শুক্রবার, ৯ এপ্রিল, ২০১০

শতাব্দী পেরিয়ে সহস্রাব্দে- বিংশ পেরিয়ে একবিংশে : কামরুল হাসান

কামরুল হাসান
একবিংশের সাথে আমার প্রথম যোগাযোগ ৯০-এর দশকের প্রথম ভাগ থেকে। এর সেপ্টেম্বর ’৯১ সংখ্যায় আমার পাঁচটি কবিতা প্রকাশের মধ্য দিয়ে। এর সম্পাদক খোন্দকার আশরাফ হোসেনকে তখন আমিই স্বল্পই চিনতাম, দূর থেকে তাঁকে দেখেছি তেমন কোন কথাবার্তা হয়নি, একুশের বই মেলায় শুভেচ্ছা বিনিময় ছাড়া। তাঁকে প্রথম দর্শনে আমার কাছে এক অনতিক্রম্য দূরের মানুষ বলে মনে হয়েছিল, যার কাছাকাছি যাওয়া দূরূহ বিশেষ করে যখন জানতাম তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালর্য়ে ইংরেজী বিভাগের একজন শিক্ষক এবং ইতিমধ্যেই কবি ও প্রাবন্ধিক হিসাবে তুমুল পরিচিত। মেধাবী ও উন্নাসিকÑ এই চিত্রটিই আমার কাছে প্রতিভাত হত। তার সম্পর্কে আমার কলেজ জীবনের সহপাঠী আজফার হোসেনের কাছে জেনেছি এবং বন্ধুর মতই তার শিক্ষককে দূর থেকে সমীহ করতাম।

১৯৯১-এর আগেই একবিংশ লিটল ম্যাগাজিন পরিমণ্ডলে বিখ্যাত ও সমীহ আদায়কারী এক পত্রিকা হয়ে উঠেছিল। তখনকার তরুণ কবিরা প্রায় সবাই এ পত্রিকায় লেখা দিতে উন্মুখ ছিল। সে সময়ে ‘গাণ্ডীব’, ‘নদী’ প্রভৃতি পত্রিকার যৌবনকাল, সে সব যদিও কোন কোন গোষ্ঠির পত্রিকা, একবিংশ কোন নির্দিষ্ট গোষ্ঠির প্রতিনিধিত্ব করত না, এটি ছিল এর সম্পাদকের নিজস্ব কাগজ। খোন্দকার আশরাফ হোসেন লেখা ছাপতেন নিজস্ব মানদণ্ডেই, লেখকের সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয়ের সূত্রে তেমন প্রকাশিত হয়েছে বলে শুনিনি, যদিও লেখালেখির সূত্রে ব্যক্তিগত পরিচয় গড়ে উঠতে পারে। তিনি সচেতনভাবেই পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের সিনিয়র কবিদের, বিশেষ করে যারা বহুল প্রচারিত, তাদের লেখা (কবিতা) না ছাপানোর একটা নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এছাড়া সত্তর দশক তাকে টানেনি বলেই সে দশকের কবিদের কবিতা তিনি আগ্রহ নিয়ে মুদ্রিত করেননি। যে দশকটিতে তিনি নিজে লেখালেখি শুরু করেছিলেন সেই আশির দশককে ঘিরে ছিল তার প্রাথমিক আয়োজন, পরে যা প্রবলভাবে নব্বই দশককে তুলে ধরে, আর এখন শতাব্দী পেরিয়ে প্রতিশ্র“তিশীল নবাগতদের লেখাকে আশ্রয় দিচ্ছেন তার পত্রিকার পাতায়।

একবিংশ-র সেপ্টেম্বর ১৯৯১ সংখ্যায় আমার পাঁচটি কবিতা ছাঁপা হয়। ঐ পাঁচটি কবিতা মুদ্রণের মাধ্যমে একবিংশের সাথে আমার সম্পৃক্ততা। মনে আছে সে সময়ে ঐ প্রকাশনা আমাকে খুব আনন্দিত ও গর্বিত করেছিল। কেননা যদিও আমি ৮০র প্রথম দিক থেকেই লেখালেখি করছি, দীর্ঘ চার বছর ভারতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াশুনা করতে গিয়ে আমি এখানকার পত্র-পত্রিকা ও লেখক গোষ্ঠি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলাম। যদিও আমার লেখা ইতোমধ্যে কলকাতার ‘দেশ’ ও শিবনারায়ণ রায় সম্পাদিত ‘জিজ্ঞাসা’ পত্রিকায় একাধিকবার প্রকাশিত হয়েছিল, তবুও বাংলাদেশের কাব্যপরিমণ্ডলে আমি স্বল্পই পরিচিত বা অপরিচিত ছিলাম। ফিরে এসেও যদিও লিখেছি, তেমন কোথাও আমার লেখা ছাপতে দেইনি।

সেই বিচারে একবিংশে ঐ প্রকাশনা ছিল অভূতপূর্ব। ইতোমধ্যে ঐ বছর বইমেলায় আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সহস্্র কোকিলের গ্রীবা’ বেরিয়ে গেছে। তবুও এখানকার পাঠক দূরে থাক, বিজ্ঞ কবিসমাজ বিশেষ করে লিটল ম্যাগের আঁতেল কবিরা প্রায় কেউই আমাকে চেনে না, পাত্তাও দেয় না। এমনি এক সময়ে আমাকে তাঁর ঈর্ষণীয় পত্রিকাটিতে খোন্দকার আশরাফ হোসেন তুলে নিলেন। আশ্চর্য যে, এর পর থেকে একবিংশের একটি বা দুটি সংখ্যা বাদ দিলে আমি এর নিয়মিত লেখক হয়ে উঠি। সে সময়ে একবিংশে কবিতা মুদ্রণ ছিল স্বপ্নের মতো এবং তা যে-কোন তরুণ কবির জন্য স্বীকৃতি পাওয়ার মতো মর্যাদাপূর্ণ। আশ্চর্য যে, তরুণ কবিদের জগতে এখনও এই যাদুটি খোন্দকার আশরাফ হোসেন ধরে রাখতে পেরেছেন। প্রতি সংখ্যাতেই তিনি এক গুচ্ছ নবীন কবিকে কাব্যপরিমণ্ডলে পরিচয় করিয়ে দেন এবং দেখা যায় তার সনাক্তকরণ প্রায়শই ভুল হয় না। একবিংশের পাতায় প্রথম আত্মপ্রকাশ করেছে এবং পরবর্তীতে বিখ্যাত হয়ে উঠেছে এমন কবির সংখ্যাই বেশি। বাংলাদেশের যে কোন লিটল ম্যাগের তুলনায় এই প্রতিভা সনাক্তকরণের কাজটি খোন্দকার আশরাফ হোসেন সবচেয়ে সফলভাবে করেছেন।

পত্রিকাটির সুনাম ছড়িয়ে পড়ছিল বাংলাদেশ ছাড়িয়ে পশ্চিমবঙ্গেও; সেখানে যে দু-একটি বাংলাদেশী লিটল ম্যাগাজিন নিয়মিত পৌঁছাত এবং কলেজ ষ্ট্রিট-এর পাতিরাম বুক ষ্টল থেকে বিক্রি হত, একবিংশ ছিল তাদের অন্যতম। এর উন্নত মান ও সম্পাদনা আকৃষ্ট করেছিল কলকাতাকেন্দ্রিক কবিগোষ্ঠিকে। বাংলাদেশের কবিতা সম্পর্কে তাদের ধারণাও পাল্টাতে শুরু করেছিল। এরই স্বীকৃতি হিসেবে একবিংশ লিটল ম্যাগাজিন পশ্চিমবঙ্গ থেকে সম্মাননা লাভ করে।

একবিংশ শুরু থেকেই কবিতাকেন্দ্রিক সাহিত্য পত্রিকা। সেপ্টেম্বর ৯১ মে সংখ্যায় এর স্লোগান ছিল ‘কবিতা ত্রৈমাসিক’। এতে লিখেছিলেন আশির দশকের মঈন চৌধুরী, মাসুদ খান, সরকার মাসুদ; নব্বইয়ের বায়তুল্লাহ্ কাদেরী, আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ, সরকার আমিন, শাহানাজ মুন্নী প্রমুখ। ঠিক এক বছর পর ঐ সেপ্টেম্বর মাসেই এর পরবর্তী সংখ্যা বেরোয়। তারপরে কি করে যেন কবিক্রমের তালিকায় আমার নামটি প্রথমেই উঠে আসে। পরে আরও কিছু সংখ্যায় একই ব্যাপার ঘটে। পরে খোন্দকার আশরাফ হোসেনের সাথে আলাপ করে জেনেছি এই কবিক্রম তিনি ঠিক করেন লটারীর মাধ্যমে। ঐ সংখ্যায় আমার টানা গদ্যে লেখা পরবাস্তব কবিতার একটি সিরিজ ‘বিনিদ্র রাতের এন্টেনা’ প্রকাশিত হয়। আমার জন্য এটি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনা। এতে মোট ১৪টি কবিতা ছিল। সে সময় অনেক তরুণ কবিকে তা মুগ্ধ ও প্রভাবিত করেছিল। এ সংখ্যাতেও আশির সরকার মাসুদ, সুব্রত অগাষ্টিন গোমেজ ছাড়াও নব্বই দশকের রনক মোহাম্মদ রফিক, বায়তুল্লাহ কাদেরী প্রমুখের কবিতা ছাপা হয়, আর ছাপা হয় বেশ কিছু বিদেশী কবির ভূমিকা সহ কবিতার অনুবাদ। নাজিম হিকমত, এমিলি ডিকসন, ওক্তাবিয়ো পাসের কবিতার অনুবাদ করেছিলেন যথাক্রমে দাউদ আল হাফিজ ও সুব্রত অগাষ্টিন গোমেজ। প্রবন্ধ লিখেছিলেন তপোধীর ভট্টাচার্য, খোন্দকার আশরাফ হোসেন ও মঈন চৌধুরী।

১৯৯৩ সনের মে মাসে প্রকাশিত সংখ্যায় আমার তিনটি কবিতা মুদ্রিত হয়। এ সংখ্যার আকর্ষণ ছিল বায়তুল্লাহ কাদেরীর ‘শীতাভ সনেটগুচ্ছ’র প্রকাশ, যা পরে বাংলা একাডেমির তরুণ লেখক প্রকল্প থেকে বই আকারে প্রকাশিত হয় ও পুরস্কৃত হয়। একবিংশের একটি নিয়মিত বিভাগ হচ্ছে কবিতাবিশ্ব। এ সংখ্যার কবিতাবিশ্বে পাউল সেলানের কবিতার অনুবাদ করেন সম্পাদক নিজেই। প্রায় প্রতি সংখ্যাতেই বিদেশী সাহিত্যের (মূলত কবিতা ও কবিতাবিষয়ক গদ্য) অনুবাদ করতে থাকেন খোন্দকার আশরাফ হোসেন। বস্তুত আজ বিদেশী কবিদের কবিতা অনুবাদের যে ঢল নেমেছে তা বহু বছর পূর্বে নিভৃতে এবং ধারাবাহিকভাবে একবিংশের পাতায় শুরু করেছিলেন খোন্দকার আশরাফ হোসেন। মঞ্জুভাষ মিত্র ও সালাহউদ্দিন আইয়ুবের প্রবন্ধ এবং আরও কিছু প্রবন্ধ নিয়ে সংখ্যাটি সমৃদ্ধ। কবিতা লিখেন আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, সরকার মাসুদ, খোন্দকার আশরাফ হোসেন, পাবলো শাহী প্রমুখ।

প্রচ্ছদের আঙ্গিকের দিক থেকে সেপ্টেম্বর ’৯১ ও সেপ্টেম্বর ’৯২ সংখ্যার মধ্যে যথেষ্ট মিল দেখা যায়, তেমনি ১১ ও ১৩ সংখ্যার ভেতর সাযুজ্য চোখে পড়ে। ১১তম সংখ্যা থেকেই একবিংশের কলেবর বেড়ে যায়্, প্রকাশিত হতে থাকে আরো আরো কবির কবিতা। এ সংখ্যায় আত্মপ্রকাশ করেন নব্বই দশকের কয়েকজন উল্লেখযোগ্য কবিÑ তুষার গায়েন, খলিল মজিদ, পাশু প্রাপণ। খোন্দকার আশরাফ হোসেনের টেরি ঈগলটনের ‘সাহিত্যতত্ত্ব’-র প্রবন্ধের ধারাবাহিক অনুবাদ, অঞ্জন সেনের কবিতার ভাষা নিয়ে প্রবন্ধ, সালাহউদ্দিন আইউবের পোষ্টমর্ডানিজম নিয়ে লেখা সংখ্যাটিকে সমৃদ্ধ করেছিল। কবিতা ছাড়াও নিবন্ধ লিখলেন সরকার মাসুদ, আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ ও বায়তুল্লাহ কাদেরী। এ সংখ্যাতেও ঐ লটারীর সংখ্যা সৌভাগ্যে আমার কবিতা সবার প্রথমে মুদ্রিত হয়। এ সংখ্যায় প্রথম আত্মপ্রকাশ করেন রায়হান রাইন। পাউল সেলানের আরো কবিতা অনুবাদ করেন খোন্দকার আশরাফ হোসেন। পশ্চিমবঙ্গের শক্তিমান কবি রণজিৎ দাশের কবিতা নিয়ে প্রবন্ধ লিখেন সমরেশ দেবনাথ।

১৪তম সংখ্যা থেকেই খোন্দকার আশরাফ হোসেন একবিংশের পাতায় একগুচ্ছ নতুন কবিকে আত্মপ্রকাশের সুযোগ করে দিলেন। এ সংখ্যায় কবিতা লিখেন মোট ১৯ জন কবি, যা থেকে একবিংশে কবিদের পদচারণা বা তাদের জন্য বরাদ্দ স্পেস যে বাড়ছে তার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। বস্তুত সে সময়টায় একবিংশ হয়ে উঠেছিল সকল মেধাসম্পন্ন নবীন কবির পদচারণার ক্ষেত্র। একবিংশে ইতোমধ্যে যাদের লেখা মুদ্রিত হয়েছে সে সকল কবিরা ছাড়াও নতুন কবিতা লিখেন কুমার চক্রবর্তী, সৌভিক রেজা, তাপস গায়েন, রোকনুজ্জামান রবার্ট প্রমুখ কবিগণ। এ সংখ্যায় একবিংশে নবাগত কবি হলেন মুজিব মেহেদী, হামিদ রায়হান, এবরার হোসেন ও সাজ্জাদ আহমেদ।

১৫তম সংখ্যায় নবাগত কবিরা হলেন জাহাঙ্গীর কবির, মেহেদী মাহবুব, মঈনুল আবেদীন ও আশরাফ রোকন। এ সংখ্যায় নব্বই দশকের বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য কবি কবিতা লিখেন। এরা হলেন টোকন ঠাকুর, খলিল মজিদ, আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ। আমার তিনটি কবিতা মুদ্রিত হয় এই সংখ্যাটিতে। তিন জন বিদেশী কবিকে স্মরণ করেন সম্পাদক : এঁরা হলেন জন কীট্স, সের্গেই ইয়েসেনিন ও স্টিফেন স্পেদ্তার। এছাড়াও স্মৃত হন শক্তিমান কবি শক্তি চট্টোপাধায়। এডওয়ার্ড সাঈদ ও উত্তর উপনিবেশিক কাউন্টার ডিসকোর্স এর উপরে প্রবন্ধ লিখেন ফকরুল আলম, রোমান্টিক কবিতার স্বরূপ নিয়ে প্রবন্ধ লিখেন খোন্দকার আশরাফ হোসেন। এ সংখ্যায় গুচ্ছ কবিতা লিখেছেন একগুচ্ছ কবি। কবিতাবিশ্বে সিলভিয়া প্লাথ, শেমাস হীনির কবিতার ভূমিকাসহ অনুবাদ প্রকাশিত হয়। বায়তুল্লাহ কাদেরীর ‘বর্ষালী চতুর্দশপদী’ এ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।

নভেম্বর, ১৯৯৬ সালের সংখ্যাটি একবিংশের ১০ বছর পূর্তি সংখ্যা। একবিংশে নবাগত নব্বই দশকের কামরুজ্জামান কামু, মোস্তাক আহমদ দীন, মামুন নেসার মাহমুদ, লিটন ওয়ারেস প্রমুখ এ সংখ্যায় কবিতা লিখেন। ‘আসমানী কবিতাগুচ্ছ’ শিরোনামে মাসুদ খান, তুষার গায়েন ও রণক মুহম্মদ রফিক এর তিনটি র্দীঘ কবিতা প্রকাশিত হয়। আসামের বরাক উপত্যকার কবিতা নিয়ে একটি ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হয় এ সংখ্যায় যেখানে আসামের বসবাসরত বাঙালী কবিদের কবিতা মুদ্রিত হয়। এ সংখ্যায় প্রবন্ধ লিখেন তপোধীর ভট্টাচার্য ও তুষার গায়েন। এছাড়া গত দশ বছরে একবিংশে প্রকাশিত লেখা সমূহের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরা হয় রেফারেন্স হিসেবে যা চমৎকার। এ সংখ্যায় আমার চারটি কবিতা মুদ্রিত হয়। আমার একটি ব্যর্থতা হল একবিংশের প্রায় দুই যুগ ধরে প্রকাশিত সংখ্যাগুলোতে নিয়মিত ভাবে গুচ্ছ কবিতা মুদ্রিত করলেও কোন গদ্য লিখতে পারিনি।

জুলাই, ১৯৯৭ সংখ্যায় অন্য আরও অনেক কবির সাথে আমার চারটি কবিতা মুদ্রিত হয়। প্রবন্ধ, কবিতা, অনুবাদ, গ্রন্থ সমালোচনা মিলিয়ে এক অনুপম সংখ্যা এটি। তপোধীর ভট্টাচার্যের ‘চেতনার নবধ্বনি’, মঈন চৌধুরীর ‘ফুকোর মানব’ উল্লেখযোগ্য। ‘অনঘ এন্টেনায়’ ত্রিপুরার আগরতলার পাঁচ জন কবির কবিতা মুদ্রিত হয়। কবিতাবিষয়ক প্রবন্ধ লিখেন খলিল মজিদ, সালমা আজিজ, আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ প্রমুখ। গ্রন্থানুচিন্তনে দুজন তরুণ কবি চঞ্চল আশরাফ ও জেনিস মাহমুনের বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থদ্বয়ের উপর আলোচনা লিখেন খোন্দকার আশরাফ হোসেন।

আঠারতম সংখ্যাটি ষাটের দশকের অত্যন্ত প্রতিভাবান, অকালপ্রয়াত কবি আবুল হাসানের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নিবেদিত। এ সংখ্যায় আমার ’রুমা সিরিজ’ শীর্ষক সিরিজ কবিতা মুদ্রিত হয়, যা পরে আমার সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ ’রূপচৈত্রের অরণ্যটিলায়’ প্রকাশিত হয়।

২০তম সংখ্যাটি ত্রিশের পঞ্চপাণ্ডবের একজন অমিয় চক্রবর্তীর জন্মশতবার্ষিকী স্মরণে নিবেদিত। এ সংখ্যায় আমার ‘রূপচৈত্রের অরণ্যটিলায়’ সিরিজ কবিতা মুদ্রিত হয়। এতে কবিতা ছিল মোট আটটি তবে সবই সংখ্যানুক্রমিক, সব মিলিয়ে এটি একটি দীর্ঘ কবিতা। অনেক দিন পর একবিংশে প্রকাশিত নিজের লেখার দিকে যখন তাকাই তখন দেখতে পাই আমার সেরা লেখাগুলোই আমি একবিংশে পাঠিয়েছি। আগে যেখানে বিচ্ছিন্ন কবিতা লিখতাম পরে সিরিজ কবিতার দিকে ঝুঁকে পড়ি। এ সংখ্যা থেকে একবিংশের অবয়ব পাল্টে যেতে থাকেÑ প্রচ্ছদে জুড়ে দেয়া হয় ভারতের চিত্রশিল্পী অপর্ণা কাউর এর চিত্রকর্ম। একবিংশের শরীরও একটু পৃথ্বুল হয়ে উঠে। আটজন নবাগত কবির কবিতা মুদ্রিত হয় এতে। এ সংখ্যায় ইংরেজ কবি টেড হিউজের ‘কাক’ নিয়ে একটি অসামান্য প্রবন্ধ লিখেন খোন্দকার আশরাফ হোসেন। কাকের স্কেচগুলো আঁকেন শিল্পী আবদুস সালাম।

বিংশ শতাব্দী পেরিয়ে একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে ত্রিশ দশকের কল্লোল-পরবর্তী যুগের পাঁচ মহারথীর জন্মশতবার্ষিকীর দেখা মিলতে থাকে। বাংলা কবিতার ঐ মহান কবিদের এক এক করে স্মরণ করে একবিংশ। অমিয় চক্রবর্তীর পর মে, ২০০১ এর সংখ্যাটি নিবেদিত হয় সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে । এ সংখ্যায় আমার ‘জলেস্থলে ঈশ্বর’ সিরিজ কবিতাটি মুদ্রিত হয়। এ সংখ্যা থেকে একবিংশের প্রিন্টার্স লাইনে আমার নাম সহকারী সম্পাদক হিসেবে মুদ্রিত হতে থাকে। আমি একবিংশের সাথে আরো ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হয়ে পড়ি।

কেবল নিজের লেখা দিয়ে নয়, লেখা সংগ্রহের ধৈর্যশীল কাজ, সে সবের সম্পাদনা, তাদের প্র“ফ রিডিংয়ের মত বিরক্তিকর কাজ প্রভৃতি ছাড়াও কখনো কখনো একাধিক ছদ্মনামে প্রবন্ধ লিখেছেন, গ্রন্থ সমালোচনা করেছেন এর সম্পাদক খোন্দকার আশরাফ হোসেন। সবচেয়ে আশ্চর্যকর যে কেবল লেখালেখিই নয় একবিংশের অনেক সংখ্যার প্রচ্ছদশিল্পীও তিনি নিজেই, যদিও তিনি নিজেকে ছদ্মনামের আড়ালে লুকিয়ে রেখেছেন। এ থেকে বোঝা যায় খোন্দকার আশরাফ হোসেন একবিংশের সাথে কতখানি মানসিক, সৃজনশীল ও বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে সম্পৃক্ত। মূলত এটি তারই আত্মজ। এর সাফল্যের শতভাগ কৃতিত্ব খোন্দকার আশরাফ হোসেনেরই।

নব্বই দশকের একগুচ্ছ মেধাবী কবির আত্মপ্রকাশ ও বিকাশ ঘটেছে একবিংশের পাতায়। এরা হলেন তুষার গায়েন, আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ, বায়তুল্লাহ কাদেরী, খলিল মজিদ। যেমন আশির দশকের প্রতিভাবান কবি মাসুদ খান, সরকার মাসুদ, সৈয়দ তারিক বারংবার লিখেছেন এ কাগজে। একবিংশে লিখেই অনেক নতুন কবিমুখ যতখানি মনোযোগ ও পরিচিতি পেয়েছেন অন্য কোন কিছুতে তা পাননি।

কবিতা প্রকাশের হাত ধরেই পরিচিত হতে থাকি এর সম্পাদকের সাথে, পরে সেই পরিচিতি ঘনিষ্ঠতায় রূপলাভ করে। দেখেছি খোন্দকার আশরাফ হোসেনকে দূর হতে যতখানি দুর্বোধ্য বা অনতিক্রম্য মানুষ বলে মনে হয়, তিনি তেমন নন, বরং অপরিচয়ের পর্দা উঠে গেলে ঐ নিকটজনদের কাছে তিনি বেশ আন্তরিক ও খোলামেলা, তবে সহজপ্রবেশ্য কখনোই নন। নিজস্ব মতামত তিনি স্পষ্ট ও খোলাখুলিই প্রকাশ করেন, তাতে অনেকেই আহত হন, তবে এটা ঠিক খোন্দকার আশরাফ হোসেন ভণিতা পছন্দ করেন না। অনেক বুদ্ধিজীবির ভেতর যেমন একটি মেকী ভদ্রতার মুখোশ দেখা যায়, তেমন কোন মুখোশ বা পরিশীলন খোন্দকার আশরাফ হোসেনের নেই। তাঁর ব্যক্তিত্বের এই দিকটিকে রূঢ় বা ’রাষ্টিক’ বলে প্রতিভাত হতে পারে। তিনি কোদালকে কোদাল বলতেই পছন্দ করেন, অর্থাৎ ভণিতাবিহীন। অসম্ভব মেধাবী ও সৃষ্টিশীল হওয়া সত্ত্বেও তিনি তেমন অহঙ্কারী নন; যদিও পুরোনো দিনের নায়কদের মত উঁচু করে বাধাঁ ঝাঁকড়া চুলের এবং বিশিষ্ট মুখাবয়বের কবি মানুষটিকে অস্পর্শিত পাহাড়ের মত মনে হয়, তবে ব্যক্তিমানুষটি সরল।

প্রথমদিকে একবিংশের শ্লোগান ‘কবিতা ত্রৈমাসিক’ থাকলেও পত্রিকাটি কখনোই ত্রৈমাসিক হতে পারেনি, হওয়া বোধকরি সম্ভবও ছিল না, কেননা খোন্দকার আশরাফ হোসেন লেখালেখি এবং অধ্যাপনার যুগল ও জটিল কাজ ছাড়াও একটি বৃহদাকার পরিবারের কর্তা ছিলেন, তাকে সে সময়ে প্রাণপাত পরিশ্রম করতে হত সংসার চালাবার ক্রমবর্ধমান খরচ যোগাতে। পরে ঐ ব্যর্থতার তিলক অপসারণ করতেই একবিংশের শ্লোগান বদলে রাখা হয় ‘বর্তমান সময়ের কবিতার কাগজ’। এরও পরে একসময় আসে নতুন স্লোগান ‘কবিতা ও নন্দনভাবনার কাগজ’। প্রকাশের পর হতে ইতোমধ্যে পঁচিশ বছর পার হয়ে গেছে, লিটল ম্যাগাজিনের স্বল্পায়ু জগতে এ এক বড় সাফল্য। বিংশ শতাব্দীর শেষ ধাপে দাঁড়িয়ে আগামী শতককে সম্মুখে রেখে তিনি এর নামকরণ করেছিলেন একবিংশ। সে নামকরণে ছিল নতুন যুগের নতুন কবিতার আশাবাদ। একবিংশ কেবল একটি শতকই নয়, একটি সহস্রাব্দের শুরুও। নিরলস পরিশ্রম, মেধাদীপ্ত সম্পাদনা ও একাগ্রতার এক উজ্জল নিদর্শন একবিংশ। জয়তু একবিংশ!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন