শনিবার, ২২ জুন, ২০১৩

কবিতার অন্তর্যামী

খোন্দকার আশরাফ হোসেনের প্রবন্ধ


কবিতা যে অন্য কোনো কলার হাতিয়ার নয়, বরং স্বয়ংসম্পূর্ণ ও স্বরাট, এ কথাটি প্রতিষ্ঠ হতে অনেক সময় নিয়েছে। কবিতা নৈতিক শিক্ষা, সমাজবদলের হাতিয়ার হিসিবে ব্যবহূত হয়েছে উপযোগবাদীদের হাতে। কবিতাকে চেতনায় শান দেওয়ার পাথরখণ্ডও ভাবা হয়েছে। কিন্তু এসবই কবিতার দ্বৈতীয়িক ব্যবহার :কবিতা তার অর্থের জন্য তার বাইরের কোনো প্রসঙ্গের ওপর নির্বরশীল নয়; সে স্বয়ংক্রিয় ও স্বায়ত্তশাসিত; তার রেফারেন্স তার নিজের ভেতরেরই বলয়িত বলে একটি কবিতা কখন, কোন সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে রচিত হয়েছে তা, এমনকি কবির সে সময়কার মানস-অবস্থাও, বাহ্য :অনুসন্ধিত্সু ব্যক্তি কোনো সুন্দরীর গয়না কোন জুয়েলারিতে তৈরি হয়, তার শুভ্রদন্তবিকাশ হাসির পেছনে কোন মাজনের কারিগরি, সেসব নিয়ে গবেষণা করলে করুন, রূপতাপসের জন্য তার কোনো প্রয়োজন পড়ে না


কলাবর্গের মধ্যে কবিতার অগ্রগণ্যতা আজ প্রায় সর্বজনস্বীকৃত হলেও চিরকাল এমনটি ছিল না। খুব সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত কবিতার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল সংগীত। যা অধরা ও অসীম, নিরাবয়ব ও বিমূর্ত, তার প্রতিভূ সংগীত; যা সাকার, দেহ-সন্নিধিতে প্রাপ্য, এবং অবশ্যই সুকুমার, তার প্রতিনিধি কবিতা। এই যে সংগীত ও কবিতার ভেদরেখা, সেটিও কোনো জলনিরোধ সীমানা নয় :শুদ্ধ কবিতার আত্মায় যেমন সংগীতের অধিবাস, তেমনি সংগীতের আত্মা প্রায়শ কবিতার অবয়বে আবির্ভূত। অন্তত দীর্ঘকাল, বাংলা কবিতায় চর্যাগান থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত, এ রকম দ্বৈতাদ্বৈত চিন্তা মহামহিম ছিল। আধুনিক কবিতায় সম্পর্কটি কলহান্তরিত প্রেমিকযুগলের মতো হলেও ভালোবাসার চোরাস্রোত উভয়কে তাতায়; না হলে এলিয়টের মতো কাঠখোট্টা কবিকেও ফোর কোয়ার্টেটসে কথা এবং সংগীতের যৌগপত্য স্বীকার করতে হবে কেন :

Words move, music moves 

Only in time; but that which is only living 

Can only die...

... Only by the form, the pattern, 

Can words or music reach 

The stillness, as the Chinese jar still 

Moves perpetually in its still stillness. 

(Burnt Norton, V)

কলাবর্গের মধ্যে কবিতার অগ্রগণ্যতা নিঃশঙ্কভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে। কিন্তু দার্শনিকদের মধ্যে বিতর্কের নিরসন তখনো হয়নি। হেগেল কবিতাকে বলেছেন 'মানবমনের বিশ্বজনীন শিল্প'; তাঁর মতে 'সকল শিল্প-আঙ্গিকের মধ্যেই কবিতার উপস্থিতি' এবং কবিতাই আর্টের 'উচ্চতম পর্যায়'। অন্যদিকে আর্থার শোপেনহাওয়ার মনে করতেন, সে-সম্মান সংগীতের প্রাপ্য, কেননা কবিতা যদিও জীবন ও জগতের সত্যিকার দর্পণ, এর মাধ্যম হচ্ছে ভাষা, এবং ভাষা যেহেতু আইডিয়ার সংস্পর্শে কলুষিত হতে পারে, সেহেতু শুদ্ধ সংগীতের তুলনায় সে ঊন। অন্যদিকে, সংগীত আইডিয়ার ঘটকালি ছাড়াই সরাসরি চৈতন্যের সাথে সংযোগ স্থাপন করতে পারে। (কীট্স কি একথা মনে রেখেই লিখেছিলেন 'Wordless' এমনকি 'soundless' সংগীতের হূদয়বেদ্যতার কথা?—"Heard melodies are sweet, but those unheard/ Are sweeter.") তাঁর মতে, সুতরাং, সংগীতই কলাবর্গের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিমান। মধ্যযুগে কবিতা ও সংগীতের এই দ্বৈরথ অবশ্য নিরর্থক ছিল, কারণ তখন কলাবিদ্যাপরম্পরায় সংগীতের স্থান ছিল তালিকার নিম্নতম স্থানে—আর কবিতা তালিকাতেই ছিল না। প্ল্যাটোর সেই বহুবিখ্যাত কবিবৈরিতার রেশ চলেছে মধ্যযুগের পুরোটাব্যাপী। রোমান পণ্ডিতরা সাতটি কলাক্ষেত্রকে দু'ভাগে ভাগ করেছিলেন :ট্রিভিয়াম (ব্যাকরণ, রেটরিক এবং লজিক) এবং কোয়াড্রিভিয়াম (পাটিগণিত, জ্যামিতি, জ্যোতির্বিদ্যা, এবং সংগীত)। রেনেশাঁসের সময় তালিকায় যুক্ত হয় চিত্রকলা। লিওনার্দো ভিঞ্চি ১৪৯০ সালে দাবি করেন যে চিত্রকলা শুধু যে কলাবিদ্যা তাই নয়, সে সর্বশ্রেষ্ঠ কলা। অন্যদিকে মধ্যযুগে কবিতা ও সংগীতকে প্রায়শ স্বীকৃত দুই কলামাধ্যমের অন্তর্ভুক্ত মনে করা হতো : কবিতা ছিল রেটরিকের একটি হাতিয়ার মাত্র, এবং সংগীত গাণিতিক সূত্রাবলির প্রয়োগক্ষেত্র। 

কিন্তু কবিতা যে অন্য কোনো কলার হাতিয়ার নয়, বরং স্বয়ংসম্পূর্ণ ও স্বরাট, এ কথাটি প্রতিষ্ঠ হতে অনেক সময় নিয়েছে। কবিতা নৈতিক শিক্ষা, সমাজবদলের হাতিয়ার হিসিবে ব্যবহূত হয়েছে উপযোগবাদীদের হাতে। কবিতাকে চেতনায় শান দেওয়ার পাথরখণ্ডও ভাবা হয়েছে। কিন্তু এসবই কবিতার দ্বৈতীয়িক ব্যবহার :কবিতা তার অর্থের জন্য তার বাইরের কোনো প্রসঙ্গের ওপর নির্ভরশীল নয়; সে স্বয়ংক্রিয় ও স্বায়ত্তশাসিত; তার রেফারেন্স তার নিজের ভেতরেরই বলয়িত বলে একটি কবিতা কখন, কোন সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে রচিত হয়েছে তা, এমনকি কবির সে সময়কার মানস-অবস্থাও, বাহ্য :অনুসন্ধিত্সু ব্যক্তি কোনো সুন্দরীর গয়না কোন জুয়েলারিতে তৈরি হয়, তার শুভ্রদন্তবিকাশ হাসির পেছনে কোন মাজনের কারিগরি, সেসব নিয়ে গবেষণা করলে করুন, রূপতাপসের জন্য তার কোনো প্রয়োজন পড়ে না। হান্স-গেয়র্গ গাদামারের কথায় ভালো কবিতা নিজেই নিজের ব্যাখ্যা "insofar as one need no additional information about the occasion and the historical circumstances of their composition." ("Religious and Political Speech", Myth, Symbol and Reality) গদ্যের সাথে তার পার্থক্য এখানেই যে, কবিতা অন্যের ভাড়া খাটে না : গাদামারের ভাষায়, "Poetry does not report, it testifies; it stands on its words." পল ভালেরির একটি উপমা ব্যবহার করে বলা চলে :নিত্যদিনকার গদ্য হলো কাগজের নোট। এটি প্রতীকী—যে মূল্যমান এতে মুদ্রিত তার নিজের অন্তর্গত মূল্য তার তুলনায় নগণ্য। অন্যদিকে কবিতা হলো স্বর্ণমুদ্রা, সে নিজেই মূল্যবান, ওকে গলিয়ে সোনা হিসেবে বিক্রি করলেও গায়ে-মুদ্রিত মূল্যের চেয়ে কম পাবার আশংকা নেই। বিনিময় মাধ্যম হিসেবে ব্যবহূত হয়েও সে স্বগুণে মহীয়ান। স্বর্ণমুদ্রার গায়ে মুদ্রিত রাজার মুখ কিংবা মূল্যমানের ছাপ উঠে গেলেও তার দামে হেরফের হবে না। 

কবিতার ভাষা শুধু অর্থের ভার বহন করে নিজেকে নিঃশেষ করে না। গদ্যের ভাষা বাজারের মিন্তি-বালকের মতো—ঝাঁকা-বোঝাই অর্থের সওদা পাঠকের দোরগোড়ায় নামিয়ে দিয়ে প্রাপ্য মজুরি নিয়ে সে চলে যায়। কিন্তু কবিতার ভাষা বেড়াতে-আসা মেহমানের মতো; হাতের বয়ে-আনা অর্থের মিষ্টির বাক্স কেবল তার শুভেচ্ছার প্রতীক; তার আসল মূল্য ওটুকুতে সীমাবদ্ধ নয়, এবং তাকে গদ্যের মতো পত্রপাঠ বিদায় দেওয়াও চলে না। তাকে মুখোমুখি নিয়ে বসতে হয়, শুনতে হয় তার না-বলা বাণীটুকু; অবসরে, "পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলিমিল।" যে-কবিতার অর্থ তার বাচ্যার্থের সমান-সমান সেটি কবিতা হিসেবে অপকৃষ্ট, সে ঠং করে বাজা একটা আওয়াজ মাত্র, যার কোনো অনুরণন নেই। ভালো কবিতা বাজবে চেতনায় কিংবা হূদয়ের তন্ত্রীতে, কাসরঘণ্টার মতো অনেকক্ষণ ধরে। যে-সুর কবির উদ্দিষ্ট ছিল না, বেজে উঠবে সেই সুরও, বলয়িত মন্দ্রিত হতে থাকবে গিরিকন্দরে উচ্চারিত ধ্বনির প্রতিধ্বনি যেমন। আর এটি যদি হয় কবিতার গীতময়তা নিয়ে বাড়াবাড়ি রকমের প্রত্যাশা, অনেকে আপত্তি করতে পারেন। তাদের জন্য বলা যাক, কবিতা কোথাও না কোথাও আবেগের না হোক মননের কোনো-নাকোনো প্রান্তকে, স্পর্শ করবে, জ্বলে উঠবে কোথাও আলো, ধসে পড়বে কোথাও পাথরের চাঁই। একটি কবিতা পড়লাম আর আমার মানসে চেতনায় কোথাও সামান্যতম কিছু ঘটল না—তাহলে বুঝবো সেটি কবিতা নয়, স্বর্ণখণ্ড নয়, ভূষিমাল, হয়তো রঙচঙে তামা কিংবা রাং। 

কবিতা যে বাজবে, সে কোথায়, না পাঠকের মনে বা মননে। এখানেই বৈবিধতা ও বৈচিত্র্য, আপনাতে আমাতে। একটি কবিতা হয়তো আমার মনে কোনো প্রতিধ্বনিই তুললো না, পড়ে থাকলো অসাড়, আর আপনার হূদয়ে সেই কবিতাই হয়তো বেজে উঠলো সুরমূর্চ্ছনা হয়ে। হতে পারে আমার এন্টেনা ধরতেই পারেনি কবিতাটির অর্থের সূক্ষ্ম সিগন্যাল; নিরেট আমার পাথরে বাজেনি তার পদশব্দ। আপনার মনটি, অন্য দিকে, উন্মুখ দোতারার মতো বাদকের আঙুলের টোকার জন্য পিড়িং হয়ে আছে। কবিতা তাই পাঠকে-পাঠকে ভিন্ন অর্থময়তা নিয়ে আসে—শুধু গণনায় নয়, গুণেও। তাই কবিতার ব্যাখ্যা এত ভিন্ন ভিন্ন। পাঠকপ্রতিক্রিয়াতত্ত্ব (Reader Response Theory) বলে, যত পাঠক তত পাঠ। আমার পাঠের সাথে আপনার পাঠের মিল না হওয়াই সম্ভব। একজন পাঠক একটি কবিতা পাঠ করেন তাঁর সমগ্রজীবন দিয়ে :তাঁর সমগ্র অভিজ্ঞতা, তাঁর শৈশব, তাঁর বেড়ে ওঠা, তাঁর বিশ্বাস, তাঁর অন্য কবিতা তথা সাহিত্যপাঠের পরিধি তথা তাঁর সামগ্রিক এক্সপোজার, তাঁর মানসিক সংগঠন সবকিছু ক্রীড়মান থাকবে তাঁর কবিতাপাঠের সময়। এবং সঙ্গত কারণেই দু'জন পাঠকের এইসব ক্ষেত্রে একদম মিলে যাওয়ার সম্ভাবনা কম। পাঠকের অধীত জ্ঞান তার যাপিত জীবন সবকিছু পাঠ্যকবিতাটিকে পুনর্নির্মাণ করে :পাঠ মানে পুনর্লিখনও—পাঠক সেই পুনর্লিখনটি করে নেয় নিজের মতো করে। যে পাঠক ইতিহাস পড়েনি, বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতের কথা তার মনে যে-প্রতিচিত্র আঁকবে (যদি আদৌ আঁকে), সেটি ইতিহাসজানা পাঠকের মনে সৃষ্ট ভাবানুষঙ্গের সাথে মিলবে না। আর এখানেই আমরা পেয়ে যাই কবিতার যে অনুবাদ হয় না সে ব্যাপারটির গূঢ় কারণ। কবিতার অনুবাদ আদপেই সম্ভব নয়, যা সম্ভব তা হলো এর পুর্নলিখন, ভিন্ন ভাষায়। আবার ভিন্ন ভিন্ন অনুবাদকের পুনর্লিখন ভিন্ন হতে বাধ্য, কেননা অনুবাদক তো প্রথমে কবিতার একজন পাঠক, এবং পাঠক হিসেবে, আগে যেমন বলেছি, সে তার সমগ্র জীবন, মেধা, অভিজ্ঞতা, অনুভবক্ষমতা সব কিছু দিয়ে তার নিজের একটি পাঠ স্থির করে নেয়। তারপর সেটিকে 'উদ্দিষ্ট ভাষা'য় তরজমা করেন। তাঁর সেই অনুবাদ-পুনর্লিখন যেহেতু মূল ভাষার নাড়ি থেকে চ্যুত হয়েছে, মূল কবির সাথে তার বিচ্ছেদও ঘটে গেছে সঙ্গে সঙ্গে। সুতরাং অনুবাদ নামে যেটি পাতে তুলে দেয়া হচ্ছে সে এক নতুন জিনিস, এক নতুন কবিতা। সে মূল কবিতার প্রতি 'বিশ্বস্ত' কি 'অবিশ্বস্ত' সে প্রশ্ন তোলাও অবান্তর; ডিভোর্সের পর প্রাক্তন স্ত্রীর/ স্বামীর প্রতি আনুগত্য আশা করে কোন জন?

কবিতার সাথে সংগীতের যে আশনাই তার স্ফূরণ ঘটে কবিতার ছন্দোময়তায়। ছন্দ মানে শুধু মাপজোখের ব্যাপার নয়, এটি মূলত ধ্বনির দ্যোতনার ব্যাপার। জলের ভেতরে মাছটি যেমন থাকে, কবিতার ভেতর থাকে ছন্দের দোলা। এমনকি যাকে গদ্য কবিতা বলে ছান্দসিকেরা দূরে রাখেন, সেখানেও রয়েছে এই চোরা ছন্দের স্রোত। বাংলাভাষার কথ্যছন্দটি আক্ষরবৃত্তীয় আঙ্গিকের সাথে যেন অজান্তে মিলে যায় :আপনি যেকোনো কথা বলেই দেখুন। এই যে বললাম, "আপনি যেকোনো কথা বলেই দেখুন", মেপে দেখুন তো অক্ষরবৃত্তি কি না! সারা পৃথিবী জুড়েই কবিরা চেষ্টা করছেন কবিতার ছন্দোময়তাকে আরো কতটা কাছে আনা যায় স্বাভাবিক বাক্যালাপের কথ্যছন্দের। এলিয়ট করেছেন, করেছেন রবীন্দ্রনাথও। 'বাঁশি' কবিতাটিকে বাকছন্দের এতটা কাছাকাছি নিয়ে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ যে, এর আক্ষরবৃত্তীয় ছন্দটি আমরা খেয়ালই করি না : 

কিনু গোয়ালার গলি। 

দোতলা বাড়ির 

লোহার-গরাদ-দেওয়া একতলার ঘর 

পথের ধারেই। 

লোনা-ধরা দেয়ালেতে মাঝে মাঝে ধসে গেছে বালি, 

মাঝে মাঝে স্যাঁতা-পড়া দাগ। 

মার্কিন থানের মার্কা একখানা ছবি 

সিদ্ধিদাতা গণেশের 

দরজার 'পরে আঁটা। 

আমি ছাড়া ঘরে থাকে আর-একটা জীব 

এক ভাড়াতেই, 

সেটা টিকটিকি। 

তফাত আমার সঙ্গে এই শুধু—

নেই তার অন্নের অভাব। 

রবীন্দ্রনাথ অবশ্য কথ্যস্পন্দন আনতে পুরোপুরি সফল হননি। ছন্দোবদ্ধ কবিতার কিছু কৌশল, যেমন এরকম 'ইনভার্সান'—"মাঝে মাঝে ধসে গেছে বালি" বা "নেই তার অন্নের অভাব"—রয়েই গেছে। কিন্তু উইলিয়াম কার্লোস উইলিয়ামসের 'দ্য রেড হুইলব্যারো' কবিতা দেখুন কত নির্মেদভাবে গদ্য, তবু ছন্দস্পন্দিত : 

The Red Wheelbarrow 

so much depends 

upon 

a red wheel

barrow 

glazed with rain 

water 

beside the white 

chickens 

আধুনিক বাংলা কবিতার ছন্দোহীনতা নিয়ে যাঁরা অভিযোগ তোলেন তাঁরা অনেকে ছন্দবধির—ছন্দোময়তার চোরা শব্দ তাঁরা শুনতে পান না। বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, জীবনানন্দ দাশ কবিতা লিখেছেন ছন্দে, বেশিরভাগ অক্ষরবৃত্তে; অমিয় চক্রবর্তী ব্যবহার করেছেন মাত্রাবৃত্ত এবং সেইসাথে হপকিন্সীয় প্রেরণায় স্প্রাং রিদম :"ঐ দোলা ডাল থেকে দু-দণ্ড উড়েছে শূন্যে পাখি,/ এইতো চোখের মগ্ন ছবির অগাধ থেকে ওঠা/ জ্বলজ্বল বোঁটা এই মুহূর্তের"। পঞ্চাশের কবিরাও কী কুশলে তাঁদের ছন্দোব্যবহারকে কথ্যস্পন্দনের ভেতরে সমন্বিত করেছেন, ছন্দব্যবহারের মধ্যেই খুঁজেছেন ছন্দমুক্তির ভাবনা, ইচ্ছেমতো বাড়িয়ে নিয়েছেন অক্ষরবৃত্তের ধারণক্ষমতা, সে সম্পর্কে শঙ্খ ঘোষের বক্তব্য শোনা যাক :"কোন পূর্বতনেরা লক্ষ করেননি এই ভাবনা, কেন তাঁরা প্রত্যাহত বোধ করেন সাম্প্রতিক কবিতার ধ্বনিপ্রবাহে? 'আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি তুই এসে দেখে যা নিখিলেশ' লাইনটির যদি অক্ষরবৃত্তে ব্যবহার হয়, তবে কি একে মনে হবে পতিত? আলোক সরকার এমনকী অলোকরঞ্জনের রচনাকেও কি কারো মনে হতে পারে ছন্দবিষয়ে অসতর্ক? আধুনিক ছন্দের ইতিহাস ছন্দশরীরে বাকস্পন্দকে আত্মীকরণের ইতিহাস, এই বাকস্পন্দকে আয়ত্ত করবার ভিন্ন ভিন্ন পথ যে খুঁজেছিলেন এই কবিরা—সেইটিই কি দৃষ্টি এড়িয়ে যায় আমাদের? তারই এক প্রবল প্রবর্তনায় যেমন পঁচিশ বছর আগে সম্ভব হয়েছিল 'পদাতিক', যেমন অক্ষরবৃত্তের শোষণচাতুর্যের আশ্চর্য ব্যবহার করেছিলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাঁর হাজরা পার্ক বা খিদিরপুর-এর মতো আয়তনকে চার মাত্রার আয়ত্তে এনে, তারই সংগত পরিণাম হিসেবে 'তুই এসে' আজ কত অনায়াসে তিন মাত্রায় গণ্য হতে পারে। পদাতিকের পর এই প্রক্রিয়া থেমে থাকেনি, এক সময়ে এই শব্দসংশ্লেষের নিপুণতম ব্যবহার করেছেন মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়। সংশ্লেষ-বিশ্লেষের যুগল ভঙ্গিতে অক্ষরবৃত্তের সম্ভাবনা আজ কবিদের কাছে অনেকটাই খোলামেলা।" (শঙ্খ ঘোষ, 'ছন্দোহীন সাম্প্রতিক', 'কৃত্তিবাস, ত্রয়োবিংশ সংকলন, শরত্কাল ১৩৭৩) আমাদের কালের সর্বাধিক সৃষ্টিশীল কবি শামসুর রাহমানই সম্ভবত ছন্দোবদ্ধ কবিতার সর্বাধিক ও সর্বশেষ ব্যবহারকারী। তাঁর হাতে অক্ষরবৃত্ত ছন্দ নৃত্যপর পাখির মতো খেলতো; শুধু বৈচিত্র্যের জন্য, এবং যখন তাঁর মনে হতো স্যাটায়ারের তীব্র চাবুক হাতে নেবেন, স্বরবৃত্তের চাল কলকলিয়ে উঠতো তাঁর হাতে :"মেষ রে মেষ তুই আছিস বেশ", ইত্যাদি। নাহলে দেখুন কীরকম বাকস্পন্দিত ও বর্ণচোরা তাঁর আক্ষরবৃত্তীয় উচ্চারণ এবং কতটা মুখের ভাষায় আত্মীয় : 

আকাশের পেটে বোমা মারলেও ছাই এক কাচ্চা 

বিদ্যে-বুদ্ধি বেরুবে না, ঠিকরে পড়বে না পরমার্শ। 

অথচ সুদূর 

আকাশের দিকে ফ্যালফ্যাল চেয়ে থাকি বারবার। 

পা-পোষে পাম্পশু ঘষে ঘষে কতদিন গেল, তবু 

পদোন্নতি মাঠে মারা যাচ্ছে, 

দপ্তরের খিটখিটে কিন্তু ফিটফাট বড় কর্তা 

কেবলি ধমকাচ্ছেন হপ্তায় হপ্তায়।

যিনি হলে হতে পারতেন আমার শ্বশুর, তিনিই তাঁর 

আত্মজাকে পশুর মতোই 

অন্যত্র চালান করে দিতে করেনি কসুর, হায় রে, 

আমি শুধু আকাশের দিকে চেয়ে থাকি ফ্যালফ্যাল। 

(আকাশের পেটে বোমা মারলেও, নিজ বাসভূমে)

কবিতা ও সংগীতের গোপন পিরিতির খবর সুবেদী পাঠকমাত্রই রাখেন। তাঁদের শিক্ষিত কান সজাগ হয়ে ওঠে সামান্যতম ইঙ্গিতে, কেননা কবিতার ভাষার মধ্যে প্রসৃত থাকে যে অন্তর্লীন দ্যোতনা সেইটিকে যদি ছন্দ বলি তাহলে অনেক নিছক গদ্যকবিতাও ঐ গুণের কারণে আদরণীয় হয়ে উঠতে পারে। ইদানীংকার ছন্দ-থেকে-মুক্তিপ্রয়াসী তরুণ কবিকুল বরং ছন্দোমুক্তির নতুন নতুন কৌশল ভাবতে পারেন, কিন্তু ছন্দোহীনতা যদি তাদের অন্বিষ্ট হয়, সে হবে সোনার পাথরবাটির সন্ধান, কেননা কবিতা ও সংগীতের দ্বৈতাদ্বৈত যমজবোনের মতো। হোক কাব্যছন্দ অথবা গদ্যছন্দ, কবিতা থেকে ছন্দের দ্যোতনা পুরোপুরি ছেঁটে ফেলতে গেলে যা থাকবে তাকে কবিতা বলা যাবে কেবল ব্যতিক্রমের বেলায়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন