খোন্দকার আশরাফ হোসেন (১৯৫০-২০১৩) কবি, প্রাবন্ধিক,
গবেষক, অনুবাদক। তিনি ১৯৫০ সালের ৪ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। ছাত্রাবস্থাতেই তিনি
লেখালেখির সংগে জড়িয়ে পড়েন। তাঁর এ যাবত প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘তিন রমণীর ক্বাসিদা’, ‘পার্থ
তোমার তীব্র তীর’, ‘জীবনের সমান চুমুক’, ‘সুন্দরী
ও ঘৃণার ঘুঙুর’, ‘জন্মবাউল’, ‘যমুনাপর্ব’ এবং ‘আয়না
দেখে অন্ধ মানুষ’।
‘বাংলাদেশের কবিতা: অন্তরঙ্গ অবলোকন’ তাঁর প্রবন্ধগ্রন্থ। অনুবাদ করেছেন সফোক্লিসের ইডিপাস, ইউরিপিডিসের মিডিয়া, আলসেস্টিস, পাউল সেলানের কবিতা, এডিথ হ্যামিল্টনের মিথলজি-সহ অনেক গ্রন্থ। তাঁর গবেষণা বিপুল। তিনি ১৯৮৫ সাল থেকে সৃষ্টিশীল কবিতার কাগজ ‘একবিংশ’ সম্পাদনা করেছেন। পেশাগত দিক দিয়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। তিনি ঢাকার ল্যাব এইড হাসপাতালে ২০১৩ সালের ১৬ জুন রোববার সকালে মৃত্যু বরন করেন। মৃত্যু কালে তাঁর বয়স হয়েছিলো ৬৩ বছর। দেশ, সমাজ, সাহিত্য, রাজনীতি ইত্যাদি বিভিন্ন দিক নিয়ে আমি তাঁর বর্তমান সাক্ষাৎকারটি ১০ নভেম্বর, ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ. এফ. রহমান হলের বিপরীতে অবস্থিত গিয়াসউদ্দিন আবাসিক এলাকার বাসায় রাতে গ্রহণ করি।
‘বাংলাদেশের কবিতা: অন্তরঙ্গ অবলোকন’ তাঁর প্রবন্ধগ্রন্থ। অনুবাদ করেছেন সফোক্লিসের ইডিপাস, ইউরিপিডিসের মিডিয়া, আলসেস্টিস, পাউল সেলানের কবিতা, এডিথ হ্যামিল্টনের মিথলজি-সহ অনেক গ্রন্থ। তাঁর গবেষণা বিপুল। তিনি ১৯৮৫ সাল থেকে সৃষ্টিশীল কবিতার কাগজ ‘একবিংশ’ সম্পাদনা করেছেন। পেশাগত দিক দিয়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। তিনি ঢাকার ল্যাব এইড হাসপাতালে ২০১৩ সালের ১৬ জুন রোববার সকালে মৃত্যু বরন করেন। মৃত্যু কালে তাঁর বয়স হয়েছিলো ৬৩ বছর। দেশ, সমাজ, সাহিত্য, রাজনীতি ইত্যাদি বিভিন্ন দিক নিয়ে আমি তাঁর বর্তমান সাক্ষাৎকারটি ১০ নভেম্বর, ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ. এফ. রহমান হলের বিপরীতে অবস্থিত গিয়াসউদ্দিন আবাসিক এলাকার বাসায় রাতে গ্রহণ করি।
অনুপ সাদি: সম্প্রতি ৩ নভেম্বর, ২০০০ আপনি ৫০ বছরে
পদার্পণ করেছেন এবং এই দীর্ঘ সময় নানা সফলতা ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করেছেন।
আপনার নিশ্চয় অনেক স্বপ্ন ছিলো এবং এখনো আছে। আপনার স্বপ্নের কথা বলবেন কি?
খোন্দকার আশরাফ হোসেন: স্বপ্ন একটি বহু অর্থসম্পন্ন
শব্দ। যদি আমার কাব্যচর্চার স্বপ্নের কথা বলতে হয় তাহলে আমার এক ধরনের স্বপ্ন ছিলো
যখন আমি কবিতা চর্চা শুরু করি। আমি সেই স্বপ্নের কথা বলতে পারি, আর যদি বৃহত্তর
প্রেক্ষাপটে দেশের কথা, সমাজের কথা এবং দেশের মানুষের জীবনসংগ্রাম বিষয়ক স্বপ্নের
কথা বলতে হয় তাহলে তার উত্তর হবে আলাদা। একটি মানুষের বহুধরনের জীবন এক সাথে থাকে;
একজীবনে অনেক জীবন সে যাপন করে।
তার বিভিন্ন ভূমিকা সমাজে আছে, পরিবারে আছে,
রাষ্ট্রে আছে; তার ক্ষমতা ও সুযোগ অনুযায়ী সে বিভিন্ন ভূমিকা পালন করে। একজন কবি
হিসেবে আমার স্বপ্নটি ছিলো পূর্ণতার। আমি যখন কবিতা লেখা শুরু করি তখন ভেবেছিলাম
একদিন আমার কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রচেষ্টা পূর্ণতা প্রাপ্ত হবে। শেক্সপিয়ার বলেছেন, ‘রাইপনেস ইজ অল’। একটি পূর্ণ ফলের যে ঋদ্ধি ও গৌরব
সেটি একজন কবি হিসেবে আমার স্বপ্নের মধ্যে ছিলো। আর যদি সামাজিক জীবনের স্বপ্নের
কথা বলতে হয় তাহলে বলবো আমার এই পঞ্চাশ বছরের সচেতন জীবনে, তরুণ হিসেবে, যুবক
হিসেবে আজ পর্যন্ত সময়টি ছিলো আমাদের সমাজ ও রাজনৈতিক জীবনে উত্তাল এবং ঝড়ো সময়।
আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি, আমি আমার জীবনের সমান্তরালে আমাদের দেশের রাজনৈতিক
ও সামাজিক জীবনের প্রগ্রসরণের সমান্তরালে আমি আমার নিজের জীবনকে যাপন করতে পেরেছি।
আমি যখন ছাত্র ছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তখন ’৬৮, ’৬৯, ’৭০-এর
গণআন্দোলন প্রত্যক্ষভাবে দেখেছি; আমি কোনো রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনের নেতা ছিলাম না
বটে তবে সক্রিয়ভাবে এসব আন্দোলনে মিছিলে শ্লোগানে অংশ নিয়েছি এবং ১৯৭১-এর
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি। এই দেশের রাজনৈতিক উন্মোচনের মধ্যে নিজেকে যুক্ত
করার পেছনে একটি স্বপ্ন নিশ্চয় কাজ করেছে। সেই স্বপ্নটি ছিলো আমাদের নিজস্ব
পদ্মা-মেঘনা-যমুনা বিধৌত যে ভূগোলটি, আমাদের যে রাষ্ট্র সীমানা, দেশের সীমানা, তার
ভিতরে বাস করতো মানুষ-- যে জনগোষ্ঠী তাদের জীবনে যে স্বপ্ন আকাঙ্ক্ষা, স্বাধিকারের
আকাঙ্ক্ষা, স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা এবং নিজেদের জীবনকে সমৃদ্ধ করার যে সঙ্গত
আকাঙ্ক্ষা সেই আকাঙ্ক্ষাকে রূপায়ন করার, রূপায়িত হতে দেখার এবং সে রূপায়ন
প্রক্রিয়ায় আমার খুব সীমিত সামর্থ অনুযায়ী কিছু ভূমিকা রাখা, এই ছিলো আমার স্বপ্ন।
আমি সেই স্বপ্ন কতটা পালন করতে পেরেছি, পূরণ করতে পেরেছি সেটি ভিন্ন প্রশ্ন তবে মানুষের
স্বপ্ন সবসময়ই তার বাস্তব প্রাপ্তিকে পেরিয়ে যায় আর পেরিয়ে যায় বলেই এটির নাম
স্বপ্ন।
অনুপ সাদি: আপনি যে সমাজের মানুষ হতে চান সে সমাজের
রূপরেখা দেবেন কী?
খোন্দকার আশরাফ হোসেন: সমাজের রূপরেখা খুব কনক্রীট
(মূর্ত) একটি জিনিস। সমাজবিজ্ঞানী সেই রূপরেখা দিতে পারেন, যারা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী
তারা সমাজের এক ধরনের রূপরেখা দিয়ে থাকেন, যেটি প্লেটো দিয়েছেন, কাল মার্কস
দিয়েছেন বা আরো যারা সমাজবিজ্ঞানী বা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী তারা দিয়েছেন। ..........
একজন কবি হিসেবে এবং একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমি যে সমাজের স্বপ্ন দেখি সে সমাজটা
হবে অবশ্যই শোষণমুক্ত; সে সমাজ হবে দারিদ্রমুক্ত এবং নিরক্ষরতা এবং
সাম্প্রদায়িকতামুক্ত একটি স্বাধীন সমাজ।
অনুপ সাদি: আমাদের সমাজটা আসলে বন্দি। আপনার কী মনে হয়?
খোন্দকার আশরাফ হেসেন: আমি এ কথার সাথে পুরোপুরি একমত।
তবে এ বন্দিদশা আসলে বহুমুখী। সমাজ একদিকে নিজস্ব জাড্যের বন্দি, নিজস্ব জড়তার
বন্দি এবং বন্দিত্বই আরো বন্দিত্বকে ডেকে আনে। বহুদিনের শৃঙ্খল যেমন পায়ে চলার
শক্তিকে কেড়ে নেয় এবং শৃঙ্খল খুলে দিলেও শৃঙ্খলমুক্ত লোকটি হাঁটতে পারে না আমাদের
সমাজকেও সে রকমই ভাবা যায়। ......... দুশো বছর উপনিবেশিক শাসন, চব্বিশ বছর
পাকিস্তানি শাসন;-- এসব কিছু আমাদের সমাজ জীবনে, সামাজিক চেতনার উপর এমনভাবে
জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছিলো যে আমরা উপনিবেশিক শিকল থেকে মুক্তি পাওয়ার পরও
মানসিক জাড্য, মানসিক শৃঙ্খলসমূহ থেকে মুক্তি পাইনি। এছাড়া রয়েছে শোষণের শৃঙ্খল
যেটি নয়া উপনিবেশিকতা এবং বৈশ্বিক রাজনীতির সাথে যুক্ত এবং সারা পৃথিবীর ভেতরে
একটি শোষণের নেটওয়ার্ক আছে যা থেকে বাংলাদেশের মতো একটি ছোট দেশ মুক্ত নয়। সুতরাং
অর্থনৈতিকভাবে আমরা শৃঙ্খলিত, মানসিকতাভাবে শৃঙ্খলিত এবং কিছু পশ্চাৎপদ
কুসংস্কারাছন্ন ধর্মীয় উন্মাদনা, সাম্প্রদায়িকতার শেকল আমাদের হাতে পায়ে জড়িয়ে আছে
এখনো।
অনুপ সাদি: ‘কে
হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে’-
জীবনানন্দ দাশ হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে চাননি। তাই বলে কি বেদনা ভুলে থাকা যায়?
আমরা কি এমন সমাজ চাইতে পারি না যে সমাজ কাউকে বেদনা দেবে না?
খোন্দকার আশরাফ হোসেন: জীবনানন্দ দাশের কবিতার উচ্চারণ
বিচার্য কাব্যিক প্রেক্ষাপটে। জীবনানন্দ দাশ যে বেদনার কথা বলেছেন সেটি আসলে
রোমান্টিক মনোবেদনা এবং সেই বেদনা থেকে মানুষ মুক্তি পাবে না এবং মুক্তিটি কাম্যও
নয়। কারণ ঐ মনোবেদনা থেকেই শিল্পের সৃষ্টি। তবে সামাজিক প্রেক্ষাপটের কথা ভাবলে
ব্যাপারটি অন্য; জীবনানন্দ আমার মনে হয় সেই সামাজিক প্রেক্ষাপটের কথা ভেবে লাইনটি
লিখেননি। বেদনা মুক্তি অর্থ হচ্ছে সামাজিক শোষণ ও শৃঙ্খলের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি;
সেই শোষণের নিগড়, জ্বালা-যন্ত্রণা থেকে মুক্তি এবং সেই মুক্তির জন্যে চিরকালই
মানুষ সংগ্রাম করছে এবং করবে। আমাদেরকেও সেই অভিশাপ বা যন্ত্রণা মুক্তির জন্যে
চেষ্টা করে যেতে হবে এবং আমার ধারণা, যদিও ধারণাটি কিছুটা কল্পস্বর্গীয় হতে পারে;--
এক সময় পৃথিবীতে এমন একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা সম্ভব, যেখানে মানুষের সামাজিক যন্ত্রণা,
শোষণ এবং বৈষম্যের যন্ত্রণা অনেকটাই কমে যাবে।
অনুপ সাদি: ‘উন্নত
দেশ নই কোনোদিন, দিন আনি খাই/ আমরা কখনো ঘামাইনি মাথা দেশশাসনে’[১] এই যে দেশ শাসনে মাথা না ঘামানো;
এটা করা কি ঠিক হয়েছে?
খোন্দকার আশরাফ হোসেন: দেশ শাসনে কে মাথা ঘামায়নি,
বিঞ্চু দে হয়তো ঘামাননি। বিঞ্চু দে ত্রিশের দশকের কবি এবং ত্রিশের দশকের কবিদের
সম্পর্কে সমাজ বিচ্ছিন্নতার-রাজনীতি বিচ্ছিন্নতার একটি অভিযোগ আছে বটে; তবে বিঞ্চু
দে-এর নিজের ব্যাপারেও কথাটি পুরোপুরি খাটে না। তার কাব্য জীবনের প্রথম ভাগে এক
ধরনের সামাজিক নির্লিপ্ততা ও বিশুদ্ধ নান্দনিকতা চর্চার ব্যাপারটা হয়তো ছিলো;
কিন্তু এই বিঞ্চু দে-ই পরবর্তীকালে পুরোপুরিভাবে রূপান্তরিত হয়েছিলেন এবং
লিখেছিলেন ‘সন্দ্বীপের চর’-এর মতো কাব্যগ্রন্থ। তিনি, ভুললে
চলবে না, যদিও বলেছেন ‘আমরা
কখনো ঘামাইনি মাথা দেশশাসনে’, এ
রকম উচ্চারণ ‘জন্মাষ্টমী’ কবিতাতেও আছে; এটি কিন্তু কবির নিজের
বচন এতটা নয় যতটা তৎকালীন মধ্যবিত্ত সমাজের রাজনীতি বিষয়ে নির্লিপ্ততা এবং
উৎসাহহীনতা; এবং সেটাকে বিদ্রুপ করার জন্যে এ লাইনগুলো লেখা হয়েছিলো বলে আমার
ধারণা। তিনি মোটেই রাজনীতি বিচ্যুত নন, অন্তত পরবর্তীকালের বিঞ্চু দে। এই বিঞ্চু
দে-ই লিখেছেন ‘জনসমুদ্রে নেমেছে
জোয়ার/ হৃদয়ে আমার চড়া’।
তাঁর হৃদয়ে চড়া বটে, কিন্তু জনসমুদ্রে যে জোয়ার নেমেছে সে সম্পর্কেও তিনি সচেতন
এবং তিনি দীপ্ত বর্শা হাতে বিজয়ী ঘোড়সওয়ারকে অর্থাৎ বিপ্লবকে আহবান জানাচ্ছেন।
অনুপ সাদি: ‘দেশ
খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও অর্ধেকের বেশি মানুষ খাদ্য থেকে বঞ্চিত’[২]। এই যে অর্ধেক মানুষের পর্যাপ্ত
খাদ্যহীন বেঁচে থাকা; ‘এ
বাঁচা তো বাঁচা নয়, এঁটোপাতা চাটা/ মাটিতে উপুড় হয়ে বুক দিয়ে হাঁটা!’[৩]।
খোন্দকার আশরাফ হোসেন: অর্ধেক মানুষের খাবার নেই, আসলে
এটা একটা আপেক্ষিক ব্যাপার। যেমন একজন বড়লোক যা খায় তা একজন সাধারণ মানুষ খাওয়ার
কল্পনাও করে না বা খেতে পারে না বা সাধ্য নেই। শোনা যায় বাংলাদেশ খাদ্যে স্বনির্ভর
হয়েছে এবং আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, আমি বাল্য এবং কৈশোর গ্রামে
কাটিয়েছি; আমি দুর্ভিক্ষ দেখেছি, প্রায় প্রতিবছরই এক ধরনের দুর্ভিক্ষ হতো এবং সেই
ব্যাপারটি এখন আর নেই। আমি প্রতি মাসেই গ্রামে যাই, আমি গ্রামের জীবন দেখি, এখন আর
সেই নিরন্ন অনাহার বা দুর্ভিক্ষ নেই। তবে বলা যায় পর্যাপ্ত খাদ্য, আবার সেই
আপেক্ষিক ব্যাপার, দু’বেলা
খাদ্য বোধ হয় মানুষ এখন জোটাতে পারে। বিশেষ করে কৃষিক্ষেত্রে গত পঁচিশ বছরে
অনিবার্যভাবেই বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় ইরি ধান চাষের কারণে, উন্নত ধরনের সেচের কারণে
কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা বেড়েছে এবং মানুষের ঠিক না খেয়ে থাকার অবস্থা এখন আর
গ্রামে নেই, যেটি আমি আমার ছেলেবেলায় দেখেছি।
অনুপ সাদি: বর্তমানে অর্থের প্রভাব দেখে কি মনে হয় না
মনুষ্যত্বের চেয়ে অর্থ বড় হয়ে গেছে?
খোন্দকার আশরাফ হোসেন: এটা একটা গ্রহণযোগ্য কথা । আমরা
সর্বত্রই দেখতে পাচ্ছি অর্থের দাপট। আর মানবিক মূল্যবোধ এক সময় খুব গুরুত্বপূর্ণ
বলে ভাবা হতো, বিদ্যালয়ে শির্থীদের শিক্ষা দেয়া হতো এবং বিভিন্ন সাহিত্য ও
শিল্পকলার মাধ্যমে মানুষের শুভবুদ্ধি ও মনুষ্যত্বকে গৌরবান্বিত করে তুলে ধরার একটা
চেষ্টা ছিলো। এখন দেখা যাচ্ছে বিনোদনের যে যুগ এসেছে, জোয়ার এসেছে সেখানে অর্থ এবং
বিত্তকে এক ধরনের মোহনীয় ও মোহময়ী মোড়কে উপস্থাপন করা হচ্ছে। টেলিভিশন দেখলে দেখা
যাবে যে ৯০% নাটক হচ্ছে বড় লোকদের নিয়ে এবং তাদের বিশাল প্রাসাদোপম বাড়ি, তাদের
বাড়ির করিডোর, ঘোরানো সিঁড়ি এবং তাদের খাওয়ার টেবিলের খাদ্যের প্রাচুর্য, তাদের
পোশাক-আশাক, সবকিছু মিলিয়ে আমাদেরকে সর্বক্ষণ দেখানো হচ্ছে;-- এই হচ্ছে বিত্ত এবং
বৈভব এবং এই ভাবে জীবন-যাপন না করলে জীবনটা অর্থহীন। এবং এর ফলে মধ্যবিত্তের মধ্যে
যাদের সাধ আছে, স্বপ্ন আছে, কিন্তু অতোটা পারে না, আর্থিক কারণে তাদের মধ্যে এক
ধরনের টেনশন সৃষ্টি হচ্ছে, হতাশা সৃষ্টি হচ্ছে এবং যে কোনোভাবে অর্থবান হওয়ার
প্রণোদনা জাগাচ্ছে যা তাদেরকে দুর্নীতি এবং বিভিন্ন ধরনের নৈতিক এবং মানসিক
বৈকল্যের দিকে ঠেলে দিচ্ছে বলে আমার ধারণা। এটা সারা বিশ্বেই ঘটছে এবং এটি
পরিকল্পনামাফিক বিশ্বায়ন ও বাজার অর্থনীতির কথা বলে চালানো হচ্ছে। সবকিছুর ভিতরে
একটি বাজারমূল্য বা বিক্রয়মূল্য বা পণ্যমূল্য ধার্য করা হচ্ছে। শিক্ষাকে পণ্য বলা
হচ্ছে। সংস্কৃতি, গান, কবিতা সবকিছুতে প্রাইস স্ট্যাম্প লাগিয়ে দেয়া হচ্ছে, ইহার
মূল্য এতো, পয়সা থাকলে ক্রয় করো। এটি খুবই দুঃখজনক এবং সারা বিশ্বজুড়েই এটি চলছে
এখন। অদূর ভবিষ্যতে কবে ব্যাপারটি পরিবর্তন হবে আমাদের জানা নেই। আমার তো মনে হয়
অদূর ভবিষ্যতে এই প্রবণতা পাল্টে যাবার কোন প্রবণতা দেখা যায় না।
অনুপ সাদি: আপনি মধ্যবিত্তের কথা বলছেন, মধ্যবিত্তরা তো
উপরে উঠতে চায়, উচ্চবিত্ত হতে চায়, তারা তো উচ্চবিত্তকে শোষণ করতে পারে না, ফলে
শোষণ করে কিংবা শোষণ করতে চায় নিম্নবিত্তকে এবং এটা তাদেরকে আরো দুর্নীতির ভেতরেই
ঠেলে দেয় ..........।
খোন্দকার আশরাফ হোসেন: মধ্যবিত্ত কীভাবে উচ্চবিত্তকে
শোষণ করবে? উচ্চবিত্ত তো নিজেরা শোষক বলেই উচ্চবিত্ত হতে পেরেছে। মধ্যবিত্ত তো না
ঘরকা না ঘাটকা। মধ্যবিত্ত আসলে দোদুল্যমান একটা সমাজ। কেউই মধ্যবিত্ত থাকতে চায়
না। মধ্যবিত্ত সব সময় তটস্থ এই বুঝি এক পা পিছলে নিম্নবিত্তের মধ্যে সে পড়ে যায় কি
না। একটু অসুবিধা হলে, চাকরিটা চলে গেলে তাকে বস্তিতে গিয়ে থাকতে হবে নিম্নবিত্তের
সাথে; এই ভয়ে সে সব সময় তটস্থ থাকে। সে কোনো প্রতিবাদ করে না কোনো কিছুর বিরুদ্ধে,
সে দিবারাত্র চাকরি করে যায়, হুজুর হুজুর করে যায়; এটা তার স্বভাব। আবার সব সময়
তার মনের ভিতর ইচ্ছা যে সে একটা সিঁড়ি পেলেই ............ উচ্চবিত্তে চলে যেতে
পারবে, সুতরাং তার ভেতরে একটা টানাপোড়েনের সৃষ্টি হয়। মধ্যবিত্ত শোষণ করার হাতিয়ার
যখন হাতে পেয়ে যায় তখন সে আর মধ্যবিত্ত থাকে না। অতিদ্রুত মধ্যবিত্ত থেকে
উচ্চবিত্তে রূপান্তরিত হয়। মধ্যবিত্ত শোষিত হচ্ছে উচ্চবিত্তের দ্বারা, মধ্যবিত্ত
সুযোগ পেলে নিম্নবিত্তকে শোষণ করবে; কারণ তার ইচ্ছা আছে উচ্চবিত্ত হবার এবং শোষণ
ছাড়া রাতারাতি উচ্চবিত্ত হওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
অনুপ সাদি: আপনি আশির দশকের কবি। ঐ দশকটিকে অনেকে বলেন
দূষিত দশক। কবিতা লেখা ছিলো যার প্রধান কাজ তিনিও জড়িয়ে পড়েছিলেন রাজনীতিতে।
খোন্দকার আশরাফ হোসেন: না, এটা আশির দশক সম্পর্কে বলা হয়
না; এটা বলা হয় সত্তর দশক সম্পর্কে। তুমি কোথায় শুনেছো আমি জানি না। সত্তর দশক
সম্পর্কে এটি ঠিক। সত্তর দশকের কবিরা সব শ্লোগান লিখেছে এবং তারা কবিতার মধ্যে
শুধু রাজনীতির কথাই লিখেছে; আর কিছু আলোচনা করেনি। বরং আশির দশকে এ প্রবণতাটির মুখ
ঘুরিয়ে দেয়া হয় এবং কিছু কিছু কবি যারা আত্মগত, সুবেদী, সুস্থির এবং সমাজ
ভাবনাদীপ্ত, প্রচন্ড-প্রখরভাবে রাজনীতিমগ্ন নয়, শিল্পসম্মতভাবে সমাজভাবনাকে প্রকাশ
করে; যাকে বলা যেতে পারে অনুভবদীপ্ত উচ্চারণ;-- এগুলোর দিকে কবিতাকে যারা নিয়ে
গেছে আশির দশকে আমি তাদের মধ্যে নিজেকে একজন মনে করি।
অনুপ সাদি: বাংলাদেশের রাজনীতি ও রাজনীতিকরা কি সৎ আছে
বলে আপনার মনে হয়?
খোন্দকার আশরাফ হোসেন: রাজনীতিকরা খুব কমই সৎ হয়ে থাকে।
রোনাল্ড রিগান একটা কথা বলেছিলেন যে, পলিটিক্স হচ্ছে মানুষের দ্বিতীয় প্রাচীনতম
পেশা এবং এটি প্রথমটির মতোই দূষিত। ........... এটা রোনাল্ড রিগানের কথা; যদিও
তিনি নিজেই রজনীতিক। তবে বাংলাদেশের রাজনীতির ভিতরে দুর্নীতি এবং অসততা এবং
বর্তমানের রাজনীতি এমন একটা অবস্থায় এসে পৌঁছেছে যে, এখানে দেশপ্রেমের চেয়ে
অন্যান্য বিবেচনাই প্রধান এবং আমরা যাদেরকে বাধ্য হয়ে নির্বাচিত করি, যারা
নির্বাচনে দাঁড়ায় তারা হচ্ছে অর্থবান মানুষ এবং তাদের অর্থ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই
অসৎভাবে উপার্জিত। খুব কম রাজনীতিকই আছেন যার ইলেকশনের খরচ যোগাতে পারেন নিজের
পকেট থেকে। সুতরাং তাদেরকে পয়সা উপার্জন করতে হয় অসৎ উপায়েই এবং নির্বাচিত হওয়ার
পর সে পয়সা তোলার জন্য তাদেরকে অসৎ কাজ করতে হয়। রাজনীতি পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই
মোটামুটি অসততার দ্বারা সংক্রমিত। হয়তো এটা একটা ‘নেসেসারি
ভাইস’ (প্রয়োজনীয় পাপ)। কিন্তু আমাদের দেশে
যেহেতু জবাবদিহিতার খুব অভাব; এ-কারণে রাজনীতিকরা দুর্নীতি এবং এ-ধরনের কাজে খুব
তাড়াতাড়ি জড়িয়ে পড়ে। কারণ কোনো বিচারের ভয় নেই। ভারতের মতো জায়গাতেও এক ধরনের ভয়
আছে, সেখানে সিবিআই বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রাজনীতিককে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। এমনকি
নরসীমা রাও দণ্ডিত হয়েছেন। এসব যদি আমাদের দেশে হতো তাহলে রাজনীতির দূষণপ্রক্রিয়া
বন্ধ করা যেতো। ............ সাধারণ মানুষ হিসেবে আমার মনে হয় রাজনীতিকে কলুষিত
করার পেছনে আমাদের দেশের সামরিক শাসকরা দায়ী। তারা শুধু রাজনীতিকে ডিফিকাল্ট
করেননি, রাজনীতিকে দূষিতও করেছেন। তারা কেনাবেচার রাজনীতি করেছেন, মন্ত্রি
বানিয়েছেন, এবং প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে লাথি দিয়ে ফেলে দিয়েছেন; ছাত্রদেরকে করাপ্ট
করেছেন, তাদেরকে দলে টেনেছেন, পয়সা দিয়েছেন; তারা এসব করেছেন শুধু বাংলাদেশ হবার
পর থেকে নয়, আইয়ুব আমল থেকেই এটি শুরু হয়েছে। সুতরাং এটি একটি অসুস্থতা বা রোগ
যেটি দেশে বাসা বেঁধেছে এবং এটি থেকে দেশ এখনো মুক্ত নয়।
অনুপ সাদি: দেশের বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলো পুঁজিপতিদের
নিকট হতে অর্থ নেয়। এটা দেশের জন্যে কতটা ক্ষতিকর?
খোন্দকার আশরাফ হোসেন: আমি যেহেতু কোনো রাজনৈতিক দলের
সাথে জড়িত নই, রাজনৈতিক দলের অর্থ সংগ্রহের প্রক্রিয়া সম্পর্কে আমার কাছে কোনো
তথ্য নেই; তবে আমি সাধারণত মনে করি পুঁজিপতিদের কাছ থেকেই অর্থ সংগ্রহ করা হয় এবং
ফান্ড গঠন করা হয় নির্বাচনের সময়। এত বিশাল কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য অর্থের
প্রয়োজন তো আছেই। ............ কিন্তু কেউ যদি অর্থ দেয় তার পেছনে স্বার্থ থাকে
এবং সে স্বার্থটি পূর্ণ হোক সেটা সে দেখতে চায় এবং সেভাবে প্রভাব বিস্তার করে।
পয়সা পেতে হলে যাদের কাছে পয়সা আছে তাদের কাছেই যেতে হবে। এটি অবশ্যই রাজনীতির
একটি ক্ষতিকর দিক বটে ..........। এটির বিকল্প কি হতে পারে, এ ব্যাপারে কোনো ধারণা
নেই।
অনুপ সাদি: বাংলাদেশের প্রধান দুটি দলই পুঁজিবাদ ঘেঁষা।
আপনি কি মনে করেন দেশের উন্নতির জন্যে বিশেষ করে বর্তমান বিশ্বায়নের আধিপত্য থেকে
রক্ষা পেতে আমাদের একটি শক্তিশালী বাম রাজনৈতিক দল সংসদে থাকা প্রয়োজন ছিলো?
খোন্দকার আশরাফ হোসেন: সারা বিশ্বই এখন একমুখী হয়ে গেছে,
তাই না? যাকে বলে ইউনিপোলার। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন এবং বিভিন্ন
কারণে বর্তমানে বামপন্থী রাজনীতি একটু বিপদের মুখে পড়েছে বহু দেশেই এবং বাংলাদেশের
বামপন্থীরা আদৌ খুব সংগঠিত শক্তিশালী ছিলেন না কখনোই। এর অনেক কারণ আছে যা
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বিশ্লেষণ করবে। আমাদের বামপন্থিদের মধ্যে হঠকারী অংশটি
জাতীয়তাবাদি আন্দোলনের সাথে সংযুক্ত ছিলো না। একটি অংশ ছিলো যারা মোটামুটি এ দেশের
মানুষের রাজনৈতিক আকাঙ্খার সাথে, বিশেষ করে জতীয়তাবাদী ধারা--চেতনার; জাতীয়তাবাদ
তো সাম্যবাদ সমাজতন্ত্রের ধারণার সাথে একেবারেই পুরোপুরি মিলে যায় তা নয়, এটা
সাম্যবাদবিরোধী সমাজতন্ত্র বিরোধী ধারণাই বটে এবং জাতীয়তাবাদ ইসলামবিরোধীও বটে;
ইসলামও এক ধরনের বৈশ্বিকতার কথা বলে; কম্যুনিজমও এক ধরনের বৈশ্বিকতার কথা বলে
কিন্তু একটা দেশের ভূ-রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটের একটা পর্যায়ে দেখা যায়
জাতীয় গণতান্ত্রিক আন্দোলন অনিবার্য হয় এবং সে আন্দোলনে বামপন্থিরা অংশগ্রহণ করে;
এটা বিভিন্ন দেশে দেখা গেছে, তারপরে আর একটা পর্যায়ে তারা হয়তো সমাজতান্ত্রিক
বিপ্লবের দিকে অগ্রসর হতে চেষ্টা করে। ........ কিন্তু জাতীয় গণতান্ত্রিক আন্দোলনে
আমাদের দেশের বামপন্থিদের একটা অংশ অংশ নিয়েছে; কিন্তু আর একটা অংশ বিরোধিতা
করেছে; বিশেষ করে চিনপন্থি যারা এবং তার ফলে বামপন্থা এক ধরনের প্রশ্নের ভেতরে চলে
গেছে। আইয়ূব খানকে সমর্থন করেছে বামপন্থিরা এদেশে; এমনকি ’৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘দুই কুকুরের লড়াই’ বলে এদেশের মানুষের জীবনপণের লড়াইকে
ব্যঙ্গই করেছে। সুতরাং বামপন্থি সম্পর্কে এদেশের মানুষের নিঃশঙ্ক কোনো সমর্থন কখনো
ছিলো না এবং মানুষের একটা ধারণা ছিলো যে এদের দিয়ে কিছু হবে না। এরা সহযোগি শক্তি
হিসেবে হেলপ (সাহায্য) করতে পারে এবং একটা অংশ, বলেছি, মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে
রুশপন্থি যারা ছিলেন তারা মানুষের চেতনার সাথে সুসামঞ্জস্য রেখেই জাতীয়তাবাদি
আন্দোলন করেছেন কিন্তু আরেকটি দল যারা ’৭৫
সালের পরে ঐ বামপন্থি লোকগুলো বেশিরভাগই চলে গেছে বিএনপি শিবিরে। ......... তারা
নিজেরা বামপন্থি ছিলেন কি না এখন হয়ত তারা নিজেরাই ভুলে গেছেন। কাজী জাফর আহমদ,
সিরাজুল হোসেন খান, আনোয়ার জাহিদের মতো লোকরা বামপন্থি ছিলেন; এদের একজনও বামপন্থি
চরিত্র রক্ষা করতে পারেননি। ফলে এদেশের বামপন্থি রাজনীতির ভবিষ্যত মোটেও উজ্জ্বল
নয়। যদিও আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বামপন্থার কথা বলেন-লিখেন,
নির্মল সেনের মতো মানুষেরা কলাম লিখেন এবং বামপন্থার প্রয়োজনে কথা বলেন। বামপন্থা
তো সমাজতন্ত্র নয়, বামপন্থা হচ্ছে আমার মতে একটা সূতোর দুভাগের একভাগে থাকা;
প্রগতির পক্ষে মানবতার পক্ষে, অসাম্প্রদায়িকতার এবং ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে থাকাও
বামপন্থা। ........ সংসদে একটি বামপন্থি দল থাকলে মন্দ হতো না। কারণ হচ্ছে আমাদের
যে দুটি প্রধান দল আছে তাদের মধ্যে মেলা পার্থক্য থাকা সত্বেও তাদের আসলে মোটামুটি
একই বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক এ্যাপ্রোচ অর্থনীতির প্রতি এবং রাজনীতির প্রতি। আওয়ামি
লিগকেও এক সময় বাম ঘেঁষা বলা যেত, এখন হয়ত অতটা বাম ঘেঁষা না হয়ে মধ্যপন্থি হয়েছে।
প্রয়োজনীয় মুহূর্তে হয়ত বামের দিকে ঝুঁকে যেতে পারে এমনকি দক্ষিণ দিকেও ঝুঁকে যেতে
পারে। কারণ এ ধরনের বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক দলের ভেতর ........ সমাজতান্ত্রিক
আদর্শের কঠোর বিধি-নিষেধ নেই এবং এরা অনেকটাই প্রস্তুত থাকে খাপ খাইয়ে চলতে।
প্রাগম্যাটিজম হচ্ছে-- দোষ এবং গুণ অর্থে আমি বলছি না-- এসব দলের চালিকাশক্তি,
অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেয়া। এখন পর্যন্তও আমি আওয়ামি লিগকে সুতোর বামপাশেই ভাবি।
অনুপ সাদি: বাঙলাদেশের বর্তমান অবস্থা দেখে কি মনে হয় না
যে ‘যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে
তারা?’[৪]
খোন্দকার আশরাফ হোসেন: তাতো বটেই। সমাজের সর্বেক্ষেত্রেই
তাই। কোনো কলেজ ছাত্রকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ মানুষ কে বা
শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবি কে তবে সে হয়তো তিনজন অভিনেতার নাম বলবে। তাদের মতে অভিনেতারাই
শ্রেষ্ঠ মানুষ, আমি বলছি না তারা খুব নিকৃষ্ট মানুষ। ......... এদেশের মানুষ এখনো
ইন্টেলেকচুয়াল এবং পারফরমারের পার্থক্য বুঝতে পারে না। পারফরমারকে সে মনে করছে
পণ্ডিত এবং পণ্ডিতকে মনে করছে পারফরমার এবং পণ্ডিতরাও পারফরম্যান্স করছে
পারফরমারের ভূমিকায়। ফলে এ দেশে এমন হচ্ছে যে যারা অন্ধ তারা সবচেয়ে বেশি চোখে
দেখছে। কারণ ....... এখানে মেধার মূল্যায়ন নেই, সততার মূল্যায়ন নেই এবং যারা
সবচেয়ে বেশি অসৎ, একটি এলাকায় যে ব্যক্তি সবচেয়ে বেশি অসৎ, খোঁজ করলে দেখা যাবে
যে সেই ব্যক্তিটি হয়ত জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হচ্ছে। সব ক্ষেত্রেই হয়তো হচ্ছে না
কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমরা এরকমই দেখি। ফলে ‘যাদের
হৃদয়ে কোন প্রেম-প্রীতি নেই, করুণার আলোড়ন নেই/ পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ
ছাড়া’। তারাই পরামর্শ সভায় বসে পরামর্শ
দিচ্ছে দেশকে-দেশবাসীকে।
অনুপ সাদি: জ্ঞান চর্চার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে কী ধরনের
স্বাধীনতার দরকার?
খোন্দকার আশরাফ হোসেন: জ্ঞান চর্চার জন্যে আর্থিক
স্বাধীনতার দরকার; বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি আর্থিক দিক থেকে নিজেরা স্বয়ংসম্পূর্ণ
হতো, ........... রাজনীতিকদের বা সরকারের মুখাপেক্ষী না হতো তাহলে স্বাধীনতা, তুমি
যেটা মনে করো তা হতো; কিন্তু আমার মনে হয় না যে সেটা সবচেয়ে বড় সমস্যা। আমাদের
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কী পড়ানো হবে, সিলেবাস কী হবে এবং কারা শিক্ষকতা করবে এ বিষয়ে
বিশ্ববিদ্যালয়ে, আমার ধারণা ’৭৩
সালের অধ্যাদেশ বা বিভিন্নভাবে প্রচুর স্বাধীনতা আছে। অর্থনৈতিক নির্ভরতা সরকারের
উপর আছে কারণ ছাত্রদের বিশ টাকা বেতন দিয়ে তো একটা টুথপেস্ট পাওয়া যায় না, কিন্তু
ছাত্ররা একমাসের শিক্ষ পাচ্ছে। ....... তবে আমার মনে হয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর
স্বাধীনতার সীমাবদ্ধতা বেশিরভাগই হচ্ছে সমাজের সাথেই যুক্ত মানসিক জড়তা এবং
অন্যান্য কারণে। আমরা আসলে কি স্বাধীন চিন্তা করতে চাই? আমাদের শিক্ষকরা কি
স্বাধীন চিন্তার অনুসারী সবাই? আমি তো দেখি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গরিষ্ঠ
অংশের ভেতরেই দেশ-সমাজ নিয়ে কোনো উৎসুক্যই নেই। ............ বিশ্ববিদ্যায়ের
শিক্ষা মানুষের সর্বাঙ্গীন বিকাশ বা মানুষের চিন্তা, বুদ্ধিবৃত্তি, মানসিক বিকাশের
ক্ষেত্র হওয়া উচিত। এ জন্য আমার ধারণা সবগুলো অনুষদেই সবগুলো শিক্ষাক্রমের সাথেই
কিছুটা সামাজিক বিজ্ঞান এবং ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞানের পঠন-পাঠন অর্ন্তভূক্ত করা উচিত;
এমনকি বিজ্ঞানের ছাত্রেরও সমাজবিজ্ঞান পড়া উচিত। কারণ একজন বিজ্ঞানের ছাত্র শুধু
বিজ্ঞানের ব্যাপারগুলো জানলেই পরিপূর্ণ মানুষ, আধুনিক মানুষ হবেন তা নয়। তাকে
মানুষের ইতিহাস, মানুষের সামাজিক বিবর্তন, তার আকাঙ্খা, তার সংগ্রাম, দেশের এবং
বিশ্বের প্রেক্ষাপটে জানতে হবে এবং এটি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দিতে পারে না।
খণ্ডিত সিলেবাস এবং খণ্ডিত চিন্তার মানুষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে বেরিয়ে আসে এবং
এটিই হচ্ছে স্বাধীনতার অভাব।
অনুপ সাদি: বাঙলা ভাষায় প্রায় পনের-বিশ জন সফল কবি
রয়েছেন কিন্তু দু’একজন
বিজ্ঞানী, সমাজ বিজ্ঞানী বা দার্শনিক নেই কেন?
খোন্দকার আশরাফ হোসেন: কবি হিসেবে সাফল্য এবং দার্শনিক,
বৈজ্ঞানিক হিসেবে সাফল্য একরকম ব্যাপার নয়। বৈজ্ঞানিক সাফল্যের জন্যে গবেষণা,
গবেষণার সুযোগ বা সমাজের পৃষ্ঠপোষকতা নেই বলে হয়ত হচ্ছে না। দার্শনিক,
সমাজদার্শনিক নেই; এটা একটা সাধারণ দৈন্য। আমার মনে হয় বিংশ শতাব্দীর তৃতীয়-চতুর্থ
দশক থেকেই দাশর্নিক শূন্যতায় বাঙালিকে পেয়ে বসেছে, এ দেশের বাঙালিই নয় শুধু
পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি সম্পর্কেও এ কথা বলা যায়। সেই মাপের দার্শনিক বা চিন্তাবিদ
জন্মগ্রহণ করছে না; হয়তো সামাজিক পরিস্থিতি দার্শনিকদের আবির্ভাবের অনুকূল নয়।
সমাজবিজ্ঞনী, সমাজচর্চা দেশে যে হচ্ছে না তা নয়; এ দেশের বেশকিছু সমাজবিজ্ঞানী
আছেন যারা উদাহরণযোগ্য কাজ করেছেন এবং করছেন এখনো। বিজ্ঞানের গবেষণার জন্য যে ভৌত
অবকাঠামো দরকার, গবেষণাগার দরকার, টাকা বা ফান্ড দরকার সেটা নেই। তবে হয়তো আমাদের
দেশের বিজ্ঞানীরা আমেরিকায় গিয়ে গবেষণায় সাফল্য দেখাচ্ছেন। বিজ্ঞানী নেই-- এটি
দেশের সামগ্রিক ব্যর্থতার একটি।
অনুপ সাদি: আপনার বেহুলা বাংলাদেশ কবিতায় আছে ‘রাজপথে দাঁড়ালাম বুকে পিঠে সেঁটে নিয়ে
ক্রোধ/ সহস্র মৃত্যু আর অবমাননার নেবো প্রতিশোধ’--
এই প্রতিশোধ কি নেয়া যায় বা নেয়া প্রয়োজন?
খোন্দকার আশরাফ হোসেন: নেয়া যায় কি না জানি না তবে নেয়া
প্রয়োজন তো বটেই। সহস্র অবমাননা এবং সহস্র অন্যায়ের প্রতিশোধ নেবো কথাটি বিশ্লেষণ
করলে দেখা যাবে আজকে[৫] নূর হোসেনের মৃত্যু দিবস। নূর হোসেনের বুকে-পিঠে লেখা ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি
পাক’ এই কথাগুলো কিন্তু আমার মনের ভেতরে
ছিলো যখন আমি কবিতাটি লিখি এবং ঐ নবীন লখিন্দর রাজপথে আঙুল তুলে দাঁড়িয়ে আছে
এতোদিন যে অন্যায় এবং অত্যাচার আমার উপর মানে দেশের উপর করা হয়েছে তার প্রতিশোধ
নেবো আমি। এটা শুধু জিঘাংসা নয়। প্রতিশোধের একটা দিক হচ্ছে Justice, Revenge এবং Justice পরস্পর সংলগ্ন। কখনো কখনো
Revenge is the only way of having justice when justice is denied. ন্যায় বিচার
সঠিকভাবে না পেলে প্রতিহিংসা বা জিঘাংসাই একমাত্র পথ এবং Revenge-কে ফ্রান্সিস
বেকন বলেছেন ‘Wild justice’; কিন্তু justice তো বটেই। কিন্তু
কবিতাতে যদি বলা হয় ‘প্রতিশোধ
মানে হচ্ছে রক্ত নেবো’--
তাতে কবিতা থাকে না। ......... এখানে দেশকে অভিযুক্ত করা হচ্ছে এবং নায়ক লখিন্দর,
যে বলছে কবিতাটি, বলছে আমার লাশ তুশি রাজপথে শুইয়ে রেখে বিদেশি বণিকের কাছ থেকে
আধুলি ও সিকি ভিক্ষা নিয়েছো। অর্থাৎ আমার দারিদ্রকে দেখিয়ে, হাড়কে দেখিয়ে সাহায্য
এনেছো, আমার কাফন খুলে নিয়ে তুমি বানিয়েছো ফিনফিনে ওড়না। দেশকে বা বেহুলাকে
অভিযুক্ত করছে লখিন্দর এবং এর ভেতরে তীব্র ক্ষোভ আছে, অভিমান আছে এবং জিজ্ঞাসা
করছে তুমি আমাকে জাগালে কেন। জাগালে যখন তখন আমি প্রতিশোধ নেব। তোমার বিরুদ্ধে নয়;
প্রতিশোধ হতে পারে ভিনদেশী বণিকের বিরুদ্ধে বা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে,
অনেক কিছুই হতে পারে প্রতিশোধের লক্ষ্যবস্তু; কবিতার অর্থ তো এক রকম নয়।
অনুপ সাদি: ‘ভালোবাসিয়াছি
ভালবাসিয়াছি ভালোবাসে নাই ভালো’[৬]।
এ যুগে মানুষকে কি ভালো কোনোকিছু ভালোবেসেছে? মানুষ তো সবদিক দিয়ে খারাপের দিকেই
এগুচ্ছে।
খোন্দকার আশরাফ হোসেন: কথাটি সত্য নয়। মানুষ সবসময় খারাপের
দিকে এগোয় না। ......... রবীন্দ্রনাথের কথায় আছে, ‘মন্দ
যদি তেতাল্লিশ হয় ভালোর ভাগ সাতান্ন’,
আমি এটাই বিশ্বাস করি। শুভ এবং অশুভের দ্বন্দ্ব চলছে পৃথিবীতে এবং তারপরও পৃথিবীর
নিজের প্রবণতা বা গতি কিন্তু শুভর দিকে। অশুভকে সে দূর করতে চায় তার নিজের শরীর
থেকে; একটা ক্যান্সার আক্রান্ত মানুষ যেমন আক্রান্ত অংশ কেটে ফেলে সুন্দর হতে চায়।
শুদ্ধ হওয়ার সংগ্রামটি কিন্তু সবসময়ই চলছে। মনে হচ্ছে শুভ পারছে না কিন্তু আমার
ধারণা এক সময় শুভই জয়ী হবে, মঙ্গলেরই জয় হবে; আমি অন্তত বলতে পারি ........ কবি হিসেবে; এটাই আমার বিশ্বাস।
অনুপ সাদি: সময় দেবার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
খোন্দকার আশরাফ হোসেন: ধন্যবাদ তোমাকেও। ধন্যবাদ পত্রিকা
সংশিষ্ট সকলকে ও অগণিত পাঠককে।[৭]
তথ্যসূত্র ও টীকাঃ
১. বিঞ্চু দে’র
কবিতা ‘কাসান্ড্রা’র একটি লাইন।
২. দৈনিক প্রথম আলো ১৬.১০.২০০০।
৩. মরাবাঁচা-- গোলাম কুদ্দুস।
৪. জীবনানন্দ দাশের কবিতার লাইন।
৫. সাক্ষাৎকার গ্রহণের দিন, ১০ নভেম্বর, ২০০০)
৬. বুড়ো নাবিকের প্রেমগীতি, খোন্দকার আশরাফ হোসেন-এর
কবিতার লাইন।
৭. সাক্ষাতকারটি দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকায় ২৭
নভেম্বর, ২০০০ তারিখে প্রকাশিত হয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন