শুক্রবার, ৯ এপ্রিল, ২০১০

একবিংশ ও নব্বইয়ের দশকের কবিতা : খলিল মজিদ

খলিল মজিদ
বিশ শতকের আয়ু ফুরিয়ে যাওয়ার মৃত্যুযন্ত্রণা বোধ করি আশির দশকের মধ্যভাগেই অনুভব করতে পেরেছিলেন খোন্দকার আশরাফ হোসেন। নইলে ১৯৮৫ সালেই কেন তার কাগজের নাম রাখবেন ‘একবিংশ’? এবং অচিরেই ১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতন্ত্রের পতনের মাধ্যমে বিশ্বে স্নায়ুযুদ্ধের তাড়না-নিস্তারে একক মার্কিন কর্তৃত্বাধীন বাজার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার প্রবর্তনে এবং তথ্যপ্রযুক্তির বিপুল বিস্তারে ইন্টারনেটের মায়াজালে গ্লোবালাইজেশনের আধুনিক-উত্তর ধারণাপ্রবাহ নিয়ে এগিয়ে আসে একবিংশ শতাব্দী। ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ এরিক হবসবাম কথিত ‘শর্ট টুয়েন্টিথ সেঞ্চুরি’র (১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মাধ্যমে অনেক দেরিতে সুচনা এবং ১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মাধ্যমে আগাম সমাপ্তি) ধারণা কবি হিসেবে খোন্দকার আশরাফ হোসেন আগাম উপলব্ধি করেছিলেন; তাই তাঁর কর্মযাত্রাটি শুরু করেন ভবিষ্যতের ইঙ্গিতবাহী নামাঙ্কনে। এবং ভবিষ্যতের কবিদের অর্থাৎ যারা কিনা একবিংশ শতকে কবিতা চর্চায় ও কবিখ্যাতিতে সময় আলোকিত করবেন তাদের কবিতাকে সনাক্ত করার জন্য অনেকটা জ্যোতিষবিদের মতো নাক্ষত্র গণনা করতে ব্যাপৃত হন।

প্রথম সংখ্যার সূচনাতেই ঘোষণা করা হয়, ‘একবিংশ শতাব্দীর দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছি আমরা; .. নতুন শতাব্দী, নতুন সময় এবং নতুন অভিজ্ঞতার বোধন ঘটবে। আমরা এবং কবিতা তখনো থাকবো; উন্মার্গগামী রকেট নয়, কবিতাই আমাদের পৌঁছে দেবে সে মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে। আমরা কেবল প্রস্তুতি নিতে পারি, প্রস্তুত হতে পারি আমরা যারা নতুন, যারা মারী ও যুদ্ধের মধ্যে শৈশব কাটিয়েছি, যারা দুঃশাসনের তমসার মধ্যে পঞ্জরাস্থি জ্বালিয়ে নিজেদের করেছি অন্য নাবিকের জন্য বাতিঘর, আমরা যারা আগামী শতকেরও বেশ কিছুকাল বেঁচে থাকবো। নতুন সময় আমাদের, একমাত্র আমাদের। আর একবিংশ নতুনদেরই পত্রিকা। .... যারা অপ্রতিষ্ঠিত, যৌবনাবেগে টলমল, প্রতিভাবান, উদার, অভিনিবিষ্ট, শ্রমী এবং নির্ভয়, আমরা তাদের জন্য পাটাতন নির্মান করতে চাই...’। হ্যাঁ, একবিংশ’র পঁচিশ বছরের যাত্রাপথটিকে সময়ের তরুণ কবিদের জন্য একটি সুদৃশ্য মজবুত ও ভবিষ্যত-অভিমুখী পাটাতন বলেই মনে হচ্ছে। প্রথম সংখ্যার ঘোষণা তবে কোন কাব্যিক স্বপ্ন-কল্পনা মাত্র ছিল না; ছিল সামর্থবান কর্মীপুরুষের সুচারু কর্মপরিকল্পনা।

সার্ধদশক আগে ‘একবিংশ’ নাম ধারণ করে যেহেতু ভবিষ্যতের কাব্যক্ষেত্রকে সনাক্ত করতে ও চাষাবাদ করে সোনালী ফসল ফলাতে উদ্যোগী ছিলেন সম্পাদক, সেজন্যে তিনি কবিতা নির্বাচনে প্রথমাবধি ছিলেন উত্তর-সা¤প্রতিক। তখন অর্থাৎ আশির দশকে কবিতা চর্চা ও প্রকাশের মূল ক্ষেত্রে ছিলেন ষাটের ও সত্তরের দশকের কবিগণ, এমনকি পঞ্চাশের শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, আল মাহমুদ প্রমুখের কবিতা ও কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হচ্ছিল সমানতালে। কিন্তু একবিংশ ঘোষণা করলো, প্রতিষ্ঠিতদের নয় বরং অপ্রতিষ্ঠিত প্রতিভাবান, নতুন চিন্তাধারী, নতুন সময়ের নির্মানে নিষ্ঠাবান যারা তাদের লেখার জন্য উন্মুক্ত এ কাগজ।

এই নতুন সময়ের নির্মানে নিষ্ঠাবান কবিতা কর্মীদের উন্মেষ ঘটে মূলত আশির দশকের প্রান্তিক কালে এবং তা বিস্তৃতি ও পরিণতি লাভ করে নব্বইয়ের দশকে। পাশাপাশি বাংলাদেশের কাব্যক্ষেত্রে একবিংশ শতাব্দীর নয়া ডিসকোর্স (উত্তর-আধুনিকবাদ, উত্তর-ঔপনিবেশিকতা, ঐতিহ্যের পুনঃনির্মান এবং জ্ঞান ও বিজ্ঞানের সকল শাখার সমন্বিত চিন্তনপ্রক্রিয়া) বিকশিত হয় বিশ্ববাস্তবতার অনিবার্য অভিঘাতে, বিশ শতকের নব্বইয়ের দশকেই। ফলে একবিংশ কীভাবে বাংলাদেশের তথা বাংলা ভাষার নব্বইয়ের দশকের কবিতাকে সনাক্ত করেছে তা খুঁজে দেখার প্রয়োজন আছে বৈকি।

স¤প্রতি শূন্য দশকের কয়েকটি কবিতাগ্রন্থের আলোচনা গিয়ে বলেছিলাম যে, ‘সময়ের তরঙ্গে বাঁকবদলের নিরীক্ষার মধ্যেই নব্বইয়ের কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য নিহিত। বিশ্বব্যবস্থার পরিবর্তনের দোলায় দোদূল্যমান বাঙালির মানসচেতনায় দ্রুত পরিবর্তন চিহ্নিত হতে থাকে এ সময়। বাংলাদেশের কবিতার ভাববলয়ে এবং শিল্প-সংগঠনে নতুন এক হাওয়ার বেগ সঞ্চারিত হয়। শিল্প নির্মানের নয়া ডিসকোর্সে প্রভাবিত হতে থাকে বাংলা ভাষার কবিতা; তার জন্য নতুন চিন্তা-কল্পনা এবং বাক্যের নয়া বিন্যস্ততা চিহ্নিত হতে থাকে। ঐতিহ্যের পুনঃনির্মানের সচেতন চর্চা এর আগে এত বড় আয়োজনে আর দেখা যায়নি।’

রাশেদ মিনহাজ নামের আড়ালে খোন্দকার আশরাফ হোসেনও এক আলোচনায় বলেছেন, ‘বাংলাদেশের কবিতা যখন নব্বইয়ের দশকে প্রবেশ করছিল, তখন চারিদিকে একটি সাজ-সাজ রব। তরুণ কবিদের কোলাহল শোনা যাচ্ছিল চারিদিকে, বেরোচ্ছিল বহু ক্ষুদ্র কাগজ ... এই কাগজগুলোতে এবং একবিংশ-এ একঝাঁক নতুন কবির কবিতা প্রকাশিত হতে থাকে’- যারা ক্রমে নব্বইয়ের দশকের কবি হিসেবে পরিচিতি পায়।

এই নতুন কবিদের অধিকাংশই নিয়মিত অথবা অনিয়মিতভাবে একবিংশ’র কোন না কোন সংখ্যায় উপস্থিত হয়েছেন। এই উপস্থিতি এ জন্যে উল্লেখযোগ্য যে, ঐ সময়ের তাদের শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলোই একবিংশ-এ পত্রস্থ হয়েছে।


সুব্রত অগাস্টিন গোমেজের যাত্রা শুরু হয় একবিংশ-এর মাধ্যমেই ফেব্র“য়ারি ১৯৮৯ সংখ্যা থেকে; তবে ১৯৯২ পর্যন্ত মাত্র চারটি সংখ্যায় লিখেছেন তিনি। নানা ভঙ্গির বাক-বিন্যাসের মাধ্যমে জাতিসত্তার যাত্রাপ্রবাহকে উপলব্ধি করার সচেতন আয়োজন দেখা যায় তার কবিতায়। তিনপর্বের সমন্বয়ে তাঁর দীর্ঘ কবিতা 'তনুমধ্যা’ নব্বইয়ের দশকের শুরুতে বাংলাদেশের তরুণ কবিতাকর্মীদের আলোড়িত করেছিল। ভাষার ঐতিহাসিক ও কালানুক্রমিক ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বের শব্দবোধ ও বাক্যবিন্যাস, বাংলা কবিতার ইতিহাসের ধারাবহিকতায় ব্যবহৃত ছন্দ, লোকসাহিত্য ও ছড়ার গীতলতা এবং নৃতাত্ত্বিক নানা অনুসঙ্গের সম্মিলন ঘটিয়েছেন কবিতায়। কিন্তু নিজের কাব্যচেতনায় যথেষ্ট আস্থা রাখতে পারেননি শেষাবধি; প্রভাবিত হয়ে পড়েন সমকালীন কবি-বান্ধবদের চর্চিত ব্যঙ্গরসাত্মক পরিহাসপ্রবণ হালকা মেজাজের কবিতাপ্রকল্পে। তিনি লিখছেন প্রচুর এবং এরই মধ্যে তাঁর নিজস্ব একটি কাব্যভঙ্গি সনাক্ত করা যাচ্ছে।


‘আমার গলায় তুমি কে গো কথা কও অহোরাত্র?

কে গো দেখ আমার নয়নে, শোনো শ্রবণে আমার?

এই দেহের ভিতর দিয়ে দ্বিতীয় সে কোন পথ

চলে গেছে কোন্ দিকে , কোন আলোয়, কোন আলেয়ায়?

শত-পিতা-শত-পুত্র-পরম্পরা বংশলতিকায়

দোল খায়, অন্ধকারে সুরভি ছড়ায়! ধমনিতে..’

(জাগরণপালা: সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ)


আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ যদিও ফেব্র“য়ারি ১৯৮৮ সংখ্যা থেকে লিখছেন তবু কবিতার ভাষা ও চিন্তাপ্রক্রিয়ার স্বভাবে তিনি নব্বইয়ের দশকের প্রতিনিধি। ব্যক্তি-অভিজ্ঞতাকে রূপকের ই¤েপ্রশনে চিত্রিত করা তার কবিতাকর্ম। ছন্দ ও ভাষার ব্যাঞ্জনা নিয়ে তেমন চর্চা নেই তার কবিতায়। অব্যাহতভাবে একবিংশ-এ কবিতা প্রকাশ করছেন প্রথমাবধি। প্রথম গ্রন্থ 'শীতমৃত্যু ও জলতরঙ্গ’, এরপর 'বাল্মিকীর মৌনকথন’, 'পলাশি ও পানিপথ’ এবং এবছর প্রকাশিত 'গানের বাহিরে কবিতাগুচ্ছ’ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ তাকে কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে।


'শব্দে শব্দে পাথর সভ্যতা আমাদের পাঠ্য

স্কুল ব্যাগে পুষ্ট রাস্তাগুলো মাংসের আড়ালে।’

(শৈশব ও রাস্তা: আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ)


শরীফ শাহরিয়ার-এর কবিতা ১৯৯০ সালে প্রথম ছাপা হয় এবং এখনও পর্যন্ত অন্যান্য ছোট কাগজের পাশাপশি তিনি অনিয়মিতভাবে একবিংশ-এ সংশ্লিষ্ট আছেন। শরীফ কবিতা নির্মানে ও বিষয়ের মেজাজে যদিও আশির দশকের প্রতিনিধিত্ব করেন তথাপি নব্বইয়ের দশকে তিনি কবিতা লেখা ও প্রকাশে অক্লান্তভাবে ধারাবাহিক। স্বনির্দিষ্ট জীবনবোধকে অনাড়ম্বর বাক্যপ্রবাহে ফুটিয়ে তোলা সাধনা তাঁর।


'

এই শহরের শোকগাথা ঠোঁটে তুলে দাঁড়িয়ে আছি ব্যথিত নাগর

আর তুমি কোন জানালায় চোখ রেখে খুঁজতে থাকো সুদূর সাগর।’

(নগর প্রতিমা: শরীফ শাহরিয়ার)


দাউদ আল হাফিজ ডিসেম্বর ১৯৯০ সংখ্যায় দুর্দান্ত তিনটি কবিতা নিয়ে হাজির হন বাংলা কবিতার সবুজ মাঠে। তাঁর ‘পাতাঝরার গান এবং ঝরাপাতার সঙ্গীত’, ‘আলো, আরো আলো’ ও ‘জেরুজালেমে একদিন তিনহাজার বছর আগে’ কবিতাত্রয় দুই দশক পর আজও সমান আলো ছড়াচেছ। পরবর্তীতে প্রকাশিত তাঁর ‘আনাবাস’ কবিতাটি আধ্যাত্মিক চেতনাপ্রবাহে সত্তার শূন্যভ্রমণের এক ভাষিক চক্রাবর্ত। তিনি স্বল্পপ্রজ; কোন কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি তাঁর।


‘এইসব নাজুক শব্দাবলী ভীষণ ভালোবেসে পোশাক প্রকাশে অনীহা

প্রবল

যতখানি লোকালয়ে প্রকাশ, যতখানি মূর্ত - তারো অধিক বিমূর্ত

লীলা।

এইসব শব্দাবলী, অভিধান ছেড়ে ছুঁড়ে আমি নিঃসীম আঁধারে ডুবি

ডুবে যায়

সংসার সময় ভুত ভবিষ্যত বর্তমান।....’

(আলো, আরো আলো: দাউদ আল হাফিজ)


বায়তুল্লাহ কাদেরী মূলত একবিংশ’রই কবি। সেপ্টেম্বর ১৯৯১ সংখ্যা থেকে লিখলেও ১৯৯৩-এ শীতাভ সনেটগুচ্ছ প্রকাশের মাধ্যমে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ‘শীত’ কে জ্ঞান ও বোধির প্রতীক রূপে আবর্তমান একটি রূপকের প্রবাহে তেরটি চতুর্দশপদী নির্মান করেন। পরে বর্ষালি চতুর্দশী নামে আরও একটি সনেটগুচ্ছের মাধ্যমে সা¤প্রতিক সময়ে সনেট চর্চায় তার পারদর্শিতার স্বাক্ষর রাখেন। সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে বায়তুল্লাহ পঠিত কবিতার ইতিহাসের ধারায় প্রভাবিত। শব্দপ্রতীকের প্রবাহে ইতিহাস, মিথ ও লোকজীবনের বিভিন্ন চিহ্নায়ক ব্যবহার করেন কবিতায়।


‘শব্দে শব্দে খেলি আমি শীত নিয়ে, শীতের প্রয়াত

বন্ধু, যাকে মাঝে মধ্যে চিঠি লিখে বিরক্ত করার

প্রবণতা জাগে, উঠাই প্রসঙ্গ তার, গর্ভজাত

বৃষ্টিকে লালন করি সত্তাময়, যেনোবা মরার

আগে একবার শীত হবো; তবে আত্মপ্রবঞ্চনা

আমাকে শাসন করে রোদের মতোন, শাহরিক..’

(শীতাভ সনেটগুচ্ছ: বায়তুল্লাহ কাদেরী)


কামরুল হাসান নব্বইয়ের দশকের প্রথম থেকেই নিয়মিত লিখছেন একবিংশ-এ। তিনি বহুপ্রজ লেখক। বিভিন্ন ছোট কাগজ ও দৈনিকের সাহিত্যপাতায় তার উপস্থিতি অবিরল। হৃদয়াবেগকে ইন্দ্রিয়-সংবেদনে উপলব্ধি করতে চান তিনি। কবিতা নির্মান প্রকৌশলে তিনি বাকসংযমী, স্কেচধর্মী, ইঙ্গিতবাহী এবং প্রচল ধারার প্রতিনিধি।


'আমাদের উদ্ভট পাঠশালে তোমরা কে কে বলে নতুন

বসেছে ভুল এলামেলো বেঞ্চিতে, রোল নাম্বারহীন

তোমাদের নেই বুঝি ক্রমিক পতন?’

(আমাদের উদ্ভট পাঠশালে: কামরুল হাসান)


শাহনাজ মুন্নী’র কবি পরিচয়বাহী দু’টি কবিতা ‘ক্ষমঃ গো শ্বেত দুগ্ধ’ ও ‘চাষী বউ এর সাথে যখন বদলায় কবির জীবন’ একবিংশ-৮ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। একই সংখ্যায় সরকার আমিনও উপস্থিত হন। তাদের উদ্যোগে পরিচালিত ও প্রকাশিত ‘মঙ্গলসন্ধ্যা’ নব্বইয়ের কবিতার আলোচনায় অনিবার্য একটি অধ্যায়।


হাফিজ রশিদ খান আশির দশকের কবি। কিন্তু তাঁর আদিবাসী কবিতাগুচ্ছ নব্বইয়ের দশকের শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলোর অন্যতম। অবশ্য তাঁর কবিতা বৈশিষ্ট্যের দিক থেকেও নব্বইয়ের সমধর্মী।


‘হৃদয় সলতে পাপড়ি মেলো

এখন আলো আসবে অমল হাতের ছোঁয়ায়

লুসাই-পাড়ার তন্বী উঠোনে

মাদুর পাতো

আজকে শীতের

হালকা আমেজ হাওয়ায়’

(আদিবাসী কবিতাগুচ্ছ: হাফিজ রশিদ খান)


তুষার গায়েন নব্বইয়ের কবিদের তালিকার পুরোভাগের একজন। প্রথমত একবিংশ’র মাধ্যমেই তাঁর কবিতা পরিচিতি লাভ করে। সত্তার আন্তর্প্রবাহ তাঁর কবিতার প্রধান উপজীব্য। প্রতœস্মৃতি, দর্শন ও বিজ্ঞানের সমন্বিত বোধনে তাঁর কবিতা বিশিষ্ট। পদার্থ ও প্রাণের মধ্যকার সম্পর্কের মহাজাগতিক ঐকতান ভাষায় ফুঁটিয়ে তোলার অভিপ্রায় আছে তাঁর। টোটেম ও তন্দ্রা, নীলভবহ্রদ, আদিদর্শন, ফুরামন পাহাড়ের গান, উড়ে যাই একবিংশকালে প্রভৃতি সময়ের উল্লেখযোগ্য কবিতা হিসেবে চিহ্নিত।


‘গতকাল স্নায়ুযুদ্ধ না কি শেষ হয়ে গেছে

একটি সমষ্টিবাদ বুঝি ডুবে গেল অতল গহ্বরে

একটি কফিন মাটি থেকে তুলে নিলে

না কি সোনা এসে ভরে যাবে দেশে

একটি দেয়াল ভেঙে ফেলে দুটো দেশ

এক হয়ে যায়, একদেশ ভেঙে গিয়ে বহু

বহুদেশ এক হবে আরো কোন বাণিজ্য আশায়’

(উড়ে যাই একবিংশকালে: তুষার গায়েন)


মুজিব মেহদী অন্যান্য কাগজে হামেশা প্রকাশিত হতে থাকলেও একবিংশ-১৪ সংখ্যায় প্রকাশিত ‘নারী মাছের বিবিধ কানকো অন্যান্য আনাজ ও উচ্ছিষ্টভোগীরা’ শিরোনামের পরিহাসপ্রবণ কবিতাটি তাঁকে পাঠকমহলে আলোচিত করে। প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতাকে অভিনব ইমেজে রূপান্তর করা তাঁর বিশিষ্টতা।


'আরোগ্য থেকে দুই মাত্রা দূরে বেড়ে ওঠি

যেখানের জল সেখানে থাকে যেখানের হাওয়া সেখানে

বিষাক্ত ধোঁয়ার কুন্ডুলিতে নাসিকা কুঞ্চিত করি

আর ধেয়ে আসি পর্বতে ঘাসে’

(তার নামে স¥ৃতিঘর: মুজিব মেহদী)


টোকন ঠাকুরও ১৯৯৫ সালে ১৫তম সংখ্যায় প্রকাশিত ‘শত সপ্তাহের পদাবলী’ শিরোনামে শেক্সপিয়রীয় রীতির সাতটি সনেটের মাধ্যমে পরিচিতি লাভ করেন। পরবর্তীতে অব্যাহতভাবে কবিতা প্রকাশ করে বাক্যবিন্যাসের ব্যাপক নিরীক্ষা ও ছন্দ প্রয়োগে স্বাচ্ছন্দ্য তাঁকে পাঠকপ্রিয় করে তোলে।


‘অধিরূঢ় এমন রোদ্দুর! কতো মেঘ জমে ওঠে!

আজ পূর্ণদৈর্ঘ্য দিন! ক্রুশকল্প...ঘন্টাধ্বনি-আর

বিসদৃশে কিছু কথা... কথাগুলো নির্লিপ্ত... প্রস্ফুটে

তবু যা উদ্ভূত-অতিক্রান্ত অর্থে আসে রবিবার!’

(শত সপ্তাহের পদাবলী: টোকন ঠাকুর)


একই সংখ্যায় ‘ধানসত্য’ শিরোনামে আমারও সাতটি কবিতার একটি সিরিজ ছাপা হয় যা পাঠকদের প্রশ্রয় পায়। আগে পরে প্রকাশিত আরো কিছু কবিতা যেমন- নিদালি, প্রিয় সর্পিনী, একটি আলবাট্্রস-তার গান প্রভৃতি একবিংশের মাধ্যমে পাঠকদের নজরে আসে। এবং এখনও শিহরিত হই ছাত্রাবস্থার সেই সময়ের অনুভূতি স্মরণ করে যে একেকটি কবিতা প্রকাশের পর আমাকে ক্যাম্পাসে ও শাহবাগে পরিচিতজনেরা কবিতার নাম ধরে ডাকতো। যেমন পালকাপ্য প্রকাশের পর এখনও পর্যন্ত কেউ কেউ আমাকে ‘পালকাপ্য’ বলে ডাকে।


নভেম্বর ১৯৯৬ সংখ্যায় একসাথে যোগ দেন মোশতাক আহমাদ দীন ও কামরুজ্জামান কামু। রূপকধমী নিরাভরণ ভাষার মাধ্যমে মোশতাক ইতোমধ্যে একটি নিজস্ব কাব্যজগৎ সৃষ্টি করতে পেরেছেন বলে মনে হয়। কামু পরবর্তীতে নিজের কাব্যভাষায় নিষ্ঠাবান থাকেননি। তিনিও, অসাবধানতার বশেই হয়তো, ব্যঙ্গকবিতার চোরাবালিতে পড়ে গেছেন। কিন্তু তাঁর প্রথমগ্রন্থ ‘কবি মুখপত্রহীন’ পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল।


‘কায় ভাসিলো পথের ধূলায়

আমি ভুলে থাকি আজ গৃহে ফিরিবার দিন

কে গো ভাসালে বোলো

উড়ো মন্তরের ছায়া ঘোরের বয়ার’

(ধূলোপাঠ: মোশতাক আহমাদ দীন)


‘আজ স্মৃতি-বিধুরতা জেগে ওঠে, আজ মধ্যরাতে

বন্ধুর বোনের কাছে বলে ফেলি: রাজনীতি মানে

হলো পরাজয়

আজ মাতৃক্রোড়ে মুখ রেখে

অনন্ত ক্ষমার জন্য অশ্র“পাত করি’

(স্ত্রীলোকের জন্য উঠে আসে গান: কামরুজ্জামান কামু)


নব্বইয়ের অন্যান্য অনেক কবি যেমন- রহমান হেনরী, শামীম সিদ্দিকী, রণক মুহম্মদ রফিক, আকমল হোসেন নিপু, পাবলো শাহী, শোয়াইব জিবরান, কুমার চক্রবর্তী, পাঁশু প্রাপণ, জহির হাসান, রায়হান রাইন, তাপস গায়েন, আশরাফ রোকন, মিহির মুসাকী, শাহীন শওকত, শামসুল আরেফিন প্রমুখের কবিতা একবিংশ-এ পত্রস্থ হয়।


‘এখন নি:শব্দে অন্তর্গত, এখন মুদ্রিত আছি মেঘে

তোমাদের বাড়ির উঠোনে ছিলাম বর্ষার জল

শরতের মেঘ ছিন্ন করেছে সকল গ্রন্থি

তার শুভ্র ডানা আমাকে উড়িয়ে নেয় দূরে

তুমি কি ভুলে গেছ ঘন বাদলের দিন’

(বর্ষামগ্ন: শাহীন শওকত)


‘শাহরিক শূন্যতা বেশ্যার মতো পড়ে থাকে

একদিন যে শরীর তার ছুঁয়েছে মখমল।

সে শরীর ক্ষত হয়, বিক্ষত উত্তাপে

লালসায়। এই নারী

বহু ভোগ্যা লোলচর্মা হয়ে ওঠে।’

(সেই ঘুমঘুম ভিখারি আপেলগুলো: পাবলো শাহী)

‘ভেজানো দুয়ারখান খিলছাড়া কাঁপিতেছি আমি,

আমার অন্তরে থাকো টলোমলো সুবর্ণের খাটে।

কৃত্রিম অনন্ত শব্দে দু’হাতে মেলাতে কাব্যখানি,

বাহিরে দূত-পাখি শুক এসে শক্ত মোরে আঁটে।’

(কৃত্রিম, কৃত্রিম: রণক মুহম্মদ রফিক)


‘জয়তু বন্দনা করি, সমূহ সমীহ হতে প্রমুখ আমাকে

যে-আমি প্রবহ অহে সহ থেকে সহযোজী সকল আভাকে-

এইভাবে বা ও-ভাবে অংশ কেলাসন রূপে করেছি কেলাস;

এজন্যই আতশীর পদার্থবিজ্ঞান বোঝে কাঁচের গেলাস।’

( অহম্: পাঁশু প্রাপণ )


‘শালিখের ডানায় উঠেছে নেচে রোদ... আমি এইদৃশ্যটুকু

লিখে রেখে প্রচ্ছন্ন হওয়ায়, বাংলা কবিতাকে বলি, ও জননী,

আমি তোরে প্রেয়সীর আদরে সাজাবো... আহা’

(সাঁতারের স্বরলিপি: রহমান হেনরী)


‘আমাদের মৃত নদী ঘিরে আজ হাহাকার ওঠে। আরো কতো কৃশ,

ধবল মেঘের দী -র্ঘ নদী ছিলো, কবে তারা বাতাসের ঘর ভেঙে

গোলকের খোঁজে ঢুকে গেছে। ক্রমাগত উড্ডয়নে ক্লান্ত ডরিমার

ন্যুব্জ ডানায় ভর করে সময়ের চক্রে পড়ে, আহা!..’

(সময়: বাতাসের ভেতর উড়ে আসা বিবর্ণ ধূলো: রায়হান রাইন)


‘মহাগুরু বাষ্পীকরণ বন্ধ রেখেছেন। পত্ররন্ধ্রগুলি হাওয়ায় আবৃত,

উত্তপ্ত বালুর মর্মে মর্মে মর্মর হাওয়ায় প্লাবন, শীতল চামরে।’

(হাওয়া: কুমার চক্রবর্তী)


একবিংশ-এ লেখেননি এমন যারা নব্বইয়ের দশকের কবি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন তাদের মধ্যে শিবলী মোক্তাদীর (বগুড়ার নিসর্গ’র মাধ্যমে); চঞ্চল আশরাফ, কবির হুমায়ূন, মুজিব ইরম (মঙ্গলসন্ধ্যা’র আড্ডা থেকে); শামীম কবীর ও মজনু শাহ (দ্রষ্টব্য’র মাধ্যমে); জিল্লুর রহমান, আহমেদ রায়হান, পুলক পাল (চট্টগ্রামের লিরিক’র আড্ডা থেকে); ওবায়েদ আকাশ (শালুক-এর সম্পাদক), শামীম রেজা (দৈনিক আজকের কাগজের সাহিত্যপাতা সুবর্ণরেখা’র সম্পাদক), বদরে মুনির, সাখাওয়াত টিপু (নাটোরের উটপাখির সংশ্লিষ্টতায়); ব্রাত্য রাইসু, হেনরী স্বপন, আলফ্রেড খোকন, আয়শা ঝর্না, জাফর আহমেদ রাশেদ প্রমুখ উল্লেখযোগ্যতা অর্জন করেছেন। চঞ্চল আশরাফ বিভিন্ন ছোট কাগজ ও দৈনিকের সাহিত্য পাতায় নিয়মিত লিখেও কেন যে একবিংশ-এ অনুপস্থিত থাকলেন তা বোধগম্য নয়। ব্যক্তিক সম্পর্ক ও শিল্পচেতনায় তাঁর সাথে একবিংশ’র বিরোধ আছে বলে মনে হয় না।

এছাড়া কেউ কেউ এমন আছেন যারা নব্বইয়ের দশকে তেমন উল্লেখযোগ্যতা অর্জন না করলেও পরবর্তী শূন্যের দশকে নিয়মিত কবিতা প্রকাশ করে আলোচনায় এসেছেন তাদের অনেকেই একবিংশ-এ স্থান পেয়েছেন।

নব্বইয়ের দশকে আশির কয়েকজন কবি নিয়মিত ছিলেন একবিংশ-এ। খোন্দকার আশরাফ হোসেন, মঈন চৌধুরী, সরকার মাসুদ, মাসুদ খান ও সুহিতা সুলতানা নব্বইয়ের নতুন কবিদের পাশে সমানুপাতে নতুনভঙ্গিতে তাদের কবিতা অব্যাহত রাখেন।

এছাড়া একবিংশ-এ নিয়মিতভাবে প্রকাশিত কবিতা ও শিল্পতত্ত্ব বিষয়ক সমসাময়িক প্রবন্ধ, উত্তর-আধুনিকতা নিয়ে আলোচনা ও বিতর্ক এবং অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার কবিতা ও সাহিত্যভাবনা তরুণ কবিতাকর্মীদের কাব্যচর্চায় দিক নির্দেশনা দিয়েছে। বিশেষ করে তপোধীর ভট্টাচার্যের প্রবন্ধসমূহ, খোন্দকার আশরাফ হোসেনের সাহিত্যতত্ত্ব ও আন্দোলন বিষয়ক প্রবন্ধাদি, দাউদ আল হাফিজ অনুদিত টিএস এলিয়টের 'ঐতিহ্য ও ব্যক্তিপ্রতিভা’ এবং অক্টাভিও পাজ’র 'কবিতা ও মুক্তবাজার’ প্রবন্ধ দুটির প্রভাব অস্বীকার করা যায় না।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন