শুক্রবার, ৯ এপ্রিল, ২০১০

আশির কবিতা, ‘গৃহে ফেরে ভ্রামণিক চোখ

অঞ্জন সেন


প্রিয় সম্পাদক ‘একবিংশ’ সমীপেষু,
আপনাদের পাঠানো ‘একবিংশ’ এবং ‘প্রান্ত’ পত্রিকার দুটি করে সংখ্যা পেয়ে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের বেশ কয়েকজন কবির কবিতা পাঠের সুযোগ এল। এর আগে ‘অনিরুদ্ধ আশি’ (‘অনিরদ্ধ আশিঃ একদশকের কবিতা” সৈয়দ তারিক সম্পাদিত, একবিংশ প্রকাশন, ঢাকা, ১৯৯১) একবার দেখার সুযোগ পেয়েছি, পড়ার জন্য সংগ্রহ করতে পারি নি।
নতুন প্রজন্মের কবিতার নতুন একটা সদর্থক চেহারা স্পষ্টভাবেই দেখা দিয়েছে। কবিদের প্রত্যেকেরই ব্যক্তিভাষ যেমন বোঝা যাচ্ছে তেমনি সমষ্টিগত প্রাণের চেতনার উপাদানটিও প্রবল। ঐতিহ্য বা পরম্পরার পটভূমিতে এই ‘অনিরুদ্ধ আশি’র সময়ের কবিতাকে বিচার করা যেতে পারে। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি একাত্মতার জন্যই এই সমস্ত কবিরা বাংলা সাহিত্যের ঐতিহ্যের সঙ্গে নিজস্বভাবে সমকালে অবস্থান করে সংশ্লিষ্ট হতে পেরেছেন। এখানে কোনো সঙ্কীর্ণতা-অন্ধতা নেই। ইউরোপকেন্দ্রিক আধুনিকতার চলনে আমরা দেশজ ঐতিহ্যকে পরিত্যাগ করতে শিখেছি এবং প্রকরণে-আঙ্গিকে-আন্দোলনে আধুনিক বাংলা কবিতা কোনো না কোনো ইউরোপীয় কবির আদল আঙ্গিক বা সাহিত্য আন্দোলনের ধরনে গড়ে উঠতে চেয়েছিল। এটা বোঝার চেষ্টা অনেকেই করেননি যে ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি অনড় অচল নয়, সংস্কৃতি তার ‘শীল’ এর দ্বারা অতীতের অনেক জঞ্জাল উড়িয়ে দিয়ে আসে। চণ্ডীদাস, সৈয়দ সুলতান, চাঁদকাজী, কৃত্তিবাস, মুকুন্দরাম, আলাওল, জ্ঞানদাস, আব্দুল হাকিম, ভারতচন্দ্র, আলন ফকির, রামপ্রসাদ সেন-এঁদের ক্যাবিক বলন আমাদের সংস্কৃতির শিকড়। তার মানে এই নয় যে এই সমস্ত প্রাচীন কবিদের রচনাভঙ্গি আয়ত্ত করতে হবে। তাঁদের কাব্যিক বর্গ এবং শৈলীর বহু উপাদান আজও ভাষায় জীবন্ত। নবপ্রজন্মের কবিরা জ্ঞানত বা অজ্ঞানত ভাষার ভিত্তিমূল থেকে উঠে আসা উপাদানগুলি সংযুক্ত করবেন। ঐতিহ্য মানেই সকীর্ণ প্রাচীনপন্থা নয় বা সামন্ততান্ত্রিক বোধ নয়, ঐতিহ্যের মধ্যে যে মানবিক বোধের জীবন্ত ধারা যে প্রাণচেতনার প্রবাহন নতুন কবিদের কাছে তা প্রহণযোগ্য। আধুনিকদের বিচারে তা ছিল পরিত্যাজ্য গ্রাম্য কারণ পশ্চিমী সাহিত্যের আধুনিকতার নিরিখে এদের বিচার করা যাবে না। চর্যাপদ থেকে আজকের শাহনাজ মুন্নী বা অনুরাধা মহাপাত্রের কাব্যভাবনার মধ্যে ঐ সাংস্কৃতিক শিকড় রয়েছে গেঁথে যা উপড়ে দেওয়া যাবে না। আমাদের বাংলা কবিতার অনেক রথী মহারথী এই উৎসমূল থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চেয়েছিলেন, চেয়েছিলেন, ইউরোপকেন্দ্রিক আধুনিকতার চাকচিক্যে, সূক্ষ্মতায়, একপেশে জটিলতায় মননশীলতার, উদ্বেগ এবং আশঙ্কায় বাংলা কবিতা ইউরোপীয় চেহারা নিক। তা হয়নি, যদিও বৈচিত্র্য এসেছে, অচেনা সাংস্কৃতিক জগতের প্লাবন বয়ে গেছে। অনিরুদ্ধ আশি--প্রজন্মের কবিতায় এ দুয়েরই সুদৃঢ় সংশ্লেষণ ঘটেছে। একদিকে ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির শিকড় অন্য দিকে নবতম মনন। প্রাক-ঊনিশ শতকের বাংলা কবিতা সম্পর্কে নতুন প্রজন্মের আগ্রহের কারণ দুটি। এক, দীর্ঘদিনের উপেক্ষা দুই, সাংস্কৃতিক-কৃষ্টিগত বৃত্ত, বয়ান বা কৃতি। সাধারণ মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা-প্রেম-দৈনন্দিন জীবনযাপন থেকে যে লোকসাহিত্য তার সঙ্গে চণ্ডীদাসের পদাবলীর ভাবগত বা ভাষাগত কী সাদৃশ্য (দ্রষ্টব্য: বর্তমান আলোচকের ‘সাংস্কৃতিক আন্তর্বয়নঃ উত্তর আধুনিক কবিতা,’ একবিংশ ১৯৮৯)! লালন ফকিরের সঙ্গে রামপ্রসাদ সেনের স্বরন্যাসের কী অদ্ভুত ঐক্য! অথচ দুজনেই ভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক অবস্থানের কবি। আসলে এঁদের মানবপ্রেমটাই আকর্ষক যা অনেক আধুনিক কাব্যে-আকরণের সাদৃশ্য আছে- বিষয়বস্তুর পার্থক্য সত্ত্বেও। সুফি-সহজিয়া সাহিত্যও বাংলা সাহিত্যের একটি বিরাট সম্পদ যেখানে বিভিন্ন ধর্মের ঐক্য ও সমন্বয় ঘটেছে। বাঙালি সাধারণ মানুষ চিরকালই অসাম্প্রদায়িক ছিল, সুফি-সহজিয়া-ধর্মসাহিত্য ও লোক-সাহিত্যই তার প্রমাণ। নতুন প্রজন্ম কী ভাবে দেখছে?

“ইলেক্ট্রন কান্তা মুক্তবেনি, রাঁধতে বসেছিলো
এখন সহসা কেন্দ্র ফুঁড়ে উড়ে আসে বাঁশির ফ্লেভার
আকুল শরীর তার বেআকুল মন।
বাঁশীর শব্দে তার আউলাইলোঁ রাঁধন।।”--মাসুদ খান, ‘পরমাণু’

“ছু মোন্তর যা মোন্তর ছুচিয়ার বিষ!
যারে লাগ ভেল্কি লাগ কামাখ্যার বিষ
দোহাই কলতা গুরু দোহাই কালীর”--সরকার মাসুদ, ‘বশীকরণ-সিরিজ’


আঞ্চলিক কথ্যভঙ্গি দিয়ে শুধু মাত্র উপভাষার প্রয়োগেও কবিতা কী প্রাণবন্তু এবং শিল্পময় হয়ে ওঠে! সেই সঙ্গে কিছু ইডপয়ম এবং মিথ আপাতসরল কবিতাকে একটি কৃতি-অতিরিক্ত জটিল বিন্যাস্ দিকে নিয়ে যায়। নতুন প্রজন্মের কবিায় ভাষার এলাকা গেছে বেড়ে--আধুনিকদের বিশেষ করে গত ৪০ বছরের কবিতার ভাষাগত সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতে পেরেছে।

“আর কোন ধন চাইনাগো মুর্শিদা
মইলে আমায় সঙ্গে নিয়ো,
আমার যখন মরণ হবে রে--
গোরের বাঁশ না দিয়ো গো
আমার মুর্শিদ চান্দের হাতের লাঠি
আমার ও না সঙ্গে দিয়ো
--মোহম্মদ সাদিক, ‘মুর্শিদা গান’

“নাইমতে লারি জাল ফুঁফাই উঠে রাগ......
মাছ নাই মায়ের সুহাগ নাই
জীবনে উড়িছে চোইতের ধূলা রে
কারে বা বলিব দুখের মুড় নাই ওড় নাই
আঁধারে যাব বা কন্ চুলা রে
কিনারে ঘুরি পাইর কনর
আভগিনী দুখিনী বেহুলারে”
--দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায় (পঃবঙ্গ’) ‘জল’ (পুরুলিয়ার উপভাষা)।


নতুন প্রজন্মের কবিতায় ভাষাগত বৈচিত্রের, বিষয়বৈচিত্রের আরো দৃষ্টান্ত দেওয়া যায় :

‘তাহার তরাসে জল
পানি হইতে উঠে আসে বুকে
আকাশে কোন্ সে ফান্দ
কিভাবে বুঝাইব ব্যথা
জলে ডুবিলে কান্না হয় কলস।”
--সুতপা সেনগুপ্ত, ‘ধরাবতী’ (প: বঙ্গ)


লক্ষ্যণীয় সাধু ও প্রাকৃত ক্রিয়াপদের ব্যবহার, জল/পানির ব্যবহার, ইডিয়মের শিল্পময় ব্যবহারে অভিনব কবিতা। এই প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর আধুনিক কবিদের সঙ্গে অনিরুদ্ধ আশির কবিদের আধেয়, কাব্যভাষাগত সাদৃশ্যের কথা মনে পড়ে। বাংলাদেশ ও পশ্চিম বঙ্গের নবতম প্রজন্মের কবিদের মধ্যে তেমন পরিচয় নেই। দুদিকেই একই সঙ্গে ঐতিহ্য সংস্কৃতি ও বিশ্বজগতের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের ইচ্ছা দেখা যায়। কবিরা যে পরামর্শ করে ম্যানিফেস্টো লিখে কবিতা কেমন হবে ধরে বেঁধে দিয়ে লিখতে আরম্ভ করেছেন তা নয়। নতুন কবিতা পাঠেই নতুন সাহিত্যালোচনা, সাহিত্যতত্ত্ব।

“খাঁটি কবিতা মাটিতেই ফলে
তোমার ক্ষেত্রে আজ ফলুক
কবিতা। রাশি রাশি কবিতা
আমাদের উঠোনে মেলাবো
গ্রামময় কবিতা কুলোর
বাতাসে ছড়াব.....” --শাহনাজ মুন্নী

তোমার সন্তান রবে দুধে ভাতে
পার কর
কড়ি গুনে এই রাখ প্রেমের মোহর
তেপান্তর পেরোলেই
বনভূমি ফসলের মাঠ সোহাতিল শিয়রে শিশির
তারপর আমরা পাখি হয়ে যাই, তারপর আমাদের ঘর
--মোহম্মদ সাদিক

সয়ে যাও বিন্নী ধান আরেটু সহ না
তারা ধান ভানেও ভালো জানেও ভালো
তাদের গায়ে রুপার সোনার গহনা
--খোন্দকার আশরাফ হোসেন

আমার নতুন হয়ে ওঠার কাছে
তুমি এসো
পাত দেব, ভাতের রঙ মাখামাখি করে
তুমি আমি দাঁড়াবো নতুন
--নির্মল হালদার (পঃ বঙ্গ) ভাতগীত।

ছোটন দেখে ভাতের কণা উড়ছে পথে।
ভাতের কণা গুমরে মরে বকুল ফুলে।
--মঈন চৌধুরী


কৃষি-অন্ন-ভাত-উদর-ফলন আমাদের কৃষিনির্ভর বাঙালি জীবনের বহুকালের অঙ্গাঙ্গীভূত আকরণ। একালের কবিরা আবার ধান্যশ্রী কৃষিশ্রীকে শিল্পরূপমণ্ডিত করে তুলছেন। অনেক দিন বাঙালি ইউরোপকেন্দ্রিক আধুনিক কবিতা শুনেছে, জীবনশ্রী শোনে নাই। এই কবিতাগুলি কবিদেরই নিজস্ব চিন্তাÑকেউ গ্রাম্য ছড়ার টান রেখেছেন, কেউ লোকগান, কেউ ব্যবহার করেছেন উপভাষা, আবার কেউ মননে মেলে ধরেছেন নিজেদের, ছন্দ-স্পন্দন ও গদ্য-কথনের স্পন্দন-সবেরই নিরীক্ষা প্রচেষ্টা চলছে।
বাংলাদেশের কবিতা প্রসঙ্গে প্রায়ই পশ্চিম বঙ্গে কবিতার উত্তর-আধুনিক কথা মনে পড়ে। কবিতার আধেয়, ভাষাস্পন্দনই অন্য পারের কবিতাকে টেনে আনছে। আধুনিক নগরকেন্দ্রিক সংস্কৃতির বাইরেও আমাদের আরেকটি কৃষ্টি বহুদিন ধরে বেঁচে আছে--কৃষিকেন্দ্রিক কৌম সংস্কৃতির সঙ্গে কৌমকৃষ্টির সংঘর্ষ-লেনদেন চলছে। যেমন ভাবে গ্রামে ট্রাকটরের সঙ্গে গরুর গাড়ি চলে, ভিডিওতে টেক্সাস-বোম্বাই চলচ্চিত্রের পাশে ধর্মের গাজনপীরের গান-বিভিন্ন ব্রত-উৎসব পালিত হয়। তবুও বাংলায়, ভারত-পাক উপমহাদেশে এই কৌমকৃষ্টি বেঁচে আছে তার আদিম উৎসের কিছু পরিবর্তিত উপাদান নিয়ে যা পশ্চিম-এর আধুনিক জগতে শেষ হয়ে গেছে। কৃষিকেন্দ্রিক কৃষ্টি ছিল-আছে বলেই, চর্যাপদ-ধর্মসাহিত্য-ময়মনসিংহ গীতিকা-বিভিন্ন লোকসাহিত্য রচিত হয়েছে। মঙ্গলকাব্যের লোকচরিত্রও কৃষিজীবী সমাজেরই মূলত। এমন কী বাউল মুর্শেদী গানেও সহজ সাধনার বাইরে এই কৌমকৃষ্টির সংঘবদ্ধ মনের উপাদান সমন্বিত। আজকের নতুন প্রজন্মের কবিতায়ও তাই এই সংঘবদ্ধ মনের কৌমকৃষ্টি আপনা থেকেই এসে গেছে, ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত হব বলে জোর করে কেউ চাপিয়ে দেয়নি। তেমনি সমকালীন অগ্রগতির সঙ্গে মননও পরিবর্তিত হয়েছে। সূক্ষমনন ও মেধার নবরূপ কবিতায় স্পষ্ট। গত তিরিশ/চল্লিশ বছর এরকম একটা ধারণা গড়ে উঠেছিল, কবিতার তত্ত্ব হয় না, কবিতাই তার সব কথা বলে দেবে। চিত্রকলা-সঙ্গীত-নাটক-ইতিহাস-সমাজতত্ত্ব এসব বিষয় আলাদা বিশেষজ্ঞদের। নতুন প্রজন্মের কবিরা এ বিশ্বাস মানে না, তাঁদের মননের বিশ্ব তাই অনেক ব্যাপকতর। অনিরুদ্ধ আশির কবিতার গদ্যে এই বিজ্ঞান ও দর্শন চেতনা নতুন ভাবে উপস্থাপ্তি হয়েছে। প্রাক্-ইংরাজ যুগের সাহিত্যের সঙ্গে সমকালীন বিশ্বসাহিত্যের ঐতিহ্যও সংযুক্ত হয়েছে। একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী নতুন প্রজন্মের ঐতিহ্য এবং সার্বজনীনের সংশ্লেষণটি বুঝতে না পেরে ঐতিহ্যের বিরোধিতা করে আসছেন--এর কোনো অর্থ হয় না।

মিথ বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের, ‘অনিরুদ্ধ আশি’র কবিতায়, পশ্চিমবঙ্গের উত্তর আধুনিক কবিতার আরেকটি বৈশিষ্ট্য। আগেও মিথ বাংলা কবিতায় নানা ভাবে এসেছে, চলতি বা প্রাসঙ্গিক উল্লেখ হিসেবেই বেশী। কবিতার কাঠামো বা আকরণকে মিথের আকরণের মধ্যে মিশিয়ে দেওয়া এই প্রজন্মের একটি শৈলী। কোথাও কাব্যবিচারে দেখা যায় বাগর্থের প্রায় সমস্ত প্রশ্ন জড়ানো মিথের সঙ্গে (উদয় নারায়ণ সিংহ, সাম্প্রত ১৯৯০-অমিতাভ গুপ্ত রচিত ‘সূর্যে ধ্বনি পটে’--এর আলোচনা)।

ঝমঝম ঝরে ঘন বরিষণ
তড়িৎপ্রবাহে এক লাখ ভোল্ট
সারি সারি গাছ জানায় প্রণাম:
অর্ধেক রাধা অর্ধেক শ্যাম
--সৈয়দ তারিক

নাই কদম্ব কেলি কদম্ব এই বাড়িতে
এক পা দু-পা পা বাড়ালেই শ্যামের আড়ি
--খোন্দকার আশরাফ হোসেন


কবিতাংশ দুটিতে পদাবলীর ভাষাবর্গ লক্ষ্যনীয়। তেমনি বেহুলা, ফুল্লরা, লখিন্দর, মনসা, সখিনার চিত্রকল্পগুলিও বাংলাদেশের কবিতায় নানা ভাবে এসে যায়--

লখিন্দর শুয়ে থাকে
গোপনে গোপনে কাটে .... মনসার
এই ভাবে ছিঁড়ে যায়
বিরূপ বাতাস; পড়ে থাকে দ্বীপ-উপদ্বীপ।
--অতন্দ্রিলা রহমান

ভেসে যাও--
বেহুলার বিশ্বাসী ভেলায় তুমি ভেসে যাও অনন্ত অবধি.....
--(রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ)


কবিতাগুলি পড়তে পড়তে একটি শব্দ কয়েকবার চোখে পড়ল--
“বাঁশী বাজে। দশ দিক” (জহির হাসান)
“আমি তার বাঁশি শুনি চাদরে আবৃত”
(খোন্দকার আশরাফ হোসেন)

“বাঁশি বেজে ওঠলো শুরুর”
--(শামসুল আরেফিন)


তেমনি শঙ্খধ্বনির উল্লেখ। এসবগুলি আর কিছু নয়-- সেই যে চণ্ডীদাস বাজিয়েছিলেন তাঁর কাব্যে, তারপর থেকে এই বাঁশি শঙ্খধ্বনি শ্রীরাধা বাঙালির কৃষ্টিরই অংশ হয়ে গিয়েছে-- বৈষ্ণব-বাউলদের গানে, লোকসঙ্গীতে, রবীন্দ্রকাব্যে বাংলার সমস্ত প্রকারের কাব্যিক বর্গে (মবহৎব)। অনিরুদ্ধ আশির কবিতায় ইসলামী লোককথা, বাউল-মুর্শেদী সাহিত্য এবং মিথের প্রয়োগও সমান্তরাল-ভাবে ঘটেছে ভারতীয় পৌরাণিক মিথ ও বৌদ্ধ মিথের সঙ্গে। সমগ্র ভাবে মিথকে নতুন ভাবে ব্যবহার করছেন তরুণতম কবিরা (দ্রষ্টব্য বর্তমান লেখক স¤পাদিত ‘মিথ, সাহিত্য, সংস্কৃতি’)। পশ্চিমের সংস্কৃতিতে আর মিথের অস্তিত্ব নেই, বাংলা সংস্কৃতিতে যা প্রবল ভাবে উপস্থিত। ঔপনৈবেশিক শক্তি যে বিভেদ মৌলবাদের মাধ্যমে আমাদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল সেই সঙ্কীর্ণতা বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের কবিদের মধ্যে কোথাও নেই; নেই বলেই এই প্রজন্মের কবিতা মানবিক শিল্প হয়ে উঠতে কোনো বাধা হয়ে ওঠে না।
আরেকটি ধরণ পাওয়া যাচ্ছে ‘অনিরুদ্ধ আশি’র কবিতায়-সংক্ষিপ্ত তীক্ষ্মতা যা অনেকটা শ্লোকের মতো, জাপানী হাইকুর মতোও--আবার মন্ত্রের মতো, প্রাকৃত-পৈঙ্গলের মতো--

“আঘাত করো তীব্র/তোমার আঘাতে বেঁজে উঠি/সন্ধ্যারতির শঙ্খধ্বনি ভৌঁ-ভোঁ-
ভোঁ--”
--মিজানুর রহমান।


“আচমকা ঝড়ো গতি/কোথাও দাঁড়ানো না বক,/প্রশ্নের ভীড়;/হাওয়া বদল করবে
সাত-সকাল।”
--মাহমুদ কচি ‘বদলি: দ্রুতিমান এই শহর’।

সূক্ষ্ম মননধর্মী কবিতারও একটা আকার ফুটে উঠছে নতুন প্রজন্মের কবিতায়--
“পাথরই অধিক জ্ঞানী, -বলছে পিঁপড়েরা/পিঁপড়েরা/.../পাথর সকল বোঝে, জেনে
যায় ফলের কাহিনী/পিঁপড়েরা চেঁচায়, অন্ন-সন্ধানেই আয়ুক্ষয় করে/পাথর এসব
দেখে, আর জ্ঞানী হয়ে ওঠে।”
--ফরিদ কবির, ‘জ্ঞানতত্ত্ব’


মননশীলতার সঙ্গে সমাজ ও ইতিহাসসচেতনতাও সমাজ ভাবে উপস্থিত-
“আমাদের খেয়েছে গ্রীষ্মের কাল, খেয়েছে আশ্বিন
খেয়েছে বেড়াল হুলো, খেয়েছে মৌলবী
নিমাইয়ের উর্ধ্ববাহু হাঁটুজলে সফরীর কীর্তন করছে
বৌমাছ তোমাকে খেয়েছে রাতে দুষ্মন্ত প্রেমিক
আমার বুকের মধ্যে, শকুন্তলা, অঙুরী সোনার।”
--খোন্দকার আশরাফ হোসেন, “বৌমাছ’


>ঐতিহ্য প্রসঙ্গে কী ভাবছেন বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম?“বর্তমান আন্তর্জাতিক প্রতিবেশে একজন কবিতা শিল্পীর পক্ষে কেবলই স্বদেশিকতায় মজ্জমান থাকা কূপমন্ডুকতা মাত্র। আবার, একজন কবি যেহেতু, সাধারণত, মাতৃভাষায় কবিতা রচনা করেন, যেহেতু তার চেতনার বিশাল অংশ উত্তরাধিকার সূত্রে ও পরিবেশ সূত্রে স্বদেশের সঙ্গেই লগ্ন তাই স্বাদেশিক ঐতিহ্যকে তিনি অস্বীকারও করতে পারেন না। এখানেই প্রয়োজন অন্তত প্রাথমিক স্তরের সমন্বয়।”--সৈয়দ তারিক, ‘আগামীর কবিতা’।
“এই দশকের কবিরা অত্যন্ত ঐতিহ্যসচেতন। এঁদের কবিতা কোনো ভূঁই-ফোঁড় ব্যাপার নয় বরং বাংলা কবিতার আবহমান স্রোতের সাথে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত। আমরা কবিতার নতুন দিগ¦লয় নির্মাণে তৎপর কিন্তু তা ঐতিহ্যকে অস্বীকার করে নয়।”--সরকার মাসুদ, ‘এই সময়ের কবিতাঃ ১৯৮৩-১৯৮৯’।

ঐতিহ্যের কথাটা বার বার জোর দিয়ে লিখছি কারণ একালে ঐতিহ্যকে এড়িয়ে আন্তর্জাতিক সংস্কৃতি বলতে আমরা যাকে বুঝি তা পশ্চিমের কয়েকটি মাত্র উপাদন না থাকার মতই। তেমনি বিশুদ্ধ অবিমিশ্র ভারতীয় বা বাংলাদেশী সংস্কৃতিও অনেকটাই মনগড়া, কারণ নানান দেশ ভাষা-জাতির থেকে আমাদের সংস্কৃতি গ্রহণ এবং আত্তীকরণ-সংশ্লেষণ করে চলেছে তার মূল গঠনের মধ্যে। ভিন্ন সংস্কৃতি যেখানে জোর করে চাপানো হয় সেখানে আত্তীকরণ-সংশ্লেষণ ঘটে না। সাহিত্যে আধুনিকতার একটা অর্থ এবং লক্ষ্য ইউরোপের সমকক্ষ হওয়া। আমাদের ধার করা আধুনিকতা তাই সৌখিন ভাববিলাস অতিজটিল বৌদ্ধিক কচকচানি হিসেবে রয়ে গেল। ঐতিহ্যের, সংস্কৃতি-কৃষ্টির বিচার বিশ্লেষণ তাই জরুরী। খুবই আশার কথা বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের কবিতায় ইতিহ্যের একটা স্পষ্ট মানবিক প্রতিরূপ ধরা পড়েছে। শুধু বাংলাদেশ বা পশ্চিমবঙ্গের নতুন প্রজন্মের কবিদের মধ্যে নয়, মধ্যপ্রাচ্য-আরব দুনিয়া, চীন, জাপান ও আফ্রিকার নতুন সাহিত্যেও শিকড়ের আকর্ষণ ও ঐতিহ্যের বিস্তার লক্ষ্যনীয়।
নতুন প্রজন্মের সব উল্লেখ্য কবি কবিতা পাঠের সুযোগ পাইনি। দুটি মাত্র পত্রিকার দুটি মাত্র সংখ্যা ভিত্তি করে এ আলোচনা। বাংলাদেশের কবিতার ভাষা-শৈলী-আকরণ বিস্তৃত আলোচনার দাবী রাখে, এ আলোচনা কখনই তা সম্পূর্ণ করতে পারেনি। নাসিমা সুলতানার একটি কবিতার কথা মনে পড়ে গেল, তাঁর লেখা ‘প্রান্ত’ বা ‘একবিংশের’ সাম্প্রতিক সংখ্যাগুলিতে দেখলাম না--
যে কবিতা তার হৃদয় ঢেলে দেবে প্রখর বোদ্দুর, প্রগাঢ় জ্যোস্না
সে তুলতে পারবে মাথা আকাশ সমান
সিঁড়ি ভেঙে উঠতে উঠতে ভাঙবেনা হাঁটু
সে শুনবে যুদ্ধের ডঙ্কা, শেকলের ঝন্ঝন্, জয়ের উল্লাস
সে বলতে পারবে, ‘আহ্, একটা সোন্দর জেবন চাই, দাও”
--নাসিমা সুলতানা


বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের কবি ও প্রাবন্ধিকদের অভিনন্দন জানাই

অঞ্জন সেন
সম্পাদক: গাঙ্গেয়পত্র, কলকাতা

(একবিংশ ৯/মার্চ ১৯৯২ সংখ্যা থেকে পুনর্মুদ্রিত)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন