সোমবার, ১৭ জুন, ২০১৩

খোন্দকার আশরাফ হোসেনের ৫টি কবিতা











পরিচয় শুরু হলো পাউল সেলানের অনুবাদ দিয়ে

কতবার জাহান্নামের আগুনে পোড়াতে চেয়েছ আমাকে
কতবার বুরুজ পর্বত থেকে ঝুলিয়ে রেখেছ
তোমার তরবারি
কত দিন ক্ষুধার্ত উদর নিয়ে কেঁদে কেঁদে
রাত করেছি কাবার

কত লক্ষ বছরের পাথর ঠেলেছি
পাহাড়ের ঢাল ঠেলে কেবলই উজানে
কতবার তোমার ইগল এসে ঠুকরে ঠুকরে
খেয়েছে নাড়িভুঁড়ি
তোমাকে দেখেছি অলিম্পাসের তুষারধবল
চূড়ার মহিমায়
তুমি ধরে আছ দুই হাতে বজ্র আর অশনির চাবুক
তুমি সেমিলির ঘরে যখন স্বর্ণবৃষ্টি
হয়ে নেমেছিলে, অপার তৃষ্ণায়
তোমার প্রেমের দান ভেবে ঘরে নিয়ে-
ছিলাম আগুন।
তোমার কাছে চেয়েছিলাম জীবনজিজ্ঞাসার উত্তর
তুমি আকাশ থেকে ভয়াল শব্দে ছুড়ে দিলে
দুইখণ্ড পাথর
দশটি নিষেধ দিলে, চেয়েছিলাম পিপাসার জল
রক্তের কম্বল দিলে, চেয়েছিলাম মিলনের হাত
তীব্র দ্রংষ্ট্রার ঘায়ে আমাকে ঝুলিয়ে রাখলে-
দুই পাশে দুজন তস্কর!
গ্যালিলির জলে রক্তমাখা হাত ধুয়ে নিয়ে
তোমার স্তোত্র পড়তে বসেছি খড়ের আগুনের আলোয়
তখন পূর্বাকাশে মন্দিরা বাজাচ্ছিল কার দুটি মোহন হাত
কেউ কেউ তোমার নাম করে গালমন্দ করতে করতে
পাহাড়ে ঢুকে গিয়েছিল, আর ফেরেনি
দুটি শহর আগুনে ছাই হলে পর স্বনিযুক্ত পরিত্রাতারা
তোমার নামের জয়ধ্বনি দিচ্ছিল দশ দিগন্তে
আমি তোমার নাম জিহ্বার অগ্রভাগে এনে
ছুড়ে দিলাম নিষ্ঠীবনের সাথে
আমাকে ক্ষমা করার কোনো অবকাশ তোমাকে দেব না
বলে গর্জমান মানুষের স্রোতে মিশে গেলাম
কেননা মানুষের গায়ের গন্ধ তখন আমার কাছে
পারিজাত কুসুমের চেয়েও আকর্ষণীয়
তোমার ইগলেরা জানি আজও আমাকে খুঁজছে।

চাঁদের খোঁয়ারি

চাঁদ সদাগরের নাও এইমাত্র জলাঙ্গির খাল ছেড়ে
ক্ষীরনদে পড়েছে
আর তখনি ছুটে এল দিগন্ত থেকে
একঝাঁক নীল কৈবর্ত্যের মতো বৃষ্টির ডাকাত
হামলে পড়ল ছৈ-গলুইয়ের ওপর; মাঝিমাল্লারা
দড়াদড়ি লগি বৈঠা ছেড়ে
দুই ঊরুর মধ্যে হাত নিয়ে সারেন্ডার করেছে;
লুঠিয়ারা
পাল ভিজিয়ে, বুড়ো চাঁদের গাল ভিজিয়ে
তার মাথার উষ্ণীষ পায়ের কাষ্ঠপাদুকা ভিজিয়ে দিয়ে
বসে থাকল, যাবার নাম নাই
যেন বহুদূরের সাগাই আসিচ্ছে কুটুমের
হুড়ুমের কোলা সাবাড় কৈত্তে!
ছৈয়ের ভিতরে ছৈ, তার মধ্যে পুত্রসহ বধূ,
একচোখ-কানা পদ্মাডাইনির চোখ এড়িয়ে
চলেছে ঘরে,
আজ কৃষ্ণাচতুর্দশীর রাতে
তাদের অতন্দ্র অসহস্পর্শ লোহার বাসর
আজ বোনা হবে ভাটিবাংলার আগুনসুতায়
চিরবিদ্রোহের আলোয়ান
তুমুল বৃষ্টির মধ্যে চাঁদমিয়া দেখছেন বাংলার
অনাগত ভবিষ্যৎ
নাচিয়া খেলিয়া সহর্ষে বাবরি দোলাইয়া
কৈবর্ত্যের পুত্ররা
মনসার সিংহপাহারা থেকে ছিনিয়ে আনছে
সোনার মাদুলি,
অনাগত রক্তের ধারাশীর্ষে তার মুক্তির কহ্লার!

সূর্য সেন হলের শহীদেরা

এক-একটা মুখ যেন বালির ভেতরে পোঁতা আধেক নৌকার মতো
অবয়ব নাক মুখ স্পষ্ট নয়, ঠিকানা হারিয়ে গেছে, বাড়িঘর বিষয়-আশয়
ছিল নাকি কেউ মায়ের আঁচলে ধন, পিতার আশার স্বপ্নঘেরা ছেলে,
কোনো তরুণীর গোপন চাহনি পড়েছিল কারও মুগ্ধ নওল দুচোখে কিনা,
আজ আর জানবার কোনোই উপায় নেই।
নামটুকু কেবলি উদ্ধার করি
নথিপত্র ঘেঁটে; চল্লিশ বছর বৈ তো নয়, ইতোমধ্যে অপরিচিতির মেঘ
ঢেকেছে তাদের মুখ, যেন তারা অবয়বহীন শহীদ নামের ইতিবৃত্ত,
যেন কোনো ভিন্গ্রহ থেকে আসা এলিয়েন,
আস্হাবে কাহাফ, কিংবা কোনো
সপ্তম শতকী ডুবে-যাওয়া নাবিকের চিরকুটে লেখা
কাহিনিবোতলে-পোরাআমাদের হাতে এসে পড়েছে দৈবাত্,
যেন তারা আমাদের কেউ নয়, কক্ষনো ছিল না।
একাত্তর আজ গল্প বটে, সযত্নে পাঠ্য লাল মার্জিনের খাতা
গল্প, বীরত্ব আর কপটতা, রক্ত আর মৃত্যুর অবাক কাহিনি মাত্র।
কিন্তু এরাও জীবিত ছিল একদিন, ছিল আমাদের সহপাঠী, আজও যারা
বেঁচে আছি, চিনতাম তাদের কাউকে কাউকে :
জিল্লুর মুর্শিদ, ইতিহাসের পড়ুয়া, ফরিদপুরের ছেলে, কিংবা আতাউর,
ময়মনসিংহ শহর থেকে পড়তে আসা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র,
কিংবা সাদত স্যার, মহান শিক্ষক, যিনি
এপ্রিলের কবলিত মধ্যদিনে বাসা থেকে সেই যে গেলেন নিউমার্কেটের দিকে,
আর ফিরলেন না কোনো দিন। বদিউল, আবদুর রহিম, আমিরুস সালাম
শামসুজ্জামান এবং মনির, তারা আজ গল্পে নেই,
নেই কোনো মার্জিনে কোথাও,
শুধু স্মৃতি কান্নার আখরে আঁকিবুঁকি এঁকে রেখে গেছে হয়তো মায়ের,
বোনের, প্রিয়ার মধ্যরাতের বালিশে, হয়তো তারাও গত এত দিনে;
ইতোমধ্যে শহীদের মুখগুলো বিস্মৃতির বাওড়ে উধাও
কবরের বাতিল ঘাসের মধ্যে ডুবে-থাকা হাল-ভাঙা নাবিকের নাও।
২৩-০৩-২০১০

*(
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্য সেন হলের শহীদদের স্মৃতিভাস্কর্য স্মৃতির জানালা ৭১’ উদ্বোধন করা হয়েছে ২৫ মার্চ ২০১০ মধ্যরাতের পর। সেই উপলক্ষে রচিত।)


যেতে হলে যাবো

একদিন রাঙাবালিয়ায় যাবো, একদিন সন্দিগ্ধপুকুর পাড়ে
নামাবো কষ্টের ভার। একদিন হরিষবিষাদপুর ডানে রেখে
তীব্র এক বাঁক খেয়ে ঢুকে যাবো আনন্দনিশ্চিন-গড়ে
কোনো একদিন শুভক্ষণ দেখে
দূর্বাঘাসের দেশে মৌপিপাসার নদে খেলবো ঝাঁপই
জন্মাবো পিপুলবৃক্ষ আত্রেয়ীর জলধোয়া কোনো এক মাটির উঠানে
হেঁটে গিয়ে বসবো দুখি কানাইবংশীর থানে
লোকে বলবে ক্যাংকা করে আলেন বাপই
আলোচাল ধোয়া হাতে কলাবউ নবীনা সুজাতা
নিগৃহী যুবার জন্যে কদলিপাতায় দেবে সুগন্ধ পায়স
একদিন চলে যাবো পায়ে ঠেলে মুগ্ধপুর কামুক তেমাথা
অশোক বৃক্ষের ডালে ত্রিকালের স্বপ্নচোষা অতৃপ্ত বায়স
একদিন সুখসমসি-পুর যাবো হাতের তালুতে নিয়ে কৃষ্ণ মধুমাছি
যাতি হলি যাবখন আপাতত কেষ্টনগরে নষ্ট গোঁসাই হয়াছি ॥


বৈয়াকণের প্রেমগীতি

তিন মাস গৌরবে ছিলাম বহুবচনের অন্তরালে টিকে,
তুমি ডাক দিয়েছিলে নৈঋতের অসম্পূর্ণ অন্ধকার বিচে
রূপবতী মধ্যমার উপমিত আকাঙক্ষার দিকে
তিন মাস বাসনার পরপারে টলটলে দিঘিটির নিচে
ঘুমিয়ে ছিলাম নঞ, তবু তৎপুরুষ তো বটে
মজ্জমান শাপলার নমিত মস্তক নিয়ে ক্লীবের সংশয়
মনে জাগে, পড়ে গেছি মনে হলো গভীর সংকটে -
তোমার জলের পাটাতন ফুঁড়ে জেগে ওঠা নয়
আমার কর্মধারয়। বহুব্রীহি-দিনে ধান উপচে ওঠে যাদের গোলার
নিত্য-নমস্য তারা সমস্যমান এ পৃথিবীর কোনোকিছু তাঁদের ছোঁবে না।
কৃপার ভিখারি আমি, সমপ্রদানের মতি হবে কি তোমার?
নিত্যবৃত্ত বর্তমানে তোমার আমার সন্ধি হবে কী হবে না
এই নিয়ে দ্বন্দ্বে আছি, অপিচ স্মরণ রাখো, মধ্যপদ আজো
লুপ্ত নয় যদি তুমি অনাবৃত, অপাবৃত মধ্যমায় বাজো।

৩টি মন্তব্য: