১৬ জুন খোন্দকার আশরাফ হোসেন ১৬ জুন চলে গেলেন না ফেরার দেশে। তাঁর লেখা নির্বাচিত ১৫টি কবিতা প্রকাশ করা হল। কবিতাগুলো তিনি বিভিন্ন সময়ে কুলদা রায়কে পাঠিয়েছিলেন।
প্রার্থনায় নম্র হও পাবে
আমাকে পাবে না প্রেমে, প্রার্থনায় নম্র হও পাবে,
কামে-ঘামে আমি নেই, পিপাসায় তপ্ত হও পাবে।
পাখিরা প্রমত্ত হলে সঙ্গিনীকে ডেকে নেয় দেহের ছায়ায়-
ছায়া নয়, রৌদ্রতাপ জ্বালাবার শক্তি ধরো, কেবল আমাকে
তপ্তজলে দগ্ধ করো, রুদ্ধ ক্রোধে দীপ্ত করো, পাবে।
পৃথিবীর সর্বশেষ কবি আমি অহঙ্কার আমার কবিতা
বিষাদে বিশ্বাসে পূর্ণ হৃদয়ের জলাধারে ধরো,
আমাতে নিবদ্ধ হও পূর্ণপ্রাণ ফলবন্ত হও-
আমি তো নিষিদ্ধ প্রেম, শুদ্ধ ব্যথা, বিষাক্ত আঙুর,
আমার বিষের দানা জিভে কাটো, রক্তরস যিশুর রুধির
পান করো, নতুন প্রজন্ম সাধ তুঙ্গ করো, পাবে।
আমাকে পাবে না দুঃখে, একটি হতাশা শুধু দেহে
ছুরির ফলায় জমা একফোঁটা প্রাকৃতিক স্বেদের মতোন
তীক্ষ্ণ করো, মূর্ত করো, পাবে।
তেত্রিশ বছর ধরে বুকের সন্তাপ জমা সে সন্তাপ তুলে নাও চুলে,
মেঘের উড়াল-দেয়া পাখিদের ফেলে যাওয়া অবিন্যস্ত ছায়া
চোখের মণিতে গাঁথো, উড়ালে বিশ্বাসী হও, পাবে।
আমাকে পাবে না প্রেমে, প্রার্থনায় নম্র হও, পাবে,
তৃপ্তির সন্ত্রাসে নয়, পিপাসায় তপ্ত হও, পাবে।
তিন রমণীর ক্বাসিদা
১
তিনটি রমণী বসে বুকে আঁটে ছায়ার বোতাম,
তিনটি রমণী তারা এইখানে কাটছে শোলোক,
পিপাসার জল নয়, হাতে নিয়ে জলের পিপাসা
দীপ্ত এক অশ্বারোহী টেনে ধরে ঘোড়ার লাগাম।
তিনটি রমণী শুধু বুনে যায় সূক্ষ্মতন্ত্র জাল-
একহাতে সুতা ধরা অন্য হাতে তারার চরকা,
সুতা ছিড়ে পুনর্বার জোড়া দেয় আনত নয়নে,
তিন রমণীর চুলে বাঁধা আছে আঁধার রুমাল।
কারা নাকি রাজা হবে, কারা হবে
রাজার জনক;
গর্গনের তিন মেয়ে চুলে ওড়ে সাপের ছোবল,
কানে গোঁজা কম্রফুল, পদতলে রতি
শঙ্খচুড়;
‘'দেখা হবে পুনর্বার', বলে ওঠে
তারা আচানক।
‘এই যে দীপিত রোদ এইখানে আঁধার ঘনাবে,
এই যে পুরুষ যায় এই হবে প্রমত্ত নায়ক-
তারপর শেষ হবে পৌরুষের সব ছলাকলা,
রক্তমাখা উত্তরীয় কালপ্রাতে মাছেরা জড়াবে।’
এই বলে তিন নারী ছুড়ে দেয় সুতলির টাক,
নিবদ্ধ শিকার শুধু জলে দেখে ঘূর্ণ্যমান পাক।
২
আমি দেখেছিলাম তাদের।
ঈশ্বরী পাটনীর খেয়া পার হয়ে পাড়ে নামতেই
তিনটি কলস কাঁখে তিনজন নারী এসে
সামনে দাঁড়িয়েছিল, তিন
প্রাজ্ঞ বৃক্ষের মতোন।
একজন হাত তুলে বলল, ‘দাঁড়াও
কথা আছে।’
একজন কলস নামিয়ে বুকে আড়াআড়ি রাখলো দু’হাত,
অন্যজন তিরস্কারে বিদ্ধ করে চোখ দুটো খুলে নিল।
আমি অন্ধ তখন, চোখের পার থেকে
সাদা ঝাউগাছের দোলানো পর্দা সরাতে চাইলাম,
আমি বললাম, ‘আমি কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি না,
আমাকে দৃষ্টি দাও।’
ওরা বলে, ‘চক্ষু দিয়ে তুই শুধু আলোক দেখি,
ফুল আর মমতা শৈবাল তোর হৃদয় খেয়েছে, বৃদ্ধাঙ্গুলে
সবুজ পাতার অনত্মর্ভেদী শিকড় গজায়, তুই
মানুষ চিনিস না, চিনিস না অনত্মর্গত শূন্য আর পূর্ণের
জ্যামিতি:
তোর চোখ অন্ধকার, অন্ধকার
আজ তোর চোখ হোক তবে।’
আমি চিৎকার করে বললাম, ‘তোরা কারা?
ওরা বলে, ‘আমরা তিনটি বোন, তিন শুদ্ধ
জগতের মেয়ে’
‘কাখের কলসে কী? পূর্ণতার অবিমিশ্র ফল ও জলধি।
আমরা যাচ্ছি দূরে মুগ্ধতার রাজবাড়ি, তুই যাবি
আমাদের সাথে?
আমি বলি, ‘আমার তো চোখ নেই, অন্ধকার
মুখ
কী করে দেখাবো বলো, ওরা যদি
আমাকে না নেয়?
বলে তারা, ‘তুই আয়, কলসীর
মগ্নতায় তোকে ভরে নেই,
পূর্ণতা প্রকাশ হলে তুই-ই হবি একমাত্র আলোর গোলক।’
৩
কোন এক প্রসন্ন সকালে নদী তীরে
উলটকম্বল ঘাসে জীবনের হিম রোদ মেলেছিল শাড়ি,
আর জলের ছায়ারা
কাঁপছিল বুকের গেলাসে রাখা ইসবগুলের দানা।
এক নারী কাছে এসে তুলে নিল চিবুক দু’হাতে,
চুমু খেল চুলের সীমানত্ম এসে কাঁটাতার তুলে রাখে
যেইখানে, বলল, আমি তোর
একক জননী
আমাকে চুম্বন কর-
আমার উত্থান ছাড়া নীল নিসর্গের জল অর্থহীন, বৃথা।
মধ্যাহ্ন দুপুরে এক ভিন্নতর নারী এসে দিল হাতছানি,
বলল, এসো, আমার
চুলের মধ্যে মুখ রাখো, হাত রাখো
হাতের ভেতর,
জগৎ ও জন্মের খেলা তোমাকে দেখাবো চলো-
কোথায় শম্বর কাঁদে নষ্টনীল চাঁদের জ্যোৎস্নার নীচে
অথবা কোথায়
জলের ঘূর্ণির মধ্যে ভেসে ওঠে ক্রমাগত চৌষট্টি গোলাপ।
আমি তার বিনম্র হাতের নিচে ক্রমে গলে যেতে থাকলাম,
সামনে বাড়ব কুণ্ড
আর আমি নিজেই তখন এক প্রজ্বলনত্ম গীজারের চোখ।
ফুটন্ত শিরার তাপ স্নিগ্ধ হলে বিকেলের ধূসর আলোয়
এলো নারী কম্রমুখ, চিবুকের
প্রস্ফুটিত নবীন ভ্রমর
আমার দু’হাতে দিয়ে বলল, শোন তুমিই জনক,
অম্লান ইসবগুল
বুকের গেলাসে আমি ভিজে উঠেছি যে স্নেহ মমতার জলে
আমি তাকে নিয়ে যাবো অন্য এক স্ফুলিঙ্গের কাছে,
স্ফটিক গেলাসে রাখা আগুন প্রশ্রয় দিয়ে ফুটিয়েছো
শমিত অঙ্গার-
আমি তার রুদ্রতাপ মেখে নিয়ে দিলাম হীরক।
সুদূরের পাখি
কী খুঁটছ সারা দিন অননন্তের পাখি?
খুঁটছি যবের দানা, শস্যবীজ, খুঁটছি
জীবন।
কী খোঁজো সমস্ত দিন ডালপালা লতার ভেতর?
খুঁজছি নিজেরই বুক, এখানে
ফেলে যাওয়া আগের জনম;
হারানো যৌবন খুঁজি, পুঁজিপাটা
যা ছিল অক্ষয়
প্রমত্ত ঝড়ের পরে এই বৃক্ষ অশোকের গোপন কোটরে
জমা রেখে চলে যাই, অতীতের
শীতল সন্তাপ
কাম প্রেম শঙ্খনীল চিরজীবী পাথরের কাছে
জমা ছিল, তারপর বিস্মৃতির ঝড়ে উড়ে গেছি।
সারা দিন কাকে ডাকে অনন্তের পাখি?
ডাকি ছায়া, নম্র আলো, ডাকি
পূর্ণ ফলের বিশ্রাম,
আলোচাল-ধোয়া হাতে একবার আত্মার সঙ্গিনী
কপালের ঘাম মুছেছিল; উঠানের এক
প্রান্তে বেড়ে ওঠা
পুঁইডালিমের পাতা একবার গেয়েছিল নির্বাণের গান--
তারপর মিশে গেছি জল পাতা ধূলার শরীরে।
দিনান্তে কোথায় ফের ওড়ে যাও পাখি?
প্রমত্ত ঝড়ের পরে যেইখানে উড়ে যায় মেঘ,
আলো ছায়া যেইখানে গড়ে তোলে অভিন্ন আশ্রয়--
সেই ঘুম বিস্মরণ, সেই বৃক্ষ
লতার ভেতর।
কী নিচ্ছ ঠোঁটের ফাঁকে সুদূরের পাখি?
আমি নিচ্ছি দুটো খড়, এই মৃত্যু, আরেক জীবন।
ইনসমনিয়া
নিদ্রার গভীরে যাবো, হে সময়, তুলে রাখো
তীক্ষ্ম তরবারি,
বিষাদের বিষ-ফলা আত্মসম্বরণ করো, আমি
ঘুমের মিহিন সুতো, কারুকাজ
বোনা নম্র পাখির পালক
চুলের হৃদয়ে গেঁথে হেঁটে যাবো, কোষবদ্ধ
ছুরিকার ঘুম,
রোদ্রপক্ক
আপেলের ঘুম
আমাকে কে এনে দেবে? আমি তাকে
জীবনের সুখ
প্রসন্ন প্রহর দেবো, নাগরিক
পাশবালিশের নম্র তুলোট পালক,
রৌদ্রের আততি-ভরা দুপুরের কর্মব্যসত্ম পায়ে হাঁটা
ঘর-ফেরা
ঘর।
মানুষেরা কেমন ঘোরের মধ্যে হাঁটে সারাদিন,
পালানো পাখির খোঁজে মাঠঘাট রাজপথ, প্রমত্ত
এভিন্যু
হেঁটে যায়, জীবনের কণ্ঠা ধ’রে ঝুলে থাকে বাসের যাত্রীরা,
এ-পাড়া ওপাড়া ঘুরে ক্লান্ত হয় ফেরিঅলা, তার
মুলিবাঁশ-চেরা হাত নেমে আসে বেলুনের সুতা থেকে,
মুখোশের
বাঘ
একলাফে খেয়ে নেয় দ্বিপ্রহর স্বপ্নাবলী কপালের ঘাম।
ঘুমের অন্দরে যাবো, চেতনার
দৌবারিক পথ ছেড়ে দাও,
পথ ছাড়ো মর্মব্যথা, শিরার
চৈত্রের দাহ, সংহারক জল,
ঘুমের সড়ক বেয়ে যাবো একা-
ফেলে যাবো চুল থেকে খসা ফুল, ঝরা তীর
নক্ষত্রবীথির,
মেঘের তোরণ থেকে নম্র নারী দোলাবে আঁচল।
নিমগ্ন
পথের ঘুম
আমাকে কে এনে দেবে? আমি তাকে
দূরত্বের দূরগামী পথ
দেবো, আকাঙ্ক্ষার রথ দেবো, ঘর্মাক্ত
দুপুর-দিন অতন্দ্র সকাল...
আজ রাতে নিদ্রা দাও, কাল ফের
চুমু খাবো ঘামের কপাল।
সাপ
খেয়েছ চাঁদের জল, হতমানে
কোনদিন খাওনি মৃত্তিকা
অভিশাপ ব্যর্থ তাই বিধাতার, চন্দ্রিমার
ঔজ্জ্বল্যের আলো
পিঠের নরম আঁশে জলচর ইলিশের মতো জমাকলো,
কিছুই হারাওনি তুমি, শাপভ্রষ্ট, না স্বর্গ না পৃথিবী-কণিকা।
বরং আদম ঈভ দুই ঠোঁটে চেটে নেয় মৃত্তিকার তাপ,
মানুষেরা বুকে হাঁটে, হাত পা তো
বাঁধা দেয়া জীবনের ঋণে,
(অর্ধেক গিয়েছে তার বেনোজলে, আর অর্ধেক
খরার দুর্দিনে)
জীবন নাটকে তাই মানুষেরা, তুমি নও, বিতাড়িত
পাপ।
প্রতারক ঈশ্বরের প্রতিভূরা আমাদের কেড়ে নেয় দিন,
এখন চিকন সাপ আমাদের চাই, শোন, লোহার বাসর
রন্ধ্রহীন, ঘুমায় বেহুলা নারী, পাশে তার
একক নাগর,
স্বার্থপর নতুন পৃথিবী তারা কালপ্রাতে সাজাবে রঙিন-
(একচেটিয়ার যুগে ভালোবাসা সে-ও নাকি পুঁজির খাতক)
তোমাকেই হতে হবে চন্দ্রবণিকপুত্রের অমোঘ ঘাতক।
লাবণ্য আমিই জয়ী
দুঃখের কেমন স্বাদ কি করে জানবে তুমি, বলো?
এই আমি সারাদিন দীর্ঘরাত দুঃখের বিষম ফল চিবুতে চিবুতে
হেঁটে যাচ্ছি, তুমি জানবে না কি প্রশান্তি এর
নম্র শাঁস ত্বক আর অন্তর্লীন বীজে। তোমার
সচ্ছল জিভ
আঙুরের বীর্যহীন মিষ্টত্বের ক্লেদটুকু চিনলো কেবল--
বিষাদ অম্লতা তার পান করবে, সে
ধৃষ্টতা তোমার হবে না।
বিরহীকে করুণার কিছু নেই, প্রত্যাখ্যানে
মহিমার আলোক ফোটে না।
আমাকে ফেরালে বলে তোমাকে পেলাম আরো বুকের গভীরে--
আকাশকে আলিঙ্গন করবে সাধ ছিলো সমুদ্রের,
আকাশ ফিরিয়ে দিলো বলেই তো সে কান্নায় নামে,
পৃথিবীর ঘাসেদের সজল প্রার্থনা নয়, বৃষ্টি
নামে নিজের দুঃখেই।
আমাকে হারালে বলে তুমি আজ জয়ী নও, হারলে
তুমিও!
তোমাকে তোমার গর্ব, আমি নই, কেবলি
হারালো।
কাছে আসি বারবার তাই বলে ভেবো না যে আমি রিক্ত শুধু--
নদীর উন্মুখ ধারা সমুদ্রসঙ্গমে যায় সেকি তীব্র জলের আশায়?
জল তো শরীর তার তবু কেন নদী তার মিষ্ট জল সমুদ্রের লবণে
জড়ায়--
তোমার লাবণ্য থেকে তুলেছি দুঃখের কালো সৈন্ধব লবণ,
না হলে চোখের জল কম ছিল একথা তো তুমিও বলবে না।
বাউসী ব্রিজ' ৭১
কাঠবিড়ালির মতো ত্রস্ত নৈপুণ্যে আমরা নৌকা থেকে লাফিয়ে
পড়েছিলাম,
তখন কৃষ্ণা একাদশীর ডাইনী রাত ছিলো গর্ভবতী, আর তার
কিছুক্ষণ পর
ষাঁড়ের বাঁকানো শিঙ নিয়ে চাঁদ তার হাউডআউট থেকে বেরিয়ে
এসেছিলো,
আকাশ-এরিনার অন্য কোণায় তখন মেঘ নামক এক যোদ্ধা অপেক্ষমান।
ঐ রাতে চাঁদ আমাদের সুহৃদ ছিলো না, আমরা
অন্ধকারকে চিনেছিলাম
আর চরের নরোম মাটির সব মুথাঘাসে আমাদের মস্তকগুলো ছিলো
সমর্পিত।
আমরা সূর্য নামক এক স্বরাট সম্রাটের বন্দনা গাইতে গাইতে
ঐ মরা চাঁদের দিকে পিঠ রেখে শুয়ে পড়েছিলাম মাটিতে
একসঙ্গে আঠারোজন উত্তাল যুবক। আমাদের
হাল্কা অস্ত্রগুলো
আর শরীরের সকল শিরা তখন উন্মুখ একটি প্রহরের অপেক্ষায়-
শুরু হবে শিরা ও শস্ত্রের মত্ত যুগলবন্দি, তার আগে
আকাশ বেঁধে নিচ্ছে সারেঙ্গির তার, একসারি
তারার দর্শকবৃন্দ
রুদ্ধশ্বাস, তবলায় প্রস্তুত হয়ে আছে আষাঢ়ের ডুবডুব
নদী...
যেন কোন অদৃশ্য গুণীর মসত্মক হেলন মাত্র একসাথে আকাশে উড়ে
যাবে
সুরের সহস্র গমক। আমাদের
অস্ত্রগুলো তাক করা, আমাদের
হৃদয়গুলো স্থির অচঞ্চল মৎসধ্যানী সারসের মতো, আমাদের
শিরায় শিরায় শত্রু হননের মৃদঙ্গ সত্মব্ধতার পাথর হয়ে আছে।
যেন এই মাত্র আকাশ আর মাটিতে উঠবে এমন মহৎ সঙ্গীত
যার জন্য উন্মুখ হয়ে সারারাত, দীর্ঘ
ক্রন্দনের মতো রাত জেগে
বসে আছে সমসত্ম প্রকৃতি, নদী গাছ, মাটির
কুটির আর কৃষকের
পাঁজরা ও কপাল।
আমরা কাঠবিড়ালির মতো ত্রস্ত আনন্দে লাফিয়ে পড়েছিলাম চরের
মাটিতে,
আকাশ ছাড়া আমাদের আর কোন শিরস্ত্রাণ ছিল না,
মায়ের ভালোবাসা ছাড়া বুকের দু'ইঞ্চি নিচে ধুকপুক আমাদের
হৃদয়গুলোর জন্য ছিল না অন্য কোন রক্ষাধর্ম, আমাদের
পায়ের নিচে
ঘাস ছাড়া অন্য কোন পাদুকা ছিল না।
কেননা আমরা তখন গুম্ফায় পায়চারি করা কোনো সন্ত বৌদ্ধের
নগ্নপদ মহিমা,
আমরা তখন আকাশভেদকারী মস্তকে তারার উদ্ভাসগুলো গেঁথে নিয়েছি,
আর আমাদের হৃদয়ে তখন শত্রুকে ঘৃণা করার মতো আতীব্র সুখ।
আমরা সারস পাখির মতো অহংকারী মুখ, মাটিতে নত
করেছিলাম,
সামনে একটি ইস্পাতের কঠিন ব্রিজ, আমাদের
সকল লক্ষ্য তখন
যেখানে
কেন্দ্রীভূত
আমাদের পশ্চাতে স্মৃতির মতো মায়ের কান্নাভেজা চোখ
বোনের ‘ভাইজান ভালোয় ভালোয় ফিরে এসো' প্রেমিকার নীরব চোখে
এইমাত্র উড়ে যাবে এমন পাখিকে শেষ চুম্বনের মতো এক আকাশ মমতা।
হঠাৎ আমরা দেখলাম আমাদের সামনে কোন ব্রিজ নেই, ইস্পাতের
কঠিন বেড়ি নেই যাকে আমরা এখনই ভাঙবো, এমনকি নয়
শত্রুরাও...
আমাদের সামনে কৃষ্ণপক্ষের ওপারে, অন্ধকার
ব্রিজের ওপারে তখন
একটি মাত্র মুখ, সে আমাদের মা, প্রেমিকা, মাতৃভূমি
না স্বাধীনতা
তার বিচারে আমরা অক্ষম ছিলাম।
আর তখনই, ঐ শিঙ-বাঁকা চাঁদের নিচে, অন্ধকার
তারায় তারায় খচিত
সভাস্থলে সময় হলো, সেই মুগ্ধ
প্রহর যখন ওস্তাদ তার
মাথাটুকু কিঞ্চিত হেলাবেন, আর আমাদের
শিরায় শিরায়
রুদ্ধ ঝর্ণার ধারা অস্ত্রের ধাতব মুখে পুষ্পিত উল্লাসের মতো
আকাশ ও মাটিতে নামাবে আঠারো কোরাসের অঝোর বৃষ্টি,
ব্রিজের ইস্পাতের বুক উদ্দাম আনন্দে ধুলো হবে, নক্ষত্রের
শিরায় শিরায়
বেজে
উঠবে ফুলকির নুপুর।
জীবন ও মৃত্যুর মাঝখানে মুহূর্তের জন্য দুলে উঠলো ব্রিজ,
যেন কেউ আমাদের শিহরিত যৌবন টাঙিয়ে দিয়েছে কালো
দিগন্তের
দেয়ালে,
আর আমরা শীতের রাতে সূর্যের প্রার্থনাস্তবগানরত কৃষকের মতো
আমাদের মুখগুলো মাটির কাছাকাছি নামালাম, মমতার
বিন্দু বিন্দু রক্তে
চরের মাটিতে জ্বলন্ত ফুল ফোটানোর ঠিক আগ মুহূর্তে, কি
আশ্চর্য,
আমাদের চিবুকগুলো ভয়ে নয়, আসন্ন
মৃত্যুর সন্ত্রাসে নয়,
ভালোবাসার মতো এক আর্দ্র, কোমল
আবেগে ডুকরে কেঁদে উঠলো।
মানুষ
মানুষকে কেউ ধারণ করতে পারে না
না নিসর্গ না ঈশ্বর না প্রেম না ঘৃণা
মানুষের হাতে নীল বেলুন তার চোখে দুই কালো মাছি
মানুষকে কেউ ধারণ করতে পারে না, মানুষের
কোনো জন্মদাতা নেই, তার কটির
উত্তাল যৌবন কারো
উত্তরাধিকার নয়।
মানুষকে কেউ ধারণ করতে পারে না
না নিসর্গ না ঈশ্বরের দিগন্ত-প্রসারী আলখাল্লা
না নদী না জন্মভূমি।
মানুষের কোনো উপমা নেই, রূপকল্প
নেই, ব্যতিহার
বহুব্রীহি নেই, স্বরলিপি ব্যাকরণ নেই
শাসনতন্ত্র, অর্থ-অভিধান চর্যাচর্য নেই।
মানুষ আত্মভেদী, আত্মনাশী নীল পতঙ্গ
একদিন সে পাঁজরের হাড় দিয়ে গড়েছিল এ পৃথিবী
একদিন মানুষই ধ্বংস করবে তাকে।
না ঈশ্বর না দেবতা না পাষাণ মৃদঙ্গ না প্রভাত না
মধ্যরাতে নিমগ্ন বালিশ না ফোয়ারা না যোনি না
কবন্ধ রাত্রির ঘুম কোনো কিছু না।
শুধু মানুষই পারে নিজেকে ভাঙতে। যেমন
সাজাতে।
আমি সেই ভঙ্গুর ভঙ্গপ্রিয় ত্রিভঙ্গ মুরারির জন্যে
আমার কবিতা রেখে যাই।
আর কেউ নয়, আর কারো জন্যে আমার
দীর্ঘশ্বাস নেই, না গ্রন্থ না সুহৃদ না পলাতক
ভ্রমর গুঞ্জন না নারী না নিশ্চল বসন্ত বাহার...
আমি মানুষকে ভালবাসি কেননা সে একদিন
নিজহাতে নিজেকে পোড়াবে।
জীবনের সমান চুমুক
আরেকবার পাখিদের অট্টহাসি শুনে জেগে উঠলাম।
রাত্রির গাঢ় কুয়াশার সর দু’ হাতে
সরিয়ে
সূর্য চুমুক দিয়েছে আলোর বাটিতে, আর আমি
গত দিনের ক্ষুধার ক্লান্তি সারা শরীর থেকে শিশিরের
মতো মুছে দিলাম, চোখ মেলে চেয়ে দেখলাম ভোর
অথবা বিশুদ্ধ ভাষায় সেই প্রভাত যার কথা বহু দিন
বলা হয়েছে আমাকে, আমার
ক্ষুধার্ত পূর্বপুরুষদের
আমার বিশীর্ণ স্ত্রী এবং পুত্রকন্যাদের।
আহা ভোর, আহা প্রভাত। আমি
ডগোমগো
আনন্দের পুষ্পঝারিতে গোসল করলাম বহু দিন পর,
উপোসী রাত্রি জাগরণের পর হিমেল বাতাসের মধ্য দিয়ে
নিদ্রানামক ঘরে ফেরা, বাতাবিনেবুর
গন্ধ শুঁকে শুঁকে
ঘুমের পাতিহাঁসের পিছু পিছু শ্যাওলা পুকুরে ডুব।
হায়, এম্নি মুহূর্তে আরেকবার পাখিদের
অট্টহাস্য শোনা গেল,
‘তুই প্রভাত চাস, আলোর উদ্ধার চাস, পাতিনেবুর
বুকচেরা
সুগন্ধের আত্মদান চাস, স্বাধীনতা চাস? তুই মুর্খ।
রাত্রির ছেঁড়া অন্তর্বাস ফুঁড়ে বেরুনো জীবনের হাঁটু দেখে
ভাবিস তুই পেয়ে যাবি ভোর, ক্ষুধার
খাদ্যের সৌরভ!
তুই স্বাধীনতা চাস পাবি, মুক্তি
পাবি না।’
শরীরের রক্তের আক্রোশে তবে আমি কী চেয়েছি?
আমি জীবনের কণ্টক ডাল নুইয়ে এনেছি পিপাসার কাছে,
বুকের পাঁজর চিরে উপড়ে এনেছি আমার হৃৎপিণ্ড, হাড়ের
কাঠামো দিয়ে একে একে গড়েছি তিনটি মনোহর স্থাপত্য,
ক্ষুধার্ত চোখের সামনে আলোর হরিদ্রা মিছিল দেখে
আমি কি তাদের কৃষ্ণচূড়া ভেবে আশ্বসত্ম হইনি!
আমার দীর্ঘশ্বাস পাখিরা তাদের চঞ্চুতে তুলে নিল
আর ভোরের বাতাস আমার হাড়ের কাঠামো ভেদ করে
বাজাতে লাগলো বিষণ্ন সানাই, সূর্য তখন
গাঢ়
কুয়াশার সর দু’হাতে সরিয়ে চুমুক দিয়েছে আলোর বাটিতে,
অনাহারে ক্লিষ্ট মুখে তুলে আমি শেষবার বললাম, আমাকে
দাও শুধু একটি চুমুক, তারপর আরো
একটি দীর্ঘ রাত্রির
সক্রোধ বুকের মধ্যে আমি আমার পাতিহাঁস খুঁজে নেব।
আমার বিশীর্ণ ছায়া লেপ্টে থাকলো ঘাসের বিস্তৃত কপাটে,
শতাব্দীর হাহাকার আমার প্রসারিত হাতের নাগাল থেকে
কেড়ে নিল আলোর বাটি, বাতাবিনেবু, আমার
প্রশ্বাস,
আর তখন বিষণ্ন পাখিরা ফের আমাকে শোনালো শেষ কথা-
‘তুই মৃত্যুর স্বাধীনতা পাবি, মুক্তি
পাবি না।’
মোহর
ধুলোর ভেতর একজোড়া মোহর পড়ে আছে।
কাঠ কুড়িয়ে জড়ো করি, সন্ধানে
যাই আগুনের-
কোথাও পাই না।
তারুণ্য আমাকে বিদ্ধ করে তুলে নিলো ভোজসভায়
হাতের নাগালে পানপাত্র
অন্ধকার গিলে নিলো আমার ক্ষুধার আগুন।
তৃপ্তির পেছনে ছুটলাম, সে আমাকে
দেখালো নদী,
পিপাসা ঝুলিয়ে রাখলো আগডালে ঘুড়ির মতো,
প্রেম বললো, একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকো সারস।
ধুলোর ভেতর একজোড়া মোহর পড়ে আছে
আমি অহংকারী তা ছুঁয়েও দেখলাম না-
দেহ তুলে দিলাম ভিখিরিকে
চোখদুটো নিলো আগুন-আহারী সাপ
চারটি পুরুষ নিলো আমার উদ্ধার।
গেলাসের ভেতর মরে পড়ে আছে চিতল হরিণ!
মির্জা গালিবের না-লেখা কবিতা
তোমাকে খুঁজবো আমি দিনমান, খুঁজবো
বৃথাই,
শুধুই খুঁজবো পথে, পাবো না
জেনেও, যদি পাই
ব্যর্থ হবে তোমাকে আমার খোঁজা, তোমাকে
চাওয়ার
তৃষ্ণাটুকু বেঁচে থাক, সেই তো
পাওয়ার!
পথ চাই তা না হলে আমি আর পথিক থাকি না;
তোমার মনযিলে তুমি থেকে যাও নির্বিকার, আর
অনন্ত ঘূর্ণির পাকে আমাকে ঘোরাও বারবার-
কোথায় তোমার বাস আমি পান্থ খবর রাখি না।
জন্মান্ধ শোকের মতো বসে থাকব জানালায়
আহত বাঘের মতো চোখ রাখব শিকারীর দোনলায়
তোমার শ্বাসের গন্ধ সারাদিন আমাকে পোড়াবে
তোমার সুদূর হাত দুর্গশীর্ষে রুমাল ওড়াবে-
তোমার না-দেখা চোখে যদি জ্বলে আমার কবর
তবুও তোমার কাছে ক্ষমা চেয়ে দেবো না খবর।
কালো বাইবেল
আমার চোখের সামনে খোলা আমার প্রিয় বাইবেল।
বাইবেলে কোনো কালো মানুষের প্রতিকৃতি নেই।
মলাটের ওপর যিশুর স্বগীর্য় আনন, নম্র চোখে
করুণার ঝর্নাধারা, ঈষৎ
স্ফূরিত হাসি, সে-ও
বড়োবেশি সাদাময়, সুশোভন, ভালো।
আমি একজন কালো যিশুর প্রতিকৃতি খুঁজছিলাম।
ওরা শ্রীকৃষ্ণের মতো এক ঘনশ্যাম কবির মৃতদেহ
উপহার দিয়ে বলল, এই মুর্খ অমৃতের ভাগ চেয়েছিল,
আমরা ওকে মৃত্যুর হিস্যা বুঝিয়ে দিয়েছি।
আমি দেখতে চেয়েছিলাম শক্তিমান কোনো কালো স্যামসনকে।
ওরা একজন কৃষ্ণ বিপ্লবীকে কারাগারের অন্ধকারে ঠেলে দিয়ে
হেসে উঠল, আমরা ওর দুচোখ উপড়ে নিয়েছি,
ওর কুঞ্চিত কেশদামের স্পর্ধা কেটে নেয়া হয়েছে,
অতঃপর ওকে আমরা মেষশাবকের বিনয় শেখাবো।
আমি স্পর্শ করতে চেয়েছিলাম এক কালো মেরীর স্নেহার্দ্র চিবুক।
ওরা সোয়েটোর তিন সহস্র জননীর কোলে তুলে দিলো
গুলিবিদ্ধ লাশ;
তিরিশ লক্ষ কালো মানুষের রক্তে ভিজে গেলো বাঙলার মানচিত্র।
আমি গির্জার প্রশসত্ম চাতালে পড়ে থাকতে দেখলাম
অগণন কালো ঈশ্বরের মূর্তি, দীপ্তিমান
চাবুকের মতো।
স্বদেশের মানচিত্র
হাতে রক্তের নদী হেঁটে পার হলেন একজন কালোরঙ মুসা।
আমার বাইবেলের কালো অক্ষরগুলো অগুনতি কৃষ্ণকায় মানুষের মতো
নিরব শোকমিছিল করে পার হয়ে গেল অন্ধকারে :
আমার চোখের সামনে তখন শূন্যতার সাদা পৃষ্ঠা শুধু, ধু ধু।
তীর
তীরকে বানানো হয়েছিল কামারশালায়
কামারের
আঙুল পুড়িয়ে,
নেহাইয়ের
আতীব্র পাথর-বুকে
জ্বলন্ত
লোহার আত্মদান তারপর
অয়োময় হাতুড়িরর নির্ঘোষে নেমে আসা মৃত্যুর ভেতর
লৌহফলকের
জন্ম
জন্ম
নিলো তীর
ইস্পাতের
তীক্ষ্ণধার উন্মুখতা,
নির্জীব পড়ে থাকা তূণীরের
নিরবতার আত্মার মধ্যে ব’সে সে কাঁদে
ঐ
তীর,
একদা অগ্নিবর্ণ নেহাইয়ের ওপর
মায়ের
মতো চিৎ হয়ে শুয়ে জন্ম দিয়েছিলো
যে-লৌহখণ্ড
তার জন্যে সে কাঁদে,
জননীর
জন্যে সে কাঁদে,
নিজের
জন্য সে কাঁদে।
দূর আকাশের পারে নক্ষত্রেরা শোকে অধীর হয়,
ফেরেশতারা
ছুঁড়ে দেয় তাদের
হস্তধৃত
বর্শাগুলো,
করুণা তীব্রগতি ঘোড়ার সওয়ার হয়ে
আকাশময়
ঘোষণা করতে থাকে সেই শোককথা
সেই তীব্র ল্যামেন্টেশন হা পৃথিবী
হা
জন্ম-মৃত্যু, জগদীশ্বর-ঈশ্বর
কী
করে থামাবো
তীরের
ক্রন্দন
কী করে মেটাবো আবিশ্ব আমূল এই কান্না
সত্মব্ধতার সুইসুতা হাতে নিয়ে মা ধরিত্রী ডাকে
আয়
তোর দুঃখগুলো সেলাই করে দিই
তোর
টুটাফাটা
চৈত্রের ক্ষেতের মতোন বুকটাতে
বুলিয়ে
দিই মায়ের দরদ;
সূর্যদেব
তাঁর আলোর
বাল্বগুলো
ফাটিয়ে দিয়ে পাশে এসে বসেন
তবু
কান্না থামে না তীরের
সে তবে কী চায় ঐ তীর ঐ অয়োময়
পাষাণের
তীক্ষ্ণধার ফলা?
আনখ অনঘ শত্রু বিদ্ধ হতে চায়
আয়নায়
আয়নামহলদ্বারা
বেষ্টিত এ জঘন্য আত্মতার
জরীন
সনদ থেকে মুক্তি চায় সে
হতে
চায় পুনরায়
খনির
মনের ভেতর মগ্ন আকরিক
জ্যা-মুক্ত জীবনের
প্রতিশ্রুতি বিদ্ধ করে তীরের সত্তাকে।
প্রমিথি
কতবার জাহান্নামের আগুনে পোড়াতে চেয়েছ আমাকে
কতবার বুরুজ পর্বত থেকে ঝুলিয়ে রেখেছ
তোমার তরবারি
কত দিন ক্ষুধার্ত উদর নিয়ে কেঁদে কেঁদে
রাত করেছি কাবার
কত লক্ষ বছরের পাথর ঠেলেছি
পাহাড়ের ঢাল ঠেলে কেবলই উজানে
কতবার তোমার ইগল এসে ঠুকরে ঠুকরে
খেয়েছে নাড়িভুঁড়ি
তোমাকে দেখেছি অলিম্পাসের তুষারধবল
চূড়ার মহিমায়
তুমি ধরে আছ দুই হাতে বজ্র আর অশনির চাবুক
তুমি সেমিলির ঘরে যখন স্বর্ণবৃষ্টি
হয়ে নেমেছিলে, অপার তৃষ্ণায়
তোমার প্রেমের দান ভেবে ঘরে নিয়ে-
ছিলাম আগুন।
তোমার কাছে চেয়েছিলাম জীবনজিজ্ঞাসার উত্তর
তুমি আকাশ থেকে ভয়াল শব্দে ছুড়ে দিলে
দুইখণ্ড পাথর
দশটি নিষেধ দিলে, চেয়েছিলাম পিপাসার জল
রক্তের কম্বল দিলে, চেয়েছিলাম মিলনের হাত
তীব্র দ্রংষ্ট্রার ঘায়ে আমাকে ঝুলিয়ে রাখলে-
দুই পাশে দুজন তস্কর!
গ্যালিলির জলে রক্তমাখা হাত ধুয়ে নিয়ে
তোমার স্তোত্র পড়তে বসেছি খড়ের আগুনের আলোয়
তখন পূর্বাকাশে মন্দিরা বাজাচ্ছিল কার দুটি মোহন হাত
কেউ কেউ তোমার নাম করে গালমন্দ করতে করতে
পাহাড়ে ঢুকে গিয়েছিল, আর ফেরেনি
দুটি শহর আগুনে ছাই হলে পর স্বনিযুক্ত পরিত্রাতারা
তোমার নামের জয়ধ্বনি দিচ্ছিল দশ দিগন্তে
আমি তোমার নাম জিহ্বার অগ্রভাগে এনে
ছুড়ে দিলাম নিষ্ঠীবনের সাথে
আমাকে ক্ষমা করার কোনো অবকাশ তোমাকে দেব না
বলে গর্জমান মানুষের স্রোতে মিশে গেলাম
কেননা মানুষের গায়ের গন্ধ তখন আমার কাছে
পারিজাত কুসুমের চেয়েও আকর্ষণীয়
তোমার ইগলেরা জানি আজও আমাকে খুঁজছে।
ক বি তা-কুফরি কালাম by খোন্দকার আশরাফ হোসেন
আমার জীবন ছিল না-খোলা বইয়ের মতো
প্রথম পাতাটা তুমি উল্টেছিলে নিজ হাতে
গুঁজে দিয়েছিলে কয়েকটা ঝরা পাপড়ি
গোলাপ কিংবা অন্য কোনো মরসুমি ফুল
আজ মনে নেই, বহুকাল আগে, প্রাতে।
বহুকাল ছিল শুকনো সে-ফুল পাতার ভাঁজে
মনে হয়েছিল তুমিই রয়ে গেছ
শুকনো বকুল খরতাপে পোড়া ডালে,
যেমন আটকে বেঁচে যায় কোনো অলোক শিলার খাঁজে
গড়ানো মানুষ পাহাড়ের খাড়া ঢালে।
তোমার জীবন ছিল না-লেখা খাতার পাতা
একটিই নাম কাঁপা হাতে লিখেছিলে তাতে;
সারাটা জীবন সেই সে অক্ষরগুলো
তোমাকে দিয়েছে আগুনের উত্তাপ,
দহনের ওম, হূদয়পোড়ানো ভাঁপ
ঘুরে ঘুরে শুধু জপেছ সে নাম,
জ্বরের জড়োয়া জড়ায়ে শীতের রাতে
মানুষ যেমন ভুল বকে যায় তুলকালাম।
ভুলের সরণি ধরে একা একা হেঁটেছ যে-পথে
সঙ্গী হতে পারে না সে-পথে কেউ
দুর্গম আর ভয়াল মানস-বাঘেরা সেখানে শাণায়
ধারালো নখর, চিরে চিরে খায় সুষুম্নার লাল রক্ত;
ছিবড়ে শরীর অর্ধ-অসাড়, ভাষা-হারানোর বনে
তবু জেগে ছিল চার অক্ষরে দাগানো সে নাম—
জাদুকরের জিহ্বায় যেমতি কুফরি কালাম।
ঘোর বর্ষা
১
বৃষ্টির ছাতা মাথায় নিয়ে নির্দ্বিধায় নেমে পড়ি রাস্তায়।
আর কোনো ভয় নেই, ভয়ের ডরটা পেরুতে পারলে।
অঝোর ধারাবর্ষণ এসে মুক্ত করে দিয়ে গেল আমাকে―
আহ্ শান্তি, আকাশজোড়া মুগ্ধ মানকচুর ছড়ানো পাতাটা
আমাকে রক্ষা করছে বৃষ্টিময়তার মধ্যে, ভিজিয়ে দিয়ে।
যে-মেয়েটি ট্রাফিক সিগন্যালে ফুল বেচে, ভিজছে সে-ও,
তার হাতে ধরা গোলাপের গোছা দুটো জল খেয়ে সতেজ;
এই তুমুল বৃষ্টির মধ্যে কেউ গাড়ির কাচ খুলবে না জেনেও
এসে দাঁড়াচ্ছে থেমে-যাওয়া গাড়ির পাশে, অভ্যাসমাফিক।
জল দাঁড়ায়ে গেছে টাকনু তক, পানির হালট ভেঙে ওপারে
হেঁটে গেলেন পাজামা-গোটানো এক মৌলবী সাহেব।
কালস্রোতে ভেসে যাওয়া ধনমান লক্ষ করে বিষণ্ন এক পাগল
ভেজা কাকের সাথে অঝোরে ভিজতে থাকে চৌমাথায়।
রমনার গাছগুলো শতাব্দীর ঘুম-ভাঙা কলহে মেতেছে
বাবড়ি চুলের সাথে দীর্ঘ কেশদাম লুটোপুটি হাওয়ায় হাওয়ায়
ঝরাপাতা সাঁতার কাটছে তেলাপিয়া মাছ, প্রেমপত্র,
পরিত্যক্ত ঠোঙার সাথে জীবনের শেষ চিকিৎসার হ্যান্ডবিল ।
এত প্রাণ এত দু:খ এত নিরাভরণ দীনতা ও ক্ষুধা
সব ঐ নিরন্ধ্র বৃষ্টির মধ্যে মনে হয় হারিয়েছে ধার
সবকিছু ক্লান্তির অপর পারে আবছায়া ধূসরতা মৃত্যুমলিনতা
ঢেকে রাখে ক্রোধ, প্রেম, অহোরাত্র কলহের মানকচুপাতা।
২
ঘন বর্ষার দিনে কাচারিঘরের মধ্যে নানান দৃশ্যের জন্ম,
বাঁশের চাঙারি বানাচ্ছে কেউ, ফুটে উঠছে ডেভিডের তারা চাচড়ের ক্রসবুনোটে
কোন এক নাজেহাল শহর ভ্রমণের গল্প বলছে হাতফেরতা হুঁকা
সেবার মাছের ঝাঁক উঠে এসেছিল আউশের ক্ষেতজুড়ে খণ্ডকালীন মাছুড়েরা বলে
টেটা বল্লম হাতে ওয়াটারলু’ যুদ্ধের স্মৃতি কয়েকজন প্রাক্তন সেনার।
এদিকে হৈ হৈ পাঁচটি কিশোর বাতাবিনেবুর ওয়ার্লডকাপে
কাকেরা ভেজা ডালের মোরাকেবায় প্রসন্ন, কেউ কেউ হীনযানী অতন্দ্রচাক্ষুষ
কাদার ভেতর থেকে উজানি কৈয়ের হৃদি করতলে ধরে যেন বুদ্ধের যৌতুক।
ঘনবর্ষার দিনে তাসের আসরে সব টুয়েন্টি-নাইন -রঙ কল্পনার ধনু
আছাড়ি-পিছাড়ি যায় কিষাণীর জলভেজা কষ্ট শাড়ি নিঙাড়ি নিঙাড়ি।
কারো-কারো মনে পড়ে কে যেন পদ্মার বোটে ভেসেছিল দূরদেশি বাবু
দেখেছিল ছাতিমের উদার পাতার নিচে ভিজছে পিতৃগৃহষ্ণেু নায়রী
এবার হলো না গান সাজাদপুরের হাটে বিষয়ীরা ডুবিয়েছে নাও
বেহদ্দ পানির দরে পাট বেচে ঘরে ফেরে উদাস লালন ।
৩.
আকাশের জলকরঙ্কবাহীরা সারি সারি দাঁড়ায়ে গিয়েছে
আর ঢালছে তাদের কুম্ভ থেকে জল,
নিচে মানুষের সাধ্যমত ঘরবাড়ি, ধানক্ষেত, পালানের নামিলা মরিচ
ভেসে যাচ্ছে পানিয়া ভরনে নদীতীর উথালিপাথালি যায়
বাইচের নৌকা আর কলার ভেলার চলে সমতুল নওরোজ, ফেটিবাঁধা
গায়েনের দোহার ধরেছে মালকোচা পরনে কিশোর
কচুরিপানার ঘূর্ণি ঢোঁড়াসাপের হৃদয় কাড়িছে
হেঁকে যায় বজ্রের চাবুক হাতে তুড়–ক সওয়ার
জলের সিন্ধুক খুলে কী কী রত্ন পাওয়া যায় দেখে নেয় জেলে
উপরে টিনের বাদ্য ঝমাঝম বৃষ্টির নাচুনি
থামালে কত্থক নাচ একটুখানি টুসকি দেয়ে সোনার ছেলেরা
কবি পরিচিতি
খোন্দকার আশরাফ হোসেন : কবি প্রবন্ধকার ও সম্পাদক--একবিংশ। প্রফেসর, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
‘হোরেশিওর প্রতি হ্যামলেট’
উত্তরমুছুনতার অসামান্য কবিতা; সেটা পাচ্ছি না কেন?