বুধবার, ১৯ জুন, ২০১৩

খোন্দকার আশরাফ হোসেনঃ জীবনের সমান কবি

কামরুল হাসান | ১৮ জুন ২০১৩ ৩:২১ অপরাহ্ন


সকলকে বিমূঢ় ও শোকস্তব্ধ করে ১৬ জুন রোববার সকালে নিরালোকে চলে গেলেন কবি খোন্দকার আশরাফ হোসেন। প্রথমটায় মনে হল ভুল শুনেছি, বিশ্বাস হয়নি, কেননা তাঁর যাওয়ার সময় হয়নি, কত কাজ পড়ে ছিল সৃষ্টিশীল দু’হাতে, সেসব ছেড়ে কী করে চলে যান তিনি? তাঁর মৃত্যু এত অপ্রত্যাশিত যে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসেছিলাম, চোখ ভরে উঠছিল জলে, আর মনে পড়ছিল তাঁর সাথে কাটানো অসংখ্য স্মৃতিময় দিনের কথা। কী প্রাণবান মানুষ ছিলেন শক্তিমান এ কবি!

খোন্দকার আশরাফ হোসেনকে প্রথম দেখি বাংলা একাডেমির বইমেলায়, সেটা আশির দশকের শেষভাগ। কোকড়ানো চুলের শ্যামলা রঙের দীর্ঘদেহী মানুষটির ভিতর কি যেন আকর্ষণ ছিল, ছিল এক অনতিক্রম্য দেয়ালও, কেননা তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, কবি হিসেবে প্রবল স্বীকৃত, উপরন্তু তিনি আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু আজফার হোসেনের শিক্ষক। বন্ধুর শিক্ষক হিসেবে প্রথমদিকে তাকে দূর থেকে সমীহ করেছি, কাছে ভিড়বার সাহস হয়নি। তাঁর সাথে আমার সখ্য গড়ে ওঠে তাঁরই সম্পাদিত ‘একবিংশ’ পত্রিকায় লেখা মুদ্রিত হওয়ার মধ্য দিয়ে। তখন তিনি ব্যক্তিগতভাবে আমাকে চিনতেন না। ব্যক্তিগত পরিচয় না থাকা সত্ত্বেও কেবল কবিতার বিচারে লেখা মুদ্রিত হওয়ার রেওয়াজ বাংলাদেশে খুব বেশি না থাকায় তখন বিস্মিত হয়েছিলাম, সম্পাদকের প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে গিয়েছিল। পরবর্তীতে কাছে ভিড়ে দেখলাম মানুষটি প্রাণখোলা ও আড্ডাপ্রিয়। এক অদ্ভুত সারল্য আছে তাঁর, আছে চমৎকার রসবোধ। তরুণদের লেখার প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল বেশি, তরুণদের সাথে মিশতেন বন্ধুর মতই। আজকের স্বনামখ্যাত অনেক তরুণ কবির প্রথম লেখা তিনি তাঁর সম্পাদিত ‘একবিংশ’-এ ছেপেছেন। নিজে প্রতিভাবান ছিলেন বলেই প্রতিভা চেনার এক দুর্দ্দান্ত ক্ষমতা ছিল তাঁর। ‘একবিংশ’ হয়ে উঠেছিল তরুণ কবিদের একটি প্রিয় পত্রিকা ও সৃজনশীল আশ্রয়।
আমৃত্যু তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। আমার সৌভাগ্য হয়নি সরাসরি তাঁর ছাত্র হওয়ার, কিন্তু তাঁর ছাত্রদের মুখেই শুনেছি শিক্ষক হিসেবে তিনি ছিলেন অতুলনীয়। সাহিত্যের জটিল বিষয়কে সহজ করে তুলতে পারার অসামান্য দক্ষতা ছিল, আর কবি বলেই কাব্যিক অলঙ্কারে ভরা ছিল বক্তৃতা, যে অলঙ্করণ আমরা তাঁর কবিতা বিষয়ক গদ্যে পাই। শব্দের অভাবনীয় মোচড় দেখি লেখায়; চিত্রকল্প, উপমা, উৎপ্রেক্ষা, প্রতীকের কুহকঘেরা জগৎ। বাংলা ও ইংরেজি–দু’ভাষাতেই সাবলীল ও শক্তিমান, এমন লেখকের সংখ্যা খুব বেশি নেই এ দেশে, এ বিচারেও তিনি ছিলেন বিরল প্রজাতির লেখক। তার অনুবাদের উচ্চমান থেকেই এটা প্রতীয়মান। এক দুর্বোধ্য কারণে, কিংবা বলা যায় বিভাগীয় শিক্ষকদের এলিট মনোভাবের শিকার হয়ে, তিনি ছিলেন কিছুটা নিঃসঙ্গ। কেননা শহুরে উচ্চবিত্ত পরিবার থেকে আসা তার ‘এলিট’ সহকর্মীরা গ্রাম থেকে উঠে আসা খোন্দকার আশরাফ হোসেনকে সহজভাবে গ্রহণ করেননি। তিনি ছিলেন নিতান্তই কৃষকের সন্তান এবং পুরোপুরিই একজন স্বনির্মিত মানুষ; কেবল মেধার জোরে এসে ঠাঁই নিয়েছিলেন দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে, কারো অনুকম্পায় নয়। তবে অকৃত্রিম স্নেহ পেয়েছিলেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ও অন্যান্য সিনিয়র শিক্ষকদের।

বহুমাত্রিক মানুষটি কবি পরিচয়েই সবচেয়ে বেশি গর্বিত হতেন। বয়সের বিচারে তিনি ষাটের শেষভাগের কবি বলে পরিগণিত হতে পারতেন, কিন্তু কিছুটা বিলম্বে তার কাব্যজগতে প্রবেশ (প্রস্তুতিতে প্রয়োজনীয় শ্রম) এবং আবির্ভাবেই বাজিমাত। প্রথম দু’টি কাব্য তিন রমণীর ক্বাসিদা (১৯৮৪) ও পার্থ তোমার তীব্র তীর (১৯৮৬) সমালোচক ও কবিদের নজর কাড়ে এবং কবি হিসেবে তিনি দ্রুতই নিজের জায়গাটি খুঁজে পান। কবি আল মাহমুদ সেসময়ে বলেছিলেন, ‘বাংলা কবিতায় এক শক্তিমান কবির আবির্ভাব ঘটেছে।’ কবি শামসুর রাহমান তাকে সুপ্রসন্ন অভিবাদন ও স্বাগত জানিয়েছিলেন। এ দু’টি কাব্যের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৮৭ সালেই ‘আলাওল পুরস্কার’ পান। ২০০৮ সালে ‘ব্রক্ষ্মপুত্র পদক’ ছাড়াও সম্প্রতি প্রাপ্ত জীবনানন্দ পুরস্কার তাঁর কবিপ্রতিভার অমলিন স্বীকৃতি। বাংলার কৃষ্টি, ঐতিহ্য, মাটি ও মানুষের প্রতি ঘোরানো ছিল খোন্দকার আশরাফের কাব্যের মুখ। প্রথাগত ভাষায় লিখলেও তাঁর কবিতার ছন্দোমাধুর্য, ধ্রুপদী চারিত্র, ও নিটোলত্ব মুগ্ধ করেছিল পাঠকদের। তবে তিনি সময়ের সাথে দ্রুতই বদলে নিয়েছেন কবিতার বিষয় ও ভাষা। তাঁর এই অভিযোজন ক্ষমতা প্রশংসনীয়। শেষের দিকে হয়ে উঠেছিলেন উত্তরাধুনিক কবি। আধুনিকতা থেকে উত্তরাধুনিকতায় যাত্রায় তিনি বারংবার নিজেকে ভেঙেছেন, কখনো অতিক্রম করে গেছেন নিজেকেই। এসবই তার প্রতিভার নিগূঢ় স্বাক্ষর। বিষয় ও আঙ্গিক নিয়ে অনেক নিরীক্ষা করেছেন কবিতায়, কোথাও থেমে থাকেননি। ওই দুটো কাব্য ছাড়া তিনি লিখেছেন জীবনের সমান চুমুক (১৯৮৯), সুন্দরী ও ঘৃণার ঘুঙুর (১৯৯২), যমুনাপর্ব(১৯৯৮), জন্মবাউল (২০০১), তোমার নামে বৃষ্টি নামে(২০০৭), আয়(না) দেখে অন্ধ মানুষ (২০১১) প্রভৃতি অসামান্য কবিতাগ্রন্থ। কুয়াশার মুশায়েরা ছিল এবছর বইমেলায় প্রকাশিত সর্বশেষ কাব্য, আর বাঙালির দ্বিধা ও রবীন্দ্রনাথ এবং বিবিধ তত্ত্বতালাশ শেষ প্রবন্ধের বই।
asraf-by-masud-anondo.jpg
খোন্দকার আশরাফ হোসেন। ছবি: মাসুদ আনন্দ।
অনুবাদে সিদ্ধহস্ত খোন্দকার আশরাফ হোসেন ১৯৮৬ সালেই তিনটি ধ্রপদী গ্রীক নাটক সফোক্লিসের রাজা ঈদিপাস এবং ইউরিপিদিসের মিডিআ ও আলসেস্টিস সফল অনুবাদ করেন। তাঁর অনুবাদ কেবল মূলের প্রতি বিশ্বস্ত নয়, তারা সৃজনশীল। এছাড়া অনুবাদ করেছেন পাউল সেলানের কবিতা (১৯৯৭), টেরি ঈগলটনের সাহিত্যতত্ত্ব (২০০৪), ডেভিড অ্যাবারক্রম্বিরসাধারণ ধ্বনিতত্ত্বের ভূমিকা (১৯৮৯)। শেষোক্ত দু’টি গ্রন্থ বাংলা ভাষায় মূল্যবান সংযোজন। এছাড়া তাঁর অনেক অনুবাদ বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কেবল কবিতা নয়, প্রবন্ধ এবং অনুবাদেও তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কারের যোগ্যতা ধারণ করতেন। অথচ অমন প্রতিভাবান মানুষটিকে রিক্ত হাতে ফিরতে হলো ঈশ্বরগৃহে।

গতবছর সার্ক সাহিত্য উৎসবে লক্ষ্মৌয় কাটানো কয়েকটি দিন অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে তাকে দেখার সুযোগ আমার হয়। এরও আগে কলকাতায় একটি সাহিত্যিক আমন্ত্রণে আমরা একত্রে যোগ দিয়েছিলাম। দেখেছি প্রিয় সহধর্মিণীর স্মৃতিতে কাতর মানুষটির চোখে বেদনার জল। অল্পবয়সে ভালবেসে যাকে বিয়ে করেছিলেন, যার সাথে কেটে গেছে যৌবন ও মধ্যবয়সের সকল দিনরাত্রি, তার আগেভাগে চলে যাওয়াকে তিনি মেনে নিতে পারেননি। সহধর্মিণী ছাড়াও মায়ের মৃত্যু তাকে শোকাতুর রাখতো। আপাত কাঠিণ্যের আড়ালে তাঁর মনটি ছিল দয়ার্দ্র। প্রকৃত কবির মতো চেতনা জুড়ে শুধুই কবিতা বিষয়ক ভাবনা বইতো। সাহিত্যের শিক্ষক হিসেবে তিনি যেমন কাব্য কাঠামোর চুলচেরা বুঝতেন, কবি হিসেবে বুঝতেন তাদের মান। নিরহঙ্কারী মানুষটি ছিলেন অত্যন্ত বন্ধুপ্রিয়, সরস মন্তব্যে চমক দিতেন আর মাতিয়ে রাখতেন সকলকে, নিজেকে নিয়েও মশকরা করতেন প্রচুর। প্রতিটি বইমেলায় তাঁর উপস্থিতি ছিল চোখে পড়বার মতো, শেষের দিকে বাণিজ্যিক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোর ভন্ডামীকে পাশ কাটাতে নিজেই নিজের বই প্রকাশ করতেন, একাধিক বই, আর সেসব সাজিয়ে নিয়ে বসতেন লিটলম্যাগ চত্বরে। তিনি যে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, সে পরিচয়কে অগ্রাহ্য করে কেবল কবি ও সম্পাদক হিসেবে বিরাজ করতেন নতুন লিখিয়েদের প্রাণবান আসরে। প্রায় প্রতিদিন বইমেলা শেষে আমরা কয়েকজন হেঁটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ক্লাবে এসে কিছুক্ষণ বসতাম। তিনি আমাদের আপ্যায়ণ করতেন এবং সরস কৌতুক ও বিদগ্ধ আলোচনায় ভরিয়ে তুলতেন প্রহরগুলো।

তিনি যে কেবল একজন শক্তিমান কবি ছিলেন তাই নয়, তার হাতে ফুটতো অসাধারণ গদ্য। যারা তার প্রবন্ধ পাঠ করেছেন তারাই মুখোমুখি হয়েছেন এক অননুকরণীয় গদ্যের, ভাষা তার কলমে সাদা পৃষ্ঠার মঞ্চে ঘুঙুর পরে নেচে ওঠা সুন্দরী হতো। পঞ্চাশ ও ষাটের প্রধান কবিদের নিয়ে লেখা তার প্রবন্ধসমূহ নতুন করে চিনিয়ে দেয় ওইসব কবিদের। বস্তুতঃ খোন্দকার আশরাফ হোসেনের মূল্যায়নের অপেক্ষা করতেন অনেক গুরুত্বপূর্ণ কবি। কবি বলেই সেসব গদ্যের শরীরে একদিকে ছিল কবিতার অলঙ্কার ও মাধুর্য, অন্যদিকে ছিল মেধার দীপ্তি ও শাণিত বিশ্লেষণ। তাঁর অনেক লেখায় পাই মেধা, তীক্ষ্ণদৃষ্টি ও কৌতুকবোধের অসামান্য সমাহার। বিশ্বসাহিত্যে আয়াসহীন গতায়ত এবং তত্ত্বীয় কাঠামোর উপরে দখল তাঁর তুলনামূলক আলোচনাগুলোকে নিয়ে গেছে ভিন্নতর উচ্চতায়, সমৃদ্ধ করেছে পাঠকের জ্ঞানের ভান্ডার। যেখানে আবদুল মান্নান সৈয়দে এসে পাঠক জটিল গদ্যের অলাতচক্রে পড়ে যান, সেখানে খোন্দকার আশরাফ হোসেনের গদ্যে পান কবিতার মোহনীয় সৌন্দর্য।বাংলাদেশের কবিতা : অন্তরঙ্গ অবলোকন তাঁর বিরল প্রতিভারই দীপ্তি ছড়ায়, যা ওইসকল প্রবন্ধকে এক মলাটের ভেতর ধারণ করে।

খোন্দকার আশরাফ হোসেন যদি একটি কবিতা বা প্রবন্ধও না লিখতেন, তবু ‘একবিংশ’ পত্রিকা সম্পাদনার জন্য তিনি আমাদের অশেষ কৃতজ্ঞতাভাজন হয়ে থাকতেন। ১৯৮৫ সাল থেকে শুরু করে মৃত্যুর বছরটি পর্যন্ত সুদীর্ঘ ২৮ বছর সম্পূর্ণ একক উদ্যোগে তিনি কবিতা এবং কবিতা বিষয়ক গদ্যের অত্যন্ত উঁচুমানের পত্রিকাটি সম্পাদনা করে আসছিলেন। লেখা সংগ্রহ, বাছাই, প্রুফ রিডিং থেকে শুরু করে প্রকাশনার প্রতিটি খুঁটিনাটি তিনি নিজে দেখতেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত গোছানো এক মানুষ, প্রকৃতিদত্ত প্রতিভার সাথে কঠোর পরিশ্রম করার মানসিকতা মিলিত হলে যে বিস্ময় উৎপাদিত হয়, ‘একবিংশ’ ঘিরে তাঁর বিপুল কাজ সে বিস্ময়ই বহন করে। ‘একবিংশ’-এর জন্য প্রচুর প্রবন্ধ তিনি লিখেছেন, দু’হাতে অনুবাদ করেছেন বিদেশী সাহিত্য, লিখেছেন বইয়ের আলোচনা। কখনো পর্যাপ্ত গদ্য না পেলে রাশেদ মিনহাজ ছদ্মনামেও লিখেছেন। কখনো পত্রিকাটির প্রচ্ছদও এঁকেছেন, ভাবা যায়? একবিংশের সাম্প্রতিক সংখ্যাগুলো ত্রিশের পঞ্চপাণ্ডব কবিকুল ঘিরে, বাংলা ভাষার প্রণম্য কবিদের উপর অত্যন্ত নিষ্ঠা ও মেধা সহকারে প্রকাশ করছিলেন একেকটি সংখ্যা। মাঝে নিজের পিএইচডি অভিসন্দর্ভ লেখার কাজের জন্য কয়েক বছরের বিরতি ছাড়া বিরতিহীনভাবে এবং অপত্যস্নেহে কাগজটিকে লালন করেছেন, যা তরুণ কবিদের জন্য সৃষ্টিশীলতার বাতাবরণ খুলে দিয়েছিল। ‘একবিংশ’-এ লেখা ছিল প্রতিটি তরুণ কবির আরাধ্য। নতুন প্রতিভা শনাক্ত করা ও লালন করার গুরুদায়িত্বটি পালনের জন্যই তিনি আমাদের নমস্য হতেন। তরুণদের পরিচিত করিয়ে দিয়েছেন বিশ্বসাহিত্যের বিপুল ঐশ্বর্যের সাথে। তাঁর বিশ্ব কবিতার সোনালী শস্য গ্রন্থটি এরকম প্রবন্ধে ঠাঁসা (উল্লেখ্য, বইটি তিনি তুষার গায়েন, বায়েতুল্লাহ কাদেরী ও আমাকে উৎসর্গ করেছেন)। এসবই তিনি করেছেন পরম নিষ্ঠায়, নিজ ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে।

তিনি ছিলেন প্রগতিমনস্ক, অসাম্প্রদায়িক, আধুনিক চেতনার মানুষ। ছিলেন অন্যায়ের প্রতিবাদী, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাহী। কেবল চেতনাবাহী বললে কম বলা হবে, তিনি যৌবনে সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। তার সারল্য কোদালকে কোদাল বলতে শিখিয়েছে, যা তাকে কখনো কখনো কারো কারো অপছন্দের পাত্রে পরিণত করতো। তবে সেসবই সাময়িক, কেননা মানুষটির মহৎ স্বভাবের পরিচয় বিরুদ্ধবাদীরা শীঘ্রই পেতেন। অল্প সময়ের নোটিসে তাঁর মরদেহ দেখতে ও শ্রদ্ধা জানাতে ছুটে আসা কবি-লেখকদের ভীড় প্রমাণ করে তিনি সকলের কতখানি প্রিয় ছিলেন। দেখেছি তাঁর ছাত্রদের প্রিয় শিক্ষককে হারানোর বেদনায় অঝোরে কাঁদতে।

দীর্ঘদিন ‘একবিংশ’-এ লেখালেখি ও আড্ডার সূত্রে আমি তার বেশ ঘনিষ্ঠ ছিলাম। সে ভালবাসার প্রকাশ হিসেবেই কিনা জানিনা, একদিন বিস্মিত হয়ে দেখি ‘একবিংশ’-এর প্রিন্টার্স লাইনে সহকারী সম্পাদক হিসেবে আমার নাম মুদ্রিত। যদিও সম্পাদনার সুদূরতম কাজটিও কখনো তিনি আমাকে দেননি, তবু আমার নাম মুদ্রিত করতেন। ২০১২ সালে বইমেলায় প্রকাশিত আমার নির্বাচিত কবিতা গ্রন্থের মোড়ক তিনিই উন্মোচন করেছিলেন। এরও আগে আরও কিছু বইয়ের মোড়ক উন্মোচন তাঁর হাতেই হয়েছে। আমার মনে হতো এই নিরহঙ্কারী প্রতিভাবান মানুষটি কাছে থাকলে আর অনত্র ছোঁটার কী প্রয়োজন? আমার ঈশ্বরের নিজগ্রহ কবিতাগ্রন্থটি আমি তাকে এবং ‘নিসর্গ’ সম্পাদক সরকার আশরাফকে যৌথভাবে উৎসর্গ করি, যা ছিল তাঁদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের একটি বিনম্র উপায়।

প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাস এলেই আমরা, তাঁর ভক্তরা, তাকে বলতাম, ‘স্যার, এবছর আপনি অবশ্যই পুরস্কার পাবেন।’ শুনে তিনি খুশী হতেন, চোখমুখ উদ্ভাসিত হতো আনন্দে। পুরস্কার ঘোষণার পরে আমরা অপরাধবোধে মুখ লুকাতাম আর তাঁর চোখেমুখে একটা উদাসীন বিষন্নতা ভেসে উঠতো। এটা ঘটছিল গত ৭/৮ বছর ধরেই। ঘনিষ্ঠ বলেই জানি বাংলা একাডেমি পুরস্কারের প্রতি তাঁর একটি আকাংখা জেগেছিল, যোগ্য ছিলেন বলেই এটা জেগেছিল। বছরের পর বছর তাঁর চেয়ে কম মেধাসম্পন্ন কবিদের (কখনো স্রেফ অকবিদের) পুরস্কৃত করে বাংলা একাডেমি নিদারুণ অবহেলা করছিল এই প্রতিভাবান কবির প্রতি। অন্ধ প্রতিষ্ঠানটি আয়নায় এবার নিজের মুখ দেখে নিতে পারে। হার্টের অসুখটি ধরা পড়ার পর থেকেই আমার মাঝে একটি ভয় বাসা বেঁধেছিল, পরবর্তী ফেব্রুয়ারির আগেই, ঈশ্বর না করুক, যদি তিনি মৃত্যুবরণ করেন, তবে বাংলা একাডেমি লজ্জায় কোথায় মুখ লুকাবে? শেষাবধি সে বিপর্যয়ই ঘটল, সত্তরের মেধাবী কবি আবিদ আজাদের মতোই, নিদারুণ অবহেলিত হয়ে, অভিমান নিয়ে চলে গেলেন খোন্দকার আশরাফ হোসেন। তাকে পুরস্কার দিয়ে বরং বাংলা একাডেমি সম্মানিত হতে পারতো, কেননা একজন মহৎ কবির পুরস্কারে কিছু যায় আসে না, পুরস্কার তাকে ছোট বা বড় করে তুলতে পারে না। এক অর্থে এটা বরং ভালোই হল কেননা একাডেমির পুরস্কার নিয়ে বেশ কিছুকাল ধরেই যে বিতর্ক আর কানাঘুষা চলছে, সে অপবাদ তাকে নিতে হলো না।

এখন সকল পুরস্কার, তিরস্কারের ঊর্ধ্বে চলে গেছেন খোন্দকার আশরাফ হোসেন। মৃত্যু তার তীব্র তীর পার্থের বুকে বিঁধিয়েছে; কিন্তু আমরা জানি, জানে বাংলা সাহিত্যের সকল সিরিয়াস পাঠক, খোন্দকার আশরাফ হোসেনের মৃত্যু নেই, যমুনা(পর্ব) বেয়ে তার কাব্যের ভেলা চিরকাল বয়ে যাবে। জীবনের সমান চুমুক-এর কবি তো আসলে জীবনেরই সমান, কেননা তাঁর সমগ্র জীবন কবিতাকে ঘিরেই আবর্তিত, অন্য সকল ভূমিকা পোষাকী মাত্র। আজন্মবাউল মানুষটি জীবনের উঠোনে কালও প্রবলভাবে উপস্থিত ছিলেন, আজ দূরবর্তী কুয়াশায় মিশে গেলেন। কবির সাথে আমার সর্বশেষ দেখা হয় সূর্যসেন হলে, যে হলের তিনি প্রভোষ্ট ছিলেন। সেদিনই তিনি ত্রিশালের কবি নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন। আমি জানতাম না সে সুসংবাদ, কি যেন প্রাণের টানে চলে গিয়েছিলাম। তখন কি জানতাম হৃদয়ের জমিনে ঘরবাড়ি তোলা মানুষটির সাথে সেটাই আমার শেষ দেখা হবে! আজ অশ্রুসজল চোখে এই মহৎ কবির প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই। বাংলার ঋতু আষাঢ় এসে গেছে, তাঁর নামে বৃষ্টি ঝরবে এই বাংলায়, বাংলার পাঠকের চোখে!

1 টি মন্তব্য:

  1. valo laglo kamrul vai ..........কবি খোন্দকার আশরাফ হোসেন
    বিয়োগপবের বাতিঘর ।জয়তু কবি

    উত্তরমুছুন