সোমবার, ১৭ জুন, ২০১৩

কবির মৃত্যু









জাহেদ আহমদ

চলে গেলেন খোন্দকার আশরাফ হোসেন! অকালে, এত অকস্মাৎ, এই চলে-যাওয়া। তাঁর প্রস্থানদৃশ্য কোনোপ্রকার নাটকীয়তাহীন, অতি নিভৃতে, সম্ভবত খুব-কেউ জানতেনও না টানা-দুইদিন তিনি হাসপাতালায়িত ছিলেন। সম্ভবত, কেননা আজকাল তো তরুণতর কবি যিনি কিনা কাব্য-লিখিবেন-বলিয়া-ঠিক-করিয়াছেন-কিন্তু-লিখিয়া-উঠিতে-পারেন-নাই-এখনও-সময়াভাবে এমনদেরকেও যখন দেখি খুকখুকে কাশি হলেও খবর হয়ে বিরাজেন মিডিয়ায়---ফেসবুকে হোক বা বান্ধবদোস্তের ব্লগস্পটে---সেখানে খোন্দকারের রোগসংবাদ বা তাঁর তবিয়তের ফিলহাল স্ট্যাটাস জানতে পেলে কেউ কেউ অন্তত যারা কবিসাহিত্যিক না, যারা আমার মতো কবিতার ভোলাভালা পাঠক কেবল, তারা আরোগ্যাশীর্বাদ করতেন মনে মনে এবং প্রকাশ্য কমেন্ট পোস্ট করে। অথবা আর-কিছু পারি না-পারি, মৃত্যুশয্যায় একজন কবি অমুক---এহেন সংবাদে একটা লাইক তো দিবার পারতাম!!!

পার্থ, তোমার তীব্র তির ---একবিংশ  বছরের-পর-বছর সংখ্যাগুলোর সম্পাদকীয়তে আপনার মৃদুস্বর মার্জিত কিন্তু তীক্ষ্ম রসবোধ খুব উপভোগ করতাম, খোন্দকার! সম্পাদকীয়তে, এবং সমগ্র পরিকল্পনায়, এত সচেতন পত্রিকাবিন্যাস আমার মতো শিল্পবোধশক্তিরহিত অপগণ্ডকেও আকৃষ্ট করেছিল একসময়। এরপর একবিংশ,  আমি ও আমার বন্ধুরা পাশাপাশি ছিলাম পরষ্পরমুগ্ধ বহুদিন। অনেক দিয়েছে, আমাকে অন্তত, এই পত্রিকাটি। তখন কোনো সার্চইঞ্জিন ছিল না, ছিল কিছু অপ্রাতিষ্ঠানিক ছোটকাগজ, আর হুটহাট কবিতা ও কাব্যতত্ত্ব প্রভৃতি নিয়া সার্চ দিলা আর হুড়মুড়ায়া পাঁচসহস্র স্কলার্লি আর্টিকল বারায়া আইলো---কল্পনাতেও অমনটি ছিলনাকো। কয়েকটি ছোটকাগজ ছিল, পশ্চিমবঙ্গেরই বেশি, অপ্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার উনোনে একটু শুকনো খড় ও লাকড়ি যোগাত আমাদের। দেশে ছিল গুটিকয় তখন, আমাদের বেড়ে-ওঠার সময়ে, একবিংশ  একটি তাদেরই।

কত কী পড়েছি আমরা আপনার অনুবাদে! সেলানের কবিতা পড়েছি, ঈগল্টন পড়েছি দীর্ঘদিন-ধরে-প্রকাশিত ধারাবাহিকে, একটা দুর্দান্ত প্রবন্ধ পড়েছি ওলে সোয়েঙ্কার, লিভারপুল পোয়েটদের নিয়ে সেই মিষ্টি বিস্তারিত প্রবন্ধটি, কিংবা মায়া এঞ্জেলা, আর সেই হাইকু কবিদের নিয়ে এবং তাদের উল্লেখযোগ্য অনেক হাইকুর সৃজনশীল তর্জমা আলোচনা সহ, কোরিয়ার বিশেষ এক কাব্যধরন সিজো  সম্পর্কে প্রথম জেনেছি আপনারই দৌত্যে, টেড হিউয়েজের কাক  সম্পূর্ণ ও অন্যান্য অনেক, অথবা আমাদের শ্রেণিকামরাপাঠ্য পড়াশোনায়-পরীক্ষাপাশে প্রভূত সহায়তা করেছেন আপনি আপনার সফোক্লিস্ এবং ইউরিপিডিস্ অনুবাদগুলো দিয়ে। এইসব ঋণ---আপনার নিকট---একে কী যেন বলে উপমহাদেশীয় দর্শনে? একলব্য নই আমি। যাকগে।

এবং আপনার পত্রিকার বিশেষ কয়েকটি সংখ্যার কথা মনে রাখব না! যারপরনাই যত্নের কাজ সেসব। অসম্ভব সুচয়িত ও মেধাবী সমস্ত কাজ। একটু বিদ্যায়তনঘেঁষা, এ নিয়ে একটু খেদ অবশ্য ছিল আমাদের। রসবোধ ফুটে উঠত সমস্তকিছুতেই, কিন্তু রম্য নয়, রগড় কদাপি নয়। ঋজু, স্পষ্টরেখ সব। চোখধাঁধানো নয়, মনোরম, মনমাখানো। দুই যুগন্ধর কবিকে একসঙ্গে পেশ করেছেন বড় সসম্ভ্রম শ্রদ্ধায়, নজরুল-জীবনানন্দ সংখ্যায়। বুদ্ধদেব বসু সংখ্যা করেছেন, লিখেছেন আধুনিকবাদ নিয়ে মনোজ্ঞ প্রবন্ধ, দুনিয়ার সর্বত্র কোথায় কেমন আধুনিকতা খাড়া হয়েছিল সেসব নিয়ে বিপুল পরিসরে সুবিস্তৃত লিখেছেন, পড়ে আলো পেয়েছি। কিংবা আবুল হাসান নিয়ে একটা ভালোবাসাদীপ্ত সংখ্যা করেছিলেন, অমিয় চক্রবর্তী নিয়ে যেমন, কত কাজ একজীবনে! শেষের দিকের একবিংশগুলো খুব পড়েছি বলব না, তবে দেখেছি উল্টেপাল্টে এবং খোঁজ রেখেছি একবিংশ বেরোলো কি না, আমার জীবন ও জীবিকায় এখন পড়াশোনার কোনো বালাই নাই।

তিনি ছিলেন, বিশ্বকবিতার সোনালি শস্য  তুলে দিয়েছিলেন আমাদের হাতে, এখন নেই আর। তিনি ছিলেন, অন্তরঙ্গ অবলোকন  করিয়েছিলেন আমার মতো অনেককেই বাংলা কবিতার দিকে, এখন নেই আর। তিনি হৃদিবিভ্রাটে পড়ে নিজের ছায়াটা গুটিয়ে চলে গিয়েছেন কীর্তিনাশার দিকে। বেহুলার ফেলে-যাওয়া ভেলায় চেপে বেহুলারই কাছে? একটা কাব্যসঙ্কলন করেছিলেন নিজের, এন্থোলোজি নিজের কবিতার ইংরেজি ভাষান্তরের, নাম রেখেছিলেন অন বেহুলা'স র্র্যাফ্ট । একাডেমিতে খুব যশস্বী ছিলেন, ইংরেজি পড়িয়েছেন জীবনভর বিশ্ববিদ্যালয়ে, একাডেমিয়ার রামরেখা-লক্ষণরেখা মান্যিগণ্যি করে গেলে আরও যশ হতো ওই লাইনে। কিন্তু তরুণ কবিদের যত্নআত্তি করে বিস্তর অপমান সয়েছেন, অনুমান করি সংগত কারণে, তবু অবসর নেননি পত্রিকা প্রকাশের স্বেচ্ছাবৃত্তি থেকে শেষবছর পর্যন্তও। বর্তমানকালের কবি হলে তো 'ফিল্ডওয়ার্ক' করে সেরে কবেই স্টেজে উঠে উদাসনয়ন মুস্কুরাইতেন। তা তিনি করেননি, কেন যে! সে-যা-হোক, বড় উদাত্ত ছিলেন তরুণদের লেখা ছাপাতে, মুক্তহস্তে লেখা চাইতেন শর্তারোপনবিহীন, শুনেছি আমি, আমার বন্ধুদের অনেকেই খুব ভালো কবি এবং তাদের কবিতা খোন্দকার সযত্ন প্রকাশ করেছেন তাঁর পত্রিকায়, লেখক হলে আমিও লিখতে পারতাম তাঁর পত্রিকায়---এতটাই উদার ও লিখনমগ্ন ছিলেন তিনি, বিভিন্ন সময়ে বন্ধুদের মুখে শুনেছি তাঁর পত্রিকান্তপ্রাণের গল্প।

কবির মৃত্যু তিনভাবে হতে পারে শ্রেয় ও কবির কাঙ্ক্ষিত : এক, ফুলের আঘাতে; দুই, হৃদজটিলতায়; এবং তিন, বুলেটবিদীর্ণ বক্ষে। প্রথমোক্তভাবে মৃত্যু পেয়েছিলেন রাইনার মারিয়া রিলকে, আমরা জানি। জীবনের সমান তীব্র চুমুক  নিয়ে আমাদের কবি খোন্দকার আশরাফ হোসেন দ্বিতীয়োক্তভাবে আলিঙ্গন করেছেন মৃত্যুকে। কিন্তু তাঁর আত্মা আমরা পাচ্ছি চিরকাল তাঁর কবিতায়, আত্মার শাঁস ও সুবাসিত নির্যাস তো কবিতাই, তাই না? এখন তাঁকে এওয়ার্ড গছিয়ে মরণোত্তর ক্ষেপিয়ে না-তুললেই হলো। ঘুমোতে দেই আমরা তাঁকে, জেগে উঠবেন যখন আমরা কবিতা পড়তে শুরু করব তাঁর।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন