রবিবার, ১৬ জুন, ২০১৩

তারুণ্যের খাপে চাই সতর্ক দু’টি ছুরি : খোন্দকার আশরাফ হোসেন



[ কবি খোন্দকার আশরাফ হোসেন আশির দশকের অন্যতম কবি। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন  ফারহান ইশরাক । লিঙ্ক ]

ইশরাক: প্রস্তুতিপর্বে, কবিতার পেয়ালায় ঢেলে দর্শনের যে নির্যাস আপনাকে পান করতে দেখি পরবর্তী পর্যায়ে তৃষ্ণার সে চুমুক থেকে মুখ ফিরিয়ে সমাজচেতনার আশ্রয়ে দাঁড়িয়ে আপনাকে বাজাতে শুনি সমকালীনতার শেষাত্মক বাঁশি, যদিও তা নন্দনের আবশ্যিক শর্তকে আদৌ ব্যাহত করে না। এর অন্তরালে  কাজ করেছে চেতনার কোন বিশেষ প্রতারক-খোলস পাল্টানো সমাজবিকৃতির অভিঘাত, নাকি মনস্তত্ত্বের স্বতঃস্ফূর্ত রূপান্তর?



খোন্দকার আশরাফ হোসেন : দার্শনিকতা আমার কবিতার ভেতরে একটি সুগুপ্ত ফল্গুর মতো বহমান বলে ধারণা করি। তবে পাঠক তাকে কতোটা স্পর্শ করবেন তা আমার জানা নেই। অথবা এমনও বলা যায়, দার্শনিকতা একটি নম্র সুরের দীর্ঘবাদনের মতো আমার কবিতার পশ্চাৎ সঙ্গীত হিসেবে বেজেছে, কখনো কিছুটা ধীরোদাত্ত, কখনো খুব মৃদু ও প্রায় অলক্ষ্যযোগ্যভাবে।

তাই জীবনের সমান তৃষ্ণার চুমুক বলে যাকে অভিহিত করছো, তা যেমন দার্শনিকতা, সমাজচেতনার সমকালীনতার বাঁশিও তেমনি দার্শনিকতা-বিযুক্ত নয় কোনো মতেই। জীবনকে তরমুজের মতো ফালি করলে প্রতিটি খণ্ডেই পাওয়া যাবে তার সবকিছুর সমানুপাতিক ভাগ- শাঁস, ত্বক আর অন্তর্লীন বীজের উপস্থিতি থাকবে সবকটা ফালিতেই। আমার কবিতার প্রতিটি কাল-স্তরেই পাওয়া, একই ভাবে, সমাজভাবনা, জীবন-মৃত্যুবিষয়ক দার্শনিক অনুচিন্তন, এবং আর সবকিছু। তবে একথা স্বীকার করবো যে, প্রথম কাব্যগ্রন্থ তিন রমণীর ক্বাসিদা-য় যে অন্তর্বৃতির খোলস ছিলো, পার্থ তোমার তীব্র তীর থেকেই তার অনেকটাই খসে যেতে থাকে। বারান্দার আলো এসে ঘরের ভেতরটাকে ডাকতে থাকে- আমার আমিত্বের সাথে যুক্ত হয় একটি ঝুলবারান্দা, যেখানে দাঁড়িয়ে জীবনের চলমান রৌদ্রছায়ার খেলা দেখতে প্রলুব্ধ হই। স্বতঃস্ফূর্ত রূপান্তরই বলবো একে, কেননা পাল্টানো সমাজবিকৃতির অভিঘাত ভিতর-বাসিন্দাকে চঞ্চল করতে পারে না, যদি না মনের ভেতরেই ঘটে সমান্তরাল আন্দোলন-আলোড়ন।

ইশরাক :
পৃথিবীর সর্বশেষ কবি আমি অহংকার আমার কবিতা- তিন রমণীর ক্বাসিদা কাব্যের অহংদীপ্ত এ ঘোষণা আপনার শৈল্পিক আত্মবিশ্বাস কিংবা সৃষ্টির অহংকারকে কীভাবে কাব্যকলার দ্রাবকে নিষিক্ত করেছে?

খোন্দকার আশরাফ হোসেন : যে ভিতর-বাসিন্দার কথা আগে বলেছি, সে-ই আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে ঐ
অহংদীপ্ত পঙ্ক্তিটি। আমি এখনো বুঝি না কেন ওটি লিখেছিলাম। দেবতায় বিশ্বাস করি না, তবে কবিতাকে দৈব বলে ভাবি। কখনো কখনো এরকম কোনো কোনো পঙ্ক্তি লিখে ফেলে অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকি- এই উচ্চারণ ঠিক এভাবে কখনো ভাবিনি তো! কোথায় ছিলো এই পঙ্ক্তিগুলো, এক মিনিট আগেও? তো পৃথিবীর সর্বশেষ কবি আমি অহংকার আমার কবিতা- এই পঙ্ক্তিটি লিখেছিলাম কোনো-এক নিমজ্জিত মুহূর্তে; কোনো-এক অবাঙমানসগোচর বোধ দ্বারা স্পৃষ্ট, তড়িতাহত খরগোশের মতো লাফিয়ে উঠেছিলো সে। ধৃষ্টতা হবে তুলনা, তবু মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ, কিংবা জীবনানন্দ দাশের এমত দৃপ্ত আত্মঘোষণা-

কেউ যাহা জানে নাই- কোনো এক বাণী-

আমি বহে আনি

আমার পায়ের শব্দ শোনো-

নতুন এ

আর সব হারানো-পুরনো।


তবে আমার ঐ উচ্চারণের ভেতরকার অহংকারকে কাব্যিক অহংকার ভাবাই ভালো, নিদেনপক্ষে rhetorical posture  হিসেবেও যদি দেখো, মনে কিছু করবো না। তবে এটুকু আত্মবিশ্বাস না থাকলে কবিতার চৌকাঠ না মাড়ানোই ভালো। যথার্থ নতুন কবি মাত্রেরই পায়ের শব্দে পুরনো দরদালান সামান্য হলেও কেঁপে ওঠে বৈকি!

ইশরাক: মোটা দাগে যেমনটি স্বীকার করা হয়ে থাকে :
কবিতার ইতিহাস তার গঠনপ্রযুক্তির ইতিহাস তেমনি. লক্ষ্য করি, আপনার কবিতাও তার গঠনতাত্ত্বিক গুরুত্বকে স্বীকার করে নিয়ে তাকে প্রতিষ্ঠিত করছে- নিরীক্ষার এ প্রবণতা কবিতার কালনিরপেক্ষ সার্বজনীনতার স্বভাবটিকে সুরক্ষা দিতে পারে কতোটুকু?

খোন্দকার আশরাফ হোসেন : কবিতার বিষয় পাল্টায় বটে, কিন্তু তা একটি সসীম আবর্তনীর মধ্যে। অন্যদিকে গঠনকৌশল মুক্তসম্ভাবনাময়- কালে-কালে পাল্টায়- কখনো কখনো পুরনো কোনো কৌশলের/আঙ্গিকের সশব্দ প্রত্যাবর্তন যে ঘটে না তা নয়, তবে তাও সম্পূর্ণ অবিকলরূপে নয়। ভালোবাসার কবিতা লিখেছেন সাকো কিংবা কাতুলুস কিংবা পেত্রার্ক বা দান্তে; লিখেছেন শেক্সপীয়র, জন ডান, বিদ্যাপতি ও রবীন্দ্রনাথ- ভালোবাসার আবেগ চিরন্তন ও অভিন্নরূপী; কিন্তু ঐসব কবির কবিতা বিবিধ বিভায়, তাৎপর্যে ও প্রখরতায় ঋদ্ধ যে হতে পেরেছে সে তাঁদের ব্যবহৃত গঠনশৈলীর বৈধিতার কারণেই। অবশ্য, একথাও স্মরণযোগ্য যে, ভালোবাসা, বা অন্য কোনো জীবন-প্রধাবনাকে বিভিন্ন দার্শনিক প্রেক্ষায় অবলোকনের বৈচিত্র্যও এর জন্য অনেকটা দায়ী। শৈলীগত নিরীক্ষা
কবিতার কালনিরপেক্ষ সার্বজনীনতার স্বভাবটিকে নাকচ করে না। বৈদ্যুতিক বাতির আলোকে নানা আচ্ছাদনের চাতুর্যে মোহময়, আলো-আঁধারি, নিনাদিত কিংবা শমিত, কারুকার্যময় কিংবা সহজ, মর্মভেদী কিংবা রাজসিক, নানারূপ দেয়া যেতে পারে। কিন্তু ভেতরের আলোটাকে না হতে দিলেই হলো।

ইশরাক : পৌরাণিক প্রস্তাবনা আদি অর্থে যেভাবে হাজির হয়, তার বিপরীত ইঙ্গিতে কীভাবে আপনি তাকে কাব্যের কোটরে আধুনিকায়িত প্রোথিত করেন?

খোন্দকার আশরাফ হোসেন : আমার কবিতায় পুরাণ-প্রসঙ্গ বিচিত্রভাবে এসেছে। বস্তুত আশির দশকে যখন কবিতা লিখতে শুরু করি, তখনই আমার কবিতায় পুরাণের উপস্থিতি সাগ্রহে লক্ষ্য করেছিলেন কোনো-কোনো সমালোচক। আসলে বাংলা কবিতায় বিষ্ণু দে-র পর গ্রিক-পুরাণের ব্যাপক ব্যবহার করেছেন শামসুর রাহমান (তবে শামসুর রাহমান বিষ্ণু দে-র মতো  ভারতীয় পুরাণের দ্বারস্থ হননি মোটেই)। আমার কবিতায় (আমি বলবো বহুকাল পর) গ্রিক-ভারতীয়-ইসলামি মিথের সশব্দ এবং মিলিত প্রত্যাবর্তন ঘটেছে। তবে আমি চেষ্টা করেছি পুরাণকে সমকালীন জীবনের নানা উন্মন্থন, নানা প্রধাবনার অনুষঙ্গ হিসেবে ব্যবহার করতে।
তিন রমণীর ক্বাসিদা কবিতায় ম্যাকবেথের প্রসঙ্গ এসেছে (যদিও তা মিথ নয়), সেই সাথে গ্রিকপুরাণের মেডুসা তথা গর্গনের উলেখ। মহাজীবনের পথে টগবগ অশ্ব ছোটানো নায়কের (মনে পড়তে পারে বিষ্ণু দে-র ঘোড়সওয়ারকে) জন্য অপেক্ষা করছে তার অমোঘ নিয়তি, তার অনিবার্য নিমজ্জন বিনাশ আর অপচয়ের মধ্যে। খুব দুরাগত মনে হলেও সমকালীন বঙ্গেতিহাসের ট্রাজিক উলাসের ঝাপট ধৃতিমান পাঠকের গায়ে এসে লাগবে। লাইন দশেক উদ্ধৃত করি :

কারা নাকি রাজা হবে, কারা হবে রাজার জনক;

গর্গনের তিন মেয়ের চুলে ওড়ে সাপের ছোবল,

কানে গোঁজা কম্রফুল, পদতলে রতি শঙ্খচূড়;

দেখা হবে পুনর্বার, বলে ওঠে তারা আচানক।



এই যে দীপিত রোদ এইখানে আঁধার ঘনাবে,

এই যে পুরুষ যায় এই হবে প্রমত্ত নায়ক-

তারপর শেষ হবে পৌরষের সব ছলাকলা,

রক্তমাখা উত্তরীয় কাল প্রাতে মাছেরা জড়াবে।




এই বলে তিন নারী ছুঁড়ে দেয় সুতলির টাক,

নিবদ্ধ শিকার শুধু জলে দেখে ঘুর্ণ্যমান পাক।

[তিন রমণীর ক্বাসিদা-১]

ইসলামি মিথের মধ্যে কারবালার ট্রাজেডিকে ব্যবহার করেছি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কারণ্য ও ক্রন্দনের অনুষঙ্গ ও রূপক হিসেবে।
নোটনের জন্য শোক কবিতাটি পড়তে পারো : সেখানে সদ্য স্বামীহারা সখিনা, কারবালার যুদ্ধযাত্রী কাসেমের নবপরিণীতা, আর যমুনার চরের কৃষকবধূ সখিনা (যার স্বামীও যুদ্ধে গেছে) একাকার হয়ে গেছে- তারা এসে দাঁড়িয়েছে শোক ও সন্তাপের একই জমিতে। তাদের সাথে আবার যুক্ত হয়েছে আবহমান বাংলার একমাত্র নিজস্ব মিথ-কন্যা বেহুলার শোকযাত্রা- কলার ভেলায় : গাঙুড়ের জলে তার ভেসে চলে জীবন-যৌবন উদ্ধৃতি দিই-

কাসেম ফিরবে বলে দুয়ারে দাঁড়িয়ে থাকে মেহেন্দি সখিনা-

দূরের নদীর তীরে রক্তবর্ণ হয় শুধু সন্ধ্যার মেঘ-

কাসেম ফেরে না।

ফিরে আসে রক্তমাখা প্রান্তরের প্রমত্ত দুলদুল,

চরের বাতাসে ওড়ে সখিনার অন্ধকার চুল।

[নোটনের জন্য শোক]

এছাড়া উপমা-উৎপ্রেক্ষার উপকরণ হিসেবে মিথানুষঙ্গ আমার কবিতায় সর্বত্রই প্রাপ্য বলে ধারণা করি।

ইশরাক : সাঙ্কেতিকতার কৃৎকৌশলে যতোটা, তার চেয়ে বেশি অনুভূতির তীব্রতা প্রকাশে, মনে হয়, নিবেদিত আপনার কবিতা- যেটাকে আবার দশকবৈশিষ্ট্যের কার্যকারণগত ফলশ্র
তি হিসেবেও বিবেচনায় নিতে চান কেউ কেউ; এ ব্যাপারে আপনার নিজস্ব উপলব্ধিটি কী রকম?

খোন্দকার আশরাফ হোসেন : সাঙ্কেতিকতা আধুনিকবাদী কবিতার একটি কুলক্ষণ বটে, তবে তার রকমফের, তারতম্য রয়েছে। সাঙ্কেতিক কবিতায় অনুভূতির তীব্রতা প্রকাশিত হয় না তা নয়, তবে সেখানে সংকেতের চাবি ঘোরানোর শ্রমটি স্বীকার করতে হয় পাঠককে। আর তন্মাত্রই খুলে যেতে পারে সংকেতাবদ্ধ আবেগের প্রবল ধারা। র‌্যাঁবোর কবিতা কি অনুভূতির তীব্রতম প্রকাশ নয়? দশক বলতে আশির দশককে যদি বোঝাতে চাও, তবে সেখানে সাঙ্কেতিকতাই প্রধান বৈশিষ্ট্য (অন্তত আমার সমদশকীয় অন্য কবিদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে)। অনুভূতির তীব্রতা আর আবেগের মত্ততার মধ্যে পার্থক্য ব্যাপক। আমার কবিতা নিরাবেগ না হলেও আবেগপ্রধান নয়। আর অনুভূতির তীব্রতা কাকে বলে তার উদাহরণ কীটসের কবিতা।

ইশরাক : জ্ঞানতাত্ত্বিক অভিজ্ঞতার সম্প্রসারণ আপনার কবিতার পটভূমিকে বহুলাংশে বিস্তৃত করেছে, যা কিনা আপনার বিরুদ্ধে দুর্বোধ্যতার প্রশ্নটিকে কখনো কখনো অংশত উসকে দিয়েছে। ভোক্তাশ্রেণীর পঠনস্বল্পতাকেই এ প্রসঙ্গে দায়ি করতে চান, নাকি কবিতায় বুদ্ধিবাদের ব্যবহার সম্পর্কে আর কোনো সম্পূরক বিশেষণ পেশ করবেন?

খোন্দকার আশরাফ হোসেন : আমার কবিতাকে দুর্বোধ্য বলে যারা সরিয়ে রাখতে চান, তারা হয় কিঞ্চিত্তম শ্রমস্বীকারে পরাক্সমুখ, অথবা অপরিণতমনস্ক পাঠক যার পাঠ্যপুস্তকে পঠিত সরল কবিতার খোঁয়ারি কাটেনি, অথবা তিনি আধুনিকবাদী কবিতার দিগন্তবিস্তারী চিন্তনপ্রেক্ষা সম্পর্কে অনভিজ্ঞ, অনভ্যস্ত, অথবা কবিতাপাঠকে উপন্যাসদি গদ্যপাঠের সৌখিনতা বলে মনে করেন। আরো এক শ্রেণীর পাঠক আছেন, তাঁরাই গরিষ্ঠ সংখ্যক, যারা কবিতায় প্রেম অথবা সরাসরি রাজনীতি ছাড়া অন্যকিছু খোঁজেন না। আমাদের দেশের কবিতাপাঠকরা জীবনানন্দ দাশ পড়ে বলে আমরা বলি; কিন্তু তারা কোন কবিতাগুলো বেছে বেছে আওড়ায় (বনলতা সেন, কিংবা হায় চিল) তার দিকে তাকালেই বোঝা যাবে জীবনানন্দ দাশের কবিতার গর্ভগৃহে প্রবেশের অধিকার খুব কম বাংলাদেশী পাঠকের আছে।
বনলতা সেন কবিতটিই অনেকে বোঝেন না; এক ধরনের বহিরাকর্ষণ আছে কবিতাটির মধ্যে, নানা ইতিহাস-ভূগোল পরিক্রমার রোমাণ্টিকতার মধ্যে, স্থান-নাম ও নায়িকাদের মোহনীয় উপস্থাপনার মধ্যে। আর এলায়মান দোলায়মান অক্ষবৃত্তীয় ঘুণপোকার নাচন পাঠকমনে যে ঘোর সৃষ্টি করে তা-ও এর জন্য দায়ী বটে। কিন্তু ঐ কবিতার শেষ স্তবকটির দুর্বোধ্যতা বিশাল। এতো দুর্বোধ্য স্তবক বাংলা কবিতায় কম আছে : পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন/তখন গল্পের তরে আর মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন সত্যি সত্যি আছেন, না স্মৃতিসারমাত্র, তা-অবধি ঠাহর হয় না।

তবে সাম্প্রতিকতম কবিতায় আমি, সম্ভবত, সহজতর হয়েছি।
তোমার নামে বৃষ্টি নামে গ্রন্থর কবিতাগুলোতে উচ্চারণ সহজ, তবে সহজভাবে গূঢ় কথা বলার প্রয়াসটি হয়তো লক্ষ করা যাবে। এমিলি ডিকিনসন কিংবা ফ্রস্টের  আপাতসারল্য কীরকম প্রতারক, তা নিশ্চয়ই লক্ষ করেছো।

ইশরাক: বোধি ও বুদ্ধির ভারসাম্য প্রতিষ্ঠায় আপনার কবিসত্তার যে স্বরূপ নিরুপিত হয় তার পেছনে প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানচর্চার ভূমিকা কীরকম বলে আপনি মনে করেন? প্রাতিষ্ঠানিক গাম্ভীর্য শিল্পের নির্মাণকলায় যে সংহতি আরোপ করে তা কি কখনো শিল্পের সহজিয়া স্বভাবকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, বিশেষত আপনার নিজস্বনির্মাণ প্রক্রিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে?

খোন্দকার আশরাফ হোসেন :
প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানচর্চা বলতে কি আমার শিক্ষাদান পেশাকে ইঙ্গিত করছো? প্রাতিষ্ঠানিক গাম্ভীর্য কথাটাও খোলাসা নয় আমার কাছে। আমার কবিসত্তার স্বরূপটি নির্মাণের পেছনে আমার বিদ্যাশিক্ষার কিছুটা ভূমিকা তো আছেই; ঐ বিদ্যাশিক্ষার বিপদও অনেকখানি। তবে সহজিয়া স্বভাবের সাথে শিল্প কথাটার বিরোধ বোঝা যায় ইংরেজি শব্দবন্ধদ্বয়-Ônature এবং `artifice এর দ্বন্দ্বটি বুঝলে। যে কোনো নির্মাণই আয়াস এবং বুদ্ধিসাধ্য-সহজিয়া লালন আর শিল্পী রবীন্দ্রনাথ, স্বভাব-কবিত্ব আর শিল্পিত কবিতা, দুই ঘরের বাসিন্দা।

তবে অধীত বিদ্যার রূপায়ন তো কাব্য নয়- কবিতা ভিন্ন এক রসায়ন, মেধা, মনন, অনুভূতি আর আবেগের বিবিধমাত্রিক দ্রবণে তার উৎসার। এলিয়টের বহুপঠিত রূপকটি স্মরণ করো। ঐ দ্রবণে সোনাও গলে পাথরও গলে, ফলত যা উৎপাদিত হয়, তা, না সোনা, না পাথর (সোনার পাথরবাটি?), না বিদ্যা, না বুদ্ধি না আবেগ- না কিছু। সে এক ভিন্ন জিনিশ। অদ্রবীভূত বিদ্যার পাথর যে কবিতায় মাথা উঁচিয়ে বিরাজ করে সেটি অপকৃষ্ট কবিতা,  pendantry-এর উদাহরণ। জীবনানন্দ দাশের কবিতায়, বিশেষত
বেলা অবেলা কালবেলাসাতটি তারার তিমির পর্যায়ের, বিপুল মননবিশ্বের ছায়াপাত ঘটেছে- অধীত বিদ্যারও কিছুটা। কবিতা হিসাবে পূর্ব-জীবনানন্দ থেকে তা সামান্য উন বলে আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস।

ইশরাক : আপনার কবিতায় মহত্বচেতনা ও চিরকালীনতার অনুভব সুক্ষ্ম পারম্পরিকতার সূত্রে যুথবদ্ধ বলে, তা কি নতুন সাম্প্রতিক কাব্যপ্রয়াসের সাথে কোনো সংঘর্ষ বা তির্যকতা তৈরি করে?

খোন্দকার আশরাফ হোসেন : তোমার প্রশ্ন থেকেই মনে হচ্ছে,
নতুন ধারা সাম্প্রতিক কাব্যপ্রয়াসের মধ্যে মহত্বচেতনা ও চিরকালীনতার অনুভব অনুপস্থিত। তা-ই যদি হয়, তবে সাম্প্রতিক কবিতার সাথে তীর্যকতা অবশ্যম্ভাবী। মহত্বচেতনা কিংবা চিরকালীনতার অনুভব নতুন প্রজন্মের কাছে বিশেষত পাশ্চাত্য post modernism-এর পরহেজগার যারা, তাদের কাছে বিস্বাদ, পরিত্যাজ্য গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ মনে হতেই পারে। জীবনের খণ্ডায়ন এবং অশুভস্থ সম্পর্কে সচেতনতা তথাকথিত হাই মডার্নিজম এরই বৈশিষ্ট্য। তবে আধুনিকবাদী কবিতায় জীবন আছে centre-stage-এই, তার বিরূপতা মালিন্য, অশুভত্ব সবসহ। আর আছে ক্লিন্ন-খিন্ন-তাপিত মানুষ! পোস্টমডার্নিজম জীবন ও মানুষ দুই প্রপঞ্চকেই প্রান্তে ঠেলে দিতে চায়- স্নানের জলের সাথে বাচ্চাটিকেও ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে সে। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কবিতায় এরকম একটি ধারা আছে বটে; কিছুদিন বেশ প্রবলও ছিলো। কিন্তু শুকিয়ে যাচ্ছে সে-ধারা, কারণ উৎসের মানসসরোবর তাদের খটখটে শুকনো। অন্য একটি ধারা, যা জীবনের মহত্ব ও মানুষের অগ্রগণ্যতাকে মান্য করে, সেটিই চলমান; আরো পুষ্ট হচ্ছে সে, উভয় বাংলায়, ক্রমাগত। আমার সাযুজ্য শেষোক্ত ধারার সঙ্গে। আমি আছি আবহমান বাংলা কবিতার সঙ্গে।

ইশরাক : চেতনার বৈশ্বিকরণ, আপনার বিবেচনায়, কী মাত্রায় ভৌগোলিক বৈশ্বিকরণের অনুগামী? বাস্তুচ্যুতি ও প্রবাসন অভিজ্ঞতা ছাড়া কাব্যের সফল গোলকায়েন কতোটুকু সম্ভবপর বলে আপনার মনে হয়?

খোন্দকার আশরাফ হোসেন : কাব্য কোনো পণ্য নয় যে তার
বিশ্বায়ন, মুক্তবাজার ইত্যাদির প্রয়োজন হবে। গোলকায়ন-তত্ত্বেই আমি বিশ্বাস করি না। একটি জনগোষ্ঠীর কবিতা সেই জনগোষ্ঠীর জীবনচর্চার ফসল, তার প্রেক্ষিত তার দেশ, তার মাটি ও মানুষ। তার ভেতরে যে-টুকু বৈশ্বিকতা তা আসলে মানুষের সার্বজনীন যা গুণাবলি, যে-উদ্যাপন, তারই বৈশ্বিকতা। কোনো ভূগোল পরিক্রমা প্রয়োজন নেই মানুষের সার্বজনীন অনুভবকে জানা-বোঝার জন্যে। বাস্তুচ্যুতি ও অভিবাসন, যাকে ইংরেজিতে ফরধংঢ়ড়ৎধ বলে, তার ফসল এক বিশেষ ধরনের কবিতা- দেশ ও মাটি হারানোর কান্নায় ভরা, শিকড়বিহীনতাকে বৈশ্বিকরণ বলাতে আমার প্রচণ্ড আপত্তি আছে। চেতনার বৈশ্বিকরণের জন্য ভৌগোলিক মূলোৎপাটন তথা অভিবাসন এমনকি বিশদ ভ্রমণের কোনো প্রয়োজন নেই- আজকের এই নখাগ্র-ধৃত টেকনোলজির যুগে তো নয়ই।

ইশরাক : প্রাতিষ্ঠানিকতার সাথে শুদ্ধশিল্পের আদৌ কোনো বিরোধ কি থাকতে পারে বলে আপনার মনে হয়? আপনার শিল্পজীবনে প্রাতিষ্ঠানিকতার প্রভাব আপনার অগোচরে কাজ করেছে বলে কি মনে হয়েছে কখনো?

খোন্দকার আশরাফ হোসেন : এই প্রশ্নটির সাথে পূর্ববর্তী একটি প্রশ্নের মৌলিক সাদৃশ্য থাকায়, আমার বিশ্বাস, এর প্রাসঙ্গিক জবাব ইতোমধ্যেই তুলে ধরেছি।

ইশরাক: সাহিত্যে শ্রেয়বোধের যে একটি আশ্রয় যুগে যুগে কমবেশি রক্ষিত হয়ে এসেছে, বিবর্তিত বিশ্বের নতুন ব্যবস্থাপনায় তা কতোটুকু তাৎপর্য নিয়ে বহাল থাকছে বলে আপনার মনে হয়?

খোন্দকার আশরাফ হোসেন : বিবর্তিত বিশ্বের নীতি ব্যবস্থাপনা যদি  নৈতিকতাকে পুরোপুরি বর্জন না করে থাকে, তবে সাহিত্যে শ্রেয়বোধের প্রাসঙ্গিকতা থাকবেই। আজকের অশান্ত, সন্ত্রাস-কম্পিত বিশ্বে এর প্রয়োজনীয়তা আরো বেড়েছে বলেই ধারণা করি। সাহিত্য যদিও নীতিকথার ঢোলক নয়, তবু সাহিত্য শ্রেয়বোধের দিকেই ঝুঁকে থাকে, অন্তত থেকেছে আজতক।

ইশরাক : শিল্পের প্রতি আপনার যে মনস্তাত্ত্বিক নিবিষ্টতা, জীবনচক্রের পরিক্রমায় তার কী ধরনের রূপান্তর ঘটেছে বলে আপনি অনুভব করেন? শিল্পের বয়সনিরপেক্ষ কোনো নিরঙ্কুশ  আবেগ কি আপনার মধ্যে কাজ করে?

খোন্দকার আশরাফ হোসেন : বয়স বাড়ার সাথে সাথে সেটি বেড়েছে বলেই মনে হয়। আর তারুণ্যেও আমি উলম্ফনে বিশ্বাস করিনি-সুস্থির শৈল্পিকতার অনুধ্যান করেছি। আমার কবিতায় প্রথমাবধি স্থিরপ্রজ্ঞ সুস্থিতি ছিলো।
ইশরাক:
জীবনের সমান চুমুক কবিতায় রাত্রির গাঢ় কুয়াশার সর দুহাতে সরিয়ে, সূর্যের, আলোর বাটিতে চুমুক দেয়ার যে চিত্রকল্পটি আমরা লক্ষ্য করি, তার পাশাপাশি তৃতীয় বিশ্বের তৃষ্ণাকাতর গণমানুষের কবিপ্রতিনিধি নিজে বঞ্চিত থেকে যান তাঁর প্রত্যাশিত মুক্তির অধিকার থেকে। যদিও ধৃষ্টতাই বটে, তবু জানতে ইচ্ছে করে এই অর্থের বাইরে আর কোনো দার্শনিক ইশারা এর মধ্যে লুকিয়ে আছে কিনা।

খোন্দকার আশরাফ হোসেন : বেশিরভাগ পাঠক তোমার সাথে একমত হবে যে,
জীবনের সমান চুমুক কবিতাটিতে তৃষ্ণাকাতর ক্ষুৎপীড়িত গণমানুষের আল্টিমেট বঞ্চনার কথা বলা হয়েছে-- তুই মৃত্যুর স্বাধীনতা পাবি, মুক্তি পাবি না-কিন্তু এর ভেতর একটি অস্তিত্ববাদী জিজ্ঞাসাও দুর্নিরীক্ষ্য নয় : স্বাধীনতা বনাম মুক্তি-এই দার্শনিক দ্বৈধ নিরাকরণযোগ্য নয় আমার কাজে। তবে সেই গূঢ় পাঠটি যদি কেউ না দেখে, আমি খুব একটা বিলাপ করবো না সে জন্যে।

ইশরাক : এবার তরুণের কাব্যপ্রয়াস বিষয়ে আসি- শূন্যদশকীয় শব্দকুশলতা বা ভাবতির্যকতা আপনার কাছে কেমন মনে হয়; এ সময়কার কাব্যভাষার প্রতি আপনার প্রকৃত প্রতিক্রিয়াটি আমাদের জানাবেন কি?

খোন্দকার আশরাফ হোসেন : শূন্যদশকীয় শব্দকুশলতা না বলে আমি বলবো শব্দবিহ্বলতা। ২০০০-এর কবিরা বয়সে তরুণ, কিন্তু তাদের অবলম্বিত ভাষা প্রৌঢ়ের আলস্যজড়িত, কুয়াশাময়, মদির, আঁখি ঢুলুঢুল ও বড়বেশি শোভন-মনে হয়, দাশগুপ্ত কবিটির পুনর্জন্ম হয়েছে, রূপসী বাংলা পর্বের, কিংবা তারও আগের নরম শব্দ-ওম এদেরকে রৌদ্রবিতৃষ্ণ করেছে বলে মনে হয়। বাংলাদশের কবিতায় দেখা দিয়েছে মেরুদণ্ডের অসুখ, কুঁজো হয়ে আসছে দেহ, ক্ষীণ হচ্ছে কণ্ঠস্বর-- ফিসফিস কথা নিজেরই কানে কানে। রোদে পিঠ দিয়ে দাঁড়ানো সটান পৌরুষ, দৃপ্ত ও সজাগ মানসসংগঠন, জীবনের নান্দীপাঠ, হায়, লুপ্ত হতে চলেছে কবিতার সংবেদনে ও সংগঠনে। কিন্তু তবু এলিজি পাঠ করবো না, প্রতীক্ষায় থাকবো সেই কণ্ঠের, যে পুনরায় জাগাবে আমাদের ইতিবাচকতায়, জীবনের সহর্ষ, সোৎসাহ উদ্যাপনে।

ইশরাক: একটি কবিতার জন্ম মুহূর্ত, আপনার সার্বভৌম অনুভবে, কাব্যকর্মের বাইরে ব্যয়িত মুহূর্ত থেকে উত্তাপও উত্তেজনার দিক থেকে কী রকমভাবে আলাদা বলে আপনার মনে হয়?

খোন্দকার আশরাফ হোসেন : কবিতার জন্মমুহূর্ত কবিরও নবজন্মের মুহূর্ত, অথবা তার জন্মের পুনর্নবায়ন। কবিতা রচনার মুহূর্তে কবি তার পরিপার্শ্ব থেকে ছিন্ন হয়ে এমন একটি মনোদৈহিক অবস্থায় পৌছান যার সাথে অনুপ্রেরিত, যোগাবস্থার মিল আছে। বহুবার কোলরিজের যে পঙ্ক্তিগুলো আউড়েছি শ্রেণীকক্ষে, সেগুলোই হতে পারে সে-অবস্থার অবিকল্প বিবরণ। প্রসঙ্গত বলি, অনুপ্রাণিত কবিকে আমি ভয় পাই না; তাকে নমস্য ভাবি। সৃষ্টির সেই মুহূর্তটিতে কবির চারপাশে গড়ে ওঠে আলোর বৃত্ত; মাটি থেকে যেনো শূন্যে উঠে যান তিনি। যারা দেখে তারা সভয়ে চিৎকার করে বলে

Beware, beware,

His flashing eyes, his floating hair

Weave a circle round him thrice

And close your eyes with holy dread

for he on honey-dew hath fed.

And drunk the milk of paradise.


এই ম্যাজিক্যাল মুহূর্তের বর্ণনাকে রোমাণ্টিকতার অতিরেক বলে ঠেলে ফেলো না। কবিতা-সৃষ্টির (বিশেষ) মুহূর্তটি একটি দৈব-মুহূর্ত বটে, যার সাথে শুধু কোনো প্রেরিত পুরুষের অলৌকিক জ্ঞান লাভেরই তুলনা চলে।

২টি মন্তব্য:

  1. চমৎকার! ইশরাক ভাইকে ধন্যবাদ!

    উত্তরমুছুন
  2. আমি লিটন চক্রবর্তী মিঠুন, ইংরেজি বিভাগ, ঢাবিতে পড়ছি। ইশরাক ভাইয়ের নেওয়া এই সাক্ষাৎকারটি আমার খুব উপকারে আসবে। উনাকে ধন্যবাদ !

    উত্তরমুছুন