শনিবার, ২২ জুন, ২০১৩

ছন্দময় জীবনের উজ্জ্বল গান

ইকবাল আজিজ

সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে চলে গেলেন আশির দশকের উজ্জ্বল কবি ও প্রবন্ধকার খন্দকার আশরাফ হোসেন। তিনি একজন আধুনিক, সুশিক্ষিত ও প্রাণবন্যায় চঞ্চল কাব্যনির্মাতা। খন্দকার আশরাফ হোসেন এত তাড়াতাড়ি চলে যাবেন কেউই ভাবেনি। যখনই দেখা হয়েছে তাঁর মধ্যে এক অদ্ভুত প্রাণচাঞ্চল্য লক্ষ্য করেছি। সব সময় লক্ষ্য করেছি, তিনি অনেকের মাঝে একা, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে সর্বদা অস্থির পদক্ষেপে হেঁটে গেছেন। খন্দকার আশরাফ হোসেন তাঁর বয়সী কবি সাহিত্যিকদের তুলনায় একটু বেশি বয়সে সাহিত্যজগতে পদার্পণ করেছিলেন। বয়সের দিক দিয়ে ছিলেন ষাট দশকের কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার সমান বয়সী ও তাঁর সহপাঠী। কিন্তু তিনি কবিতা লিখতে শুরু করেছিলেন এক দশক পরে পরিণত বয়সে। ১৯৮০ সালে তিনি যখন কবিতা লিখতে শুরু করেন, তখন সহযাত্রী হিসেবে পেয়েছিলেন মাসুদ খান, রেজাউদ্দিন স্টালিন, সোয়েব সাদাব, সাজ্জাদ শরীফ, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ, বদরুল হায়দার, সরকার মাসুদ প্রমুখকে। তাঁরা সবাই ছিলেন তাঁর চেয়ে বয়সে ছোট; খন্দকার আশারাফ তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক, ভার্সিটির ছাত্রাবাসের হাউসটিউটর। অর্থাৎ আশির দশকের তরুণ কবিদের তুলনায় বয়স ও জীবিকার দিক দিয়ে যথেষ্ট দায়িত্বশীল ও পদমর্যাদাসম্পন্ন। তাঁর এই বেশি বয়সে অনেক কম বয়সী কবিদের সঙ্গে কবিতা লেখার বিষয়টি নিয়ে অনেকে মৃদু পরিহাস করতেন, তিনি গায়ে মাখতেন না। কারণ স্বতঃস্ফূর্ত আবেগপ্রবণতার দিক দিয়ে তিনি অনেক তরুণকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন, সেই সঙ্গে ছিলেন দারুণ আত্মবিশ্বাসী। এই আত্মবিশ্বাস ও প্রাণচাঞ্চল্য নিয়ে এগিয়ে গেছেন খন্দকার আশরাফ হোসেন।
আশির দশকের শুরুতেই তাঁর সঙ্গে আলাপ দৈনিক ইত্তেফাকে কবি ও সাহিত্য সম্পাদক আল মুজাহিদীর দফতরে। মুজাহিদী ভাই তাঁর মধ্যে সম্ভাবনার আলো দেখেছিলেন, তাই পৃষ্ঠপোষকতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। ইত্তেফাকের সাহিত্য পাতায় তিনি প্রায় প্রতিমাসে গদ্য পদ্য লিখেছেন; অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হন তখন থেকে। আল মাহমুদ ও আবুল হাসানের কবিতার প্রভাব তাঁর মধ্যে প্রথম থেকেই লক্ষ্য করেছিলাম; তবে খন্দকার আশরাফ হোসেন ছিলেন সুশিক্ষিত ও কবিতায় আন্তর্জাতিকতার অনুসারী। স্পেনের কবি ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা তাঁর কাব্যজীবনকে প্রভাবিত করেছিলেন; গার্সিয়া লোরকার গ্রামীণ চেতনতা ও মানবিক বোধ তাঁর কবিতায় সুস্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা গেছে। লোরকা যেমন স্পেনের আন্দালুসীয় ঐতিহ্যের অনুসারে ‘ক্বাসিদা’ রচনা করেছিলেন, তেমনই আশরাফ হোসেনও তাঁর একটি কাব্যগ্রন্থের নাম রেখেছিলেন ‘তিন রমণীর ক্বাসিদা।’
লোরকা আন্দালুসীয় লোকজ ঐতিহ্যের মধ্যে দিয়ে তাঁর কবিতার মূল সূত্রকে উপলব্ধি করেছেন আর খন্দকার আশরাফ বাংলার পুঁথিকবিতা ও লোকজীবনের মধ্য দিয়ে তাঁর কবিতার ভিত্তিভূমি খুঁজে পেয়েছেন। যদিও স্পেনের লোরকা একজন বিশ্ববিখ্যাত কবি আর আশরাফ হোসেন একজন স্বল্প পরিচিত কবি, কিন্তু খ্যাতি দিয়ে হয়ত কবি ও কবিতা পরিমাপ করা যায় না। এ ছাড়া কবিতার ইতিহাসে দেখা গেছে, অনেক অখ্যাত কবি মৃত্যুর পরে তাঁর কবিতার মধ্য দিয়ে নবজন্ম ও ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছেন। আশরাফ হোসেনের ক্ষেত্রে এ ধরনের সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেয়া যায় না। আশরাফ হোসেন পুঁথি কবিতার বিষয়বস্তুকে তাঁর কবিতায় গ্রহণ করেছেন খুবই মননশীলতার সঙ্গে।
‘বারো জঙ্গ করে মর্দ শাহা সেকান্দার
তেরো জঙ্গ করে শুনি টুঙ্গির শহর।
আবু শামা ভালবাসতো ঘোড়া
তার ছিল কালো কুচকুচে এক মদ্দা জানোয়ার...

শামার ঘোড়াটি কবে মিশেছে মাটিতে
উধাও ক্ষুরের শব্দ কাদামাটি জলার ভেতর।
আর সেই ঘোড়সওয়ার, সময়ের কালো যুবরাজ?
শুনেছি তার পায়ের গোড়ালি বাঁধা রিকশার রেকাবেÑ
এখন সে জঙ্গ করে টুঙ্গির শহরে।’
(জঙ্গনামা)

পূর্ববঙ্গীয় লোকসাহিত্য ও লোকঐতিহ্য খুবই সমৃদ্ধ। ইংরেজী সাহিত্যের মেধাবী ছাত্র খন্দকার আশরাফ তাঁর পরিশীলিত চেতনার মধ্য দিয়ে নিজ জন্মভূমির পল্লীগাথাকে পুনর্নির্মাণ করেছেন। এটা তাঁর সৃজনশীলতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তাঁর চিত্রকল্পে ফেলে আসা গ্রামের রূপকাহিনী ও জীবনকাহিনী অতি সুস্পষ্ট। আশরাফের “কবিতা কোলাজ”- এ তেমনই একটি চিত্র কী আশ্চর্য রূপময় :
“কতো রঙ্গ দেখি যাদু, রঙ্গে রঙ্গে বেলা গ্যালো ভাটি
আকাশে প্রস্তুত হলো মেঘবতী ঘোড়া
ধুলোর আদর নিয়ে রুক্ষ চুলে পথ হাঁটি
পশ্চাতে টিনের বাদ্য, পিঠে পড়ে কোড়া।’
বৃহত্তর ময়মনসিংহে জন্মগ্রহণকারী খন্দকার আশরাফ হোসেন হয়ত বাল্যকাল থেকে ময়মনসিংহ গীতিকার পরিবেশ ও চেতনাকে ধারণ করেছেন তাঁর হৃদয়ে। তাই এত স্বতঃস্ফূর্তভাবে লোকজ বোধ তাঁর কবিতায় উৎসারিত হয়েছে।
আশির দশকের শুরুতে আমি ও রেজাউদ্দিন স্টালিন তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়েছিলাম। বয়সে আশরাফ হোসেন আমার চেয়ে পাঁচ বছরের বড় হলেও কবিতায় ছিলেন আমার পরবর্তী দশকের কবি। তবু সত্তর দশকের কবি হিসাবে আশির দশকের খন্দকার আশরাফ ও রেজাউদ্দিন স্টালিনের সঙ্গে আমার যথেষ্ট ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল। আশরাফ হোসেন কবিতায় নতুন কিছু করতে চেয়েছিলেন। এই আকাক্সক্ষা থেকে তিনি ১৯৮৪-৮৫ সালে প্রকাশ করেছিলেন কবিতা পত্রিকা ‘একবিংশ ।’ এই পত্রিকার প্রথম সংখ্যাতেই আমি, খন্দকার আশরাফ ও রেজাউদ্দিন স্টালিন তিনটি দীর্ঘ কবিতা লিখেছিলাম। এই পত্রিকায় প্রথম দু’তিন বছর আমি নিয়মিত লিখেছিলাম; পরে পত্রিকার নীতি ও লক্ষ্য পছন্দ না হওয়ায় সরে এসেছিলাম। কিন্তু আশরাফ হোসেন তাঁর নিজের মতো করে পত্রিকাটি চালিয়ে এসেছেন ২৮ বছর। তিনি নিজেই ছিলেন পত্রিকাটির প্রধান লেখক; স্বনামে ও ছদ্মনামে প্রচুর গদ্য পদ্য লিখেছেন। তবু কোনো সংঘবদ্ধ কবির দল এই পত্রিকার মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ করেনি। তবে এই পত্রিকায় নানা ধরনের আলোচনা, কবিতা ও অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। সেইসঙ্গে ছাপা হয়েছে নতুন কবিদের অসংখ্য কবিতা। পত্রিকায় প্রতিটি সংখ্যার মূল চরিত্র হিসাবে নিজের অস্তিত্ব বজায় রেখেছেন খন্দকার আশরাফ হোসেন। তাঁকে যেমন বেশিরভাগ সময় রাস্তায় একা একা হাঁটতে দেখেছি; তেমনি পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশের বেলাতেও তিনি ছিলেন একা। দুঃখে-সুখে, নিদ্রায়- জাগরণে মানুষ যে মূলত একা এটা তাঁকে দেখে আমি গভীরভাবে উপলব্ধি করেছি; সেইসঙ্গে মনে পড়েছে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতার সেই বিখ্যাত পঙ্ক্তি :
“বিরূপ বিশ্বে মানুষ নিয়ত একাকী।”
মানুষ নিঃসঙ্গ হলেও জীবন ও সময়ের প্রয়োজনে সামাজিক হয়। খন্দকার আশরাফের সঙ্গে আমার একটা আলাদা সখ্য গড়ে উঠেছিল; সেইসঙ্গে আমাদের সঙ্গে সর্বদা ছিলেন স্নেহভাজন কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন। ক্যাম্পাসে গিয়ে আমরা প্রায়শই আশরাফ হোসেনের সঙ্গে আড্ডা দিতাম। আশির দশকের স্বৈরাচারী আমলের কথা। আশরাফ তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ছাত্রাবাসের হাউসটিউটর; ছাত্রাবাস সংলগ্ন একটি ফ্ল্যাটে থাকেন। এক সন্ধ্যায় তাঁর কাছে গেছি আমি ও স্টালিন; কথায় কথায় অনেক রাত হয়ে গেছে। এমন সময় ছাত্রাবাসে দুটি ছাত্রসংগঠনের মধ্যে সংঘর্ষের সূত্রপাত হলো। সেই সঙ্গে সহিংস বিস্ফোরণের আওয়াজ। আমরা সে রাতটা থেকে গেলাম তাঁর বাসায়। ভাবী আমাদের জন্য খিচুিড় ও ডিম ভাজা সহযোগে নৈশভোজের আয়োজন করলেন। আমরা হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসেছি, হঠাৎ করে আমি বলে ফেললাম, ‘ভাবী একটু আচার আছে কি?’ আমার কথায় আশরাফ ভাই, স্ট্যালিন ও ভাবী হা হা করে হেসে উঠলেন। ভাবী অবশ্য আচার বের করে দিলেন। এদিকে পাশের ছাত্রাবাসে সংঘাত ও তা-ব তখনও চলছে। আমার এই ‘আচার চাওয়ার’ প্রসঙ্গটি আশরাফ ভাই ও স্ট্যালিন পরে অনেককে বলেছেন। সোমবার পত্রিকায় খন্দকার আশরাফের মৃত্যুর খবর শুনে সেই পরনো কাহিনী মনে পড়ল। নিজেদের খুব দুর্ভাগা মনে হলো। কারণ আশরাফ ভাই মারা গেছেন রবিবার দুপুরে। সেদিনই ঢাকায় তাঁর জানাজা হয়ে গেছে। সোমবার তাঁকে জামালপুরের গ্রামে পরিবারিক গোরস্তানে সমাহিত করা হয়। অর্থাৎ মৃত্যুর পরে তাঁকে শেষ দেখা হলো না।
তাঁর মৃত্যুতে মনে হলো, আমাদের সবারই বিদায়ের পালা শুরু হয়েছে। একে একে সবাইকে চলে যেতে হবে। আশরাফ ভাইও চলে গলেন। কিন্তু তাঁর কবিতা ও প্রবন্ধের মূল্যায়ন অবশ্যই হবে নতুন করে। খন্দকার আশরাফ হোসেন বেঁচে থাকবেন আমাদের মধ্যে তাঁর সাহিত্য কর্মের মধ্য দিয়ে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন