’

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন