শনিবার, ২২ জুন, ২০১৩

অহঙ্কার যেখানে অলঙ্কার :


বী রে ন মু খা র্জী
ভোরের কাগজ : শুক্রবার, ২১ জুন ২০১৩

‘নির্মোহ যুক্তিবাদ’ এর সুস্পষ্ট প্রভাব মেলে কবি খোন্দকার আশরাফ হোসেনের কবিতায়। ব্যক্তি জীবনে তিনি যেমন নির্মোহ-স্বভাবী তেমনি তার কবিতায় ছড়িয়ে রয়েছে ব্যক্তিক চিন্তার নানামাত্রিক ব্যাখ্যা। কবিতায় ধারণ করেছেন যাপিত জীবনের অলঙ্ঘনীয় সত্যরূপটি। কবির এক কিংবা দুই পঙ্ক্তির ‘কুয়াশার মুশায়েরা’ থেকে শুরু করে অধিকাংশ কবিতা পাঠে এমন সত্যই সন্ধানী পাঠকের সামনে উন্মোচিত হয়।
‘গ্রামনিসর্গের মধ্যে দেখা হয়, তুমি উল্টোপথে হাঁটা দাও’, ‘আমি জ্বালাই অযুত মোম্বাতি, তুমি দুপা মুড়ে বসো তোমার কান্নার ভেতর’ কিংবা ‘আমি দগ্ধ বাহু দিয়ে আগলাই তোমার যাবার পথ, তুমি পুলিশে খবর দাও’ (কুয়াশার মুশায়েরা) এমন পঙ্ক্তি রচনার মধ্য দিয়ে কবিকে আপাতবিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখি; কিন্তু তা শিল্পের দায়বদ্ধতা এড়িয়ে নয়। শিল্প তো তাই-ই যা কবির অনুভবের সর্বোত্তম প্রকাশ। অনুসন্ধানী কবি মাত্রই বিশ্বচরাচরের পাঠক ও সৃজনজ্ঞানে কল্পনাপ্রয়াসী। একজন কবি প্রকৃতিসহ জীবনের গভীর পাঠে তুলে আনেন সেই অনন্তসত্য যা সাধারণ্যে সহজে অনুগম্য নয়। যে কবির কবিতায় পাঠলব্ধ অভিজ্ঞানের যথার্থ প্রয়োগ সুনিশ্চিত, সে কবির কবিতা ততবেশি দ্যুতিময়Ñ সার্বভৌম চেতনার পরিচায়ক। হাজার বছরের বাংলা কবিতার ভিত্তিভূমে দাঁড়িয়ে কবিতায় তাৎপর্যময় অহঙ্কার সৃষ্টি করে খোন্দকার আশরাফ হোসেনও সার্বভৌমত্ব অর্জনের দিকে এগিয়ে রয়েছেন।

কবির কবিতা পাঠে চাতুর্যহীন, নিরীক্ষাধর্মী ও বহুতলবোধ সম্পন্ন পঙ্ক্তির সন্ধান পাওয়া যায়। ‘আমাকে পাবে না প্রেমে, প্রার্থনায় নম্র হও পাবে,/ কামে-ঘামে আমি নেই, পিপাসায় তপ্ত হও পাবে’ (প্রার্থনায় নম্র হও পাবে) পঙ্ক্তিতে কবির চাতুর্যহীন প্রত্যয় সরল অর্থে পাঠকের মননে গভীর চিন্তার দ্যুতি ছড়াতে সমর্থ। আবার তিনি যখন বলেনÑ ‘পৃথিবীর সর্বশেষ কবি আমি অহঙ্কার আমার কবিতা’ তখন আবিস্কৃত হয় শিল্পের প্রতি কবির এক প্রতিশ্রুতিশীল সংবেদনা। কবিকে অহঙ্কারী মনে হলেও, কবির ব্যক্তিক অহঙ্কার কাব্য অলঙ্কারের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় না, হয়ে ওঠে শিল্পসত্যের পরিচায়ক। কবিতায় পরিণত ভিন্নতার কারণে প্রকাশকালেই সমঝদার পাঠকদের নজর কাড়তে সক্ষম হন তিনি। ‘তিন রমণীর ক্বাসিদা’র কবিতাগুলোতে আঙ্গিকগত চমক কিংবা ঐহিত্যের জড়তা ভেঙে নতুনতর জাগরণ না থাকলেও বিষয়বস্তু ও বাচনভঙ্গির নতুনত্বে¡ ঐতিহ্যের সীমাকে লঙ্ঘন করে যাওয়ার ইঙ্গিত স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। বলা যায়, ভিন্ন ইঙ্গিত ও ইতিবাচক অর্থে তার কবিতা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে পাঠকের সামনে হাজির হয়।

শুধু প্রকরণ কিংবা ভাব-ভাষা-বিষয়ে নয়, কবিতায় চিত্রকল্প ও উপমা প্রয়োগের ক্ষেত্রেও তিনি স্বতন্ত্র ও বহুমাত্রিক ধারার সংযোজন ঘটান। খোন্দকার আশরাফ হোসেনের কবিতার গভীর পাঠে মালার্মে, এলিয়ট, রিলকে এমনকি পাউল সেলানের কবিতার মর্মার্থ ছন্দায়িত হলেও তিনি দেশীয় মিথ ও অনুষঙ্গে কবিতাকে মন্ময়ী রূপ দিয়েছেন, প্রকৃতির সান্নিধ্য জারিত অভিজ্ঞানে কবিতা করে তুলেছেন বৈশিষ্ট্যম-িত। কবি ভূঁইফোড় নন, বিধায় পূর্ববর্তী কবিদের কবিতার ভাবার্থগত অন্বয় বা সাজুষ্য থাকাটাও দোষের নয়। এর দুটি কারণ আলোচিত হতে পারে পারে। এক ‘বিশ্বসাহিত্যের ব্যাপক পঠন’ এবং দুই ‘কবির ঋণ গ্রহণ প্রবণতা’। ‘কবিতা থেকে কবিতা সংক্রমিত হওয়ার বিষয়টি একটি সাধারণ ও স্বতঃসিদ্ধ অভিপ্রায় মাত্র’ তাই কবির ঋণ গ্রহণ প্রবণতা বিশ্ব-দর্শনের ছোঁয়ায় কবিতাকে ঐশ্বর্যপূর্ণ করে। খোন্দকার আশরাফ হোসেনের কবিতাও বিশ্বপ্রেক্ষিত বিবেচনায় বাংলা সাহিত্যকে বহুলাংশে ঋদ্ধ করেছে।

একজন প্রকৃত কবি অভিজ্ঞানের ছন্দাবরণে সৌন্দর্যসত্যের সন্ধান করেন। এ অভিযাত্রায় খোন্দকার আশরাফ হোসেন সমর্থ হয়েছেন। ফলে তার কবিতা আলোচনায় এসেছে বারবার। তিনি ছিলেন একাধারে শিক্ষক, কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক। ‘তিন রমণীর ক্বাসিদা’, ‘পার্থ তোমার তীব্র তীর’, ‘জীবনের সমান চুমুক’, ‘সুন্দরী ও ঘৃণার ঘুঙুর’ ‘যমুনাপর্ব’, ‘জন্মবাউল’, ‘আয়না দেখে অন্ধ মানুষ’ কবির উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। তিনি অনুবাদ করেছেন সফোক্লিসের ‘রাজা ঈদিপাস’, ‘ইউরিপিডিসের মিডিআ’, ‘টেরি ঈগলটনের সাহিত্যতত্ত্ব’, ডেভিড অ্যাবারক্রম্বির সাধারণ ধ্বনিতত্ত্ব’, ‘ইউরিপিডিসের আলসেস্টিস’ ও ‘পাউল সেলানের কবিতা’। প্রবন্ধগ্রন্থ ‘বাংলাদেশের কবিতা: অন্তরঙ্গ অবলোকন’, ‘চিরায়ত পুরাণ’, বিশ্বকবিতার সোনালী শস্য’, ‘রোমান্টিক ও আধুনিক কবিতার অক্ষ-দ্রাঘিমা’, ‘কবিতার অন্তর্যামী’ ইত্যাদি। এ ছাড়াও নির্বাচিত কবিতা, কবিতা সংগ্রহ এবং নিজস্ব অনুবাদে রয়েছে নিজের কবিতার সংকলন।

কবিতা রচনায় ছন্দ গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রক্রিয়া। কবিতায় ছন্দের সন্নিবেশ মানুষের হৃদ-স্পন্দনের মতো অপরিহার্য এটা জানতেন কবি। এজন্য ছন্দের শাসন ও ধী-শক্তির প্রয়োগে তিনি কবিতাকে গড়ে তুলেছেন হৃদয়গ্রাহী। ছন্দ সচেতন ও নিসর্গনন্দনের কবি খোন্দকার আশরাফ হোসেন যেমন রচনা করেছেন আধুনিক ঘরাণার কবিতা তেমনি লিখেছেন সনেট। কখনো তিনি কবিতায় মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা খুঁজেছেন। এক্ষেত্রে তার ‘ইনসমনিয়া’ কবিতাটি বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। কবিতাটির একটি সর্গÑ

‘নিদ্রার গভীরে যাবো, হে সময়, তুলে রাখো তীক্ষè তরবারি,

বিষাদের বিষ-ফলা আত্মসম্বরণ করো, আমি

ঘুমের মিহিন সুতো, কারুকাজ বোনা নম্র পাখির পালক

চুলের হৃদয়ে গেঁথে হেঁটে যাবো, কোষবদ্ধ ছুরিকার ঘুম’

‘জীবনী অভিজ্ঞতার মাধ্যমে একজন কবি নিসর্গের বৈচিত্রময় আবহকে কবিতার প্রতিপাদ্য করে তোলেন’, কবি খোন্দকার আশরাফ হোসেনও তার কবিতায় প্রকৃতির পরিপ্রেক্ষিত রচনা করেছেন প্রাসঙ্গিকভাবে। তিনি ‘ঘোর বর্ষা’ নামের দীর্ঘ কবিতায় নিসর্গের রহস্য ছড়িয়ে দিয়ে পাঠকচিত্তে ‘নিসর্গের চিরন্তন রূপ’ যেমন অঙ্কন করতে সমর্থ হন তেমনি আত্মপরিচয় ও আত্মপর্যবেক্ষণ থেকে অস্তিত্বের সন্ধান করেন।

‘জল দাঁড়ায়ে গেছে টাকনু তক, পানির হালট ভেঙে ওপারে হেঁটে গেলেন পাজামা-গোটানো এক মৌলবী সাহেব।

কালস্রোতে ভেসে যাওয়া ধনমান লক্ষ করে বিষণœ এক পাগল

ভেজা কাকের সাথে অঝোরে ভিজতে থাকে চৌমাথায়।’

কবি মাত্রই প্রকৃতি প্রেমিক। প্রকৃতির নানামাত্রিক আবর্তন-বিবর্তন, উপাদান কবিকে আকৃষ্ট ও প্রভাবিত করে। প্রকৃতিভাবনার সঙ্গে মানবশ্লিষ্ট বিষয়াটির পরিপ্রেক্ষিত রচনার মধ্য দিয়ে একজন কবির শক্তিমত্তা ফুটে ওঠে। কবি খোন্দকার আশরাফ হোসেন প্রকৃতি নিবিষ্টতার মধ্য দিয়ে যেমন আত্মপ্রশস্তি খুঁজেছেন তেমনি প্রেমচেতনা, বেদনাবিলাস, নৈঃসঙ্গবোধ আত্মস্থ করে কবিতায় স্থিরতা এনেছেন। চারিপাশের জটিলতা ও সঙ্কীর্ণতার মধ্যে আচ্ছন্ন থেকেও প্রকৃতির চোখে মানবমনস্তত্ত্ব অন্বেষণ ও অপার সৌন্দর্য অবলোকন করেছেন। প্রেমচেতনার ক্ষেত্রে মাঝে মধ্যে তাকে ফ্রয়েডীয় তত্ত্বের অনুসারী হতে দেখা যায়।

“আমি দেখেছিলাম তাদের।/ ঈশ্বরী পাটনীর খেয়া পার হয়ে পাড়ে নামতেই/ তিনটি কলস কাঁখে তিনজন নারী এসে/ সামনে দাঁড়িয়েছিল, তিন প্রাজ্ঞ বৃক্ষের মতোন।ৃএকজন হাত তুলে বলল, ‘দাঁড়াও কথা আছে।’/ একজন কলস নামিয়ে বুকে আড়াআড়ি রাখলো দু’হাত,/ অন্যজন তিরস্কারে বিদ্ধ করে চোখ দুটো খুলে নিল।” রোমান্টিক আবহে কবি যাপিত জীবনের ক্লেদ তুলে ধরেছেন ‘তিন রমণীর ক্বাসিদা’ দীর্ঘ কবিতার এ পঙ্ক্তির মাধ্যমে।

‘শিল্প-সাহিত্য বিচারে নিরপেক্ষ মহাকালের অনিবার্য ভূমিকা’ সম্পর্কে কবি দূরদর্শী ছিলেন বলে প্রতীয়মান হয় তার কাব্যের শিল্প-প্রেক্ষিত বিবেচনায়। শিল্পাদর্শের দিক থেকে খোন্দকার আশরাফ হোসেনকে শনাক্ত করা যায় ‘আত্মপ্রত্যয়ী কবি’ হিসেবে। কবি শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে ভাষার সৌধ গড়ে তোলেন সত্য, কিন্তু সেখানে শিল্পকুশলতা ও শিল্পশালীনতা, ভাষা, ছন্দ, অলঙ্কার ইত্যাদি কবিতার গঠনগত সত্যকেও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হয়। এক্ষেত্রে আশরাফ হোসেন অনেকটা পথ অতিক্রম করেছেন। কবিতার গতানুগতিক ধারা এড়িয়ে গিয়ে ভিন্নস্বর সমন্বয়ের চেষ্টা করেছেন। কোলরিজ বলেছেনÑ ‘ইবংঃ ড়িৎফং রহ ঃযব নবংঃ ড়ৎফবৎ’ অর্থাৎ শব্দের অবশম্ভাবী বাণী বিন্যাসই হচ্ছে কবিতা। শব্দই হচ্ছে কবিতার প্রাণ। খোন্দকার আশরাফ হোসেনের কবিতায়ও শব্দ সচেতনতা লক্ষ্যনীয়।

‘খেয়েছ চাঁদের জল, হতমানে কোনদিন খাওনি মৃত্তিকা

অভিশাপ ব্যর্থ তাই বিধাতার, চন্দ্রিমার ঔজ্জ্বল্যের আলো

পিঠের নরম আঁশে জলচর ইলিশের মতো জমাকলো,

কিছুই হারাওনি তুমি, শাপভ্রষ্ট, না স্বর্গ না পৃথিবী-কণিকা।’
‘সাপ’ কবিতাটির মাধ্যমে একদিকে যেমন তার শব্দ প্রয়োগ সচেতনতার সাক্ষ্য মেলে তেমনি সংবেদনশীল মানবসত্তার চেতনাবোধেরও স্বাক্ষর মেলে। যুগচেতনা সম্পর্কে তিনি সচেতন ছিলেন বলেই তার কবিতা বাংলা কবিতার রূপান্তরের ধারাবাহিকতা অবলম্বন করেও সমকালীন। মূলত তার কবি সত্তার মূলে ফুটে উঠেছে দূরস্থিত কল্পনাময় জীবনের স্বতস্ফুর্ততা। কণ্ঠস্বরে স্বকীয় কাব্যভাষার প্রণোদনা আর জীবনের নানা জটিলতা পরিগ্রহ করে বাস্তবমূখী। সমকালীন ধারার কবি কবি খোন্দকার আশরাফ হোসেন ‘কাব্যসত্যের’ মধ্য দিয়ে বৃহত্তর ‘সমাজসত্য’ উন্মোচনে সচেষ্ট থেকেছেন। সাহিত্যের প্রচল ভ-ামীর বিপরীতে দাঁড়িয়ে নিবিষ্টচিত্তে সাহিত্য সাধনা করেছেন। তিনি কবিতায় যে আপন দিগবলয় বিনির্মাণ করেছেন তা সংখ্যা বিচারে হয়তো কম কিন্তু শিল্পমান বিচারে উৎকৃষ্ট। নিসর্গচেতনা, মানবের হার্দিক টানাপড়েন ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যতাবোধ তার কবিতার অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ। কবিতায় তিনি যে যুক্তিবোধ প্রতিষ্ঠা করেছেন তা নির্মোহ, যেখানে ব্যক্তিক অহংবোধ কবিতার মধ্য দিয়ে অলঙ্কার হয়ে উঠেছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন