শনিবার, ২২ জুন, ২০১৩

প্রকৃত কবির বিদায়

ডঃ তপন বাগচী

কবি খোন্দকার আশরাফ হোসেনের সঙ্গে আমার পরিচয় আমার দীর্ঘদিনের। ঢাকা এসেই তাঁর কবিতার সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে। তারপর ফরিদপুর সাহিত্য ও সংস্কৃতি উন্নয়ন সংস্থার আলাওল সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৭) পাওয়ার পরে সরাসরি পরিচয়। সেই থেকে ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে মফঃস্বলের কবিতাক্রান্ত তরুণের চোখে কবি দেখার আনন্দ নিয়ে ঘোরা-ফেরা।
তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে বাংলা বিভাগের মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, হুমায়ুন আজাদ; ইংরেজি বিভাগের কাশীনাথ রায়, খোন্দকার আশরাফ হোসেন; সংস্কৃত বিভাগের নিরঞ্জন অধিকারী, সমাজকল্যাণ ইনস্টিটিউটের মোহাম্মদ সামাদ, খাদ্য ও পুষ্টি বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের বিমল গুহ কবি হিসেবে খ্যাতিমান। এঁদের দূর থেকে দেখেই তৃপ্তি। স্বৈরাচার-বিরোধী আন্দোলনে জাতীয় কবিতা উৎসবকে কেন্দ্র করে ক্যাম্পাস জুড়ে তখন দেশের প্রধান কবিদের যাতায়াত। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, মোহন রায়হান, গোলাম কিবরিয়া পিনু, আসলাম সানী, তারিক সুজাতকে তখন প্রতিদিনই ছাত্রশিক্ষক কেন্দ্রের চত্বরে পাই। রাজপথে তখন কবি ও কবিতার কদর বেড়েছে। ছাত্রদের মধ্যে তখন সঞ্জীব চৌধুরী, জাহিদ মুস্তাফা, ইস্তেকবাল হোসেন, শামসুল আরেফিন, জেনিস মাহমুন, সরকার আমিন, শাহনাজ মুন্নী, চঞ্চল আশরাফ, বায়তুল্লাহ কাদেরী, মতিন রায়হান, তাপস সরকার, নাজিব তারেক প্রমুখ কবির সঙ্গে পরিচয়। এরকম এক সময়ে কবি খোন্দকার আশরাফ হোসেনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। তিনি কেবল কবি নন, ‘একবিংশনামের একটি সাহিত্য-পত্রিকার সম্পাদক। তাঁকে ঘিরে একদল তরুণ কবির সমাবেশ। সেই সমাবেশের অবশ্য আমি নেই। কারণ আমি যতটা কবিতা লিখি, তার চেয়ে বেশি রাজপথে সেøাগান তুলি। কবিতার চেয়ে তাৎক্ষণিক ছড়া লিখেও রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন করি।

খোন্দকার আশরাফ হোসেনের অফিস কক্ষে কবিদের আড্ডায় কখনো যাইনি। তাঁর কাগজে কখনো লেখার সুযোগ হয়নি। নিজেকে অপাঙ্ক্তেয় মনে হত বলে লেখা পাঠাইনি। তবে প্রতিটি সংখ্যাই পাঠ করি। সাহিত্যেও হাল-হকিকত জানার চেষ্টা করি। দেখা হলেই তিনি বলতেন, ‘কী হে কবি, বাংলা কবিতার খবর কী?’ তারপর রাস্তায় দাঁড়িয়ে নানান কথা হতো। একসময় দেখি তাঁর পত্রিকায় তাঁর কবিতা নিয়ে ২৪ পৃষ্ঠার একটি আলোচনা। সেখানে তাঁর কবিতার ছন্দ বিশ্লেষণে কিছু ভুল চোখে পড়ে। রোকেয়া হলের সামনে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তাঁর সঙ্গে একেদিন দেখা হলে, সেই কথা বলিÑ ‘আশরাফ ভাই, আপনার কাগজে, আপনার কবিতার ভুল বিশ্লেষণ ছাপলেন কী করে?’ তিনি বলেন, ‘মুখে বললে তো হবে না, লিখে দিতে হবে। সেজন্য আমার কালের চৌকাঠ আছে।’ ‘কালে চৌকাঠশিরোনামে একবিংশপত্রিকায় পাঠপ্রতিক্রিয়া ছাপা হতো। আমি বললাম, ‘আচ্ছা। পরের দিনই আমি ছন্দ বিশ্লেষণে ভুলের সীমানানামে ছোট্ট একটা প্রতিক্রিয়া লিখে তাঁর অফিস-কক্ষের দরজার ফাঁক দিয়ে রেখে আসি। কয়েকদিন পরে দেখা হলে তিনি বলেন, ‘কবি, আপনার লেখাটা পেয়েছি। ভালো করেছেন। আমি পরের সংখ্যায় ছেপে দেব। কিন্তু পাল্টা প্রতিক্রিয়া এলে সামলাতে পারবেন তো?’ বললাম, ‘কলম নিয়ে এলে পারব, লাঠি নিয়ে এলে হয়তো পারব না। কিন্তু সেই লেখাটি তিনি ছাপেননি। ২/৩ সংখ্যা বেরিয়ে যাওয়ার পরে একদিন শাহবাগে দেখা হলে লেখাটি না ছাপা হওয়ার কারণ জানতে চাইলাম। তিনি সদুত্তর দিতে পারেননি। মনে হলো, ভক্তলেখকদের তিনি মন রক্ষা করে চলতে চেয়েছেন।

দৈনিক ভোরের কাগজপত্রিকায় একবার কবি শামসুর রাহমান আর খোন্দকার আশরাফ হোসেনের মুখোমুখি সংলাপ নিয়ে প্রতিবেদন ছাপা হয়। তাঁদের সংলাপের সূত্রধর ছিলেন সাজ্জাদ শরিফ। তিন কবির আলোচনায় সাম্প্রতিক কবিতাচর্চা ও কবিতা-ভাবনা প্রকাশিত হয়েছে। আমি তখন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে কাজ করি। কেন্দ্রের ক্যান্টিনে বসে আড্ডা দিতে দিতে আমি কিছু প্রতিক্রিয়া জানাই সাজ্জাদ শরিফকে কাছে পেয়ে। তিনি আমাকে লিখে দিতে বললেন আমার অভিমত। পরের সংখ্যায় আমার অভিমত প্রকাশিত হয়। আমি তাতে বলেছিলাম যে, কথাবার্তা শুনে শামসুরা রাহমানকে তরুণ মনে হলো আর খোন্দকার আশরাফ হোসেনের কণ্ঠে শুনলাম প্রবীণের সুর। এই কথাটি তিনি মেনে নিতে পারেননি। তাই পরের সংখ্যায় লিখলেন, ‘প্রতিক্রিয়াশীলদের প্রতি। যেহেতু প্রতিক্রিয়া জানিয়েছি, তাই প্রতিক্রিয়াশীল বলা যেতেই পারে। কিন্তু তাঁর লেখায় একটু ভিন্ন সুর শুনে খারাপ লেগেছিল। ছন্দে একমাত্রা এদিক-সেদিক হলে তপন বাবুরা তেড়ে ওঠেন’- এই জাতীয় বাক্য রচনা করায় তাঁকেই প্রতিক্রিয়াশীল মনে হয়। দেখা হলে আমি তাঁকে একটু কড়া ভাষায় আক্রমণ করেছিলাম। তিনি হো হো হেসে তা উড়িয়ে দিলেন।

তাঁর সঙ্গে এমন অম্ল-মধুর স্মৃতি রয়েছে। তাঁর কবিতার আমি একনিষ্ঠ পাঠক। তাঁর বাংলাদেশের কবিতা: অন্তরঙ্গ অবলোকনগ্রন্থ নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা লিখি পত্রিকায়। তাঁর সঙ্গে আমার অন্তরঙ্গতা গাঢ় হতে থাকে। সকাল-বিকাল ধূমশলাকার শ্যামপীরিতি ছাড়তে হবেনামে একটি চরণ আমার বেশ প্রিয়। তাঁর তিন রমণীর ক্বাসিদা’ (১৯৮৪), ‘পার্থ তোমার তীব্র তীর’ (১৯৮৬), ‘জীবনের সমান চুমুক’ (১৯৮৯), ‘সুন্দরী ও ঘৃণার ঘুঙুর’ (১৯৯১) তাঁর কবিকীর্তির স্মারক। কেবল কবি নন, প্রাবন্ধিক, শিক্ষাবিদ ও অনুবাদক হিসেবেও তিনি সমান কৃতিত্বের অধিকারী। স্বীকৃতির মাপকাঠি যদি হয় পুরস্কার, তাহলে প্রচলিত পুরস্কার তিনি তেমন পাননি। জাতীয় পর্যায়ে স্বীকৃত আলাওল সাহিত্য পুরস্কারই ছিল তাঁর প্রধান সম্বল। ষাটের দশকের কবিদের সমান বয়সী হয়েও তিনি আশির দশকের কবি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাই পুরস্কারের জন্য তাঁর কাজের চেয়ে সময়ের গুরুত্বটাই সামনে চলে আসত। যথাসময়ে যথাপুরস্কার থেকে তিনি তাই বঞ্চিত ছিলেন। এটা তাঁর জন্য ছিল দুর্ভাগ্যজনক। প্রকৃত কবি পুরস্কারের জন্য লেখেন না। পুরস্কারের জন্য আক্ষেপও করেন না। তাই পুরস্কার না পাওয়ার দায় প্রাপকের নয়, প্রদায়কের।

মাস খানেক আগে তিনি জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছিলেন। গত ৩/৪ বছরের মতো এবারেও নজরুল-জয়ন্তীর অনুষ্ঠানে আমি গেছিলাম আলোচক হিসেবে। এবারে বাড়তি আনন্দ ছিল প্রিয় কবিকে উপাচার্যের আসনে দেখা। ছবিও তুললাম তাঁর। কিন্তু তিনি যে আজ ছবি হয়ে যাবেন, সে কথা কে জানতে!


খোন্দকার আশরাফ হোসেনের মৃত্যুর খবর প্রায় সকল পত্রিকায় গুরুত্ব পেয়েছে উপাচার্য হিসেবে। এটি তাঁর প্রতি অবিচার বটে! তাঁর মতো কবির জন্য উপাচার্য পরিচয়টি মুখ্য হতে পারে না। সারাজীবন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করে মাসখানেক ধরে ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা থানা অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হওয়ায় তাঁর মৃত্যুর সংবাদ হয়েছে ভালুকা প্রতিনিধির বরাতে। এটিও সুবিচার নয় বলে আমরা ধারণা। তাঁর মৃত্যুসংবাদ জাতীয় সংবাদ হিসেবেই গুরুত্ব পেত পারত। এহ বাহ্য! মিডিয়া যাই করুক, কবি হিসেবেই তিনি বেঁচে থাকবেন পাঠকের দরবারে। একজন প্রকৃত কবির বিদায়ে আমরা তাঁর পাঠকেরা, অনুজেরা আজ শোকাকুল! বাংলাদেশের কবিতায় শুধু নয়, বাংলা কবিতার বিচারেই তিনি বড় কবি হিসেবে মূল্য পাবেন। সময়ই বিচার করবে তাঁর প্রকৃত প্রতিভা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন