শনিবার, ২২ জুন, ২০১৩

খোন্দকার আশরাফ হোসেন কবির মৃত্যু নেই

যে জীবনের পরিমাপ সাফল্য বা ব্যর্থতার তুলাদণ্ডের বদলে ওজন করতে হবে বোধের সংবেদনশীলতায়। তার কবিতা পাঠের স্পর্শকাতর অনুভূতিতে জারিত হয়ে আমাদের অবিন্যস্ত কাব্য-ইতিহাসের উদভ্রান্ত দিগন্তে তাকে দেখা যাবে সুউচ্চতায়। খোন্দকার আশরাফ হোসেনকে নিয়ে স্মৃতির রহস্যময় খেলাটি কোন নিয়মে চলবে জানি না। ভবিষ্যৎ তাকে কোন ব্যক্তিত্ব কাঠামোয় বাধবে, সেটাও আমাদের অজানা। কিন্তু যা নিশ্চিতভাবে জানা, তা হলো, অতীত বা বর্তমানের মতো, তিনি আর কবিতা সমান্তরালে হাত ধরাধরি করে চলবে ভবিষ্যতের পথে।
ড. মাহফুজ পারভেজ ষাটোত্তীর্ণ পুরোটা জীবন তিনি ব্যয় করেছেন কবিতার জন্য, কাব্য-পত্রিকা সম্পাদনার জন্য, সাহিত্যের অধ্যাপনা ও গবেষণার জন্য। মজবুত শরীর দেখে মনে হতো না, এতটা বয়স হয়েছে। স্বল্পভাষী-ভাবুক চেহারা দেখে বোঝা যেত না অন্তর্গত প্রাজ্ঞতা। গুপ্ত তারুণ্যে এসে তিনি জুটেছিলেন আমাদের কালে_আশির দশকের কবি-লেখকদের সঙ্গে। এই সেই খোন্দকার আশরাফ হোসেন, যাকে কবিতার বাইরে বৈষয়িক জীবন ও জগতের সাপেক্ষে ভাবাই যেত না। গত রোববার (১৬-৬-১৩) রাতে টিভি ক্রলে তার মৃত্যু সংবাদ দেখে আমার দুঃখ-ভারাক্রান্ত-মন দেয়ালের বিষণ্ন-বুকসেলফ থেকে হাতে তুলে নেয় 'খোন্দকার আশরাফ হোসেনের কবিতা সমগ্র'। কবি আল মুজাহিদী, তৎকালীন ছাত্রনেতা, একাত্তরের উপদ্রুত দিনে জামালপুরের প্রত্যন্ত ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় আবিষ্কার করেন তাকে। সেই মুজাহিদী ভাই আমাকে তার কবিতা সমগ্র দিয়ে রিভিউ করতে বলেছিলেন। বইটি পড়া হয়েছে। রিভিউটি করা হয়নি। কোনো কোনো লেখা সহজে লেখা যায়। কোনো কোনো লেখা ভাবনার এতটাই গভীরে আলোড়ন তোলে, চট করে কিছু লেখা হয়ে ওঠে না। পাঠ-প্রতিক্রিয়ায় আমি তাকে পেয়েছি সুগভীর কাব্য পিপাসা ও দার্শনিক অন্বেষার অন্তঃপুরে। নিরীক্ষা ও সংশ্লেষের মেলবন্ধনে। বৌদ্ধিক দ্যোতনায়। চিন্তনের প্রাখর্যে। সেই রাতে আমার শোক নিমজ্জিত কলমে তার কথাও কাব্য ভেবে ভেবে পুঞ্জীভূত হতে থাকে কবির মৃত্যুতে শোকগাথা। পরদিন সোমবার (১৭-৬-১৩) সকালে সহযাত্রী-অগ্রণী কবিবন্ধুর স্মৃতির প্রতি নিমজ্জিত পঙ্তিগুলো মেইল করি বাচ্চু ভাইকে (আলমগীর হোসেন, সম্পাদক, বাংলানিউজ টুয়েন্টিফোর ডট কম)। বাচ্চুভাই তার অন-লাইন দৈনিকের প্রথম পাতার প্রচ্ছদে প্রকাশ করেন আমার সেই কবিতা :

খোন্দকার আশরাফ হোসেন
মাহফুজ পারভেজ

বয়সে প্রবীণ ছিলেন, তবুও ছিলেন অটুট আমাদের আশির দশকে
এতো জল জমা ছিল 'তিন রমণীর কাসিদা'য়
জানা হলো মৃত্যুর অনন্ত লহমায়।

ভালোবাসা, সে-তো শুধু মদির অশ্রুময় নির্জলা চুমুক
চৈতন্যের খ- খ- পরিণতি ছাড়া আর কিছু নয়:
আপনার সর্বাঙ্গেই লেগে আছে কৌম সময়ের শ্যাওলার মতো_
ঐতিহ্য পোড়ানো গন্ধসূত্রে অকৃত্রিম উত্তরাধিকার।
ঋতুর রহস্যভেদে পাখিরা বিভোল গ্রহণে প্রহরে
চৌচির উন্মাদ হাসি নগরের দেওয়ালে দেওয়ালে:
মিলায় রাতের রেখা চাঁদের শেকলে 
অনন্ত জোছনা-রঙা অমস্নলাগা তামার শিয়রে...
কেউ কোনো প্রশ্ন করার আগেই এক মুখ প্রাজ্ঞতায়
শত-মুখ বন্ধ হয়েছে চৌকস বয়ানে বয়ানে।

একুশ শতক, তোমাকে আগেই 'একবিংশ' নামের মুদ্রিত শরীরে
নিয়ে এসেছিলেন আশির কবি খোন্দকার আশরাফ।
বিবাগী উত্তরে ব্রহ্মপুত্র মৌলরূপে আপনার নাম ধরে ডাকে 
স্রোতে ও যৌবনে: শহর-সত্ত্বায় বাস করা তার উত্তরাধুনিক বাউলকে...
খোন্দকার আশরাফ হোসেন সতত নদী ও মৃত্তিকা পুঁজি করে 
কবিতার নীল নিবিড়তা ছুঁতে চেয়েছেন
কালে কালে একবিংশে অনন্তে... 

বলতে দ্বিধা নেই, খোন্দকার আশরাফ হোসেন কেবল অর্থহীন 'শব্দের ব্যায়াম' করে জীবন অতিবাহিত করেননি; চিন্তার নিবিষ্টতায় জীবনযাপন করেছেন। কচুরিপানা-অধ্যুয়িত শিক্ষা ও কাব্য আঙিনায় দাঁড়িয়ে তার কথা ভাবলেই আমাদের মনে পড়বে খোন্দকার আশরাফ হোসেন নামের একটি আলোকস্তম্ভকে। সত্যিকারের কাব্যচর্চা আর জ্ঞানানুসন্ধান তাকে দিয়েছিল একটি বিরল সম্পদ, যার নাম মেরুদ-। আর একটি বিরল সম্মান, যার নাম আইডেনটিটি বা পরিচিতি। কবি বলে আলাদা করে তাকে চেনাতে হতো না। কবি ও তিনি সমার্থক হয়ে উঠেছিলেন। তার মৃত্যুতে শোক বিহ্বল অতল জলের ঘূর্ণিতে আবর্তিত হয়ে তার মুক্তমন, নির্ভীক জিজ্ঞাসা, দার্শনিক প্রশ্নময়তা, তর্কের আভিজাত্য, বিতর্কের সৃষ্টিশীলতা এবং অবশ্যই কবিতার নীল নিবিড়তা স্পর্শের মননশীলতাকে এক সাচ্চা কাব্য-সংগ্রামীর জীবন-গল্প বলে মনে হয়। যে জীবনের পরিমাপ সাফল্য বা ব্যর্থতার তুলাদ-ের বদলে ওজন করতে হবে বোধের সংবেদনশীলতায়। তার কবিতা পাঠের স্পর্শকাতর অনুভূতিতে জারিত হয়ে আমাদের অবিন্যস্ত কাব্য-ইতিহাসের উদভ্রান্ত দিগন্তে তাকে দেখা যাবে সুউচ্চতায়। খোন্দকার আশরাফ হোসেনকে নিয়ে স্মৃতির রহস্যময় খেলাটি কোন নিয়মে চলবে জানি না। ভবিষ্যৎ তাকে কোন ব্যক্তিত্ব কাঠামোয় বাধবে, সেটাও আমাদের অজানা। কিন্তু যা নিশ্চিতভাবে জানা, তা হলো, অতীত বা বর্তমানের মতো, তিনি আর কবিতা সমান্তরালে হাত ধরাধরি করে চলবে ভবিষ্যতের পথে। একজন কবির জন্য এর চেয়ে মহার্ঘ্য প্রাপ্তি এবং সৌভাগ্য আর কিছুই হতে পারে না। 
কালের যাত্রা
শাহীন রীশাদ
(খোন্দকার আশরাফ হোসেন বন্ধুবরেষু)

আমাকে প্রতীক্ষাই থাকতে হবে অনন্তকাল
তোমার আরেকটা লেখা দেখার জন্যে
আমি জানি পত্রিকার পাতায় অাঁতিপাঁতি করে খুঁজবো ছুটির সকালে
নিরর্থক...
কোথাও খুঁজে পাবো না আর, পাবো না কোনদিনও।
পাবো না যমুনা পর্ব অথবা পার্থের তীব্র তীর
আমি কান পেতে রইলেও শুনতে পাবো না আর
নাচঘরে বেজে ওঠা ঘৃণার ঘুঙুর।

ত্রিশালের ক্লাসে বসে কিশোরী ছাত্রী আর
রাখবে না কোনো চিঠি পাতার ভাঁজে।
রমনার ভিড় ঠেলে বলবে না কোনদিন আর,
'কী খবর রীশাদের ... বিষাদ কীসের?
চলো না গল্প হোক অনন্ত নাগের, চলো না শ্রাবণ দেখি
ভেজা শহরের।'

সারাদিন অঘোরে হাঁটতে হাঁটতে তুমি পেঁৗছে গেলে
ইস্টিশানে, একাকী ধরবে বলে আন্তঃনগর,
এ ক্যামন যাত্রা তোমার অনন্তের দেশে!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন