বুধবার, ১৯ জুন, ২০১৩

আশরাফ স্যার, আমরা অপেক্ষায় আছি

দ্রাবিরা আঞ্জুমান হুদা | ১৯ জুন ২০১৩ ২:০৭ অপরাহ্


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে পড়ার সুযোগ পাওয়ার পরপরই আমার বাবা আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন খোন্দকার আশরাফ হোসেন স্যারের সাথে। কলাভবনে টিচার্স লাউঞ্জে বসে থাকা বাবরি চুলের দীর্ঘকায় মানুষটির আকর্ষণীয় বাচনভঙ্গীর কথা ততদিনে আমি বহুবার শুনে ফেলেছি একই বিভাগ থেকে পাশ করে যাওয়া আমার বড় আপুদের কাছ থেকে। সেদিন স্যারের সামনে বসে মুগ্ধ হয়ে স্যারের কথা শুনেছিলাম আর ভেবেছিলাম কবে তার ক্লাস পাবো! পেলাম ২য় বর্ষে উঠে। সেমিস্টারের যাঁতাকল সত্ত্বেও romantic poetry কোর্সটি স্যার পড়ালেন চমৎকার!!
ক্লাসে মনে হয় এমন কেউ ছিলোনা যে স্যারের লেকচার মুগ্ধ হয়ে শোনেনি। তবে বেশীরভাগ ছাত্রছাত্রী যখন স্যারের কাছে কীটস পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলো, আমার কেন জানিনা স্যারের পড়ানো কবিতাগুলোর মধ্যে Coleridge এর “The Rime of the Ancient Mariner” ই বেশী ভালো লাগতো । পড়াবার সময় স্যারের কথাগুলো জাদুকরের মত শোনাতো! স্যারের ভরাট কণ্ঠে শোনা কবিতাটির কয়েকটি পংত্তি “Water, water, everywhere, And all the boards did shrink;/Water, water, everywhere, Nor any drop to drink.” এখনো যেন কানে বাজে। কেবল পাঠ্যবই ভিত্তিক পড়াশোনায় যে স্যার বিশ্বাসী ছিলেননা, তার প্রমাণ আমরা বারবার পেয়েছি স্যারের ক্লাসে।

স্যার ইংরেজি সাহিত্যের যাই পড়াতেন, তার সাথে বাংলা সাহিত্যের কোন না কোন সামঞ্জস্য দেখিয়ে আমাদের পড়বার ও জানবার আগ্রহ বহুগুণ বাড়িয়ে দিতেন। ঠিক এরকম সময়ে যখন স্যারের ক্লাস পেয়ে আমরা নতুনরা মুগ্ধ, তখনই স্যারের আগ্রহ ও পৃষ্ঠপোষকতায় এবং তাঁর অসংখ্য অনুগামী ছাত্রছাত্রীর চেষ্টায় স্যারেরই দেয়া “আকাশে মেলি ডানা, মাটিতে শেকড়” মূলমন্ত্র সাথে নিয়ে গোড়াপত্তন হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইংরেজি বিভাগের সংস্কৃতি সংসদ “কৃষ্ণচূড়া” র । কিছুদিনের মধ্যেই সংগঠনটির প্রথম অনুষ্ঠান হল। সে অনুষ্ঠান নিয়ে স্যারের আগ্রহ আমাদের সম্মিলিত আগ্রহকে যেন ছাপিয়ে গিয়েছিলো! আস্তে আস্তে সেই ছোট্ট সংগঠন ডালপালা ছড়ালো, একটু একটু করে এগিয়ে যেতে লাগলো, স্যার সবসময় সংগঠনটির সাথে ছিলেন ছায়া হয়ে। প্রতিটি অনুষ্ঠানেরই অন্যতম আকর্ষণ ছিল স্যারের কণ্ঠে আবৃত্তি।
asraf-by-masud-anondo.jpg
শুধু বিশেষ উপলক্ষেই নয়,বিভাগের করিডরে আশরাফ স্যারের নিত্যদিনের উপস্থিতিও যেন একটা অন্যরকম কিছু ছিল! প্রায় ছ’ ফুট লম্বা প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষটি করিডোর দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে যখন সহাস্যে প্রিয় ছাত্রছাত্রীদের সাথে কথা বলতেন তখন তাঁকে খুব আপন মনে হত। যেকোনো উপলক্ষে স্যারের উৎসাহে আমাদের উৎসাহ নতুন প্রাণ পেতো। অনেক সমস্যাতেও স্যার সাহায্য করতেন অকুণ্ঠচিত্তে। মনে আছে, একটি অনুষ্ঠানের জন্য আমরা যখন রিহারসেল করার জায়গা খুঁজছিলাম, স্যার আমাদের তার বাংলোতে জায়গা করে দিলেন, টানা ২দিন সেখানে আমরা রিহারসেল করলাম। ছোটোখাটো ব্যাপারেও স্যার আমাদের মতামতকে গুরুত্ব দিতেন। সেবার রিহারসেল করার সময় স্যারের বাসায় থাকা একটি হারমোনিয়াম দিয়ে স্যার বারবার জিজ্ঞেস করছিলেন যে সেটি ঠিক আছে কি না! সবসময় আমাদের মনে একটা বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে যেকোনো সমস্যা নিয়ে স্যারের কাছে গেলে স্যার কোন না কোনভাবে হাত বাড়িয়ে দেবেন।

আশরাফ স্যারের প্রতি আমাদের আরেকটি অন্যরকম ভাললাগা কাজ করতো, যখন আমরা অনুভব করতাম বাংলা ভাষার একজন অসামান্য প্রতিভাবান কবি আমাদের শিক্ষক। স্যারের কণ্ঠে তাঁরই রচিত অসাধারণ কিছু কবিতার আবৃত্তি শোনার সৌভাগ্য আমার হয়েছে বেশ কয়েকবার, কখনো ক্লাসে, কখনো কোন অনুষ্ঠানে, তাও প্রায়ই ইচ্ছে হত স্যারের কণ্ঠেই স্যারের কবিতা শোনার। ৩য় বর্ষের মাঝামাঝিতে এসে যখন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি কবে চতুর্থ বর্ষে উঠে স্যারের ক্লাস পাবো, ঠিক সেসময় স্যারের ত্রিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হবার খবর পেলাম। কেন জানিনা স্বার্থপরের মতো মনে হয়েছিলো, এটা হতে পারেনা; স্যার আমাদের ক্লাস নেবেন না, ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে নিজের কোন কবিতা আবৃত্তি করে নিজেই হেসে “আত্ম বিজ্ঞাপন করছি, কিছু মনে করোনা” বলে ক্লাসগুলোকে হাসির ফোয়ারায় প্রাণবন্ত করে তুলবেন না, হাসিমুখে আমাদের যেকোনো উদ্যোগে উৎসাহ দেবেন না তা তো হতে পারেনা। স্যার আমাদের আশ্বস্ত করেছিলেন যে তিনি মাঝে মাঝেই আমাদের কাছে আসবেন। স্যার কি সেই কথা ভুলে গিয়েছিলেন? ত্রিশাল যাবার কথা ছিল তাঁর, কোথায় গেলেন তিনি! না, হাসিখুশি প্রাণবন্ত সজ্জন মানুষটি হঠাৎ এভাবে চলে যেতে পারেন না।

স্যারকে নিয়ে লেখা একটি বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে স্যার আমার আব্বুকে হাসতে হাসতে বলেছিলেন যে আমি তারও মেয়ে, সেই আশরাফ স্যার বাবা দিবসে এভাবে চলে গেলেন না ফেরার দেশে! কিছুতেই বিশ্বাস হতে চায় না। স্যারের আকস্মিক মৃত্যুতে শোক জানিয়ে বিভাগের দেয়ালে টাঙানো কালো ব্যানারটি দেখলে হঠাৎ কেমন থমকে যেতে হয়, স্যারের রুমের বন্ধ দরজার সামনে রাখা পুষ্পস্তবকটি বড্ড বেমানান লাগে। এইতো সেদিনও যিনি খুব করে ছিলেন, আজ একটুও নেই! মৃত্যুর পর তাঁর নিষ্প্রাণ শরীর, কিভাবে সে দৃশ্য চোখ মেলে দেখি!! স্যার শয্যাশায়ী – এই দৃশটিও যে ভাবা যায়না! আশরাফ স্যার বললেই সদা প্রফুল্ল মানুষটির চেহারাই চোখের সামনে ভেসে ওঠে। শুনছি স্যারের চিকিৎসা সুষ্ঠুভাবে হয়নি। যারা দায়ী তারা আসলে কিছু হারায়নি, যতটা আমরা হারিয়েছি। আমরা আর ফিরে পাবোনা একজন অসামান্য শিক্ষককে, একজন অসাধারণ আশরাফ স্যারকে।

ঠিক এই মুহূর্তে এক বছর আগেকার সেদিনের কথা মনে পড়ছে, যেদিন স্যারের বাসায় আমরা কয়েকজন একটি অনুষ্ঠানের জন্য রিহারসেল করছিলাম। বাইরে তুমুল বৃষ্টি , আমরা স্যারের ড্রয়িং রুমে বসে গাইছি “আজি ঝরঝর মুখর বাদর দিনে”, আর স্যার বাইরে বারান্দায় তার ইজিচেয়ারে বসে বৃষ্টি দেখছেন। হঠাৎ একবার কিছুক্ষণের জন্য তাকিয়ে রইলেন দেয়ালে ঝোলানো তাঁর সদ্য পরলোকগতা স্ত্রীর ছবির দিকে। কেমন যেন মায়া লেগেছিল স্যারের জন্য সেদিন, মনে হয়েছিল মানুষটা খুব একা। জানিনা কোথায় চলে গেলেন আমাদের সবার ভীষণ প্রিয় স্যার। যিনি এতো প্রবলভাবে ছিলেন, তিনি কখনোই পুরোপুরি চলে যেতে পারেন না। আমরা স্যারের অভাব ভীষণভাবে বোধ করবো। যারা স্যারের সাথে কীটস শেলী কোলরিজ পড়তে পারবেনা, তারা যেমন অনেককিছু থেকে বঞ্চিত হবে, তেমনি আমরা যারা কিছুটা হলেও স্যারের সান্নিধ্যে আসতে পেরেছিলাম, তারা তাঁর না থাকাটাকে মানতে পারবোনা, বরং স্যারের ফেরার পথ খুঁজে বেড়াবো তীব্র প্রতীক্ষায়। আমরা জানি, স্যার কখনো আমাদের ছেড়ে থাকতে পারবেন না। আমাদের স্যারের নেয়া প্রতিটি ক্লাসের স্মৃতিতে, “কৃষ্ণচূড়া” র প্রতিটি উদ্যোগে, ইংরেজি বিভাগের প্রতিটি পরতে পরতে এই অসামান্য প্রতিভাবান উজ্জ্বল মানুষটি বেঁচে থাকবেন চিরকাল। স্যার বলে গেছেন “আবার আসতে পারলে আটঘাট বেধে আসবো”। স্যার, আপনি অবশ্যই আসবেন। আপনার কথামতো আমরা প্রার্থনায় নম্র হয়ে আপনাকে খুঁজবো, আপনিই তো বলেছেন, তাহলে আপনাকে পাওয়া যাবে। তবে কেন নয়? আপনার কবিতাই বলে দেয়, আপনি যেভাবে ছিলেন, সেভাবেই আছেন, আজীবন থাকবেন। স্যার, আমরা অপেক্ষায় আছি।

লিংকঃ বিডিআর্টস২৪

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন