শনিবার, ২২ জুন, ২০১৩

যে শালিখ মরে যায় কুয়াশায়: কবি খোন্দকার আশরাফ হোসেন স্মরণ

তুষার গায়েন 

২১ জুন ২০১৩ ৯:৩১ অপরাহ্ন


কবি খোন্দকার আশরাফ হোসেনের মৃত্যু আমাকে যতটা বিষণ্ণ ও শোকাহত করে রেখেছে তার অধিক আচ্ছন্ন হয়ে আছি এক ছটফট করা অস্থিরতায়। সেটা যে তাঁর সাথে দীর্ঘকালের কাব্যসম্পর্ক বা ব্যক্তিগত ভালোমন্দের ঘনিষ্ঠতাই কারণ তা নয়; বরং একজন সৃষ্টিশীল, কর্মিষ্ঠ মানুষের অকাল প্রস্থানে প্রকৃতির কোথাও যেন প্রতিকারহীন এক অন্যায় সংঘটিত হয়েছে ভেবে আমার মন কোনোভাবেই তা মানতে চাইছে না। এখন আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে তাঁর অকালমৃত্যু শুধু অদৃশ্য প্রকৃতির ইশারায় নয়, বরং মনুষ্য চিকিৎসকের অবহেলাও দৃশ্যমান, দণ্ডযোগ্য কারণ। জীবনের সমান চুমুকে যার প্রত্যয় ও অধিকার, তিনি কেন তৃষ্ণার্ত থেকে অকালে বিদায় নেবেন এবং আমাদের রেখে যাবেন নিদারুণ আফসোসে!

তিন রমনীর ক্বাসিদা-র মাধ্যমে যাঁর বাংলা কাব্যজগতে আত্মপ্রকাশ, গোধুলি সন্ধ্যার রহস্যে হাতছানি দিয়ে ডাকা তিনজন নারী যাদের আমরা দেখেছি পৃথিবীর বিভিন্ন মিথ, রূপকথা ও চিত্রকলায় তারা যেন নবজন্ম নিয়ে হাজির হয় খোন্দকার আশরাফের কবিতায় এবং অবশ্যম্ভাবীরূপে নারীত্রয় উন্মোচন করে এক নতুন কবির জিজ্ঞাসাদীর্ণ আত্মপরিচয়, প্রজ্ঞা ও জীবন দর্শন। চেতনাঋদ্ধ হয়েও কবিতাকে রহস্যের চাদর কিছুটা ঘিরে থাকুক এমন আকাঙ্ক্ষা যদিও ছিল, তবু নিমগ্নতা তাঁর একমাত্র চরিত্র বৈশিষ্ট্য নয় বলে বারে বারেই তা উঠে এসেছে জীবনের উপরিতলে, ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ স্বদেশ ও পৃথিবীর রূপারোপে বিভিন্ন মাত্রায়।[১] বাংলার হাজার বছরের সংস্কৃতি ও কাব্য ঐতিহ্যের সাথে সম্পৃক্ত থেকে, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় আস্থা রেখে মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে বিশুদ্ধ কবিতার চর্চা ও প্রসারে অবিচল থেকেছেন আমৃত্যু।
khondoker.gif
একটু পরিণত বয়সে তিনি কাব্যজগতে আত্মপ্রকাশ করেন যখন তাঁর সতীর্থদের অনেকেই ষাটের শক্তিমান কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। আশির দশকে যখন তিনি সামনে এলেন, বয়সে তরুণতর সহগামী কবিরা পঞ্চাশ ও ষাটের উত্তরাধিকার নিয়ে সত্তরে অপব্যয়িত ও প্রায় জীর্ণ হয়ে যাওয়া কাব্যভাষার বিপরীতে গভীরতা সন্ধানী, নতুন কাব্যভাষা ও প্রকরণ সন্ধানে সোচ্চার। খোন্দকার আশরাফও সেই ধারার অন্যতম প্রবক্তা, তবে শেকড়চ্যুত ও উৎকেন্দ্রিক নন যা আশি ও পরবর্তী দশকের অনেক কবির ভেতর লক্ষ্য করা যায়। তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন মূলতঃ পঞ্চাশ-ষাট-সত্তর এই ত্রিকাল ও আশি-নব্বই-উত্তর দশক সমূহের সংযোগ রেখা হিসেবে এবং নবায়ন করে গেছেন নিজেকে ক্রমাগতঃ উত্তীর্ণ করে নিতে। পার্থ তোমার তীব্র তীর(১৯৮৬), জীবনের সমান চুমুক (১৯৮৯), সুন্দরী ও ঘৃণার ঘুঙুর(১৯৯১), নির্বাচিত কবিতা (১৯৯৫), যমুনাপর্ব (১৯৯৮),জন্মবাউল (২০০১), কবিতাসংগ্রহ (২০০৫), তোমার নামে বৃষ্টি নামে (২০০৮), আয়(না) দেখে অন্ধ মানুষ (২০১১), কুয়াশার মুশায়েরা (২০১৩) নামের কাব্যগ্রন্থগুলোতে কাল পরিবর্তনের লক্ষণ ও নিজেকে ক্রমাগত অতিক্রম করে যাওয়ার ছাপ সুস্পষ্ট। প্রচুর স্মরণযোগ্য, উৎকৃষ্ট কবিতা তিনি রচনা করেছেন এবং তার অধিক নতুন কাব্যস্পৃহাকে ধারণ ও বিকশিত করতে প্রায় তিন দশক ধরে সম্পাদনা করেছেন ‘একবিংশ’-র মত উচ্চমানের কবিতা পত্রিকা। `একবিংশ’-র ২৫ বর্ষ পূর্তি উপলক্ষ্যে যখন আমি আর দেশে নেই, অনেক স্মৃতিতাড়িত হয়ে লিখেছিলাম, “আমি জানি, কোথাও কোনো কিছুকে ঘিরে এক বন্ধন রচিত হয়েছিল — ধুলোওড়া ফাল্গুনের বিকেলে সারি সারি বইয়ের অস্পষ্ট গুঞ্জন আর সতীর্থদের বুক-ধুকপুক করা সোনার হরিণ ধরার বৃত্তভেদী পদসঞ্চালন— গোল হয়ে বসে বহুক্ষণ আড্ডা, ধুমায়িত চা-পান-ধোঁয়া-সহযোগে কবিতার খানাখন্দ খোঁজার পাশাপাশি এঁর-ওঁর মুণ্ডুপাত ও অদূরে প্রেসের শব্দ— লেখা দেওয়ার ডেডলাইন— তরুণতম কবি এলেন কাঁপা কাঁপা হাতে সদ্যোজাত কবিতাটিকে প্রেসের শেষ ট্রেনে তুলে দিতে—এইসব কিছু ‘একবিংশ’কে ঘিরে আমার এখন মনে পড়ে। … … … মিডিয়া-প্রাবল্যের যুগে অনায়াস মুদ্রণের সুযোগ ও মেধাহীন অত্যুৎসাহীদের ভিড়ে এমন কবিতা পত্রিকার প্রয়োজন ছিল যা কিনা হবে কালের ছাঁকনি, যেখানে কবিতা সহজে ছাপা যায় না এবং ছাপা হওয়ার অর্থ কাব্য সম্ভাবনার এক রকম স্বীকৃতি — এমনই একটি মান ‘একবিংশ’-র অভীষ্ট ছিল এবং তা অর্জনও করেছে নিঃসন্দেহে। মধ্য আশিতে খোন্দকার আশরাফ যখন পত্রিকাটি প্রকাশ করেন তখন তিনি এমন ঘোষণাও করেছিলেন যে, একবিংশ হবে সৃজন আকাঙ্ক্ষায় ভরপুর, মেধাবী ও অপ্রতিষ্ঠিত তরুণদের আত্মপ্রকাশের পাটাতন, যেখানে মেধাহীন অথবা তথাকথিত প্রতিষ্ঠিত সূর্যের কোন স্থান নেই। হয়েও ছিল তাই, সত্তর-পরবর্তী বাংলাদেশের কবিতায় তরুণদের মধ্যে পরিবর্তনের যে আকাঙক্ষা প্রবল হয়ে উঠেছিল, তা যথেষ্ট উৎসাহ ও প্ররোচনা সংগ্রহ করে নিতে সক্ষম হয় বিশ্বব্যাপী আধুনিকতাবাদী দর্শন ও চিন্তাকাঠামো নতুন তাত্ত্বিক ও দার্শনিকদের দ্বারা ব্যাপকভাবে সমালোচিত এবং আক্রান্ত হওয়ায়। পোস্টকলোনিয়াল, পোস্টস্ট্রাকচারাল ও পোস্টমডার্ণ ডিসকোর্স তরুণদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, বিশেষতঃ এসব বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গে চর্চার ঘনত্ব ও তার প্রভাব বাংলাদেশেও বিস্তৃত হয়। খোন্দকার আশরাফ নিজে কবি, ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক ও কৃতী অনুবাদক হওয়ায় বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন আধুনিকতাবাদী কাব্য আন্দোলনের সঙ্গে পাঠককে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন ও উপহার দিয়েছেন বিদেশী কবিতার ঝকঝকে অনুবাদ; পাশাপাশি নতুন হাওয়া বদলের খবরও রেখেছেন এবং যথাসম্ভব চেষ্টা করেছেন `একবিংশ’-এ তা ধারণ করতে। তাঁর বিশেষ কৃতিত্ব এই যে, তিনি তত্ত্বের পাগলা ঘোড়ায় চড়ে লাগাম হারাতে রাজী হননি বরং উত্তরাধুনিকতাবাদী তত্ত্বের আড়ালে ঘাপটি মেরে থাকা বুদ্ধিবৃত্তিক মৌলবাদীদের অকুণ্ঠ সমালোচনা ও বিরোধিতা করেছেন — সেটা তাঁর প্রবন্ধে, ক্ষুরধার সম্পাদকীয়তে এবং প্রকাশ্য মঞ্চে।” [২]
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই দীর্ঘদেহী, প্রাণবন্ত, সজ্জন ও শ্লেষপ্রখর মানুষটি নিজের পেশা, শিল্প সাধনা ও সংসার ধর্মের মধ্যে আশ্চর্য ভারসাম্যে সমন্বয় সাধন করে গেছেন এবং কবিদের ক্ষেত্রে যে ধরণের জাগতিক ব্যর্থতা প্রায় স্বাভাবিক বলে দৃশ্যমান হয়, সেটা তাঁর ক্ষেত্রে ছিল না বলেই জানি। প্রখর দায়িত্বজ্ঞান ও আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন খোন্দকার আশরাফকে অতি তরুণ বয়সে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ ও চার সন্তানের জনক হওয়ায় সংসার ধর্ম পালনের যে কঠিন দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে হয়, তাতে কবিসুলভ উদাসীনতা ও বেহিসেবী আবেগের স্থান সম্ভবত তাঁর জীবনে বেশী ছিল না যা তিনি পক্ষান্তরে নিজের সম্পর্কে একাধিকবার আলাপচারিতায় বলেছেন, “আমি পাহাড়ে উঠতে একটি ধাপ কেটে তার উপর দাঁড়িয়ে পরবর্তী ধাপটি কেটেছি।” দ্রোহ ও দার্শনিকতার পাশাপাশি কবিতায় তিনি যথেষ্ট আবেগী ও রোমাণ্টিক; কিন্তু বাস্তবে তাঁর সমালোচক সত্তার প্রকাশ ছিল অগ্রনী যা পরিহাসময় শ্লেষ ও ছোট ছোট বাক্যবাণে শুধু প্রতিপক্ষকেই নয়, বন্ধু এবং ভক্তদেরও আঘাত করতে কুন্ঠিত ছিল না। ফলে তিনি কখনোই খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন নি যা স্পষ্টবাদী বক্তাদের ক্ষেত্রে ঘটে থাকে। তিনি সৃষ্টিশীলতার স্বার্থে ও প্রাণের তাগিদে তাঁর পেশাগত ও সামাজিক অবস্থান থেকে নেমে এসে তরুণদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু বুকের মধ্যে টেনে নিতে পেরেছেন এমন নজির দেখা যায় না। তাঁর যে যোগ্যতা, সৃষ্টিশীলতা ও কর্মনিষ্ঠা তাতে তাঁর পক্ষে আরো বেশি ভক্ত পরিবেষ্টিত থাকা এবং ‘একবিংশ’ পত্রিকাকে কেন্দ্র করে একটি বড় মাপের সাহিত্য পরিমণ্ডল গড়ে তোলা অস্বাভাবিক ছিল না। শেষাবধি তিনি আত্মকেন্দ্রিকতার বাইরে খুব একটা বেরিয়ে আসতে পারেন নি বলে আমার বিশ্বাস। পাশাপাশি বাংলাদেশের সার্বিক রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি, সুবিধাবাদ ও ক্রমবর্ধমান বুদ্ধিবৃত্তিক মৌলবাদের তিনি অদৃশ্য শিকার হয়েছিলেন, কারণ তিনি ছিলেন এসব কিছুর বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদী কন্ঠস্বর।
কানাডায় অভিবাসী হয়ে আসার ৬ বছর পর গত বছর দেশে যাই। বহুকাল পর আবার সেই বইমেলার চত্বর, ফাগুনের আগুনে পায়ে পায়ে ধুলো ওড়া, নিজের নতুন কবিতার বইয়ের স্পর্শানুভূতি এবং অনিবার্যভাবে কবি খোন্দকার আশরাফ হোসেন ও পুরনো বন্ধু-বান্ধবদের সাথে আড্ডায় ফিরে যাওয়ার আনন্দ। দীর্ঘদেহী মানুষটি লিটল ম্যাগাজিন চত্বরে নিজের ‘একবিংশ’ স্টলে এসে বসেছেন সদ্য প্রকাশিত কবিতা, প্রবন্ধ ও অনুবাদের বই নিয়ে, সাথে আছে ‘একবিংশ’-র নতুন, পুরনো অনেক সংখ্যা। মেলার শেষের দিকে অনেক তৃপ্তির হাসি নিয়ে বলতেন, “এবার বই ভালো বিক্রি হয়েছে।” বই প্রকাশকদের অবহেলা ও মিডিয়া মাফিয়াদের উপেক্ষা করে এভাবেই বিকল্প ধারার সাহিত্য সৃষ্টি ও আন্দোলনের একজন পথিকৃত হয়ে উঠেছিলেন খোন্দকার আশরাফ হোসেন।
এই সৃষ্টিশীল, নিভৃতচারী ও কর্মিষ্ঠ বহুমুখী প্রতিভাবান মানুষটিকে প্রকৃতি ও মনুষ্য চিকিৎসকেরা এত দ্রুত পৃথিবীর আলো থেকে উঠিয়ে না নিলেও পারতেন। আমি তাঁর লোকান্তরিত আত্মার শান্তি কামনা করি।

উল্লেখসূত্র:
[১] তুষার গায়েন, স্বদেশের মর্ম থেকে উঠে আসা কবি, একবিংশ, সংখ্যা ১৪, ঢাকা, ১৯৯৫
[২] ঐ, সাহিত্যের ছোট কাগজ একবিংশ-র ২৫ বছরপূর্তি: কালের ছাঁকনি—অর্জন ও আকাঙ্ক্ষা, একবিংশ, ২৫ বছর পূর্তি সংখ্যা, ঢাকা, ২০১০

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন