কামরুল হাসান
পর্যটকের ডায়েরী
বিদেশে গেলেই তার দুই-পা লম্বা হয়ে ওঠে
এক-একটি নক্ষত্র ঢাকে লম্ফমান পায়ের তালুতে
কামনার বড়শিতে গেঁথে নেয় মঙ্গোলীয় মাছ
জাভার সমুদ্রতীর ঢেকে রাখে হাতের ডিবায়
সুনামী জেনেও খুব নেমে পড়ে বালির সাগরে
অনন্ত সুডৌল সারি খরবাণ যৌবনের তেজ
সমস্ত তুলিয়া রাখে স্মৃতিময় চোখের ডিবায়
চঞ্চল পায়েরা ঘোরে সোমমত্ত পাড়া ও ঘোড়ায়।
দূরে যে প্রদীপ আছে ম্রিয়মান মুখ
সুদূরে বেদনাহত পথ চাওয়া সুখ
আপন বুকের পাখি ওম নিয়ে বাঁচে
বাবা তুমি নিরাপদে ফিরে এসো কাছে
তোমাকে প্রলুব্ধ করে মঙ্গোলীয় রূপ
গ্রীবা খাঁজে ঢেলে দেয়া বালির স্বরূপ
নিভে আসা জালে কত রূপালী রোহিত
প্রখর সে রৌদ্র বুঝি প্রাণঘাতী খুব।
ফিরে যে পৃথিবী দেখি একান্ত আমার
কেবল পুস্তক নয়, ছাত্র আছে হাজার হাজার
তারা তো শিক্ষা নিতে মনোযোগী খুব
সারি বেঁধে বসে থাকা নতমুখী ছাত্রীর রূপ
বলে, আমাদের চোখ চীনাদের চেয়েও আয়ত
আমাদের প্রাণে প্রাণে ভারতীয় মধুর সানাই
বাঁশি সুর সরে গেছে, বন্ধুর তবু দেখা নেই।
দেখি পৃথিবী আমার ঘরে চুপ করে বসে আছে আজ
দেখি সে রূপের ঢলে মত্ত হয় গৃহিণীর সাজ
আমার পর্বতগণ সুশ্রী খুব উপরন্তু গাছেরা সবুজ
ওরাও বিনম্র চোখে গভীর তাকায়, মধু স্বর ছুঁড়ে দেয়
বাংলার আকাশে ভাসে কি আশ্চর্য মেঘের গম্বুজ।
আমরা ভিন্ন জাতি, প্রমোদের ভিন্ন কলা জানি;
তোমাদের দুরন্ত উড়ন্ত লোভে ঘূর্ণিরত অবিরল ছবি
উপুড় রয়েছি দেখ কলসির মত্ত রূপে জলে
পান করো, সিক্ত হও, কেন ওরা ছুটে ছুটে আসে
সাদার জগৎ ছেড়ে জাভার পর্বতে আর বালির সাগরে?
সব পর্যটনপ্রিয় মানুষেরা ফিরে যায় ঘরে
সুন্দানিজ মেয়েদের রূপরঙ নিঙ্ড়ে নিঙ্ড়ে চেখে
প্রাচীন আপন ঘরে কৈবর্তের রূপালী ইলিশ চেনা খুব
তবু তারা চকচকে চোখে শুধু পাখির আগ্রহ জ্বেলে রাখে।
দেখেÑ সকল শিশুর মাঝে প্রিয়তর আপন আত্মজ
আত্মজার টান ঐ রূপশালী ধানভানা রমণীর চেয়ে
তীব্র খুব, দেখে তার নিজস্ব জগৎ হঠাৎ ঝুঁকির মুখে
পড়ে যেতে পারে, সমুদ্র উঠেছে ফুঁসে সুমাত্রার কূলে।
বিদেশে চোখের মর্ম, সুরমার কাজল গড়ায়
বিদেশে দিগন্ত হ্রদে অপরূপ ব্রিজেরা চমকায়,
অথচ আপন দেশে বিদেশের কত মূর্তি ঘোরে
এবং সকল বৃক্ষে অনবদ্য সবুজাভা দোলে
আকাশ একই নীল জলে আছে মাছের সাঁতার
বাঙালী ললনা ধরে সুমাত্রীয় বোনের বাহার।
পাহারা ডিঙিয়ে তারা চলে যায় পাহাড় চূড়ায়
স্তনবৃন্তে দীপ জ্বেলে ঊরুদের ভেলা চড়ে যায়
কেননা অর্থকড়ি কিনে আনে প্রমোদের রানী
ছড়াও রূপালি মুদ্রা রূপেরাও গড়াবে এক্ষুণি।
তক্ষুণি জেনে যাবে দেশে ও বিদেশে নেই ভেদ
জনে জনে পৃথিবীতে বৈচিত্রের অযুত সম্ভার
তাদের সামন্ত ভিন্ন কলা নেই আর্তস্বর নেই
চিৎকারে শীৎকারে তারা ভরে দেয় গোপন তল্লাট।
ওরা তো বেঁধেছে চুল সুডৌলের খোঁপা বেঁধে বেঁধে
বসাল সুদূর পথ উঁচু করে দৃশ্যমান ফ্লাইওভারে
নান্দনিক উচ্চনাসা জাকার্তার উঁচু দালানেরা
গর্বিত ঠমক হেনে দৃষ্টির মুগ্ধতা কেড়ে নেয়
দ্বীপে দ্বীপে উড়ে যায় আকাশ বাহন
দ্বীপে দ্বীপে মূর্তিমান মনুষ্যপ্রবর
জলে ঢলে কোমরের সমান প্রলয়
প্রণয়ে পীড়িত ওরা জানে প্রাণে গভীর প্রণয়।
সেখানে যন্ত্রের মত মেলে রাখে উড়ালের পথ
সেখানে পাহাড় যেন উদ্বেলিত সুউচ্চ স্তন
সেখানে মীমাংসা খুব জনে জনে পানীয়ের রঙে
তোমাকে শায়িত করে আকাশের ধ্র“বতারা ঢালে
কত যে ইঙ্গিতময় হাসি, কত ফেননিভ বিছানারা পাতা
মধুর চতুর সব ফাঁদ পাতা আছে সারিসারি
দ্রাক্ষারসের চেয়ে মধুতর মদ্যে গড়াগড়ি
তোমাকে ভেজাতে আছে দুগ্ধ সরোবর।
পর্যটনপ্রিয় দেশে দলে দলে এসেছে নাবিক
ডোডো পাখীদের মত মেয়েমানুষের মাংশ ভালবেসে
এখন শিকারী নব সুনামীয় ভীষণ তালুতে
প্রমত্ত থাবায় তুলে উগড়ে দেবে লীলাহীন খাটে।
বালির সৈকত জুড়ে পৃষ্ঠাময় নীলের স্বরূপ
অন্ধকারে কবরে ঐ যায় তারা সুন্দনিজ রূপ
সমুদ্র গর্জন আনে কঙ্গোর নিভন্ত আলোয়
যদিও সোমত্ত খুব প্রমত্তের প্রমোদ বিলোয়।
ঐ গণিকাদের রক্ষা করো প্রভূ, ওরা পরীদের বোন
জড়িয়ে মৃত্যুর বীজ ঘরে তোলে দ্রোণ
জীবন ও মৃত্যুর গলাগলি ধরে শুয়ে থাকে তারা
নম্র আর আমোদের নরোম শয্যায়
ওদের ভিন্ন ক্ষুধা, পর্যটকের চেয়েও মৌলিক
মুদ্রা কত নর্তকীর বসনের মুদ্রা খুলে দেয়
কড়ির দুরন্ত রথে নিয়ে যায় ক্ষুদ্র পরিসর
প্রেমিক জড়াবে আর ঢেলে দেবে গূঢ়তর বিষ।
দ্বীপসারি থেমে গেলে উড়ে চলা মেঘের মেয়েরা ..
বলে সে আরেক দেশে ভিন্নরূপ পায়ের সরাই
কেবল বর্ধিত হয় অন্য ঘড়া, প্রাণের ঘড়াই
বুঝি সব স্বপ্ন এক, বহুনিম্নে জাহাজের দীপ।
নিজের ভুবনে ফিরে দেখে তার সকলি অটুট
কেবল ভেঙ্গেছে সে রূপভর্তি দেহের কপাট
তার বহুগামী মন পৃথিবীর দেশে দেশে ঘোরে
বেঘোর মনের মত আশাতীত দর্পণের ছবি
জাভার পর্বত জুড়ে পুবের অজস্র মোমবাতি।
প্রজাপতি চিত্রিত বিচিত্র শত উড়ে উড়ে আসে
ঠাঁসবুননের গাঢ় সূচরীতি অনুপঙ্খ কত নকশায়
পৃথিবীর যত রঙ দ্যুতিময় রঙে মিশে গেলে
ফুটে ওঠে ছায়ারঙ আর অভিনব ছায়াপথ
সে সব পথের শেষে মোহনীয় অন্যসব পথ
উত্তপ্ত সে উরুর ভেলায় চড়ে দেখেছি পর্বত।
তারা বীক্ষণে ও বিজ্ঞাপনে তীক্ষè ইশারায়
ডাকে আর দেখায় নরোম ষ্ফীতি পদ্মভার তার
মাইল মাইল জোড়া সর্ষেক্ষেত মুঠো ছুঁয়ে থাকে
এখানেও রবিশস্যÑ বাঙলার বসন্তে যা ফোটে।
পুরাকালে আন্দামানে যেত কত পাপী ও বিপ্লবী
সন্ন্যাসী শতেক বড়বুদুরের মঠে ঘোরে সহিসের সাথে
চপলা যোনির মৌন ইশারায় ডাকা যত পাখি
প্রভাতে হাওয়ার ঢেউ প্রবাল বদ্বীপে এসে পড়ে।
তখন আকাশজুড়ে উঠেছে বিলাপ, সব পড়ে থাকে নিচে
এ্যালুমিনিয়মের ডানা নিয়ে আসে নিজ পৃথিবীতে
নম্র সহচরী শিশুদের মুখ সবচেয়ে প্রিয়তর তবু
বিদেশের ভ্রমে প’ড়ে স্বদেশ ভুলিয়া কত কাদা মাখি মুখে
ভালবাসি যত ভালবাসাবাসি পৃথিবীর দূর পথে পথে
বোনেরা সখীরা গলাগলি ধরে বসে আছে কতশত রথে
আকাশবিমানযানে উড়িয়া ছুটিয়া ট্রেন চলে অবিরাম
বুঝিবা সে সোনালী প্রদেশে দিবানিশি ঝরে ঘাম।
তাই ছুটে চলি শুধু, নতুন অভিজ্ঞা নিয়ে ভয়ে দিই পাড়ি
জানি না এমন বজ্রপাতে মাথা হবে কি চৌচির
দেশের মায়াবী মুখ জলে সেই হ্রদের ছবিটি বুকে ধ’রে
দ্বীপে দ্বীপে উড়ে যায় ডাঙ্গাপ্রেমী আকাশ বাহন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন