শনিবার, ২২ জুন, ২০১৩

খোন্দকার আশরাফ হোসেন : কবি ও শিক্ষক

    জুনাইদুল হক
খোন্দকার আশরাফ হোসেন : কবি ও শিক্ষক
খোন্দকার আশরাফ হোসেন হঠাত্ করেই গত রোববার দুপুরে চলে গেলেন। স্ট্রোক-এ মারা যান তিনি। শোকের ছায়া নেমে আসে তার পরিবার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল জাতীয় কবি কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়, কবি ও ছোটকাগজ কর্মীদের মধ্যে। বয়স তেষট্টি হলেও চল্লিশ বছরের যুবকের মতোই চলাফেরা করতেন তিনি। এত তাড়াতাড়ি তিনি চলে যাবেন, আমাদের কারও ধারণায় তা ছিল না।

খোন্দকার আশরাফ হোসেন আমার শিক্ষক ছিলেন। বয়সে বড় ছিলেন মাত্র পাঁচ/ছয় বছরের। আমরা তার প্রথম দিকের ছাত্র। বৃহত্তর ময়মনসিংহের মানুষ আমরা দু’জনই। বিশ্ব-ভাবনাও প্রায় একই রকম ছিল। দু’মাস আগে ডেইলি স্টার-এ তাকে নিয়ে লিখেছিলাম। প্রাণবন্ত, বুদ্ধিদীপ্ত, উইটি মানুষ ছিলেন খোন্দকার আশরাফ হোসেন। ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা। বন্দুক হাতে যুদ্ধ করেছেন এমন কবি সব দেশেই অল্প কয়েকজন থাকেন। আমাদের আছেন রফিক আজাদ, আবিদ আনোয়ার, ইংরেজী ভাষার কবি কায়সার হক ও খোন্দকার আশরাফ হোসেন। কবিতা লিখতে শুরু করেন একটু দেরিতে, আশির দশকের শুরুতে, ত্রিশ বছর বয়সে পা দিয়ে। ছিলেন আমাদের অন্যতম সেরা কবি ও প্রাবন্ধিক, সম্পাদনা  করেছেন ‘একবিংশ’ অসামান্য ছোটকাগজ। পঁচিশ বছরের অধিককাল পত্রিকাটি বাঁচিয়ে রেখেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চল্লিশ ্বছর শিক্ষকতা করেছেন। ইংরেজি বিভাগের চেয়ারম্যান ছিলেন। সব বয়সী কবি ও লেখকদের সঙ্গে মিশেছেন বন্ধুর মতো। ছিলেন বিনয়ী ও সদালাপী। বাংলা একাডেমী চত্বরে বা আজিজ মার্কেটে দিয়েছেন আড্ডা। প্রিয় ছিলেন ছাত্র-ছাত্রীদের ও কলিগদের। তার তিন কন্যা ও একমাত্র পুত্রকে রেখে গেছেন শোকের সাগরে। নাতি নাতনীদের খুব ভালবাসতেন।
১৯৫০ সালে জামালপুরের জয়নগর গ্রামে জন্মেছিলেন খোন্দকার আশরাফ হোসেন। আটটি কবিতা সংকলন ও তিনটি প্রবন্ধের পুস্তক রেখে গেছেন আমাদের জন্য। অনুবাদ করেছেন সোফোক্লেস, ইউরিপাইডিস, পল সেলান ও টেরি ঈগলটন। তার কবিতা ইংরেজি, জার্মান, ফরাসি, তেলেগু ও হিন্দি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। দুই বাংলাতেই তিনি জনপ্রিয়  কবি ছিলেন। বাংলা কবিতার বরপুত্র শামসুর রাহমান তার কবিতা পছন্দ করতেন।
ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক হয়েও চলাফেরায় খাঁটি বাঙালি ছিলেন খোন্দকার আশরাফ হোসেন। কবিতা লিখেছেন তিন দশকের বেশি সময় ধরে। প্রচুর কবিতা লিখেছেন কিন্তু গভীরতাকে ছুটি দেননি কখনও। চিন্তাশীল এই কবি বাংলাদেশ, তার মিথ, তার ইতিহাস, তার রাজনীতি ও সমাজকে তুলে ধরেছেন। অস্তিত্ববাদী দর্শন ও সুফিবাদের পথেও হেঁটেছেন। লিখেছেন জন্ম ও মৃত্যুর মতো বিষয় নিয়ে, সময় ও অনন্তকাল নিয়ে। তার প্রেমের কবিতায় মিশেছে প্যাশন ও প্রজ্ঞা। নারীর দুঃখ-কষ্ট নিয়েও তিনি সোচ্চার ছিলেন। গভীর অন্তরদৃষ্টি নিয়ে বিচার করেছেন মানুষের জীবনকে। মন জয় করেছেন সিরিয়াস পাঠকের।
নির্বাচিত কবিতা, তিন রমণীর ক্বাসিদা, পার্থ তোমার তীব্র তীর, জীবনের সমান চুমুক ও জন্ম বাউল তার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। ১৯৮৭ সালে পেয়েছেন আলাওল সাহিত্য পুরস্কার। অল্প কিছুদিন আগে পেয়েছেন জীবনানন্দ দাশ পুরস্কার। ইংরেজি কবিতার একটি সংকলনও তিনি প্রকাশ করেছিলেন। পিএইচডি গবেষণা করেছেন বাংলাদেশের কবিতায় পাশ্চাত্য প্রভাব নিয়ে। নির্মলেন্দু গুণের নির্বাচিত কবিতা সম্পাদনা করেছেন। চমত্কার কিছু প্রবন্ধ লিখেছেন বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই। ২০০৬ সালে ঢাকা বিশ্বদ্যািলয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রী পেয়েছেন। যুক্তরাজ্য থেকে আরেকটি এম এ করেছিলেন ১৯৮১ সালে। ছিলেন সূর্যসেন হলের প্রভোষ্ট। ভালবাসতেন আধুনিক ইংরেজি ও মার্কিন কবিতা আর সাহিত্য তত্ত্ব পড়াতে। ‘তিন রমণীর ক্বাসিদা’ আশির দশকে একজন প্রতিভাবান কবির আগমন বার্তা ঘোষণা করে। আল মাহমুদ প্রবন্ধ লিখে তার প্রশংসা করেছিলেন। মিডিয়ার সহযোগিতা প্রথমে কম পেলেও পরে পেয়েছেন খোন্দকার আশরাফ হোসেন। ধীরে ধীরে প্রাপ্য খ্যাতি ও সম্মান আদায় করে নিয়েছেন। আমাদের অন্যতম সেরা কাব্যকণ্ঠ ছিল তার।
-

http://www.dainikamadershomoy.com/index.php/features/lekhalekhi/item/18277-%E0%A6%96%E0%A7%8B%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A6%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%86%E0%A6%B6%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%AB-%E0%A6%B9%E0%A7%8B%E0%A6%B8%E0%A7%87%E0%A6%A8--%E0%A6%95%E0%A6%AC%E0%A6%BF-%E0%A6%93-%E0%A6%B6%E0%A6%BF%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%B7%E0%A6%95.html

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন