শুক্রবার, ৯ এপ্রিল, ২০১০

কবি জফির সেতু'র কবিতা

দুধগাছ

দুধগাছ আমার মা;

না হলে বাবা কি করে আমাদের
এই বনের ভেতর পেলে-পুষে মানুষ করলেন

নাঙ্গা সময়ের নিচে শিশুদের ভাতের যোগাড় ছিল না;

জন্মেছি রোগা-পটকা আমরা ন’ভাই-বোন

মা ছিল হাড়-জিরজিরে কিন্তু বুকভরা দুধ
আমরা ন’ভাই-বোন স্তন চুষে স্তন খেয়ে;

দুধের ফেনায় পুড়ে পুড়ে মা আমার ধনুক আর

শস্যের দেবী হয়ে গমক্ষেতে সূর্যালোক হয়ে জ্বলে
ফলবতী মাটিতে বিষন্ন লাল ফুল হয়ে ঝরে;

মা আমার চিরহরিৎ, বাবা বিষগাছ--বড্ড হারামি!



সভ্যতা

মানুষের সফলতা অনেক
যেমন, মানুষ গম দিয়ে রুটি বানাতে পেরেছে।

মানুষ আগুনে সেঁকে রুটি খেতে শিখেছে
এমনকি সে বসে বসে হিসি করতেও পারে;
মানুষ অস্ত্র বানাতে ও চালাতে পারে এটাও তার
একটা সফলতা-- এটা মানতেই হবে।


বেহুলা

গাঙ্গুড়ের ঢেউয়ে ঢেউয়ে কলার মান্দাসে
চম্পাই নগরের কুলবধূ;

সঙ্গী তার মৃত-গলিত লখা; হতভাগ্য পুরুষ
উজানি নদীতে প্রমত্ত স্রোত, ভাঁড় ও বৃষভকুল
ব্রীড়ায় আনত দেহ, শোণিমা মুখ

হিন্তাল কাঠের লাঠি হাতে জেদী চম্পাই-নাগরী
ইন্দ্রের সভাতে;

নৃত্য-গীতে কাল কেউটের ফণায় প্রেম
কিরীট হয়ে জ্বলে

ভাসে সপ্তডিঙা মধুকর কালীদহে, গাঙ্গুড়ের জলে।


মন্দার

সমুদ্রমন্থন-জাত
হে কল্পতরু, তোমাকে নিয়েও
দেব-দানবে যুদ্ধ ;

পুরুষের প্রেমের প্রথম উপাচার হয়ে
স্বর্গ থেকে মর্ত্যে বিস্তার ;

কাঁটাতেও থাকে ফুল ও ফল

ক্ষুধা ও সৌন্দর্যে কে জানে
তোমার গহ্বর ?

দেবতারা মানুষ, তাদের কান্নার পাশে
মূঢ়-শবের রক্তও অমৃত নীল হয়ে ওঠে।


কর্কট

স্তন থেকে দুধ ছলকে পড়ছে
এই দুধ অনাগত শিশুর জন্য;

পদ্মযোনি থেকে রক্তপাপড়ি ঝরছে
এই আর্দ্রবীজ উন্মাদ পৃথিবীর জন্য;

মানুষের জন্য আমার এই শেষ চিরকুট।


প্রাকৃত

সাপ ও ময়ূরের মাঝখানে এক খঞ্জ নাচছে
এই দৃশ্যে এক শূদ্রের কন্যা হেসে ওঠে;
নাচের মুদ্রায় লোকটার নাভির ভেতর নাভি পদ্ম হয়ে ফোটে;
শূদ্রের কন্যা খঞ্জের প্রেমে পড়ে খুন হয়ে যায়
তারা দুইজন দৃশ্যত সাপ ও ময়ূরের মাঝখানে।


হেমন্ত

ধানের দুধের গন্ধে ছেয়ে গেছে মাঠ
হলুদ সর্ষের ফুলে বনের শেষ মধু;
ষাঁড় ও শালিকের পাশে বিমুগ্ধ আমি
হেমন্তের ছুরি দিয়ে বিঁধি সুপক্ব ফল
তার উজ্জ্বল-বর্ণ আঁশ, সুমিষ্ট ঘ্রাণ;

সবিস্ময়ে লক্ষ করি এই দেহ কবে

যেন ছিল রসালো শস্যের দানা, দুধগাছ।


মৃত্যু

মৃত্যু হচ্ছে বাদাম গাছ;
ঝুরা মাটির গহ্বর থেকে কিছু দুষ্ট বালক
তাকে উপড়ে ফেলে দিয়েছে শূন্যের ভেতর;
মৃত্যুর বাদামগাছ বালির ভেতর আবার
তরুণীর জলদ ঘ্রাণ হতে চাইছে।


গরম হাত

প্রতিটি গরম হাতে লুকিয়ে আছে একটি কবর;
সন্ধ্যেবেলা উষ্ণ রুটির সাথে মোরগের ফ্রাই
আর নারীর নাভির ভেতর রক্তের ক্ষিপ্ত যে-আয়ু
ঘুম ও ভুট্টার দেহের পাশে এই উদ্গম, লড়াই
মাংসল বেদনার মতো সংক্রামক বটে;
মানুষের দেহে চূড়ায় আঘাতদায়ী যে-মুগ্ধউষ্ণ ঋতু
তারও ভেতর এক গরম হাতের কবর শুয়ে আছে।


তোমাকে জিগাই

মা নিষাদ আমাকে জিজ্ঞেস করেছে
প্রতিটি পঙ্ক্তি রচনার আগে
তুমি হত্যাদৃশ্য দেখ কি-না
তোমার হাঁটুর নিচে রক্ত লেগে আছে কি-না
তোমার উরুর মাংসে যজ্ঞ দাও কি-না
আমি বোকার মতো নীরব থেকেছি আর
মা নিষাদ আমাকে আবার অন্ধকার জঠরে টেনে নিয়েছে;
তোমাকে জিগাই--
মা নিষাদ তোমাকে আর কী কী জিজ্ঞেস করেছে?



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন