শনিবার, ২২ জুন, ২০১৩

বিদায় কবিতার পার্থ

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম | 

খোন্দকার আশরাফ হোসেন
খোন্দকার আশরাফ হোসেন
খোন্দকার আশরাফ হোসেন বহুমুখী সৃজনশীলতায় ছিলেন মুখর ও বর্ণাঢ্য। লেখালেখি ও শিক্ষকতার পাশাপাশি সম্পাদনা করেছেন সাহিত্যপত্রিকা একবিংশ। সম্প্রতি তিনি পরলোকগত হয়েছেন, তাঁর স্মরণে এ আয়োজন।

বাংলাদেশের কবিতার হিসাব হয় দশকওয়ারি বিভাজনে। ১৯৬৮ সালে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই, আমাদের বিভাগে তখন দুই কবি স্বনামে প্রকাশিত, প্রতিষ্ঠিতও বলা যায়—সেলিম সারোয়ার আর মুহাম্মদ নূরুল হুদা। এক বছরের ছোট-বড়। হুদা ভাইয়ের সহপাঠী ছিলেন খোন্দকার আশরাফ হোসেন, কিন্তু তিনি তখন কবিতা লিখছেন, হয়তো করোটির ভেতরে, অন্যের চোখে না পড়া খাতায়। কবি হিসেবে তাঁর আবির্ভাবকে তিনি বিলম্বিত করলেন, বেছে নিলেন আশির দশককে। অবশ্য তাঁর কবিতা নানা সাময়িকীতে, সাহিত্য পাতায় ছাপা শুরু হয়েছে তার আগেই। কিন্তু প্রকাশ যেহেতু তাঁর আশির দশকে, তাঁর ওপর ওই দশকের ছাপ পড়ে গেল। এ নিয়ে তিনি আমোদই পেতেন। কিন্তু আমার মনে হয়েছে, তাঁর কবিতার মৌল যেসব বৈশিষ্ট্য—রোমান্টিকতার সঙ্গে বাস্তবতার একটি জটিল কিন্তু স্থিতিস্থাপক সমীকরণ; তীক্ষ্নঅন্তর্দৃষ্টির সঙ্গে বোধের এবং অনুভূতির সংবেদি সংযোগ; সময়কে ব্যক্তি, সমাজ, দেশ ও বিশ্বের ক্রমশ পরিবর্তনশীল মাত্রায় স্থাপন; স্থানীয় বীক্ষণ এবং অভিপ্রায়কে নগর ও বৃহত্তর পরিসরে স্থাপন করে এর নানা রূপ নির্ণয়; ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং মিথের পরিপ্রেক্ষিতে আধুনিক মানুষের বিপন্নতা, বিচ্ছিন্নতা কল্পনার রসায়নে জারিত করে তাদের ভিন্ন অভিঘাত এবং অর্থের সন্ধান; আধুনিকতার সঙ্গে উত্তর-আধুনিক চিন্তা ও সংস্কৃতিসূত্রের বিবাদ-বিসংবাদ এবং এসবের প্রকাশে এক চমৎকার পরিমিতিবোধ; প্রকৃতির অন্তর্গত স্বপ্নময়তার সঙ্গে প্রকৃতি-পলাতক মানুষের দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক এবং ফর্ম ও শৈলীগত নানা চমৎকারিত্ব এবং নিরীক্ষা—সেসবের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত প্রকাশের জন্য আশির দশকটিই ছিল অনুকূল। মুক্তিযুদ্ধ থেকে নিয়ে পঁচাত্তর সাল পর্যন্ত একটা ঘোরের মধ্যে ছিল বাংলাদেশ: স্বপ্ন ছিল, উচ্চাশা ছিল, উঁচুতে ওড়ার বাসনা ছিল। সেগুলো যখন ভেঙে গেল, হাত ফসকে বেরিয়ে গেল, একটা হতাশার খাদে নেমে গেল দেশটা। মানুষ দেখল, একাত্তরকে ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। মানুষ বিপন্ন হলো, কুপিত হলো, তাদের ভেতর রক্তক্ষরণ হলো। আশির দশকটা যখন শুরু হলো, এক দুঃসময়ের পর আরেক দুঃসময় ছায়া ফেলতে লাগল, মানুষ ভেতরে ভেতরে প্রস্তুত হতে থাকল ওই দুঃসময়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজেদের অস্তিত্বকে জানান দিতে। বাংলাদেশের কবিতার আশির দশক তীব্রতা নিয়ে এল, প্রকাশে বলিষ্ঠতা আর স্পর্ধা এবং কল্পনার বিস্তার নিয়ে এল, ফর্মে নিরীক্ষাকে শুধু বহিঃস্থ কোনো কাঠামোর প্রতিস্থাপনের পরিবর্তে ভেতরের ভৌত পরিবর্তন-স্পৃহার প্রকাশ হিসেবে দেখা শুরু হলো। ভাষায় এল বৈচিত্র্য। একই কবিতায় নানা মাত্রায় ব্যক্তি নিজেকে মেলে ধরতে শুরু করল। 


খোন্দকার আশরাফ নিবিষ্ট পাঠক ছিলেন। ইংরেজি সাহিত্যে একটা অধিকার আদায় করে নিয়েছিলেন: বাংলা সাহিত্যের আদি-মধ্য-আধুনিক যুগের নানা অঞ্চলে ক্লান্তিহীন পরিব্রাজক ছিলেন। জার্মান ভাষাটাও শিখেছিলেন গ্যেটে অথবা হাইনেকে নিজেদের শর্তে আবিষ্কারের জন্য। আধুনিকতাকে তিনি মানুষের আত্মআবিষ্কারের এক মৌলিক সত্য হিসেবে ধরে নিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি আধুনিকতার কোনো একটি রূপকে স্থির-বিশিষ্ট বলে কখনো ভাবেননি। আধুনিকতার একটি বঙ্গীয় রূপ আছে, যাতে পশ্চিমের অনেক শর্ত অকেজো, অপাঙেক্তয়। তিনি সেটির সন্ধান করেছেন। এ জন্য তাঁর কবিতার বিপন্ন নাগরিক মানুষ কোনো প্রূফ্রক নয়; সে একান্তই এক বঙ্গসন্তান, যার মনোজগতে এ দেশের নিসর্গ-সমাজ, মানুষ-ইতিহাস খোদাই করে আঁকা। এসবই এই মানুষের বেঁচে থাকার অথবা জীবনকে বিদায় জানানোর শর্ত। এ জন্য জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে তাঁর মিলটি, অন্য কোনো কবি থেকে, বেশি। কিছুকাল তিনি জীবনানন্দের হাত ধরে প্রকৃতি ভ্রমণ করেছেন, মিথ পড়েছেন। কিন্তু দ্রুতই ওই হাত তিনি ছেড়েও দিয়েছেন। তাঁর একা চলায় সহায় হয়েছে তাঁর একান্ত নিজস্ব একটি ভাষা। তাঁর কল্পনার দার্ঢ্য, বস্তু ও বিষয়ের অন্তর্গত জীবনে একটি হাত রেখে দেওয়ার তাঁর শক্তি এবং আধুনিক সাহিত্যের যে দুই প্রধান উপাদান—iৎony ও wit-সে দুটির কার্যকর প্রয়োগ। তাঁর অনেক কবিতায় তিনি প্রবচনীয় শক্তিতে, সংক্ষেপে, এমন সব অবস্থার, অনুভবের অথবা অভিজ্ঞতার সারাৎসার নির্মাণ করতেন, সেগুলো হয়ে দাঁড়াত লিখে রাখার মতো। 


তিন রমণীর ক্বাসিদা যখন বের হয়, অবাক হয়েছিলাম, ক্বাসিদার কর্মটাকে কত সহজে নিজস্ব বয়ানের একটি বিষয় তিনি করে নিয়েছিলেন। তার পরিবেশ, প্রকৃতি, চরিত্র—সবই বাংলাদেশের, কিন্তু ক্বাসিদার গতিশীল এবং স্থিতিস্থাপক ফর্মে ফেলে সেগুলোকে যেন এক অনন্ত উদ্যাপনের বিষয় তিনি করে ফেললেন। আমার সব সময় মনে হয়েছে, খোন্দকার আশরাফ তাঁর কবিতাকে উৎপ্রেক্ষাধর্মী অথবা হঠাৎ-অভিজ্ঞানে কেন্দ্রমুখী না করে বয়ানধর্মী করেছিলেন এ কারণে যে, তিনি তাদের একটা রুদ্ধ সমাপ্তি রেখায় আটকে রাখতে চাননি। তাঁর কবিতার সমাপ্তি আসলে অনেক নতুন শুরুর একটি বিন্দু। ইংরেজিতে এই কৌশলকে বলা হয় open-ended। তা ছাড়া, বয়ানের যে বিস্তার, নানা দিকে মোড় নেওয়ার সুযোগ এবং এমনকি কোনো অভিজ্ঞানিক বা epiphanic অনুভব বা রূপকল্পকেও জায়গা করে দেওয়ার ক্ষমতা তার পরিপূর্ণ ব্যবহার খোন্দকার আশরাফ করেছিলেন।


তাঁর দ্বিতীয় বই পার্থ তোমার তীব্র তীর পড়ে আমার এ রকম ধারণা হলো, তিনি যেন সেই অর্জুনের জায়গায় নিজেকে স্থাপন করেছেন, এবং নানা প্রতিষ্ঠান অচলায়তন প্রচল এবং প্রথার অবরুদ্ধতার দিকে তাক করে তির ছুড়ছেন। তির তিনি আরও ছুড়ছেন তাঁর কবিতার অঞ্চলকে চিহ্নিত করতে, এর মালিকানা প্রতিষ্ঠা করতে। তিনি এই গ্রন্থে নিয়ে এলেন ভাষার নতুন দ্যোতনা, উপমার যথার্থতা এবং বিষয়বস্তুর নতুনত্ব; তার প্রকাশে এল বলিষ্ঠতা এবং তীক্ষ্নতা, যেন তিনি ধনুকে তির লাগিয়ে তাক ঠিক করছেন। এরপর যতগুলো বই তাঁর বেরোল, জীবনের সমান চুমুক অথবা সুন্দরী ও ঘৃণার ঘুঙুর এমনকি সম্ভবত তাঁর সর্বশেষ গ্রন্থ তোমার নামে বৃষ্টি নামে দেখা গেল। প্রতিবারই তিনি নতুন পথে হাঁটছেন। অডেন সম্পর্কে বলেছিলেন ইয়েটস। প্রতিবারই তো দেখি নতুন পোশাকে সে হাজির হয়। খোন্দকার আশরাফও যেন তাই, অডেন লিরিকধর্মী কবিতা লিখতেন, এলিজি লিখেছে, ব্যালাডকে নতুন করে সাজিয়েছেন, বাম পন্থায় বিশ্বাসী, ধর্ম পন্থায় বিশ্বাসী কবিতা লিখেছেন। আশরাফও লিরিক লিখেছেন, ব্যঙ্গ কবিতা লিখেছেন, প্রেমের কবিতা লিখেছেন, প্রতিবাদের কবিতা লিখেছেন। লিরিকধর্মিতা তাঁর কবিতার একটি অন্তর্গত বৈশিষ্ট্য, যেমন শব্দ নিয়ে নিত্যনতুন তাঁর চিন্তা। প্রতিটি শব্দ থেকে তিনি তাদের যতটুকু দেওয়ার, যেন তা-ই আদায় করে নিতেন। 


শব্দ নিয়ে খেলা করতে তিনি পছন্দ করতেন। মধুসূদন যে বলেছিলেন শব্দের সঙ্গে শব্দের বিয়া দেয় যে জন, সে কবি, আশরাফ যেন ছিলেন সেই বিবাহ-পুরুত, অথবা ঘটক। ইংরেজিতে যাকে pun বলে, তাতে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। আমি তাঁকে বলতাম pun-বন্ত মানুষ; যেন pun তাঁকে সহজ হতে, আমুদে হতে সাহায্য করেছিল।


নিজে কবিতা লিখে তিনি সন্তুষ্ট থাকেননি। একটি কবিতাপত্র সম্পাদনা করেছেন প্রায় ২৮ বছর। একবিংশ দুই বাংলাতে ছিল সমান পাঠকপ্রিয়। এ দেশে তরুণ কবিদের পথ দেখাতে, তাদের সাহিত্যরুচি সৃষ্টিতে এবং বাংলা কবিতার চলমান ইতিহাসের পর্যায়ক্রমটি ধরে রাখতে একবিংশ-এর ছিল এক বিশাল ভূমিকা। আমরা খোন্দকার আশরাফের চলে যাওয়া নিয়ে শোক করছি, কষ্ট পাচ্ছি একবিংশ-এর সামনে পড়া সংশয় চিহ্ন নিয়েও।


অত্যন্ত বড় মাপের অনুবাদক ছিলেন খোন্দকার আশরাফ, সফোক্লিস-ইউরিপিডিস-এর নাটক অনুবাদ করেছেন, নিজের কবিতার একটি অনুবাদগ্রন্থ বের করেছেন On Behulas Raft নামে, ২০০৮ সালে। টেরি ইগলটনের সাহিত্যতন্ত্র এবং এডিথ হ্যামিল্টনের মিথোলজির তর্জমা-ব্যাখ্যা করে বই ছাপিয়েছেন। এবং কয়েক বছর আগে বাংলাদেশের কবিতার আধুনিকতা ও উত্তরাধুনিকতার প্রভাব নিয়ে একটি বই লিখেছেন Modeৎnism and Beyond : Westeৎn Influence on Bangladeshi Poetৎy নামে। এই নামে তিনি পিএইচডি গবেষণা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কেন জানি তিনি আমাকে তাঁর পিএইচডি গবেষণার তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে বেছে নিলেন। খুব ভালো একটি কাজ ছিল অভিসন্দর্ভটি। আমার থেকে বয়সে এক বছরের বড় ছিলেন, কিন্তু আমার ব্যাখ্যা-মন্তব্যকে তিনি সব সময় গুরুত্বের সঙ্গে নিতেন। এ ছিল তাঁর গবেষক হিসেবে নিষ্ঠার একটি প্রকাশ। 


জুনের ১৬ তারিখ দুপুরে তিনি হঠাৎ চলে গেলেন। ‘চিকিৎসা’ নামের একটি কবিতা কাছে তাঁর, যেখানে হাসপাতালের ক্লিনিকে শুয়ে এক সাদা আলখাল্লা পরিহিত এক মানুষের মুখের সৌন্দর্য থেকে এক লাফে তিনি পৌঁছালেন সেই ঘরে, ‘যেখানে আমার জন্য ঘুমের বিছানা পাতা’, যেখানে এক নম্র চাষি বউ তাঁকে শাওনে আসার আহ্বান জানাল (সুন্দরী ও ঘৃণার ঘুঙুর)। 


ঘুমের দেশেই চলে গেলেন শেষ পর্যন্ত খোন্দকার আশরাফ। ১৬ তারিখ বিকেলে জানাজার আগে তাঁর ছেলে শুভ তাঁর জন্য সবার কাছে ক্ষমা চাইল, যদি কোনো কারণে তিনি কারও মনে কষ্ট দিয়ে থাকেন। ছোট্ট করে সে শুধু বলল, ‘আমার বাবা খুব ভালো মানুষ ছিলেন।’
দিনটা ছিল বাবা দিবস।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন