Published: 2013-06-16 18:01:14.0 Updated: 2013-06-16 20:50:02.0
মুক্তিযোদ্ধা, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও অনুবাদক খোন্দকার আশরাফ হোসেনের আরও দুটি উল্লেখযোগ্য পরিচয় হলো তিনি ছিলেন শিক্ষক এবং একটি সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক। কিন্তু এতসব পরিচয়ের মধ্যে যে পরিচয়টি সবচেয়ে বেশি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে সেটা তার কবি পরিচয়। তিনি নিজেও এই পরিচয়টিতে বেশি গৌরববোধ করতেন।
তারই এক কবিতায় তিনি বলেছিলেন:
তারই এক কবিতায় তিনি বলেছিলেন:
“পৃথিবীর সর্বশেষ কবি আমি, অহংকার আমার কবিতা
আমাকে পাবেনা প্রেমে, প্রার্থনায় নত হও পাবে”
আমাদের কাছে বহুমুখী পরিচয়ের এই অনন্য ব্যক্তিত্ব খোন্দকার আশরাফ হোসেন আজ সকালে (১৬ জুন ২০১৩) কোলাহলহীন স্থবিরতার এমন এক জগতে প্রবেশ করেছেন যেখান থেকে কখনো কেউ ফিরে আসেন না।
কিন্তু যে জীবন তিনি যাপন করেছিলেন তা সৃষ্টিশীল কর্মে ছিলো মুখর ও বর্ণাঢ্য। অল্প বয়সেই লেখালেখি শুরু করলেও লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন কিছুটা বিলম্বে। ১৯৫০ সালে জন্মগ্রহণকারী আশরাফ হোসেন ৩৪ বছর বয়সে ১৯৮৪ সালে ‘তিন রমনীর ক্বাসিদা’ নিয়ে প্রবেশ করেন কাব্যজগতে। এই কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই তিনি সাহিত্যের সমঝদার পাঠক এবং লেখকদের নজর কেড়ে নিয়েছিলেন কবিতায় তার পরিণত মন ও মনোভাবের কারণে। এই গ্রন্থের কবিতাগুলোর আঙ্গিকে কোন চমক ছিলো না, ছিলো না ঐহিত্যের জড়তা ভেঙে নতুন কোন জাগরণের কিন্তু এর বিষয়বস্তু ও বাচনভঙ্গীর নতুনত্ব ঐতিহ্যের সীমাকে লঙ্ঘন করে যাওয়ার ইঙ্গিতগুলো ছিলো স্পষ্ট। বছর দুয়েক পর অর্থাৎ ১৯৮৬ সালে যখন তার ‘পার্থ তোমার তীব্র তীর’ বের হলো তখন লেখক ও সাহিত্যের পাঠকরা চমকিত হয়েছিলেন ইঙ্গিত ও প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের এই দ্রুততায়। এরপর অল্প সময়ের ব্যবধানে তার 'জীবনের সমান চুমুক' (১৯৮৯), 'সুন্দরী ও ঘৃণার ঘুঙুর' (১৯৯১), 'নির্বাচিত কবিতা' (১৯৯৫), 'যমুনাপর্ব' (১৯৯৮) এবং 'জন্মবাউল' (২০০১) কাব্যগ্রন্থগুলো বের হয়।
রচনার প্রাচুর্যে যেমন, তেমনি বিষয়ের বহুমুখিতা ও শিল্পকৌশলের দক্ষতায় আটের দশকের কবিদের মধ্যে তিনি বিশিষ্ট হয়ে উঠেছিলেন। কবিতার পাশাপাশি তিনি বিপুল পরিমাণ গদ্যও লিখেছিলেন। মূলত সাহিত্য ও সাহিত্যতত্ত্ব বিষয়ক গদ্য চর্চাই ছিলো তার আগ্রহের প্রধান ক্ষেত্র। এর সঙ্গে ভাষাতত্ত্বকে তিনি পেয়েছিলেন একাডেমিক গবেষণার সূত্রে। ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর শেষে তিনি ১৯৮১ সালে যুক্তরাজ্যের লীডস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাষাতত্ত্বে দ্বিতীয় দফায় স্নাতকোত্তর করেন। অবশ্য এর বছর খানেক আগে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিপ্লোমা-ইন-টিচিং ইংলিশ ওভারসিজ সম্পন্ন করেন খোন্দকার আশরাফ। সাহিত্য যেহেতু ভাষাশ্রয়ী একটি মাধ্যম, ফলে ভাষাতাত্তিক এই সব গবেষণা এবং অধ্যয়ন তার সৃষ্টিশীল সাহিত্যকর্মকে সমৃদ্ধ করেছিলো।
সাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধ রচনায় তিনি তার দশকে এক অপ্রতিদ্বন্দী ভূমিকায় ছিলেন। দেশি ও বিদেশি সাহিত্য সম্পর্কে তার প্রবন্ধের পরিমাণ বিপুল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি 'Modern and post modern Bengali poetry' নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা শুরু করলেও পরবর্তীতে তিনি যখন বিভিন্ন পত্রিকায় দেশি বিদেশি সাহিত্য নিয়ে প্রবন্ধ লেখা শুরু করলেন তখন তাতে প্রাতিষ্ঠানিক শুষ্কতার পরিবর্তে বরং সাহিত্যিক প্রসাদগুণই মুখ্য হয়ে ওঠে। তার গদ্যশৈলীও ছিলো খুব উপভোগ্য, তাতে থাকতো বিষয়ের সাথে সামঞ্জস্যের সূত্রে শব্দের বা অনুষঙ্গের কৌতুকরসপূর্ণ উল্লেখ ও বিন্যাস। তীর্যকতা ও কৌতুকরসের মিশেলে তার গদ্য হয়ে উঠেছিলো তার ব্যক্তিত্বেরই বিশ্বস্ত প্রতিফলন। ব্যক্তিজীবনেও তিনি ছিলেন রসের ভান্ডারী। প্রসন্ন স্বভাবের খোন্দকার আশরাফ হোসেনের সঙ্গে যারা পরিচিত তারা তার গদ্যের শৈলীর মধ্যে খুঁজে পাবেন তার নিজেরই ব্যক্তিত্বের ছায়া।
তার উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে 'বাংলাদেশের কবিতা অন্তরঙ্গ অবলোকন' (১৯৯৫) 'কবিতার অন্তর্যামী: আধুনিক উত্তর আধুনিক ও অন্যান্য প্রসঙ্গ' (২০১০) 'রবীন্দ্রনাথ ইয়েটস গীতাঞ্জলী' (২০১২) এবং 'বাঙালির দ্বিধা ও রবীন্দ্রনাথ এবং বিবিধ তত্ততালাশ' (২০১৩)। এই বইগুলোর শিরোনাম যতই গুরুভার শোনাক না কেন তার গদ্যশৈলীর স্বচ্ছতা, প্রাণবন্ততা আর সাহিত্যিক গুণের কারণে এগুলো আমাদের কাছে সব সময়ই আকর্ষণীয় হয়ে আছে।
গদ্য ও কবিতার পাশাপাশি তিনি বিশ্বসাহিত্যের নানান ক্ষেত্র থেকে তুলে এনেছিলেন চিরকালীন কিছু শস্য যা আমরা দেখতে পাবো তার 'চিরায়ত পুরাণ' (২০০২), 'সফোক্লিসের রাজা ইদিপাস' (১৯৮৭), 'ইউরিপিডিসের মিডিআ' (১৯৮৭), 'ইউরিপিডিসের আলসেস্টিস' (১৯৮৭) পাউল সেলানের কবিতা' (১৯৯৭) এবং 'টেরি ঈগলটন: সাহিত্যতত্ত্ব' (২০০৪) নামক গ্রন্থগুলোয়। নিজেদের সোনালি সম্ভারও তিনি বিদেশিদের হাতে উপহার হিসেবে তুলে দেয়ার জন্য বাংলার লোকসাহিত্য থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন 'Folk Tales from Bangladesh' (১৯৮৫) এবং 'Folk Poems from Bangladesh' (১৯৮৫) শিরোনামে দুটি বই। এছাড়া ২০০১ সালে তিনি জনপ্রিয় কবি নির্মলেন্দু গুনের কবিতা অনুবাদ করেছিলেন 'Selected poems of Nermalendu Goon' শিরোনামে। অধ্যাপনা জীবনের কর্মব্যস্ততা এবং সৃষ্টিশীল রচনার পাশাপাশি তিনি ‘একবিংশ’ নামের একটি সাহিত্য পত্রিকাও সম্পাদনা করেছেন তিরিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে। পাঠকদের সাহিত্যরুচিকে উচ্চতর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তার মেধা ও পরিশ্রম বাঙালির গড় পরিচয়ের বাইরে এমন একটি অবস্থানে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলো যা আমাদের সবার জন্য একটা দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
তার আয়ুস্কাল ছিলো মাত্র ৬৩ বছরের, কিন্তু তাঁর কর্মময় জীবনের দৃষ্টান্ত ৬৩ বছরের সীমাকে অতিক্রম করে যে দীর্ঘায়ু হয়ে উঠবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। মৃত্যু মানে সব সময়ই পর্দা টেনে দেয়া নয়।কোন কোন মৃত্যু আমাদের সামনে উম্মোচন করে মৃতের অবহেলিত ও অনালোকিত দিকগুলোকে। এই উন্মোচন খুলে দেয় জীবনেরই আবেক দরজা। শোক ও শ্রদ্ধায় তার মরণোত্তর আবির্ভাবকে চিরস্বাগতম।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন