রবিবার, ১৬ জুন, ২০১৩

খোন্দকার আশরাফ হোসেনের প্রয়ানে ফেসবুকে শোক-লেখা


জাকির তালুকদার--
আমাদের ভাষার অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কবি খোন্দকার আশরাফ হোসেন আজ মারা গেলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছেন। মাত্র কয়েকমাস আগে ত্রিশাল কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছিলেন। মুল পরিচয় কবি, এবং গুরুত্বপূর্ণ কবিতাপত্রিকা 'একবিংশ'-এর সম্পাদক। 
তাঁর সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা বা সখ্য তেমন ছিল না। দেখা হলে শুভেচ্ছা বিনিময় করতাম। তাঁর পত্রিকায় আমি একটিমাত্র কবিতা লিখেছিলাম।
তারপরে আমি কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি গদ্যে মনোনিবেশ করেছি। কিন্তু নিয়মিত পড়েছি একবিংশ এবং তাঁর কবিতা। তাঁকে দেশের গুরুত্বপূর্ণ কবি হিসাবেই বিবেচনা করেছি সবসময়। তিনিও আমার লেখা গল্প মনোযোগ দিয়েই পড়তেন শুনেছি। 'চিহ্ন' পত্রিকার সাক্ষাৎকারে তিনি আমাকে দেশের অন্যতম প্রধান গল্পলেখক বলেছিলেন। 
মনে আছে 'একবিংশ' পত্রিকার ১০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য দিতে এসে হুমায়ুন আজাদ এমন জঘণ্য বক্তব্য ও নীচতার পরিচয় দিয়েছিলেন যে আমরা অনেকেই রেগে গিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি আমাদের শান্ত করেছিলেন। 
বামপন্থীদের 'রামপন্থী' বলেছিলেন বলে তাঁর সাথে আমি কথা বলা বন্ধ করেছিলাম। তিনি পরে নিজের অর্বাচীন মন্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। 
বাংলাদেশের অনেক হেজি-পেজি কবি বাংলা একাডেমী পুরস্কার পেলেও খোন্দকার আশরাফ হোসেন পাননি। ড আনিসুজ্জামানদের এই ধরনের অপরাধের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।

আহমাদ মোস্তফা কামাল--
চলে গেলেন কবি খোন্দকার আশরাফ হোসেন। অপ্রত্যাশিত, অকাল এই প্রয়াণ। নাকি বাড়ি গেলেন? মনে পড়ে, অন্তত বছর বিশেক আগে তাঁর 'বাড়ি যাবো' কবিতাটি পড়ে দারুণ আপ্লুত হয়েছিলাম, যেন নিজেকেই দেখে উঠেছিলাম ওই কবিতায়। আজ এতদনি পর তাঁর প্রয়াণের খবর পেয়ে সেই কবিতাটিই মনে জেগে উঠলো আবার, আর মনে হলো- কবিতা হারায় না কখনো, কবিদেরও মৃত্যু হয় না আসলে। এরপর থেকে তিনি তাঁর কবিতা নিয়েই ছিলেন আমার সঙ্গে এতগুলো দিন, থাকবেনও।

বাড়ি যাবো, বাড়ি যাবো, বাড়ি...
পথ ছাড়ো অন্ধকার, পথ ছাড়ো দূরত্বের দূরগামী পথ
বাড়ি যাবো, বাড়ি...

বৈশাখের বটবৃক্ষ তালুতে কপোল রেখে বলে, 'হায়,
এ ছেলেকে কিছুতেই ফিরতে দেয়া চলবে না'; নগরীর পথ,
দালানের পরভৃত কোকিলের পঞ্চস্বর ডেকে বলে, শোন
তোর কোনো বাড়ি নেই,
অন্তরঙ্গ উচ্চারণে যাকে বলে হোম
সুইট হোম - সে আজ ভেসে গেছে বিস্মৃতির যমুনার জলে।
তোমার আসার জন্য কেউ নেই হাট করে ঘরের দরোজা,
পলাতক সময়ের ঝুঁটিবাঁধা কাকাতুয়া
দাঁড় ছেড়ে পালিয়েছে সেই কবে; ঘাটলার কাঠগুলো
কবে কোন চোর
নিয়ে গেছে অন্তপুরে চুলোর হৃদয় জুড়ে শান্তি দেবে বলে।

তবু বাড়ি যাবো, বাড়ি যাবো, বাড়ি....
পথ ছাড়ো সুসময়, প্রতিশ্রুত সুখনিদ্রা, নিমগ্ন বালিশ,
পথ ছাড়ো জীবনযাপন ব্যথা, পথ করে দাও।
আজ যাবো
ঝিনাই নদীর জল হাঁটুতে কাপড় তুলে পার হবো,
মধ্যরাতে ডাক দেবো
মা মাগো এসেছি আমি! সেই কবে গভীর নিশীথে
তোমার নিমাইপুত্র ঘর ছেড়েছিল, আজ কাশী বৃন্দাবন
তুলোধুনো করে ফের তোর দীর্ণ চৌকাঠে এসেছি।

আমার কিছুই হলো না মা, লোকে বলে আমি ভীষণ নারাজ
জীবনের তপ্ত গালে চুমু খেতে,
আমি ভীতু, জীবনের দ্রুতগাড়ি বৃদ্ধাঙ্গুলি তুলে কেন থামাতে পারি না,
হিচহাইকিঙ করে কত লোক চলে গেলো দূরতম গন্তব্যে, তবুও
আমি একা এখানে দাঁড়িয়ে আছি,
বাসভাড়া হয়েছে লোপাট অন্য কারো কলাবতী আঙ্গুলের হাতে
তবু আমি বাড়ি যাবো বাড়ি যাবো, বাড়ি
এ বিশাল পৃথিবীতে এ মুহূর্তে অন্য কোনো গন্তব্য তো নেই!

পথ ছাড়ো অন্ধকার, পথ ছাড়ো দূরত্বরে দূরগামী পথ
বাড়ি যাবো, বাড়ি..

চলে তো যেতেই হয়; একটু তাড়াতাড়ি যেতে পারাটাও আসেল খারাপ নয় শেষ পর্যন্ত। তবু আপনার স্মিত হাসিমাখা মুখটি, প্রকাশে কুণ্ঠিত অথচ কোমল স্নেহমাখা চোখটি মনে পড়ে চোখ ভিজে উঠতে চাইছে, প্রিয় কবি আমার।

কবিতার জন্য এক জীবন
কবি খোন্দকার আশরাফ হোসেন তাঁর জীবনের পুরোটাই ব্যয় করেছেন কবিতার পেছনে। পেশাগতভাবে তিনি ছিলেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। কিন্তু এ পরিচয় তাঁর কাছে কখনই বড় ছিল বলে আমার কাছে মনে হয়নি। তিনি তা মনেও রাখতেন বলে মনে হত না। নব্বই দশকে আমরা যখন তাঁর সাথে আ্ড্ডা দিতে শুরু করি তিনি আমাদের মিশতেন বন্ধুর মতো। আমরা যে ছাত্র এটা মনেই রাখতেন না। অথচ তখনই তিনি পূর্ণ অধ্যাপক। কথাবার্তা এমন করে বলতেন যেন ইয়ার-দোস্ত। আমরা খুব আসকারা পেতাম। তাঁর প্রয়াণের পর এখন বুঝতে পারছি তিনি সারাক্ষণ থাকতেন কবিতাগ্রস্ত। আমরা তরুণ কবিরাই ছিলাম তাঁর সে কবিতাগ্রস্ততার সঙ্গী।
কাল যখন তাঁকে বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গনে আনা হলো চারিদিকে তাকিয়ে দেখি শেষ পর্যন্ত তাঁর শেষ যাত্রায় বিদায় জানাতে এসেছি ক’জন তরুণ কবিই। কোন মন্ত্রী আসেননি, এমপি,আমলা আসেননি।এসেছি শুধু কবিরা। সিনিয়র কবিদের মধ্যে সৈয়দ শামসুল হক আর মুহাম্মদ নুরুল হুদাকে চোখে পড়ল। জানাযায় এক কাতারে দাঁডিয়েছি আমি, বন্ধু চঞ্চল আশরাফ, কবির হুমায়ুন, শামীমুল হক শামীম, শামীম রেজা এরকম আর বিশ পঁচিশ জন। অথচ এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। যদি কাল ওখানে আসতো একজন তৃতীয় শ্রেণির ঔপন্যাসিকের মরদেহ, বা দলবাজি করা কবির তাহলে শোকের হল্লা পড়ে যেত। মন্ত্রী এমপি, আমলারা আসতেন। খোন্দকার আশরাফ হোসেনের দোষ ছিল তিনি ভাল লিখতেন, রাজনৈতিক দলবাজী করতেন না। আর ভাল লেখার কদর এ রকমই এ পোড়ার দেশে। জানাযায় দাঁড়িয়ে চোখ ফেটে জল এলো।
যোগ্য কোন সম্মানই তিনি পাননি। না পুরস্কার না রাষ্ঠ্রীয় পদক। মরার মাস আগে পেশাগত তিনি যে পদ পেয়েছিলেন সেটি তাঁর কাম্য ছিল বলে আমার কাছে মনে হয়নি। কবি কেন ভিসি হতে যাবেন। তিনি কবিই হতে চেয়েছিলেন। জীবন বিনিয়োগ করেছিলেন কবিতার জন্য, শুধু কবিতার জন্য। এবং তিনি কবিই শেষ পর্যন্ত আমাদের কাছে। বিদায় প্রিয় কবি আশরাফ হোসেন।
খলিল মজিদ—
হঠাৎ করেই খোন্দকার আশরাফ হোসেন স্যারের মৃত্য্ সংবাদটা পাই। দুদিন ধরে হাসপাতালে কেন জানলাম না। সাধারণত এমন তো হয় না। কিছু হলে তো আমাকে জানাতেন। এবার জানালেন না। 
ল্যাব এইড-এ দৌড়ে গিয়ে তার লাশ দেখলাম। কীভাবে যে আজকের দিনটা গেল।ফেসবুক খোলার মত সময় বা বোধ হয়নি। অনেক বছর ধরে আমরা একটা পরিবারের সদস্যের মতো। কীভাবে তাঁকে ছাড়া আমাদের চলবে!
কবি খোন্দকার আশরাফ যতটুকু তার চেয়ে কম নন আমার স্যার বন্ধু অভিভাবক খোন্দকার আশরাফ। 
তাকে বিদায় জানাবো কীভাবে!

M Mahedi Hassan 
বই মেলায় আমার দেখা সবচেয়ে সতেজ-সজীব-স্বতঃস্ফূর্ত-সুহৃদ মানুষের মধ্য কবি খোন্দকার আশরাফ হোসেন, কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদার, গল্পকার রফিকুর রশিদ অন্যতম । বয়সের তুলনায় তাদের সতেজতা যেন কিশোর বয়সীদেরও হারমানাতে বাধ্য ।। তাদেরই একজন কবি খোন্দকার আশরাফ হোসেন হঠাৎই চলে গেলেন । সদ্যই তিনি ত্রিশাল কবি কাজী নজরুল বিশ্ব: -এ উপাচার্য হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন ।

নিজের বেশিরভাগ বই তিনি নিজেই প্রকাশ করতেন । লিটলম্যাগ চত্বরে নিজেই বসতেন বিক্রি করতে । অসাড় লেখকদের স্টার বানানোর নষ্টামিডিয়া খেলায় তিনি ছিলেন চরম অবহেলিত । অবহেলা নিয়েই চলে গেলেন । হয়তো অভিমান নিয়েও ।

Tapan Bagchi 
খোন্দকার আশরাফ হোসেনের সঙ্গে পরিচয় ‘পার্থ তোমার তীব্র তীর’ পাঠের মাধ্যমে। ‘আলাওল সাহিত্য পুরস্কার’ নিতে ফরিদপুর গিয়েছিলেন। সেই পরিচয় অক্ষুণ্ন ছিল আমৃত্যু। মাঝে-মাঝে দু-একবার ঝগড়াঝাটিও হয়েছে সাহিত্যের বিষয় নিয়ে। কিন্তু তিনি অগ্রজের মহত্বে আমাদের কাছে ধরে রেখেছেন। জাতীয় কবি কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হওয়ার তাঁর সঙ্গে দেখা তাঁর কক্ষেই। বললাম, উপাচার্যের চেয়ারে কবিকে কেমন দেখায়, তা দেখতে এলাম। বলেই ছবি তুলে নিলাম। তারপর সেমিনার কক্ষে আমার আলোচনার সময় তিনি দর্শকের আসনে উপবিষ্ট ছিলেন। আমি মঞ্চ থেকেই সেই ছবি তুলে রাখলাম। কিন্তু আশরাফ ভাই, আপনি এত তাড়াতাড়ি ছবি হয়ে যাবেন, তা জানলে এই ছবিগুলো আমি তুলতাম না! প্রিয় কবি, প্রিয় সম্পাদক, প্রিয় অনুবাদক, প্রিয় প্রাবন্ধিক, প্রিয় শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. খোন্দকার আশরাফ হোসেনের অকালমৃত্যুকে আমি মেনে নিতে পারছি না।

Billal Mehdy
'একবিংশ' আমাকে সাহস দিয়েছিল। 
১৯৯৭-৯৮ সাল, তখনো ময়মনসিংহেই গন্ডিবদ্ধ ছিলাম, কোনো ছোটকাগজে নয়, লোকাল দৈনিকগুলোতে। একদিন সাহস করে 'একবিংশ'-এর ঠিকানায় পাঠিয়ে দিলাম এক গুচ্ছ কবিতা। এরও অনেক আগে থেকেই আমি একবিংশের খোঁজ-খবর জানতাম, আমার চক্ষু খুলে দেওয়া অগ্রজের (মুজিব মেহদী) বরাতে। 'নবাগত কয়েকজন' শিরোনামে একবিংশে একটা অধ্যায় ছিল, বর্তমান সময়ের উল্লেখযোগ্য অনেকের লেখাও ওটাতে ছাপা হয়েছে, আমারও হয়েছিল। ('একবিংশ'র ওই সংখ্যাটি কবি আবুল হাসানকে নিয়ে হয়েছিল কী-না মনে করতে পারছি না) 'একবিংশ'-এর এই প্রেরণা আমাকে পথ চিনিয়েছিল। 
তখন থেকেই এই সম্পাদক মশাই খোন্দকার আশরাফ হোসেন-কে চিনতাম, আজ হঠাৎ অপরিচয়ের অদৃশ্য সুতোয় টান পড়ে গেল। অথচ ভাবছিলাম, এইতো গেলো শুক্রবার ময়মনসিংহে যাবার পথে- একদিন হয়তো পরিচয়ের সূত্রটাকে আরও পোক্ত করে নেব এই ত্রিশালেই- জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাগত ভিসির সাথে।

আমার কিছু ভালো লাগছে না Ashraf ভাই।

হে কবি, হে সম্পাদক, যেখানেই থাকুন- সুন্দর ও কবিতাময় হোক আপনার মৃত্যুপরবর্তী দিনগুলো...

Tuhin Das
কবি, নিষ্ঠাবান সম্পাদক, অনুবাদক খোন্দকার আশরাফ হোসেনের মহাপ্রয়াণে শোকাভিভূত । বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে তরুণ এক কবির বইয়ের পাঠ উন্মোচন অনুষ্ঠানে কথা হয়েছিলো গত বছর। মাইকে বলেছিলেন : বরিশালের দু'জন কবিকে আমি জানি। হেনরী স্বপন ও তুহিন। বিশ্বসাহিত্য নিয়ে তার অগাধ পাণ্ডিত্য মুগ্ধ করেছিলো আমায়। তার অনুবাদেই পড়ি টেড হিউজের কাক সিরিজ, ওনার সম্পাদিত 'একবিংশ' পত্রিকায় ছাপা হয়েছিলো কবি আবুল হাসানের অপ্রকাশিত আরেকটি টিভি নাটক, তার পত্রিকার অসাধারণ সেই জীবনানন্দ-নজরুল, অমিয় চক্রবর্তী সংখ্যাগুলোর মতো উল্লেখযোগ্য কাজ আর হবে না জেনে আমি ব্যথিত।


Rezowan Mahmud  
বিশ্ব সাহিত্যে নিয়ে তার পাণ্ডিত্য সত্যিই আমাকে মুগ্ধ করেছিল। খুব সহজ বয়ানে কবিতা লিখতেন। ভাষা ও বিষয়ের অদ্ভুত সম্মিলন ছিল তাঁর কবিতা। বিগত বছর তিনেক আগে তাঁর সাথে আমার কথা হয়েছিল সবুজ আড্ডায়। কবিতা নিয়ে বিস্তর আলোচনা। আহা ! আজ সে না ফেরার দেশে চলে গেল ! ভাবতেও বিস্ময় লাগে।মৃত্যু শেষ পর্যন্ত কাউকে রেহাই দেবেনা ।

Murtala Ramat
আমার শিক্ষক খোন্দকার আশরাফ স্যার একজন পন্ডিত ব্যক্তি ছিলেন সন্দেহ নেই।ক্লাসরুমে তার কাছ থেকে শিখেছি অনেক কিছু। ক্লাসের বাইরে শিখেছি কীভাবে বিনয় ধরে রাখতে হয়। তার লেখা পড়ে শিখেছি লেখার কলাকৌশল। সন্দেহ নেই স্যারের বিদায়ে অনেক কিছু থেকেই বঞ্চিত হবো। মনটা খারাপ।

Anis Ahmed
কোন কোন কষ্ট আনুষ্ঠানিক শোক প্রকাশকে ছাড়িয়ে স্পর্শ করে গভীর কোন অনুভূতির স্থান । কবি ও অধ্যাপক খোন্দকার আশরাফ হোসেনের আকস্মিক চলে যাওয়া সেখানেই আঘাত হেনেছে প্রচন্ড। দীর্ঘ প্রবাস বাসের পর , যখনই ঢাকায় গেছি , ইংরেজি বিভাগে দেখা করেছি আমার এই শিক্ষক ও প্রাক্তন সহকর্মির সঙ্গে। এই তো সেদিন , ২৩শে ফেব্রুয়ারি , বাংলা একাডেমির বই মেলায় স্যারের সঙ্গে দেখা হলো , একটা বেশ আড্ডা ও হলো। সেখানে আরো ছিলেন দর্শন বিভাগের অধ্যাপক আব্দুল মুহিত , ছিলেন কাবেরী গায়েন , বায়তুল্লাহ কাদেরি , কবি হাসান আব্দুল্লাহ। আশরাফ স্যারের এবং কাবেরীর বই কেনা হলো। তার পর হাঁটতে হাঁটতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে গিয়ে আবার আড্ডা । সেখানে খাওয়া দাওয়া হলো। সম্ভবত কাবেরী কিংবা স্যার খাওয়ালেন। ছাত্র থাকাকালে তিনি আমাদের পড়াতেন ১৬/১৭ শতকের ইংরেজ নাট্যকারদের লেখা। তার ও পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর সময় আমি আর খোন্দকার আশরাফ হোসেন একই কক্ষে বসতাম। সেদিন ও বিভাগে যাওয়ার পর , ওনার রুমে যাওয়ায় বললেন , ঐ তো আপনার ডেস্ক , চেয়ার। আপনি বলেই সম্বোধন করতেন আমাকে , এবং সম্ভবত অনেক ছাত্রছাত্রীকে । ত্রিশালে কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হওয়ায় অনেক খুশি হয়েছিলাম। স্বপ্ন ছিল তাঁর ও । মাঝ পথে সব শেষ হয়ে গেল। তাঁর বিদেহী অআত্মার শান্তি কামনা করছি। আর রবীন্দ্রনাথের কথায় বলছি : 

শেষ নহে যে শেষ কথা কে বলবে ...........................। এই টুকু সান্ত্বনা।

Mashrur Imtiaz
বন্ধুতালিকায় যেসব মানুষগুলোকে দূর থেকে শ্রদ্ধা করে এসেছি, ভেবেছি কোন একদিন কাছে গিয়ে বলবো - কেমন আছেন আপনি ?, সেই মানুষগুলোই কেন যেন হঠাৎ করেই নক্ষত্রলোকের বাসিন্দা হয়ে যায়। ভার্সিটিতে থাকার সময় যাতায়াতে , কলাভবনে, টিচার্স ক্লাবে অসংখ্যবার খোন্দকার আশরাফ হোসেন (Khondakar Ashraf Hossain)স্যার এর সাথে মুখোমুখি হয়েছে। সালাম দেয়া , হাসি এ পর্যন্তই। অন্তর্মূখী আমি কখনোই আমি কখনোই বলে উঠি নাই - স্যার , আমি আপনার কবিতার পাঠক, আপনার কবিতা থেকে আমি প্রমিথিউসের কাছে আসা ইগলের অন্বেষা জেনেছি, অকারণে ভ্রমণ করেছি মুক্তাগাছায় , দুঃখ নামক গিটারে আঙ্গুল চালিয়ে রক্তাক্ত সুর শুনেছি, তিন রমণীর ক্বাসিদায় মিশে যেতে দেখেছি কতসব অচিন পুরাণ। স্যার , এইসব কখনো বলা হয় নাই। কিন্তু এসব দৃশ্যকল্প ভেবেছি কবির কাছে কৃতজ্ঞতা ছাড়াই। 

মাত্রক'দিন আগেই কর্মস্থলে যোগ দেয়া আমি মনে মনে প্রবল উত্তেজিত হয়েছিলাম এই শুনে যে, আমাদের বিভাগে আশরাফ স্যার উপদেষ্টা এবং অতিথি শিক্ষক। এবং গত বৃহস্পতিবারেই স্যার এসেছিলেন ক্লাস নিতে। সেদিনও দেখলাম ওনাকে, এবং যথারীতি কিছু বলা হয়ে ওঠে নাই। আজকেই এই অকাল নক্ষত্রপতন । মহৎ মানুষগুলো হয়তো এভাবেই মিথ হয়ে যান, চলে যান রহস্যরূপক দেশে।

Taposh Gayen                
মৃত্যু কখনোই আমাদের অতিক্রম যায় না । মৃত্যু জীবন এবং কবিতার-ই অন্য এক রূপান্তর, যা আমরা পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারি না ; কিন্তু আরাধ্য জীবনের মতো মৃত্যুকে আমাদের অর্জন করতে হয় । কবি খোন্দকার আশরাফ হোসেন কবিতার ভিতরে তাঁর জীবনের, শেষাবধি তাঁর মৃত্যুর রূপান্তর জেনে গেছেন, এই বিশ্বাসে আমি এখন আস্তিক হয়ে উঠতে চাই ।

আনোয়ার শাহাদাত শেষের শেষ কবিতাটি’র রচনায় এমন চমক ও নির্দয়তা মানবো কিনা সে দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিন থেকে যাবে। কি জানি নিঃসঙ্গতার সঙ্গে সঙ্গ বর্জন হয়তো চেয়েওছিলেন।

Abu Sayeed Obaidullah
আমার প্রিয় শিক্ষক আর কবি খোন্দকার আশরাফ হোসেনের অকাল প্রয়াণে আমরা শোকে স্তব্ধ। তার রুহের মাগফেরাত কামনা করছি। সাথে সাথে তার পরিবার ও নিকট আত্মীয় যারা আছেন তাদের জানাই আন্তরিক সমবেদনা। একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, সম্পাদক এই মানুষটির মৃত্যু বাংলা সাহিত্যের জন্য একটি অপূরণীয় ক্ষতি।

Chanchal Ashraf
কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, সম্পাদক খোন্দকার আশরাফ হোসেনকে যথাযোগ্য রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করার এবং একুশে পদকে ভূষিত করার দাবি জানাচ্ছি।
Chinu Kabir লিটল ম্যাগাজিনের ভেতর থেকে একবিংশ নিশ্চুপ আর নিথর চেয়ে আছে...

Ansar Uddin Khan Pathan 
My former teacher, Vice Chancellor of Kobi Nazrul University, PoetKhondakar Ashraf Hossain died this morning. He had a stroke while he was admitted at Lab Aid hospital for stomach pain. Only a few months back he visited me with his daughter and grand children, stayed at my Govt residence. We moved around and had endless talks. Two years back he lost his beloved wife who was bed-ridden for many years. He never went out of for a single day for those years and that was just to take care of her. Sylhet was his first touring destination after that tragic incident. I am shocked... please pray for his departed soul.

ক্যাম্বিসের ব্যাগ 
এই কবি মানুষটকে আমি দূর থেকেই দেখেছি। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এটা ভাবনায়ও আসে নি কখনো। হয় না যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের ভিতর একটা কেমন যেন 'ঐটা' থাকে..!! আমার ছাত্রজীবনে ওনাকে দেখতাম সন্ধ্যে হলেই আজিজ মার্কেটের ফুটপাতে কিংবা বিজুর দোকানের আড্ডায়। কোঁকড়ানো চুলের এই মানুষটিকে গায়ক বলে ভাবতাম। দাউদের মুখে পরে জেনেছি তিনি কবি ও ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক..!! দাউদ তার কথা বলেতে পাগলপ্রায়। বছরখানেক আগে তিনি আমাকে হঠাৎ ফ্রেন্ড রিক্যুয়েস্ট পাঠিয়েছিলেন। আমি তো অবাক..!! সত্যিই উনি তো? আমরা বন্ধু হলাম। যেনো অফিসিয়াল বন্ধুত্ব। আমি ওনাকে ধন্যবাদ দিলাম, উনিও আমাকে। আমাদের কোনো কথোপকথন হয় নি। একটি দিনও। আজ খুব খারাপ লাগছে।

ভদ্রলোক প্রথমদিন যখন ক্লাস নিতে এসেছিলেন আমাদের, শুরু করেছিলেন-"কবিতা কী?" এই প্রশ্ন দিয়ে। উত্তরে বলেছিলেন-"এক লাইনেও একটি কবিতা হয়!" দুই লাইনের কবিতা আছে জানি, এক লাইনেরও যে আছে তা জানা ছিলও না! তারপর শুরু হয়েছিল সেই দূর্দান্ত কবিতাখানি "দ্য লাভ সং অফ জে আলফ্রেড প্রুফক"! একটি কবিতা আমাদের তিনমাস ধরে একদম হৃদয়ে গেঁথে দিয়েছেন, যা কী-না এত বছর পরে এখনও একটি প্রিয় কবিতা হিসেবেই মনে আছে!
কবি সৈয়দ আশরাফ হুসেন কবিতা পড়াতেন না, শুধু কবিতা কীভাবে ভালোবাসতে হয় তা শিখাতেন!

1 টি মন্তব্য:

  1. কবিরা এরকমই যায়
    ফকির ইলিয়াস
    ==============================
    [ খোন্দকার আশরাফ হোসেন- আপনাকে ]

    দুহাতে তুলে রাখি কিছু বনঢেউ।আজ আমি কিছুই সাজাবো না।
    না আকাশ, না পুষ্প, না আগুন। কারো গায়েই পরাবো না
    নতুন কোনো পোশাক। কিছু অন্ধকার আমার প্রিয় হোক, কিছু
    বিচ্ছেদ ছিন্ন-বিছিন্ন করুক আমার পাঁজর - এমন প্রত্যয় নিয়ে
    আজ আমি নগরে বেরোবো । যারা এর আগে দেখেছে মৃত্যু, যারা
    এর আগে প্রেমকে পরিত্যক্ত ভেবে হারিয়েছে নিরুদ্দেশ, আমি
    তাদের তালিকা বানাবো। তারপর এই জীবনকে বিদায় জানিয়ে
    খুঁজে নেবো সমুদ্রজীবন। এই আয়ুকে মিশিয়ে দেবো কবিত্বের একক
    অহংকারের সাথে। আর কবিতার বই খুলে সেরে নেবো কাটাকুটি।

    জানি, কবিরা এরকমই যায়। কেউ জানে- কেউ জানে না। কেউ
    ছায়া দেখে। কেউ খুঁজে পায়না রেখে যাওয়া মায়াচিহ্ন। কবিকে
    শেষ পর্যন্ত যেতেই হয়। ঘুমে- ঘোরে আর ঘরের অদূরে। সে পংক্তি
    আমিও লিখছি- ঠিক তার বিপরীতে, দেখা হবে অন্য কোনো ভোরে!

    উত্তরমুছুন