এহ্সান মাহ্মুদ
১৯৫০ থেকে ২০১৩,
ক্যালেন্ডারের হিসেবে ৬৩ বছর। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ুর হিসেবে একেবারেই
উপেক্ষা করার মতো নয়। যে বয়সের কারো সামনে দাঁড়ালে বেশ সমীহ করে দাঁড়াতে হয়।
বয়সের কারনে হোক আর অভিজ্ঞতার কারনেই হোক, মাথা নিচু হয়ে আসে তাঁদের সামনে
দাঁড়ালে। বয়স আর অভিজ্ঞতা ছাড়াও আরো একটি কারনে কারো সামনে দাঁড়ালে মাথা নিচু
হয়ে আসে, সেটি হলো বিনয়। কারো বিনয়ী আচরণ। তবে বয়স, অভিজ্ঞতা, বিনয় এই তিনটি
গুণাবলী এক জীবনে একজন মানুষের চরিত্রে ধারন করাটা একটু দূরহ কাজই বটে।
খোন্দকার আশরাফ হোসেন,
যার বয়সসীমা ৬৩ বছর। তাঁর বয়স আর বাড়বে না। থেমে গেছে ১৬ জুন ২০১৩ আজকের
তারিখে। যে বয়সসীমা শুরু হয়েছিল ৪ জানুয়ারী ১৯৫০ এ। যার সামনে দাঁড়ালে মাথা
আপনি নিচু হয়ে আসত। বয়স, অভিজ্ঞতা আর বিনয়ের এক উজ্জ্বল উদাহরণ তিনি।
খোন্দকার আশরাফ হোসেনের
জন্ম ১৯৫০ সালে জামালপুর সদরে। ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র। পড়াশুনা করেছেন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং লীডস বিশ্ববিদ্যালয়ে। পেশাগত জীবনে ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির শিক্ষক। তারও পরে জীবনের একেবারেই শেষ বেলায় এসে
হয়েছিলেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর।
এসব পোষাকি পরিচয়ের
বাইরে রয়েছে তাঁর আরও ভিন্ন পরিচয়। তিনি একাধারে একজন কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক
এবং সাহিত্য সমালোচক। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় ২৫ টি। কবিতার বই ৮টি।
এছাড়া রয়েছে তিনটি কবিতার সংকলন। পার্থ তোমার তীব্র তীর, যমুনা পর্ব, আয়না দেখে অন্ধ
মানুষ, তোমার নামে বৃষ্টি নামে তাঁর উল্লেখযোগ্য
কাব্যগ্রন্থ।
বাংলাদেশের কবিতা অন্তর্গত অবলোকন, বিশ্ব
কবিতার সোনালী শষ্য তাঁর অনন্য সাধারণ প্রবন্ধগ্রন্থ।
পাউল সেলানের কবিতা তাঁর অনুবাদ সাহিত্যের
অন্যতম প্রধান গ্রন্থ।
ইংরেজি ভাষায় লেখা
গ্রীক পুরানের কাহিনী নিয়ে Mythology এর অনুসরনে বাংলা ভাষায় তাঁর লেখা চিরায়ত পুরান পাঠ আমাদেরকে
নিয়ে যায় রক্ত-মাংসের গ্রীক রাজ্যে। আমাদেরও মনে যেন সমান প্রেমানুভুতি জন্মে কিউপিডের মতো। আফ্রোদিতিকে দেখার জন্য আমরাও
কাটাই উন্মুখ দিন আর বীনিদ্র রজনী। কিংবা যন্ত্রনায় ছটফট করি একিলিসের মতো !
তিনি যে পুরোদস্তুর কবি
ছিলেন, তা বুঝেছি খুব বেশিদিন হয় নি। তিনি যেদিন কাজী নজরুল ইসলাম
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হলেন, তার পরের দিন পত্রিকায় খবরটা বের হয়। ঠিক ঐ সময়ে
তাঁর নাম জীবনানন্দ কবিতা পুরষ্কারের জন্য ঘোষনা করা হয়। আমি তাঁকে মোবাইল করে
ভিসি হওয়ায় অভিনন্দন জানালে তিনি বললেন, ভিসি হওয়ার খবর পত্রিকায় এসেছে নাকি
!? পুরষ্কারের ব্যাপারটা আসেনি ? যখন জানালাম, স্যার এসেছে, ছবিসহ এসেছে। তিনি ফের
জানতে চাইলেন, কোন সংবাদে ছবি এসেছে- ভিসি হওয়ারটায় নাকি পুরষ্কারের টাতে ? আমি
বললাম, জীবনানন্দ পুরষ্কারের টায়। তিনি হেসে বললেন, ওটায় আসলেই হবে। তখন
বুঝেছিলাম, তাঁর কাছে ভিসি হওয়ার চেয়ে কবিতায় পুরষ্কার পাওয়াই বড়।
এতোকিছু বলা হলেও যেন
তাঁর সম্বন্ধে আসল কথাটা বলা হলো না। তিনি ছিলেন মনে-প্রানে কবিতাকর্মী। কবি
ছাড়া আর কিছুই তিনি হতে চান নি। সেই ১৯৮৫ সাল থেকে বাংলা কবিতাকে বদলে দেয়ার
স্বপ্ন নিয়ে শুরু করেছিলেন লিটল ম্যাগ সম্পাদনা। একবিংশ নামের সাহিত্যের
ছোট কাগজটি সম্পাদনা করে আসছেন প্রায় ২৮ বছর যাবৎ। লিটল ম্যাগ সম্পাদনা করতে এসে
তিনি মিশেছেন তাঁরও প্রায় ৪/৫ পরের জেনারেশনের ছেলে-মেয়েদের সাথে। মিশতেন বন্ধুর
মতো।
তিনি হয়তো খুব বেশি
নিন্দুক রেখে যান নি ! যাদের রেখে গেছেন, তাদের একটি কমন অভিযোগ হচ্ছে- তিনি
ছোটছোট ছেলে-মেয়েদের সাথে মেশেন ! সেই ছোটছোট ছেলে-মেয়েরাও যে তাঁকে কতটা পছন্দ
করতো তার প্রমান পাওয়া গেল আজ বিকেলে বাংলা একাডেমীর নজরুল মঞ্চের সামনে।
শেষবারের মতো তাঁকে অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে আসা হলো বাংলা একাডেমীতে। না, তিনি
একাডেমীতে ঢুকেই আস্তে আস্তে হেঁটে যান নি লিটল ম্যাগ চত্বরে। যেখানে ফেব্রুয়ারী
জুড়ে প্রায় প্রতি সন্ধ্যায় তিনি এসে দাঁড়াতেন একবিংশের স্টলের সামনে।
ছোটছোট ছেলে-মেয়েরা এসে দাঁড়াতো তাঁর পাশে। কেউ এসে বলতো, স্যার কেমন আছেন ? কেউ
যতনে চুপি-চুপি তাঁর হাতে দিতো সদ্য লেখা কোনো কবিতা। কেউ নতুন কোনো কবিতার সংকলন।
তিনি আজ একাডেমীতে
এসেছিলেন কাঠের বাক্সের মধ্যে শুয়ে, কাঁধে চড়ে। সময়ের অভাবে তাঁকে নেয়া হয়নি
তাঁর প্রিয় লিটল ম্যাগ চত্বরে। তিনি শেষবারের মতো একটু জিড়িয়ে নিলেন বটতলায়।
নজরুল মঞ্চের বেদীতে। তাঁর কফিন ঘিরে ভীড় করে ছিল অনেকেই। তাঁর কাঠের কফিনের উপর
ঝরে পড়ল একটি সবুজ বটপাতা ! সবুজ বটপাতা আমি আগে কখনো ঝরে পড়তে দেখিনি। তারপরেই
দেখলাম ভীড়ের মধ্যে দু’টি মেয়ে, খানিক দূরে আরেকটি ছেলে, যাদের সাথে খোন্দকার আশরাফ
হয়তো মিশতেন, গল্প করতেন, আড্ডা দিতেন কবিতা নিয়ে, হয়তো তাঁর ছাত্র ছিলেন। সেই
ছেলে-মেয়েদের চোখে যেন আষাঢ় নেমেছে। অথচ আজ আষাঢ়ের দ্বিতীয় দিন। ঢাকার আকাশে
মেঘেজলের বা বৃষ্টির কোনো লক্ষণ নেই। কিন্তু, আজ তাঁর লেখা কবিতার বইয়ের নামটিই
যেন আমার বার বার স্মরণে আসছে- তোমার নামে বৃষ্টি নামে।
লেখক : এহ্সান মাহ্মুদ,
বিভাগীয় সম্পাদক, সাহিত্য।
বাংলাদেশ স্থানীয় সময় : ২০ ঘন্টা, ১৬
জুন, ২০১৩
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন