শুক্রবার, ৯ এপ্রিল, ২০১০

একবিংশ ২৫ বছর পূর্তি সংখ্যা




একবিংশ
২৫
পঁচিশবছরপূর্তি সংখ্যা
ফেব্রুয়ারি- ২০১০

সম্পাদক
খোন্দকার আশরাফ হোসেন

সহকারী সম্পাদক
কামরুল হাসান

সম্পাদকীয় যোগাযোগ
ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

ফোন : ০১৭১১-০১৯২৪৮
ই-মেইল : ashrafengdu@yahoo.com

প্রচ্ছদ : শুভ সালাতিন
মুদ্রক : মমিন আর্ট প্রেস, ৯ নীলক্ষেত, বাবুপুরা, ঢাকা-১২০৫

একশত টাকা



সম্পাদকীয়

একবিংশ তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছে। আজ থেকে সিকি শতাব্দী আগে সে ঘোষণা করেছিল নতুন-শতাব্দী আবাহনের মন্ত্র, বলেছিল, একুশশতকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেবে কবিতার পাঠকদের, বিনম্র পুরোহিতের মতো শতাব্দীপূরণের মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানের পাশে দাঁড়াবে, দেখবে নতুন কবিতার জন্মের মুহূর্তকে ধাত্রীমাতার মমতায়। পাঠক সাক্ষী, একবিংশ তা করেছে; একবিংশ ধূলিঝড়ে উটপাখির অন্ধতা মেনে নেয়নি, পিছিয়ে আসেনি তার লক্ষ্য ও কক্ষপথ থেকে। যাঁরা ছিটকে পড়েছেন, দায়ভার তাঁদের। একবিংশ পূর্ণতার অভিসারী ছিল, পূর্ণতা সে পায়নি, কেননা পূর্ণতা তো সর্বাংশে পাবার বস্তু নয়, শুধু আরাধনার জিনিস, শুধু চোখের সামনে জাগিয়ে রাখার ধ্রুবতারা। একবিংশ এখন যা-খুশি করতে পারে, নিতে পারে ছুটি, বরণ করতে পারে স্বেচ্ছামৃত্যু ভীষ্মের মতো, পাল্টে নিতে পারে নিজের অবয়ব, ছোটাতে পারে অশ্ব ভিন্ন-কোনো দিগন্তের দিকে।
পঁচিশবছরপূর্তির এই সংখ্যার সম্পাদকীয় লিখতে গিয়ে আবেগাক্রান্ত হচ্ছি। একবিংশ বেড়ে উঠেছে আমারই সাথে-- আমি ওকে গড়েছি, না ও আমাকে গড়েছে, সে বিচার করাও সহজ নয়। আমার আত্মা থেকে জাত এই আত্মজকে বেড়ে উঠতে দেখে আনন্দিত হয়েছি; সে এখন গাইতে চায় গান--

“বামন পিতাকে যথা ব্যঙ্গ করে বেড়ে উঠে দীর্ঘাঙ্গ তনয়
তেমনি উঠেছি বেড়ে, হে বৃক্ষেরা, হে আমার জনক সময়,
এখন আকাশ শুধু বুকে ধরি, এখন দিগন্তরেখা মাইল-পাথর।”


কিন্তু এই গৌরবের সর্বাংশ দাবি করা আমার পক্ষে অনুচিত, কেননা একবিংশকে গড়ে উঠতে সাহায্য করেছেন এর কবি-লেখকরা; তাঁরা অপার বিশ্বাসে তাঁদের সাধ্যমতো শ্রেষ্ঠ লেখাগুলো তুলে দিয়েছেন একবিংশ-কে, এর অনিয়মিত প্রকাশের অনিশ্চয়তা মনে রেখেও। আমি একবিংশের সকল কবি-লেখককে আমার অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা জানাই। কৃতজ্ঞতা জানাই এর জানা-অজানা অগণিত পাঠকদের। তাঁদের অকুণ্ঠ ভালোবাসা ও সহযোগিতা ছাড়া এতদূর আসা সম্ভবপর হতো না।

মনে পড়ছে অনেক স্মৃতি। ১৯৮৫-তে আমার বয়স পঁয়তিরিশ। আচমকা প্রেমে পড়বার বয়স যেমন নয়, তেমনি নয় আবেগের স্রোতে ভেসে একটা কিছু করে ফেলবার। আমার নিজের কবিতা লেখার অকালবোধনের কালও সেটি। সবাই জানেন ইংরেজ রোমান্টিকশ্রেষ্ঠরা ঐ বয়সে প্রায় সবাই মৃত; এলিয়ট-পাউন্ডরা তাঁদের শ্রেষ্ঠ রচনাগুলো লিখে ফেলেছেন। আর আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ বেরুলো চৌতিরিশে। অনেকে বললেন, শিঙ ভেঙে বাছুরের দলে ভিড়ে গিয়েছি। তা ঐ সময়েই একবিংশের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন, আমার চেয়ে বয়সে তরুণ কিন্তু কবিতার সহযাত্রীদের অনুপ্রেরণা ও উৎসাহে। টগবগে ও লম্ফমান হৃদয়কে ফুটবলের মতো পায়ে নিয়ে মাঠে নামলাম, লালকার্ড দেখিয়ে স্বঘোষিত রেফারিরা মাঠ থেকে বের করেও দিতে পারতেন। কিন্তু না, পেলাম হাততালি। উৎসাহ গেলো বেড়ে; একবিংশ হয়ে গেলো অস্তিত্বের সঙ্গী ও সখা। বাংলাদেশের কবিতায় একবিংশ কী দিয়েছে, বা আদৌ কিছু দিয়েছে কি না, সে-বিচার কবিতাপাঠক ও ইতিহাসকাররা করবেন অথবা করবেন না। আমাদের তাতে কিছু যায় আসে না। আমরা শুধু সময়ের উতলহাওয়ায় পালট-খাওয়া ঘুড়িও যদি হয়ে থাকি, অথবা প্রমত্ত সময়ের জলঘূর্ণিতে চংক্রমিত রক্তজবা, আমাদের সার্থকতা শুধু হয়ে ওঠায়-- হয়ে থাকা যদি না-ও হয়। আমরা আমাদের স্বাক্ষরটুকু রাখলাম, যদিও জানি, কালের সম্মার্জনীর কাছে খড়িমাটির লিখন আর মার্বেলে খোদাই অক্ষর সমানভাবে অসহায়।

একবিংশ-র পঁচিশবছরপূর্তি সংখ্যাটি এর ২৫তম সংখ্যাও বটে। কাকতালীয়ভাবে সংখ্যাদুটো মিলে গেছে। আসলে আরো অনেক বেশি সংখ্যা বের হওয়ার কথা ছিল। নানা কারণে ব্যর্থ হয়েছি। এই বৈশ্যশাসিত সমাজ শিল্পসাহিত্যবৈরী। কবিতাকর্মীরা এখানে প্রান্তিক চাষীর মতো, নিজেদের উৎপাদিত কষ্টের ফসল নিয়ে কোন্ হাটে যাবে তারা জানে না। কবিতার ক্রেতা দুষ্পাপ্য; বেশিরভাগ মানুষ শিল্পসাহিত্যের ধার ধারে না; যারা ধারে, তারাও সবাই কবিতাভোজী নয়, তারা বরং উপন্যাসাদি সহজপাচ্য খাবার নিয়ে তৃপ্ত। কবিতাহাটেও আকর্ষক জনরুচির মশলাদার চটপটিওয়ালাদেরই প্রাধান্য; তারা আবেগ এবং যৌনতার অনুপান মিশিয়ে পাঠকদের ভোলান। মাঝে একসময় বিপ্লবও বেশ বাজারকাটতি পেয়েছিল। তা সেই জনরুচির তাওয়ায় নিজেদের গেহুঁ-মকাইয়ের রোটি সেঁকে নিয়েছেন কেউ-কেউ, এখনও তাঁদর রঙমশলাদার মাল নিত্যনতুন নামে-- একশো কবিতা, দুশো পদ্য, প্রেমের কবিতা, কামের কবিতা ইত্যাদি-ইত্যাদি নাম তস্য-তস্য উপনাম সহকারে-- বিকোচ্ছে তরুণ কবিরা হাঁ করে দেখে আর ভাবে এই হাটে আমার স্থান কোথায়? পঁচিশবছর আগে এই অবস্থা আরো করুণ ছিল। এখন তো তবু বিকল্প পাঠকগোষ্ঠী গড়ে উঠছে ছোটকাগজগুলোর ঐকান্তিকতায়, কিন্তু তখন ইত্তেফাক-বিচিত্রা-সংবাদের সাহিত্য-সম্পাদকদের টেবিলে কবিদের জন্ম-মৃত্যু-শেষকৃত্য সম্পন্ন হতো। তেমনি একটি সময়ে আমরা একবিংশ প্রকাশ করেছিলাম আমাদের কবিতা প্রকাশের বাহন হিসেবে-- এ না করে আমাদের উপায় ছিল না। আমরা নির্মাণ করতে চেয়েছিলাম আমাদের মতোই তরুণ-নাতিতরুণ ও তরুণতরদের জন্য একটি প্রকাশমাধ্যম। প্রথম সংখ্যার সম্পাদকীয়তে লিখেছিলম এরকম-- “একবিংশ কেবল নতুন প্রজন্মের কবি-লেখকদের জন্য নির্দিষ্ট। যারা অপ্রতিষ্ঠিত, যৌবনাবেগে টলমল, প্রতিভাবান, উদার, অভিনিবিষ্ট, শ্রমী এবং নির্ভয়, আমরা তাদের জন্য পাটাতন নির্মাণ করতে চাই।” আরো লিখেছিলাম-- “একবিংশ শতাব্দীর দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছি আমরা; আর মাত্র সার্দ্ধদশক পর সবগুলো ঘণ্টা একসঙ্গে নিনাদিত হয়ে উঠবে, এবং নতুন শতাব্দী, নতুন সময় নতুন অভিজ্ঞতার বোধন ঘটবে। আমরা এবং কবিতা তখনো থাকবো; উন্মার্গগামী রকেট নয়, কবিতাই আমাদের পৌঁছে দেবে সে মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে। আমরা কেবল প্রস্তুতি নিতে পারি, প্রস্তুত হতে পারি আমরা যারা নতুন, যারা মারী ও যুদ্ধের মধ্যে শৈশব-তারুণ্য কাটিয়েছি, যারা অভ্রভেদী দুঃশাসনের তমসার মধ্যে পঞ্জরাস্থি জ্বালিয়ে নিজেদের করেছি অন্য নাবিকদের জন্য বাতিঘর, আমরা যারা আগামী শতাব্দীরও বেশ কিছুকাল বেঁচে থাকব। নতুন সময় আমাদের, একমাত্র আমাদের। আর ‘একবিংশ’ নতুনদেরই পত্রিকা।”

এবং একবিংশ কেবল কবিতা ছাপার কাগজ হয়ে থাকতে চায়নি। ক্রমশ সে হয়ে উঠেছে কবিতা ও নন্দনভাবনার কাগজ। বিবর্তমান ভাবনাবিশ্বের সাথে তাল ও পা মেলাতে গিয়ে নিতে হয়েছে তত্ত্ববোধিনীর কাজ। এ কাজটি অন্য কেউ নিষ্ঠার সাথে করলে আমরা স্বস্তি পেতে পারতাম। তবে আমরা খুশি আমরা চ্যালেঞ্জ নিতে পেরেছি চলার, চলতে পেরেছি সবার সাথে একলা প্রাতে। একবিংশ চলবে সামনে আরো, কেউ-কেউ এর স্বেচ্ছামৃত্যুর পরামর্শ দিলেও। এখনি অন্ধ বন্ধ হবে না পাখা।

1 টি মন্তব্য:

  1. অনেক ভালোলাগা, ভালোবাসার আরেক নাম 'একবিংশ'
    কুলদা ধন্যবাদ আপনাকে।

    উত্তরমুছুন